সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য, যিনি আসমান, যমীন ও তার মধ্যকার সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন। রাতের অন্ধকারে ক্ষুদ্র পীপিলিকার বেয়ে উঠাও যার দৃষ্টি বহির্ভূত নয় এবং আসমান ও যমীনের বিন্দু-বিসর্গও যার জ্ঞানের বাইরে নয়। “যা আছে আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু’য়ের মধ্যবর্তী স্থানে এবং যা আছে মাটির নিচে সব তাঁরই। আর যদি তুমি উচ্চস্বরে কথা বল তবে তিনি গোপন ও অতি গোপন বিষয় জানেন। আল্লাহ তিনি ছাড়া সত্য কোনো মা‘বুদ নাই; সুন্দর নামসমূহ তাঁরই।” [সূরা ত্বা-হা: ৬-৮] তিনি আদম ‘আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তাকে পরীক্ষার মাধ্যমে মনোনীত করে সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন। তিনি নুহ ‘আলাইহিস সালামকে নবী বানিয়ে পাঠিয়েছেন। অতঃপর তিনি আল্লাহর নির্দেশে নৌকা তৈরি করেছেন এবং সেটাকে চালিয়েছেন। স্বীয় অন্তরঙ্গ বন্ধু ইব্রাহিম ‘আলাইহিস সালামকে আগুন থেকে নাজাত দিয়েছেন এবং সেটার উষ্ণতাকে সুশীতল ও আরামদায়ক করেছেন। মুসা ‘আলাইহিস সালামকে নয়টি নিদর্শন দান করেছেন; কিন্তু ফেরআউন সেটা দ্বারা নসীহত নিতে পারেনি, তার অবস্থান থেকেও সরে আসে নি। ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে এমন নিদর্শন দান করেছেন যা সৃষ্টিকুলকে বিস্মিত করে দিয়েছে। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর এমন একটি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, যাতে রয়েছে সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং হেদায়েত।
কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি তাঁর অফুরন্ত অসংখ্য ও অনবরত প্রাপ্ত নেয়ামতের। অসংখ্য দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক উম্মুল কুরা (মক্কায়) প্রেরিত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর। অবারিত শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর ওপর, হেরা গুহায় তার নিশ্চিত পরম সঙ্গী আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, সত্যের ইঙ্গিত প্রাপ্ত মতের অধিকারী এবং আল্লাহর আলোতে যিনি দেখতে পেতেন সে উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, তাঁর দু কন্যার স্বামী যিনি ছিলেন সত্যভাষী সে উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, তাঁর চাচাত ভাই আলী রাদিয়াল্লাহ আনহু, যিনি ছিলেন জ্ঞানের সাগর, বনের বাঘ, তাদের সবার উপর এবং অপরাপর সম্মানিত আহলে বাইত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম, সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম যাদের শ্রেষ্ঠত্ব জগতে ছড়িয়ে পড়েছে এবং মুসলিম উম্মাহর সকল সদস্যের ওপর সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক।
প্রিয় ভাই সকল! আমাদের সামনে সম্মানিত রমযান সমাগত যা ইবাদতের মহৎ মওসুম। যে মাসে আল্লাহ তা‘আলা নেক আমলের সাওয়াব সীমাহীন বৃদ্ধি করে দেন এবং দান করেন অফুরন্ত কল্যাণ। উন্মুক্ত করেন নেক কাজে উৎসাহী ব্যক্তির জন্য কল্যাণের সকল দ্বার। এ মাস কুরআন নাযিলের মাস। কল্যাণ ও বরকতের মাস। পুরস্কার ও দানের মাস।
﴿ شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘রমযান মাস, যাতে নাযিল হয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন, যা বিশ্ব মানবের জন্য হেদায়েত, সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ এবং হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫)
এ মাস রহমত, মাগফিরাত এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস। যার প্রথমে রয়েছে রহমত, মাঝে রয়েছে মাগফিরাত এবং শেষে জাহান্নাম হতে মুক্তি।
এ মাসের মর্যাদা ও ফযীলতের ব্যাপারে এসেছে অনেক হাদীস সমূহ যেমন এসেছে অনেক বাণী:
* সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إِذَا جَاءَ رَمَضَانُ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ، وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ، وَصُفِّدَتِ الشَّيَاطِينُ»
‘যখন রমযান মাস আগমন করে, তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়’।[1]
এ মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হয় অধিকহারে নেক আমল করার জন্য এবং আমলকারীদের উৎসাহ প্রদানের জন্য। আর জাহান্নামের দ্বারসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় ঈমানদারদের গুনাহ কম অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে। শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, যাতে সে অন্যান্য মাসের মত এ মুবারক মাসে মানুষকে পথ ভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যেতে না পারে।
* ইমাম আহমদ রহ. আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«أُعْطِيَتْ أُمَّتِي خَمْسَ خِصَالٍ فِي رَمَضَانَ، لَمْ تُعْطَهَا أُمَّةٌ قَبْلَهُمْ: خُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ، وَتَسْتَغْفِرُ لَهُمُ الْمَلَائِكَةُ حَتَّى يُفْطِرُوا، وَيُزَيِّنُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ كُلَّ يَوْمٍ جَنَّتَهُ، ثُمَّ يَقُولُ: يُوشِكُ عِبَادِي الصَّالِحُونَ أَنْ يُلْقُوا عَنْهُمُ الْمَئُونَةَ وَالْأَذَى وَيَصِيرُوا إِلَيْكِ، وَيُصَفَّدُ فِيهِ مَرَدَةُ الشَّيَاطِينِ، فَلَا يَخْلُصُوا فِيهِ إِلَى مَا كَانُوا يَخْلُصُونَ إِلَيْهِ فِي غَيْرِهِ، وَيُغْفَرُ لَهُمْ فِي آخِرِ لَيْلَةٍ " قِيلَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَهِيَ لَيْلَةُ الْقَدْرِ؟ قَالَ: «لَا، وَلَكِنَّ الْعَامِلَ إِنَّمَا يُوَفَّى أَجْرَهُ إِذَا قَضَى عَمَلَهُ»
‘আমার উম্মতকে রমযানে পাঁচটি বৈশিষ্ট্য দেয়া হয়েছে, যা পূর্ববর্তী কোনো উম্মতকে দেয়া হয়নি: ১। সিয়াম পালনকারীর মুখের না খাওয়াজনিত গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের সুঘ্রাণ থেকেও উত্তম। ২। ইফতারের পূর্ব পর্যন্ত ফেরেশতাগণ সিয়াম পালনকারীর জন্য মাগফিরাতের দো‘আ করতে থাকে। ৩। আল্লাহ তা‘আলা প্রতিদিন তাঁর জান্নাতকে সুসজ্জিত করে বলেন, আমার নেককার বান্দাগণ কষ্ট স্বীকার করে অতিশীঘ্রই তোমাদের কাছে আসছে। ৪। দুষ্ট প্রকৃতির শয়তানদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, ফলে তারা অন্য মাসের ন্যায় এ মাসে মানুষকে গোমরাহীর পথে নিতে সক্ষম হয় না। ৫। রমযানের শেষ রজনীতে সিয়াম পালনকারীদের ক্ষমা করে দেয়া হয়। বলা হলো- হে আল্লাহর রাসূল, এ ক্ষমা কি কদরের রাতে করা হয়? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, বরং কোনো শ্রমিককে তার পারিশ্রমিক তখনই দেয়া হয়, যখন সে কাজ শেষ করে’।[2]
আমার দীনী ভাইয়েরা! এ মূল্যবান পাঁচটি বৈশিষ্ট্য আল্লাহ তা‘আলা অন্য সকল উম্মতের মধ্য থেকে কেবল আপনাদের দান করেছেন এবং এর মাধ্যমে আপনাদের ওপর নেয়ামাত পূর্ণ করে বিশেষ ইহসান করেছেন। এভাবে আল্লাহর কতই না নেয়ামত ও অনুগ্রহ আপনাদের ওপর ছায়া হয়ে আছে; কারণ,
﴿ كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَتَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَتُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِۗ ﴾ [ال عمران: ١١٠] ‘
তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত। মানুষের কল্যাণের জন্যই তোমাদের বের করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে। আর আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান রাখবে’। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০)
[2] আহমদ: ৭৯১৭। হাদীসের সূত্র খুব দুর্বল। হাদীসটি আহমদ ও বাযযার সংকলন করেছেন হিশাম বিন যিয়াদ আবুল মিকদাম সূত্রে। আর বর্ণনাকারী হিসেবে তিনি যঈফ। বুখারী তার সম্পর্কে বলেছেন, তার সম্পর্কে কথা আছে। আবূ দাউদ বলেছেন, অনির্ভরযোগ্য। আবূ হাতেম বলেছেন, তিনি শক্তিশালী নন দুর্বল বর্ণনাকারী। ইবন হিব্বান বলেছেন, তিনি নির্ভরযোগ্যদের উদ্ধৃতিতে জাল হাদীস বর্ণনা করতেন। তার বর্ণিত হাদীস প্রমাণযোগ্য নয়। হাফেয বলেছেন, পরিত্যাজ্য। [দেখুন, তারীখ ইবন মুঈন: ২/৬১৬; জারহ ওয়াত-তা‘দীল: ৯/৫৮; আল-কামেল: ৭/২৫৬৪; তাহযীব: ১১/৩৮; তাকরীব: ২/৩১৮]।
প্রথম বৈশিষ্ট্য:
«خُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ»
‘সিয়াম পালনকারীর মুখের না খাওয়াজনিত গন্ধ মহান আল্লাহর কাছে মিসকের চেয়েও অধিক উত্তম ঘ্রাণসম্পন্ন’।
আরবী خُلُوفُ শব্দটি প্রথম হরফে পেশ ও যবর যুক্ত হয়ে অর্থ দেয়, পাকস্থলি খাবারশূন্য হলে মুখের ঘ্রাণের পরিবর্তন এবং এক প্রকার ভিন্ন গন্ধ সৃষ্টি হওয়া। এ দুর্গন্ধ মানুষের কাছে অপ্রিয় হলেও আল্লাহ তা‘আলার কাছে মিসক থেকেও অধিক সুঘ্রাণসম্পন্ন। কেননা এ দুর্গন্ধ আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের কারণে সৃষ্টি হয়েছে। আর প্রত্যেক অপ্রিয় জিনিস যা আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর ইবাদতের কারণে সৃষ্টি হয় তা আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং এর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কল্যাণকর শ্রেষ্ঠ ও উত্তম প্রতিদান প্রদান করা হয়।
যেমন দেখুন শহীদদের প্রতি, যিনি আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে শাহাদাত বরণ করেন। কিয়ামতের দিন তিনি এমন অবস্থায় উঠবেন যে, তার শরীরের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত টপটপ করে পড়তে থাকবে যার রং হবে রক্তের কিন্তু ঘ্রাণ হবে মিসকের ঘ্রাণের ন্যায়[1]।
অনুরূপভাবে হাজীদের ব্যাপারে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা আরাফাতের ময়দানের অবস্থানরতদের ব্যাপারে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন,
«انْظُرُوا إِلَى عِبَادِي هَؤُلَاءِ جَاءُونِي شُعْثًا غُبْرًا»
‘তোমরা আমার বান্দাদের প্রতি লক্ষ্য করো, এরা আমার কাছে এলোমেলো চুল, ধুলিমাখা অবস্থায় হাজির হয়েছে’।[2] হাদীসটি ইমাম আহমাদ ও ইবন হিব্বান তার সহীহ গ্রন্থে সংকলন করেছেন।
এক্ষেত্রে এলোমেলো চুল আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়ার কারণ, তা আল্লাহর আনুগত্যে ইহরামের নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ পরিত্যাগ ও বিলাসিতা বর্জনের মাধ্যমে সৃষ্ট হয়েছে।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য:
«وَتَسْتَغْفِرُ لَهُمُ الْمَلَائِكَةُ حَتَّى يُفْطِرُوا»
‘সিয়ামপালনকারীর জন্য ইফতারের পূর্ব পর্যন্ত ফেরেশতাগণ মাগফিরাত কামনা করতে থাকেন।’
ফেরেশতাগণ আল্লাহর সম্মানিত বান্দা।
﴿ لَّا يَعۡصُونَ ٱللَّهَ مَآ أَمَرَهُمۡ وَيَفۡعَلُونَ مَا يُؤۡمَرُونَ ٦ ﴾ [التحريم: ٦]
‘তারা আল্লাহর কোনো নির্দেশ অমান্য করে না। বরং তাঁর সকল নির্দেশ পালন করে।’ (সূরা আত-তাহরীম, আয়াত: ৬)
যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সিয়াম পালনকারীদের জন্য দো‘আ করার অনুমতি দিয়েছেন। এজন্য তাদের দো‘আ আল্লাহর কাছে কবুল হওয়াই অধিক যুক্তিযুক্ত। এটা উম্মতে মুহাম্মদীর বৈশিষ্ট্য যে, আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদেরকেও এ উম্মতের সিয়াম পালনকারীদের জন্য জন্য দো‘আ করার অনুমতি দিয়েছেন। যা তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি, তাদের স্মরণ সমাদৃত হওয়া এবং তাদের সিয়াম অধিক ফযীলতপূর্ণ হওয়ার প্রমাণ বহন করে।
আর ইস্তেগফার হচ্ছে, মাগফিরাত কামনা করা। দুনিয়া ও আখেরাতে গুনাহকে গোপন রাখা এবং এড়িয়ে যাওয়া উদ্দেশ্য। এটাই প্রধান আকাঙ্ক্ষা ও সর্বোচ্চ প্রাপ্তির বিষয়। কারণ, প্রত্যেক আদম সন্তান গুনাহগার, নিজের উপর সীমালঙ্ঘনকারী, মহান আল্লাহর ক্ষমার বেশি মুখাপেক্ষী।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য:
«وَيُزَيِّنُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ كُلَّ يَوْمٍ جَنَّتَهُ، ثُمَّ يَقُولُ: يُوشِكُ عِبَادِي الصَّالِحُونَ أَنْ يُلْقُوا عَنْهُمُ الْمَئُونَةَ وَالْأَذَى وَيَصِيرُوا إِلَيْكِ»
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা প্রতিদিন (মাহে রমযানে) জান্নাতকে সুসজ্জিত করেন এবং তাকে লক্ষ্য করে বলেন, অতি শীঘ্রই আমার নেককার বান্দাগণ দুনিয়ার ক্লেশ-যাতনা সহ্য করে তোমার কাছে আসছে।’
আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যহ জান্নাতকে সুসজ্জিত করেন তার নেককার বান্দাদের প্রস্তুতি ও তাতে প্রবেশে উৎসাহ এবং প্রেরণা দেওয়ার জন্য।
হাদীসে বর্ণিত الْمَئُونَةَ وَالْأَذَى এর অর্থ হচ্ছে: দুনিয়ার দুঃখ-কষ্ট। অতএব, দুনিয়ার ক্লেশ-যাতনা সহ্য করা এবং সদা সর্বদা নেক আমলের প্রস্তুতি গ্রহণ ও তাতে লিপ্ত থাকার মধ্যেই রয়েছে মুমিনের ইহকালীন ও পরকালীণ সফলতা। এর মাধ্যমেই শান্তির আবাসস্থল জান্নাতের পথ সুগম করা উচিত।
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য:
«وَيُصَفَّدُ فِيهِ مَرَدَةُ الشَّيَاطِينِ»
‘বিতাড়িত শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়।’
এর ফলে এরা আল্লাহর নেককার বান্দাদের অন্য মাসের মত গোমরাহ করার এবং সৎ কাজ থেকে বিরত রাখার সুযোগ পায় না। এটা আল্লাহ তা‘আলার তরফ থেকে মেহেরবানী যে, তিনি বান্দাদের থেকে তাদের চির শত্রু শয়তানকে বন্দি করে রেখেছেন যে শত্রুবাহিনী মানুষদেরকে জাহান্নামে নিয়ে যেতে চায়।
এ কারণে আপনি দেখবেন, নেককার বান্দাগণ অন্যান্য মাসের তুলনায় এ মাসে নেক কাজের প্রতি অধিক উৎসাহী হয় এবং গুনাহের কাজ থেকে অনেক দূরে থাকে।
পঞ্চম বৈশিষ্ট্য:
«وَيُغْفَرُ لَهُمْ فِي آخِرِ لَيْلَةٍ»
‘আল্লাহ তা‘আলা মাহে রমযানের শেষ রাতে উম্মতে মুহাম্মদীকে ক্ষমা করে দেন।’
যখন তারা সিয়াম (রোযা) ও কিয়াম (তারাবীর সালাতের) মাধ্যমে এ মুবারক মাসের হক আদায় করে। তখন আল্লাহ তাদের বিশেষভাবে ক্ষমা করেন।
আর সিয়াম পালন যথাযথভাবে করা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নিঃসন্দেহে একটি মেহেরবানী। তিনি তাদের আমল শেষে তাদের পরিপূর্ণ প্রতিদান দিয়ে তাদের প্রতি দয়া ও মেহেরবানী করেন। কারণ একজন কাজের লোককে কাজের শেষেই তার পাওনা পুরা করে দিতে হয়।
মহান আল্লাহ তা‘আলা মাহে রমযানের এ প্রতিদানের মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের ওপর তিন দিক থেকে করুণা ও মেহেরবানী করেছেন।
প্রথমত: আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের জন্য এ মাহে রমযানে নেক আমল করার এমন ব্যবস্থা করেছেন যা তাদের মর্যাদা বুলন্দ করাসহ তাদের গোনাহ মাফের কারণ হবে।
যদি তিনি তাদের জন্য এ ব্যবস্থা না করতেন তাহলে তারা নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করতো না। সুতরাং রাসূলগণের কাছে ওহী প্রেরণ ছাড়া কোনো ইবাদতই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না।
এ জন্যই যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করার ব্যবস্থা করেন। তাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলা অসন্তুষ্ট হন এবং তাদের কাজকে শিরকের অন্তর্ভুক্ত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ أَمۡ لَهُمۡ شُرَكَٰٓؤُاْ شَرَعُواْ لَهُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا لَمۡ يَأۡذَنۢ بِهِ ٱللَّهُۚ ﴾ [الشورى: ٢١]
‘না-কি তাদের জন্য কোন শরীক বা অংশীদার ব্যক্তিবর্গ আছে যারা তাদের জন্য কোন দ্বীন বা জীবনাদর্শ চালু করেছে যা আল্লাহ মোটেই অনুমতি দেননি’। (সূরা আশ-শুরা, আয়াত: ২১)
দ্বিতীয়ত: আল্লাহ তাঁর বান্দাদের এ মাহে রমযানে নেক আমল করার তাওফীক দান করেন। অথচ অধিকাংশ মানুষই এ নেক আমলকে পরিত্যাগ করে থাকে। যদি আল্লাহর সাহায্য ও মেহেরবানী তাদের প্রতি না থাকতো তবে তারা নেক আমলের সম্মান দিতে পারতো না।
সুতরাং এটি সম্পূর্ণই আল্লাহর দান এবং তিনিই পারেন কাউকে নেয়ামতের খোঁটা দিতে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ يَمُنُّونَ عَلَيۡكَ أَنۡ أَسۡلَمُواْۖ قُل لَّا تَمُنُّواْ عَلَيَّ إِسۡلَٰمَكُمۖ بَلِ ٱللَّهُ يَمُنُّ عَلَيۡكُمۡ أَنۡ هَدَىٰكُمۡ لِلۡإِيمَٰنِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ١٧ ﴾ [الحجرات: ١٧]
‘তারা আপনার প্রতি (ওহে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইসলাম গ্রহণের ইহসান বা অনুগ্রহ প্রকাশ করছে। আপনি বলে দিন, তোমরা ইসলাম গ্রহণ করে আমার প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করো না। বরং আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। তিনি মেহেরবানী করে তোমাদের ঈমানের পথে পরিচালিত করেছেন। যদি তোমরা তোমাদের দাবীতে সত্যবাদী হও’। (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৭)
তৃতীয়ত: আল্লাহ তা‘আলা এ মাহে রমযানে অনেক প্রতিদান দিয়ে মেহেরবানী করেছেন। প্রতিটি নেক আমল দশগুণ হতে সাতশত বা তার চেয়েও অধিক গুণে বর্ধিত হবে। সুতরাং নেক আমল করে অনেক সাওয়াব অর্জন করা এটা আল্লাহ তা‘আলারই করুণা ও মেহেরবানী আর যাবতীয় প্রশংসা সকল সৃষ্টির রব আল্লাহর জন্যই।
আমার ভাইয়েরা! মাহে রমযান একটি বিরাট নিয়ামত। এ নিয়ামত তার জন্য যার কাছে এ মাস পৌঁছার পর সে যথাযথভাবে এ মাসের হক পালন করে। গোনাহ থেকে বেঁচে থেকে নেক আমল ও আনুগত্যের মাধ্যমে তার রবের দিকে ধাবিত হয়, গাফলতি ছেড়ে আল্লাহর যিকিরে মত্ত হয় এবং তাঁর থেকে দূরত্ব ছেড়ে তাঁর নৈকট্য অর্জন করে তাঁর দিকে এগিয়ে যায়। কবির ভাষায়
يا ذا الذي ما كفاه الذين في رجب حتى عصى ربه في شهر شعبان
لقد اظلك شهر الصوم بعدهمـــا فلا تصـيره أيضا شهر عصيان
واتل القرآن وسبح فيه مجتهــــدا فإنــــــه شهر تسبيح وقرآن
كم كنت تعرف ممن صام في سلف من بين اهل وجيران وأخـــوان
افناهم الموت واستبقاك بعد بعد همو حيا فما اقرب القاصى من الداني
‘হে অমুক ব্যক্তি! যার গুনাহ রজব মাসে যথেষ্ট পরিমাণ হয়েছে। এমনকি শাবান মাসেও সে তার রবের প্রতি নাফরমানী করেছে।
রজব ও শাবান মাসের পর তোমার কাছে সুশীতল ছায়া বিস্তার করে মাহে রমযান হাযির হয়েছে। তাকে তুমি পাপের মাস বানিয়ে নিও না।
কুরআন তিলাওয়াত করো, গভীর মনোনিবেশ নিয়ে তাসবীহ পাঠ করো। কারণ এটা কুরআন তিলাওয়াত ও তাসবীহ পাঠের মাস।
তোমার আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন, ভাই-বোন, পাড়া-প্রতিবেশী যাদের অনেককেই তুমি চিনতে জানতে, তারা সিয়াম পালনের মধ্য দিয়ে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করেছে।
মৃত্যু তাদেরকে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিয়েছে। তোমাকেও মরতে হবে। অবশ্য তুমি এখনো পৃথিবীতে জীবতাবস্থায় আছ।
তবে শুনে রাখো! আমল করতে হবে। কারণ, কি করে আমল থেকে দূরে থাকা ব্যক্তি আমলকারী আল্লাহর নৈকট্যশীল বান্দাহর নিকটে বা সমপর্যায়ে আসতে পারে?
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের জাগ্রত করুন উদাসীনতার নিদ্রা থেকে, তাওফীক দিন প্রস্থানের আগেই তাকওয়ায় সুসজ্জিত হতে এবং অবসর সময়গুলো কাজে লাগাতে। আর হে শ্রেষ্ঠ করুণাময়, আপনি আপনার দয়ায় ক্ষমা করুন আমাদেরকে, আমাদের পিতামাতা ও সকল মুসলিমকে।আর আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাথীদের উপর।
[2] ইবন হিব্বান: ৩৮৫২; মুসনাদে আহমাদ ২/৩০৫ নং ৮০৩৩।