যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি অনন্য, মহান, প্রবল, ক্ষমতাবান, শক্তিশালী, মহাপ্রতাপশালী; কল্পনা ও দৃষ্টিশক্তির মাধ্যমে আয়ত্ব করার উর্ধ্বে; প্রত্যেক সৃষ্টিকে তিনি মুখাপেক্ষিতার বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করেছেন; আপন শক্তিমত্তা প্রকাশ করেছেন দিবারাত্রির আবর্তনের মধ্য দিয়ে; দুরারোগ্য রোগীর ক্রন্দন শোনেন, যে নিজ অসুবিধার অনুযোগ-অভিযোগ করে; গুহাভ্যন্তরে আঁধার রাতে কৃষ্ণকায় পিঁপড়ের পদচিহ্ন তিনি দেখেন; অন্তরের অব্যক্ত এবং মনের লুকানো বিষয়ও তিনি জানেন; তাঁর গুণাবলিও তাঁর সত্তার মতোই (যেমনিভাবে তাঁর সত্তার প্রকৃত ধরণ কেউ জানে না তেমনিভাবে তাঁর গুণাগুণের প্রকৃত রূপ কেউ জানে না), যারা তার সাদৃশ্য নির্ধারণ করে (মুশাব্বিহা) তারা কাফের; কুরআন ও সুন্নায় তিনি নিজেকে যেসব গুণে গুণান্বিত করেছেন আমরা তা স্বীকার করি:
﴿أَفَمَنۡ أَسَّسَ بُنۡيَٰنَهُۥ عَلَىٰ تَقۡوَىٰ مِنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٍ خَيۡرٌ أَم مَّنۡ أَسَّسَ بُنۡيَٰنَهُۥ عَلَىٰ شَفَا جُرُفٍ هَارٖ ﴾ [التوبة: ١٠٩]
‘যে তার গৃহের ভিত্তি আল্লাহর তাকওয়া ও সন্তুষ্টির উপর প্রতিষ্ঠা করল সে কি উত্তম নাকি ঐ ব্যক্তি যে তার গৃহের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছে এক গর্তের পতনোন্মুখ কিনারায়?’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ১০৯) আমি পবিত্র ও মহান সে সত্তার প্রশংসা করি, আনন্দ ও বেদনা সর্বাবস্থায়।
আর আমি সাক্ষ্য প্রদান করি যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, তাঁর কোনো অংশীদার নেই, সৃষ্টি ও পরিচালনায় তিনি এক-অদ্বিতীয়:
﴿ وَرَبُّكَ يَخۡلُقُ مَا يَشَآءُ وَيَخۡتَارُۗ ﴾ [القصص: ٦٨]
‘আর আপনার রব যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং মনোনীত করেন।’ (সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৬৮) আমি আরও সাক্ষ্য দেই যে মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যিনি শ্রেষ্ঠতম পুণ্যাত্মা নবী।
আল্লাহ সালাত তথা উত্তম প্রশংসা বর্ষণ করুন তাঁর ওপর, তাঁর হেরা গুহার সাথী আবূ বকরের ওপর, কাফেরদের মূলোৎপানকারী উমরের ওপর, স্বগৃহদ্বারে শহীদ উসমানের ওপর, শেষ রাতে সালাত আদায়কারী আলীর ওপর এবং তার সকল পরিবারবর্গ, সকল সাহাবী মুহাজির ও আনসারীগণের ওপর। আর আল্লাহ তাদের উপর যথাযথ সালাম পেশ করুন।
আমার ভাইয়েরা! ইতোপূর্বে সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে সাত প্রকার মানুষের কথা আলোচনা করেছি। আর এই হলো অবশিষ্ট প্রকারের মানুষের আলোচনা।
অষ্টম প্রকার: ঋতুবতী মহিলা।
সুতরাং ঋতুবতী মহিলার জন্য সিয়াম পালন করা হারাম; তার দ্বারা সিয়াম পালন সহীহ হবে না।
* কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«مَا رَأَيْتُ مِنْ نَاقِصَاتِ عَقْلٍ وَدِينٍ أَذْهَبَ لِلُبِّ الرَّجُلِ الحَازِمِ مِنْ إِحْدَاكُنَّ»، قُلْنَ: وَمَا نُقْصَانُ دِينِنَا وَعَقْلِنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: «أَلَيْسَ شَهَادَةُ المَرْأَةِ مِثْلَ نِصْفِ شَهَادَةِ الرَّجُلِ» قُلْنَ: بَلَى، قَالَ: «فَذَلِكِ مِنْ نُقْصَانِ عَقْلِهَا، أَلَيْسَ إِذَا حَاضَتْ لَمْ تُصَلِّ وَلَمْ تَصُمْ» قُلْنَ: بَلَى، قَالَ: «فَذَلِكِ مِنْ نُقْصَانِ دِينِهَا»
‘তোমাদের মতো দীন ও জ্ঞানগত অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও আর কাউকে বিচক্ষণ লোকের বুদ্ধি হরণে এমন পারঙ্গম দেখিনি। তারা প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের দীন ও জ্ঞানগত অসম্পূর্ণতা কী? তিনি বললেন, নারীর সাক্ষ্য কি পুরুষের সাক্ষ্যের অর্ধেক নয়? তারা বলল, নিশ্চয়। তিনি বললেন, এটাই হলো তোমাদের জ্ঞানগত কমতি। আর ঋতু অবস্থায় তার সালাত ও সিয়াম পালন করতে হয় না, এমন নয় কি? তারা বলল হ্যাঁ, তিনি বললেন, এটাই হলো দীনী কমতি।’[1]
হায়েয হলো: প্রকৃতিগত রক্তক্ষরণ নির্দিষ্ট কয়েক দিনের জন্য যা নারীদের নিয়মিত হয়ে থাকে।
সিয়াম পালনকারী নারীর যদি সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্বেও ঋতুস্রাব দেখা দেয়, তাহলে তার ওই দিনের সিয়াম বাতিল হয়ে যাবে। তবে তা কাযা করতে হবে। তবে নফল সিয়াম হলে এর কাযা করাও নফল হবে।
আর যদি কোনো নারী রমযানের দিনের মধ্যভাগে ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র হয়, তবে দিনের শুরুতে সিয়াম পালনের প্রতিবন্ধকতা থাকার কারণে ওই দিনের বাকী অংশেও সিয়াম পালন সহীহ হবে না।
প্রশ্ন হলো, দিনের অবশিষ্টাংশ সে পানাহার থেকে বিরত থাকবে কি না?
এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। মুসাফিরের সিয়াম সম্পর্কিত মাসআলায় এ বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।
আর যদি রমযানের রাতে সুবহে সাদিক উদয়ের সামান্য পূর্বেও কোনো নারী ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র হয়, তবে তার ওপর সিয়াম পালন আবশ্যক। কেননা সে সিয়াম পালনে সক্ষমদের অন্তর্ভুক্ত, সিয়াম পালনে তার তো এখন কোনো বাধা নেই। তাই তার ওপর সিয়াম পালন ওয়াজিব। যদি সে সুবহে সাদিকের পর গোসল করে তবুও সিয়াম শুদ্ধ হবে। যেমন অপবিত্র ব্যক্তি সুবহে সাদিক উদয় হওয়ার পর গোসল করলেও তার সিয়াম শুদ্ধ হবে।
* কারণ, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«إِنْ كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيُصْبِحُ جُنُبًا مِنْ جِمَاعٍ، غَيْرِ احْتِلَامٍ فِي رَمَضَانَ، ثُمَّ يَصُومُ»
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নদোষ ছাড়া সহবাসজনিত নাপাক অবস্থায় সুবহে সাদিকের পর পবিত্রতা অর্জন করতেন এবং রমযানের সিয়াম পালন করতেন।’[2]
আর নিফাসওয়ালী মহিলাদের বিধান পূর্বোক্ত হায়েযওয়ালী মহিলাদের বিধানের মতোই।
হায়েয ও নিফাস অবস্থায় নারীর যে কয়দিন সিয়াম বাদ পড়বে, সে দিনগুলোর কাযা তার ওপর ওয়াজিব।
* কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۚ ﴾ [البقرة: ١٨٤]
‘তবে অন্য দিনে এগুলো গণনা (কাযা) করে নেবে।’ (সূরা আল-বাকারাহ্, আয়াত: ১৮৪)
* অনুরূপ আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:
مَا بَالُ الْحَائِضِ تَقْضِي الصَّوْمَ، وَلَا تَقْضِي الصَّلَاةَ. فَقَالَتْ: أَحَرُورِيَّةٌ أَنْتِ؟ قُلْتُ: لَسْتُ بِحَرُورِيَّةٍ، وَلَكِنِّي أَسْأَلُ. قَالَتْ: «كَانَ يُصِيبُنَا ذَلِكَ، فَنُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّوْمِ، وَلَا نُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّلَاةِ»
‘ঋতুবতীর কী হলো যে, সে সিয়াম কাযা করে অথচ সালাত কাযা করে না? উত্তরে তিনি বললেন, তুমি কি হারূরী? (অর্থাৎ খারেজি সম্প্রদায়ভুক্ত?) সে বলল, আমি হারূরী নই, বরং জানার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বললেন, আমাদেরও এ অবস্থা হয়েছিল। তখন আমরা সিয়াম কাযা করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। সালাতের জন্য নয়।’[3]
নবম প্রকার: যে দুগ্ধবতী কিংবা গর্ভবতী নারী সাওম পালনের কারণে নিজের বা সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন
এমতাবস্থায় তিনি সিয়াম পালন করবেন না; সাওম ভঙ্গ করবেন।
* কারণ, আনাস ইবন মালেক আল-কা‘বী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ وَضَعَ عَنِ الْمُسَافِرِ شَطْرَ الصَّلَاةِ، وَعَنِ الْمُسَافِرِ وَالْحَامِلِ وَالْمُرْضِعِ الصَّوْمَ، أَوِ الصِّيَامَ»
‘আল্লাহ তা‘আলা মুসাফিরদের সালাত অর্ধেক করেছেন। আর গর্ভবতী, স্তন্যদানকারিনী ও মুসাফির থেকে সিয়াম শিথিল করেছেন।’[4]যে কদিন তারা সিয়াম ত্যাগ করেছেন শুধুমাত্র ওই সিয়ামগুলো কাযা করা আবশ্যক। যখন তাদের জন্য কাযা করা সহজ হয় এবং শঙ্কা দূর হয়ে যায় তখনই তা কাযা করবে। যেমন অসুস্থ ব্যক্তি যখন সুস্থ হবে তখনই কেবল তার কাযা করবে।
[2] বুখারী: ১৯৩১; মুসলিম: ১১০৯।
[3] বুখারী: ৩২১; মুসলিম: ৩৩৫।
[4] আবূ দাঊদ: ২৪০৮; নাসাঈ: ২২৭৫; তিরমিযী: ৭১৫; ইবন মাজাহ: ১৬৬৭।
দশম প্রকার: অন্যের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন পূরণের নিমিত্তে যার সাওম ভাঙ্গা প্রয়োজন।
যেমন: কোনো নিরপরাধ মানুষকে ডুবে যাওয়া কিংবা আগুনে পোড়া অথবা ধসে পড়া ইত্যাদি থেকে বাঁচানো।
অতএব যদি খাবার ও পানীয় পান না করে তাকে বাঁচানো সম্ভব না হয় তাহলে তার জন্য সাওম ভাঙ্গা জায়েয হবে। বরং তখন সাওম ভাঙ্গা ওয়াজিব হবে। কারণ নিরপরাধ মানুষকে ধ্বংস থেকে বাঁচানো ওয়াজিব। আর “যা ব্যতিরেকে ওয়াজিব সম্পন্ন করা যায় না, তাও ওয়াজিব।” তবে পরবর্তীতে ভাঙ্গা সাওমগুলো কাযা করা তার উপর আবশ্যক।
আর তার উদাহরণ ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যে আল্লাহর পথে জিহাদে শত্রু নিধনের লক্ষ্যে শক্তি অর্জনের জন্য সিয়াম ভঙ্গ করে। সে সিয়াম ভঙ্গ করবে এবং পরে তার কাযা করবে। চাই সে জিহাদের সফরে হোক কিংবা নিজ শহরে, শত্রু যদি সামনে এসে যায়, সর্বাবস্থায় সাওম ভঙ্গ করে শক্তি সঞ্চয় করার বৈধতার মধ্যে কোনো হেরফের নেই। কেননা এ সময় সিয়াম ভঙ্গ করা মুসলিমদের থেকে প্রতিরোধ ও মহান আল্লাহর কালেমা উঁচু করার জন্য।
* সহীহ মুসলিমে আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
«سَافَرْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى مَكَّةَ وَنَحْنُ صِيَامٌ قَالَ فَنَزَلْنَا مَنْزِلًا فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّكُمْ قَدْ دَنَوْتُمْ مِنْ عَدُوِّكُمْ وَالْفِطْرُ أَقْوَى لَكُمْ فَكَانَتْ رُخْصَةً فَمِنَّا مَنْ صَامَ وَمِنَّا مَنْ أَفْطَرَ ثُمَّ نَزَلْنَا مَنْزِلًا آخَرَ فَقَالَ إِنَّكُمْ مُصَبِّحُو عَدُوِّكُمْ وَالْفِطْرُ أَقْوَى لَكُمْ فَأَفْطِرُوا وَكَانَتْ عَزْمَةً فَأَفْطَرْنَا»
‘আমরা রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে মক্কায় সফরে বের হলাম, তখন আমরা সাওম পালনকারী ছিলাম। এরপর আমরা একটি স্থানে অবতরণ করলাম। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা তোমাদের শত্রু পক্ষের নিকটবর্তী হয়ে গেছ। আর সাওম ভেঙ্গে ফেলে তোমাদের জন্য শক্তি সঞ্চয়ে সহায়ক হবে। ফলে সাওম ভাঙ্গা বৈধ ছিল। এরপর আমাদের মধ্যে কেউ কেউ সাওম রাখলো আর কেউ কেউ ভেঙ্গে ফেলল। তারপর আমরা আরেকটি স্থানে নামলাম তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা খুব শীঘ্রই শত্রুপক্ষের মোকাবেলা করবে। আর সাওম ভেঙ্গে ফেলা শক্তি সঞ্চয়ের জন্য অধিক সহায়ক হবে। সুতরাং তোমরা সবাই সাওম ভেঙ্গে ফেল। আর এটা বাধ্যকারী নির্দেশ ছিল, তাই আমরা সবাই সাওম ভেঙ্গে ফেলেছিলাম।’[1]
এ হাদীস থেকে বোঝা যায়, সফর ছাড়াও যুদ্ধের জন্য শক্তি সঞ্চয় করা একটি কারণ; যার নিমিত্তে সিয়াম ভঙ্গ করা জায়েয। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য শক্তি সঞ্চয় করাকে সিয়াম ভেঙ্গে ফেলার জন্য স্বতন্ত্র একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সফর স্বতন্ত্র আরেকটি কারণ। এ জন্য তিনি প্রথম স্থানে সিয়াম ভঙ্গের নির্দেশ দেন নি।
উল্লেখিত কারণসমূহে যাদের সিয়াম ভঙ্গ করা বৈধ, তাদের সিয়াম ভঙ্গের বিষয়টি প্রকাশ করায় কোনো বাধা নেই। যদি তার স্পষ্ট কারণ থাকে। যেমন অসুস্থ বা বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি যিনি সিয়ামে অক্ষম।
পক্ষান্তরে যদি সিয়াম ভঙ্গের কারণ অপ্রকাশ্য বা অস্পষ্ট হয়, যেমন ঋতুবতী মহিলা এবং ওই ব্যক্তি যে কোনো বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে রক্ষা করতে গিয়ে সিয়াম ভঙ্গ করেছে- সে আড়ালে পানাহার করবে। যাতে তার প্রতি কোনো অপবাদ না আসে কিংবা কোনো অবুঝ ধোঁকায় পড়ে এ ধারণা না করে যে কোনো কারণ ছাড়াই সিয়াম ভঙ্গ করা বৈধ।
আর উপরোক্ত প্রকারসমূহের মধ্য থেকে যার সাওম কাযা করা আবশ্যক, সে যে কদিন সাওম ভাঙ্গবে হিসেব করে তার সাওম কাযা করে নেবে।
* কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
﴿ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۚ ﴾ [البقرة: ١٨٤]
‘তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৪)
* হ্যাঁ, যে ব্যক্তি পুরো মাসই সাওম ভাঙ্গে তার জন্য পুরো মাসের সবকটা সাওমই রাখতে হবে। যদি ৩০ দিনে মাস হয় তাহলে ৩০টা সাওম রাখবে এবং ২৯ দিনে মাস হলে ২৯টা সাওম রাখবে।
আর উত্তম হলো, উযর শেষ হওয়ামাত্র দ্রুততম সময়ে তার সাওমগুলো কাযা করে নেওয়া। কেননা এতে দ্রুত কল্যাণের দিকে যাওয়া যায় ও যিম্মাদারী থেকে তাড়াতাড়ি মুক্ত হওয়া যায়।
তবে ছুটে যাওয়া সিয়াম জরুরী উযরসাপেক্ষে পরবর্তী রমযান পর্যন্ত বিলম্ব করাও বৈধ। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۗ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلۡيُسۡرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘তবে সে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫)
সিয়াম কাযার ক্ষেত্রে বিলম্বের বৈধতাই হলো চরম সহজীকরণ। তাই যদি কারও ওপর রমযানের ১০ দিনের সিয়ামের কাযা ফরয হয় তাহলে পরবর্তী রমযান আসার ১০ দিন পূর্ব পর্যন্ত বিলম্ব করা তার জন্য জায়েয।
তবে কোনো উযর ছাড়াই দ্বিতীয় রমযান পর্যন্ত বিলম্ব বৈধ নয়।
* কারণ, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন:
«كَانَ يَكُونُ عَلَيَّ الصَّوْمُ مِنْ رَمَضَانَ، فَمَا أَسْتَطِيعُ أَنْ أَقْضِيَهُ إِلَّا فِي شَعْبَانَ »
‘আমার ওপর রমযানের সিয়াম কাযা হয়ে যেতো; কিন্তু আমি শাবান মাস আসার আগ পর্যন্ত কাযা করতে সক্ষম হতাম না।’[2]
* তাছাড়া দ্বিতীয় রমযান পর্যন্ত বিলম্ব করলে তার দায়িত্বে অনেক সাওম জমা হয়ে যাবে। ফলে কখনো সে তা পালনে অপারগ কিংবা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। আর সাওম যেহেতু এমন ইবাদত যা বারবার আসে তাই প্রথমটিকে বিলম্ব করে দ্বিতীয়টির সময় পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়া জায়েয নয়, যেমন সালাত।
আর যদি কারও ওযর মৃত্যু পর্যন্ত বহাল থাকে এবং সে সিয়াম কাযা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার ওপর কিছুই আবশ্যক হবে না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা অন্য সময়ে কাযা করাকে আবশ্যক করেছেন যা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। তাই তার থেকে সিয়াম ওই ব্যক্তির মত রহিত হয়ে যাবে যে রমযান মাস আগমনের পূর্বেই মারা গেছে ফলে তার ওপর সিয়াম আবশ্যক হয় নি।
তবে সে যদি কাযা করতে সক্ষম হয় কিন্তু অলসতা হেতু কাযা না করে মারা যায়, তাহলে যে সকল সিয়ামের কাযা করা মৃত ব্যক্তির সুযোগ ছিল তার উত্তরাধিকারীগণ সে সকল সিয়ামের কাযা করবে।
* কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«مَنْ مَاتَ وَعَلَيْهِ صِيَامٌ صَامَ عَنْهُ وَلِيُّهُ»
‘যে ব্যক্তি সিয়াম আদায় না করে মারা যাবে তার অলী তথা উত্তরাধিকারীগণ তার পক্ষ থেকে সিয়াম আদায় করে নেবে।’[3]
অলী হলো, তার ওয়ারিশগণ অথবা নিকটবর্তী আত্মীয়বর্গ। আর তাই দিন অনুপাতে (তার অলী বা আত্মীয়বর্গের মধ্য থেকে) একদল লোক একই দিন তার পক্ষ থেকে সিয়াম আদায় করে, তবে তাও বৈধ হবে।
* ইমাম বুখারী রহ. বলেন,
قَالَ الْحَسَنُ إِنْ صَامَ عَنْهُ ثَلَاثُونَ رَجُلًا يَوْمًا وَاحِدًا جَازَ
‘হাসান বছরী রহ. বলেছেন, যদি তার পক্ষে থেকে ৩০ জন লোক একদিনেই সিয়াম পালন করে তাহলে তা জায়েয হবে।’[4]
যদি তার কোন অলী বা অভিভাবক না থাকে কিংবা অভিভাবক থাকে কিন্তু তারা তার পক্ষ থেকে সাওম রাখতে চায় না, তাহলে ওই ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে কাযা করা সম্ভব ছিল এমন দিনগুলোর সংখ্যা হিসেব করে প্রত্যেক দিনের জন্য একজন মিসকীনকে খাওয়াতে হবে। প্রত্যেক মিসকীনকে এক মুদ ভালো গম দেবে, যার ওজন বর্তমানে ‘আধা কিলো ও ১০ গ্রাম।’
প্রিয় ভাইয়েরা! এই হলো সিয়ামের বিধানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ। আল্লাহ তা‘আলা স্থান ও অবস্থানুযায়ী প্রত্যেক প্রকারের মানুষের সাওমের বিধান কী হবে তা বলে দিয়েছেন। অতএব এ শরীয়তে আপনাদের প্রতিপালকের হিকমত ও প্রজ্ঞা-রহস্য জেনে নিন। আল্লাহ তাঁর শরীয়তকে সহজ করার মাধ্যমে যে নেয়ামত দিয়েছেন তার শুকরিয়া আদায় করুন এবং তাঁর কাছে আমরণ এ দীনের ওপর অটল থাকার তাওফীক প্রার্থনা করুন।
হে আল্লাহ! আমাদের যাবতীয় পাপ, যা আমাদের ও আপনার যিকরের মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল তা মোচন করুন, আর আপনার আনুগত্য ও শুকরিয়ায় আমাদের ঘাটতি মার্জনা করুন, আপনার পথে অবিরাম অবিচল রাখুন এবং আমাদের সে নূর দান করুন যা দিয়ে আমরা আপনার পথ খুঁজে পাব।
হে আল্লাহ! আপনার মুনাজাতের স্বাদ আমাদের আস্বাদন করান আর আমাদের পরিচালিত করুন আপনাকে সন্তুষ্টকারীদের পথে। হে আল্লাহ! নিজেদের অধঃগমন থেকে আমাদের রক্ষা করুন, নিজেদের অলসতা থেকে জাগিয়ে দিন, আমাদের কল্যাণের পথের সন্ধান দিন এবং আপন কৃপায় আমাদের পথচলাকে সুন্দর করুন।
হে আল্লাহ! আমাদের শামিল করুন আপনি মুত্তাকীদের কাতারে আর অন্তর্ভুক্ত করুন আপনার নেককার বান্দাদের দলে।আর আল্লাহ দরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর ওপর। আমীন।
[2] বুখারী: ১৯৫০; মুসলিম: ১১৪৬।
[3] বুখারী: ১৯৫২; মুসলিম: ১১৪৭।
[4]. ফাতহুল বারী: ৪/১৯২। [তবে হানাফী মাযহাবে অলী সিয়াম কাযা করবে না বরং প্রতিদিনের জন্য কাফফারা হিসেবে মিসকীনকে একদিনের খাবার দেবে। অনুবাদক]