আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার পক্ষ হতে তাকদীর নির্ধারণ করা (বান্দাদের কর্ম সৃষ্টি হওয়া) এবং প্রকৃতপক্ষেই বান্দাদের কাজ-কর্ম তাদের প্রতি সম্বন্ধ করার মধ্যে কোন পারস্পরিক বিরোধ নেই। বান্দারাই নিজস্ব ইচ্ছা ও এখতিয়ার দ্বারা তাদের কাজ-কর্ম সম্পাদন করে

لاتنافي بين إثبات القدر وإسناد أفعال العباد إليهم حقيقة وأنهم يفعلونها باختيارهم

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার পক্ষ হতে তাকদীর নির্ধারণ করা (বান্দাদের কর্ম সৃষ্টি হওয়া) এবং প্রকৃতপক্ষেই বান্দাদের কাজ-কর্ম তাদের প্রতি সম্বন্ধ করার মধ্যে কোন পারস্পরিক বিরোধ নেই। বান্দারাই নিজস্ব ইচ্ছা ও এখতিয়ার দ্বারা তাদের কাজ-কর্ম সম্পাদন করে:

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,

الْعِبَادُ فَاعِلُونَ حَقِيقَةً وَاللَّهُ خَالِقُهم وخالق أَفْعَالَهُمْ وَالْعَبْدُ هُوَ الْمُؤْمِنُ وَالْكَافِرُ وَالْبَرُّ وَالْفَاجِرُ وَالْمُصَلِّي وَالصَّائِمُ وَلِلْعِبَادِ قُدْرَةٌ عَلَى أَعْمَالِهِمْ وَلَهُمْ إِرَادَةٌ وَاللَّهُ خَالِقُهُمْ وَقُدْرَتِهِمْ وَإِرَادَتِهِمْ كَمَا قَالَ تَعَالَى لِمَنْ شَاءَ مِنْكُمْ أَنْ يَسْتَقِيمَ وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ وَهَذِهِ الدَّرَجَةُ مِنَ الْقَدَرِ يُكَذِّبُ بِهَا عَامَّةُ الْقَدَرِيَّةِ الَّذِينَ سَمَّاهُمُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَجُوسَ هَذِهِ الْأُمَّةِ وَيَغْلُو فِيهَا قَوْمٌ مِنْ أَهْلِ الْإِثْبَاتِ حَتَّى سَلَبُوا الْعَبْدَ قُدْرَتَهُ وَاخْتِيَارَهُ وَيُخْرِجُونَ عَنْ أَفْعَالِ اللَّهِ وَأَحْكَامِهِ حِكَمَهَا وَمَصَالِحَهَا

বান্দারা প্রকৃতপক্ষেই তাদের কাজগুলো সম্পাদন করে। আল্লাহ তাআলা বান্দাদের স্রষ্টা এবং তিনি তাদের কাজগুলোরও স্রষ্টা। বান্দাই মুমিন হয়, কাফের হয়, সৎকর্মশীল হয়, পাপাচারী হয়, মুসাল্লী হয় এবং রোযাদার হয়। বান্দাদের কাজ-কর্ম করার নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে। রয়েছে তাদের ইচ্ছা। আর আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তাদের ক্ষমতা এবং ইচ্ছারও স্রষ্টা তিনিই। যেমন আল্লাহ তাআলা সূরা তাকভীরের ২৮-২৯ নং আয়াতে বলেছেনঃ

﴿إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ لِّلْعَالَمِينَ لمَن شَاءَ مِنكُمْ أَن يَسْتَقِيمَ وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ﴾

‘‘এটা সমস্ত সৃষ্টিজগতের জন্য একটা উপদেশ মাত্র। তোমাদের মধ্য থেকে এমন ব্যক্তির জন্য, যে সত্য সরল পথে চলতে চায়৷ আর তোমরা ইচ্ছা করলেই সত্য সরল পথে চলতে পারবেনা, যতক্ষণ না আল্লাহ রাববুল আলামীন তোমাদেরকে সরল পথে চালানোর ইচ্ছা করেন’’।[1]

তাকদীরের এই স্তরকে কাদারীয়াদের অধিকাংশ ফির্কাই অস্বীকার করেছে। এই জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে এই উম্মতের মাজুসী তথা অগ্নিপূজক হিসাবে নামকরণ করেছেন।

ঐদিকে তাকদীর সাব্যস্ত করতে গিয়ে আরেক দল লোক (জাবরীয়া সম্প্রদায়) খুব বাড়াবাড়ি ও কড়াকড়ি করে ফেলেছে। এমনকি কাজ-কর্ম করার জন্য বান্দার কোন শক্তি, ইচ্ছা ও এখতিয়ার থাকার কথাকে তারা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে থাকে। শুধু তাই নয়; আল্লাহ তাআলার ক্রিয়া-কর্ম এবং তাঁর হুকুম-আহকামের মধ্যে যেসব হিকমত এবং কল্যাণ রয়েছে তারা সেগুলোও অস্বীকার করে।[2]


ব্যাখ্যাঃ শাইখুল ইসলাম তাঁর এই বক্তব্যের মাধ্যমে বর্ণনা করতে চাচ্ছেন যে, পূর্বোক্ত সকল স্তরসহ তাকদীর সাব্যস্ত করার মধ্যে এবং বান্দারাই যে তাদের এখতিয়ার দ্বারা কর্ম সম্পাদন করে এবং তারা যে তাদের ইচ্ছাতেই আমল করে, -এর মধ্যে কোন বৈপরিত্য, পারস্পরিক সংঘর্ষ এবং বিরোধ নেই।

এই অংশের মাধ্যমে শাইখুল ইসলামের উদ্দেশ্য হলো ঐসব লোকের প্রতিবাদ করা, যারা বলে, যদি এটি সাব্যস্ত করা হয় যে, আল্লাহ তাআলা বান্দার কাজ-কর্ম সৃষ্টি করেন এবং বান্দারাও তাদের নিজস্ব ইচ্ছা দ্বারা কাজ-কর্ম করে, তাহলে উভয় কথার মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্ধ পরিলক্ষিত হয়। এই পারস্পরিক দ্বন্ধের ধারণা থেকেই বাতিলপন্থীদের একটি দল তাকদীর (আল্লাহর ইচ্ছা, শক্তি, ক্ষমতা, সৃষ্টি করা, সবকিছুর উপর তাঁর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি) সাব্যস্ত করতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ও কড়াকড়ি করেছে। এমনকি বান্দার উপর থেকে কাজ-কর্ম করার ক্ষমতা এবং এখতিয়ারকে সম্পূর্ণরূপে তুলে নিয়েছে!!

বাতিলদের আরেকটি দল বান্দাদের কাজ-কর্ম এবং এখতিয়ার সাব্যস্ত করতে গিয়ে মারাত্মক সীমা লংঘন করে ফেলেছে। এমনকি তারা বান্দাদেরকেই তাদের নিজস্ব কাজ-কর্মের স্রষ্টা হিসাবে নির্ধারণ করেছে। তারা আরো বলেছে যে, বান্দাদের কর্মের সাথে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার কোন সম্পর্ক নেই এবং বান্দাদের কাজ-কর্মের উপর আল্লাহর কোন ক্ষমতাও নেই!!

উপরে পরস্পর বিপরীতমুখী যে দু’টি গোমরাহ দলের আলোচনা করা হলো, তাদের প্রথম দলটিকে বলা হয় জাবরীয়া। কেননা তারা বলে বান্দা থেকে যা প্রকাশিত হয় কিংবা সে যেই কাজ ও নড়াচড়া করে, তাতে সে মাজবুর (বাধ্যগত)। তাতে তার কোন নিজস্ব এখতিয়ার, ইচ্ছা ও স্বাধীনতা নেই। আর দ্বিতীয় দলকে বলা হয় কাদারীয়া। কারণ তারা তাকদীর তথা আল্লাহর সৃষ্টি ও নির্ধারণকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে!!

সুতরাং শাইখের উক্তিঃ বান্দারা প্রকৃতপক্ষেই তাদের কাজগুলো সম্পাদন করে, -এর মাধ্যমে তিনি জাবরীয়াদের প্রতিবাদ করেছেন। কেননা তারা বলে, বান্দারা প্রকৃতপক্ষে কোন কাজই করেনা। শুধু রূপকার্থে তাদের প্রতি কর্মসমূহের নিসবত (সম্বন্ধ) করা হয়েছে!!!

আর শাইখের কথা, وَاللَّهُ خَالِقُهم وخالق أَفْعَالَهُمْ আল্লাহ তাআলা বান্দাদের স্রষ্টা এবং তিনি তাদের কাজগুলোরও স্রষ্টাঃ এর মাধ্যমে তিনি দ্বিতীয় ফির্কা তথা তাকদীরকে অস্বীকারকারী কাদারীয়া সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ করেছেন। কেননা তারা বলে থাকে, আল্লাহ তাআলা বান্দাদের কর্মসমূহ সৃষ্টি করেন না; বরং বান্দারা আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ও নির্ধারণ ছাড়াই নিজেদের কর্মগুলো নিজেরাই সৃষ্টি করে!!

বান্দাই মুমিন হয়, কাফের হয়, সৎকর্মশীল হয়, পাপাচারী হয়, মুসাল্লী হয় এবং রোযাদার হয়। বান্দাদের কাজ-কর্ম করার নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে। রয়েছে তাদের ইচ্ছাঃ এতে জাবরীয়াদের প্রতিবাদ করা হয়েছে। অর্থাৎ বান্দারা উপরোক্ত আমলসমূহে মাজবুর (বাধ্যগত) নয়। কেননা তাই যদি হতো তাহলে তাদেরকে উপরোক্ত বিশেষণগুলো দ্বারা বিশেষিত করা হতোনা। কেননা মাজবুরের কাজকে তার দিকে নিসবত (সম্বোধন) করা হয়না, তা দ্বারা তাকে বিশেষিতও করা হয়না[3] এবং মাজবুর (বাধ্যের) দ্বারা যা হয়, তাতে সে ছাওয়াবের হকদার হয়না কিংবা শাস্তিরও যোগ্য বিবেচ্য হয়না।

وَهَذِهِ الدَّرَجَةُ مِنَ الْقَدَرِ يُكَذِّبُ بِهَا عَامَّةُ الْقَدَرِيَّةِ তাকদীরের এই স্তরকে কাদারীয়াদের অধিকাংশ ফিার্কাই অস্বীকার করেঃ এই স্তর বলতে আল্লাহ তাআলার সার্বিক ও সার্বজনীন ইচ্ছা, প্রত্যেক জিনিষই তাঁর ইচ্ছাতেই হওয়া এবং সবকিছুই তাঁর সৃষ্টি, এই কথা বুঝায়। এই স্তরে ইহাও রয়েছে যে, বান্দারা প্রকৃতপক্ষেই তাদের কর্মসমূহ সম্পাদন করে। আল্লাহ তাআলা বান্দাদের স্রষ্টা এবং তিনি তাদের কর্মেরও স্রষ্টা। কাদারীয়ারা তাকদীরের এই স্তরকে অস্বীকার করে। তাদের ধারণা মতে বান্দাই তার নিজের কর্ম সৃষ্টি করে। এতে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার প্রয়োজন পড়েনা। এদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই উম্মতের মাজুসী বলে নামকরণ করেছেন। কেননা এই মাসআলাতে অগ্নিপূজকদের সাথে তাদের সাদৃশ্য রয়েছে। অগ্নিপূজকরা দু’টি স্রষ্টা সাব্যস্ত করে। তারা নূর বা আলোকে ন্যায় ও কল্যাণের স্রষ্টা মনে করে এবং অন্ধকারকে অন্যায় ও অকল্যাণের স্রষ্টা মনে করে। সুতরাং তারা বলে কল্যাণ নূরের সৃষ্টি আর অকল্যাণ অন্ধকারের সৃষ্টি। এর মাধ্যমে তারা দুই স্রষ্টায় বিশ্বাসী হয়েছে।

কাদারীয়ারাও অগ্নিপূজকদের মতই। কেননা তারা আল্লাহর সাথে অন্যকেও স্রষ্টা সাব্যস্ত করেছে। তারা মনে করে, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ব্যতীত বান্দারাই তাদের কর্ম সৃষ্টি করে থাকে। শুধু তাই নয়; তারা মনে করে বান্দারা নিজস্ব ও সতন্ত্র ক্ষমতা বলেই তাদের কর্ম সৃষ্টি করে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে এই উম্মতের অগ্নিপূজক বলেছেন, -এই কথা এক বাক্যে সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নয়।[4] কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যামানা পার হয়ে যাওয়ার পর তাদের উৎপত্তি হয়েছে। তাদের নিন্দায় যা বর্ণনা করা হয়, তার অধিকাংশই সাহাবীদের উপর মাওকুফ। অর্থাৎ এগুলোর সহীহ সনদ শুধু সাহাবীগণ পর্যন্তই পৌঁছে।

সুতরাং প্রথম দল অর্থাৎ কাদারীয়ারা বান্দার কর্ম সাব্যস্ত করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। এমনকি বান্দার কর্ম থেকে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাকে বের করে ফেলেছে। আর জাবরীয়ারা বান্দাদের কর্মকে একদম অস্বীকার করেছে। এমনকি কাজ-কর্ম করার উপর বান্দাদের কোন ক্ষমতা ও এখতিয়ার থাকাকেই অস্বীকার করেছে।[5]শাইখুল ইসলাম বলেনঃ وَيُخْرِجُونَ عَنْ أَفْعَالِ اللَّهِ وَأَحْكَامِهِ حِكَمَهَا وَمَصَالِحَهَا আল্লাহ তাআলার ক্রিয়া-কর্ম এবং তাঁর হুকুম-আহকামের মধ্যে যেসব হিকমত এবং কল্যাণ রয়েছে তারা সেগুলোও অস্বীকার করেঃ حكم শব্দটি حكمة এর বহুবচন। আর مصالح শব্দটি مصلحة এর বহুবচন। অর্থাৎ জাবরীয়ারা যখন বান্দার কাজ-কর্ম থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে এবং কাজ-কর্ম করার উপর বান্দার ক্ষমতা এবং এখতিয়ার থাকাকেও অস্বীকার করেছে, তখন এর মাধ্যমে তারা শরীয়তের আদেশ ও নিষেধের মধ্যে যেই হিকমত, ছাওয়াব ও শাস্তি রয়েছে, তাও অস্বীকার করে ফেলেছে। তারা বলেছে, আল্লাহ তাআলা বান্দাদেরকে এমন কাজের ছাওয়াব দেন, যা তাদের কর্মের অন্তর্ভূক্ত নয় এবং এমন কর্মের কারণে তিনি তাদেরকে শাস্তি দেন, যা তাদের কর্মের মধ্যে শামিল নয়। আল্লাহ তাআলা বান্দাদেরকে এমন কাজের আদেশ করেন, যা করতে বান্দারা সক্ষম নয়। সুতরাং তারা আল্লাহ তাআলাকে যুলুম এবং নিরর্থক কাজ করার অপবাদ দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাদের অপবাদের অনেক উর্ধ্বে।

[1] - অর্থাৎ তোমরা সরল পথে চলতে চাইলেই হবেনা এবং তোমরা ইচ্ছা করলেই হেদায়াতের পথ এখতিয়ার করতে পারবেনা, যতক্ষণ না আল্লাহ তাআলার তাওফীক তোমাদের সহায়ক হয়। তোমাদের ইচ্ছার সাথে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা এবং তাঁর তাওফীক এসে শামিল না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের পক্ষে সোজা পথে চলা সম্ভব নয়। সূরা কাসাসের ৫৬ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা এই কথাই বলেছেনঃ

﴿إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ﴾

‘‘তুমি যাকে পছন্দ করো, তাকে সৎপথে আনতে পারবেনা, তবে আল্লাহ্ তাআলাই যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন। কে সৎপথে আসবে, সে সম্পর্কে তিনিই ভাল জানেন’’।

[2] - তারা যেহেতু মনে করে, বান্দার কাজে বান্দা স্বাধীন নয় এবং তার কোন ইচ্ছাও নেই; বরং বান্দার দ্বারা ভাল-মন্দ যাই হোক, তা কেবল আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়, তাই আল্লাহ তাআলা যা করেন এবং বান্দাকে যেই আদেশ-নিষেধ করেছেন, তাতে আল্লাহ তাআলার কোন হিকমত এবং তাদের কোন কল্যাণও নেই। (নাউযুবিল্লাহ)

[3] - সুতরাং যাকে জোর করে বিষ পান করানো হয়, তার ব্যাপারে এটি বলা হয়না যে, অমুক ব্যক্তি বিষ পান করেছে; বরং বলা হয় বল প্রয়োগ করে বিষ পান করিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। মানুষ তাকে দোষারোপ করেনা। ঐদিকে যে নিজ ইচ্ছায় হাতে বিষ নিয়ে তা পান করে এবং নিজের জান বের করে দেয়, তাকে মানুষ দোষারোপ করে। সহীহ হাদীছে তাকে জাহান্নামী বলা হয়েছে।

এমনি বাতাস যাকে ছাদের উপর থেকে ফেলে দেয়, সে মারা গেলেও কেউ তাকে দোষারোপ করেনা; বরং তার জন্য আফসোস করে এবং দুআ করে। অনিচ্ছায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে কেউ মৃত্যু বরণ করলে তাকে শহীদ বলা হয়। পক্ষান্তরে স্ব-ইচ্ছায় কেউ ছাদের উপর থেকে লাফ দিয়ে পড়ে মৃত্যু বরণ করলে কিংবা গাড়ির নিচে নিজেকে ঢুকিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করলে কোন মানুষ তাকে ভালবাসেনা।

এমনি যার কাছ থেকে জোর করে তালাক আদায় করা হয়, তার ব্যাপারে কেউ বলেনা যে, অমুক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে; বরং বলা হয় তাকে বল প্রয়োগ করে তার কাছ থেকে তার স্ত্রীকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং তাকে তালাক দিতে বাধ্য করা হয়েছে। আর যে ব্যক্তি সজ্ঞানে নিজের স্ত্রীকে তালাক দেয়, তার ব্যাপারে বলা হয় যে, অমুক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে।

এমনি বান্দা নিজ ইচ্ছাতে নামায পড়ে বলে তাকে নামাযী বলা হয়, সে নিজেই ঈমান আনয়ন করে বলেই তাকে মুমিন বলা হয় এবং সে নিজেই রোজা রাখে বলেই তাকে রোযাদার বলা হয়। অনুরূপ যে চুরি করে তাকে চোর বলা হয়, কিন্তু যার পকেটে টাকা ঢুকিয়ে দিয়ে চোর সাব্যস্ত করা হয়, তাকে কেউ চোর বলেনা। যে ব্যভিচার করে তাকেই ব্যভিচারী বলা হয়, কিন্তু কোন মেয়ের সাথে জোর করে ব্যভিচার করা হলে, তাকে যেনাকারী বলা হয়না; বরং ধর্ষিতা বলা হয়।

সুতরাং কোন্ কাজ মানুষের ইচ্ছাতে হয় আর কোন্ কাজ তাদের অনিচ্ছায় হয়, মানুষেরা তাদের বোধশক্তি দ্বারাই বুঝে ফেলে। তাদের ফয়সালাও হয় তার আলোকেই। ইসলামী শরীয়ত মানুষের উপর এমন আকীদাহ, বিশ্বাস ও আমল চাপিয়ে দেয়নি, যা মানুষের স্বাধীন বোধশক্তি উপলব্ধি করতে অক্ষম।

মোট কথা, তাকদীর দিয়ে দলীল পেশ করে পাপাচারে লিপ্ত হয়ে শরীয়তের সীমা লংঘন করে এই কথা বলা ঠিক নয় যে, আমার নিজস্ব ইচ্ছায় নামায ত্যাগ করিনা, মদপান করিনা কিংবা পাপাচারে লিপ্ত হইনা; বরং তাকদীরে লিখা আছে, তাই আমার দ্বারা এগুলো হচ্ছে এবং আমি এগুলো করতে বাধ্য। হে আল্লাহ! আমাদেরকে তুমি হেদায়াতের পথ দেখাও। আমীন


[4] - তবে ইমাম আলবানী নিম্নোক্ত হাদীছকে সহীহ বলেছেন,

«الْقَدَرِيَّةُ مَجُوسُ هَذِهِ الْأُمَّةِ، إِنْ مَرِضُوا فَلَا تَعُودُوهُمْ، وَإِنْ مَاتُوا فَلَا تَشْهَدُوهُمْ»

‘‘কাদারীয়ারা এই উম্মতের অগ্নিপূজক। তারা যদি অসুস্থ হয়, তাদেরকে দেখতে যাবেনা এবং তারা মৃত্যু বরণ করলে তাদের জানাযায় উপস্থিত হবেনা। (আবু দাউদ, হাদীছ নং- ৪৬৯০) ইমাম আলবানী হাসান বলেছেন। এই হাদীছের ব্যাখ্যা এই হতে পারে যে, আল্লাহ পাক তাকে জানিয়ে দিয়েছেন। ফলে তাঁর যুগে তাদের অস্তিত্ব না থাকা হাদীছ অসাব্যস্ত হওয়ার কারণ হতে পারেনা।

[5] - এই মতাদর্শের মাধ্যমে তারা বান্দাকে মরা কাঠ ও পাথরে পরিণত করেছে। তাদের মতে বান্দাকে আল্লাহ তাআলা যেভাবে ঘুরান বান্দা সেভাবেই ঘুরে। তার নিজস্ব কোন স্বাধীনতা ও এখতিয়ার নেই। তাই ভাল-মন্দ সবই আল্লাহর একমাত্র ইচ্ছা ও ক্ষমতাতেই হয়। এ যেন শিশুর হাতে লাটিম এবং কাঠ-প্লাষ্টিকের পুতুলের মতই। শিশুর হাতে লাটিম শিশুর সম্পূর্ণ অনুগত ও বাধ্যগত, পুতুলকে শিশু যেভাবে নাচায় পুতুল সেভাবেই নাচে। বান্দাও আল্লাহর হাতে ঠিক সেরকমই। (নাউযুবিল্লাহ)

সম্ভবতঃ এই জাবরীয়া মতবাদ থেকেই ভোগবাদ, সর্বেশ্বরবাদ, ওয়াহদাতুল উজুদ এবং বস্তাপচা সুফীবাদের সূচনা হয়েছে। কেননা সুফীবাদের মধ্যে যারা ওয়াহদাতুল উজুদে বিশ্বাসী তারা কোন কিছুকেই হারাম মনে করেনা। মদ, জিনা-ব্যভিচারসহ সকল প্রকার কবীরা গুনাহতে লিপ্ত হওয়াই তাদের জন্য বৈধ। তারা মনে করে সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়। বান্দার এখানে কোন ইচ্ছা ও স্বাধীনতা নেই।

তাদের এই কথা মানুষের সুস্থ বিবেক ও বোধশক্তির সুস্পষ্ট বিরোধী। তাদের কথা মানা হলে নবী-রাসূল পাঠানো অযথা ও নিরর্থক হয়ে যায়। তাদের কথা যদি সঠিকই হতো, তাহলে অতীতে যারা নবী-রাসূলদের দাওয়াত অস্বীকার করলো, তাদেরকে আল্লাহ তাআলা শাস্তি দিলেন কেন? কিয়ামতের দিন তাদেরকে জাহান্নামে দিবেন কেন? বান্দার কাজ অন্যের দ্বারা হলে তার কাজের জন্য মানুষ তাকেই দোষে কেন? তার ভাল কাজের প্রশংসা করে কেন? বান্দার কাজ যদি আল্লাহর দ্বারাই হয়ে থাকে, তাহলে কি বান্দাকে শাস্তি দেয়া কিংবা ছাওয়াব দেয়া অন্যায় ও নিরর্থক হয়না? অথচ আল্লাহ তাআলা যুলুম ও নিরর্থক কাজ করা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র ও মুক্ত।

মোটকথা জাবরীয়ারা আল্লাহ তাআলার ক্ষমতা ও সবকিছুর উপর তাঁর সার্বভৌমত্ব সাব্যস্ত করতে গিয়ে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে। তারা আল্লাহ তাআলার আদল-ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের কথা বলতে গেলে ভুলেই গিয়েছে। তাদের কথা থেকে আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতার বিশেষণ সাব্যস্ত হলেও আল্লাহ তাআলার আরেকটি সিফাত অচল হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলার আদল তথা ন্যায় বিচারের দাবী হচ্ছে, তিনি বান্দাদের উপর মোটেই যুলুম করেন না। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿إِنَّ اللَّهَ لَا يَظْلِمُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ وَإِن تَكُ حَسَنَةً يُضَاعِفْهَا وَيُؤْتِ مِن لَّدُنْهُ أَجْرًا عَظِيمًا﴾

‘‘আল্লাহ কারো উপর এক অণু পরিমাণও যুলুম করেন না৷ যদি কেউ একটি সৎকাজ করে, তাহলে আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ করে দেন এবং নিজের পক্ষ থেকে তাকে মহাপুরস্কার প্রদান করেন’’। (সূরা নিসাঃ ৪০) আল্লাহ তাআলা সুরা আনফালের ৫১ নং আয়াতে আরো বলেনঃ

﴿ذَٰلِكَ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيكُمْ وَأَنَّ اللَّهَ لَيْسَ بِظَلَّامٍ لِّلْعَبِيدِ﴾

‘‘এ হচ্ছে সেই অপকর্মের প্রতিফল যা তোমরা আগেই প্রেরণ করেছো৷ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের উপর যুলুমকারী নন। এ রকম আরো অনেক আয়াত রয়েছে, যা প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাআলা যুলুম করা থেকে পবিত্র। সুতরাং বান্দাকে তাঁর আদেশ বাস্তবায়ন করার স্বাধীনতা না দিয়ে এবং নিজের সম্পূর্ণ ইচ্ছা ও ক্ষমতাবলে পাপ কাজে বাধ্য করে শাস্তি দিলে ন্যায় বিচারের ব্যঘাত ঘটে। তাই তিনি তাঁর আদল বা ন্যায় বিচার ঠিক রাখার জন্য বান্দাকে স্বাধীনতা দিয়েছেন। যাতে করে স্বেচ্ছায় আনুগত্যের কাজ করে সে নিজেই পুরস্কার পায় আবার আনুগত্যের খেলাফ করলে সে নিজেই শাস্তি ভোগ করে। যাতে করে আল্লাহ তাআলার উপর যুলুম করার কোন অভিযোগ না আসে। (আল্লাহ তাআলাই অধিক অবগত রয়েছেন)

আল্লাহ তাআলার সবগুলো সিফাতকেই একসাথে সাব্যস্ত করতে হবে। একটি মানতে গিয়ে আরেকটি ছেড়ে দিলে চলবেনা। তাই আল্লাহর আদলের দাবী হলো তিনি কাজ করার বা না করার স্বাধীনতা ও এখতিয়ার না দিয়ে কাউকে শাস্তি দিবেন না। জাবরীয়াদের কথা মানতে গেলে আল্লাহর আদল সিফাতটি ছুটে যায়।

সুতরাং বান্দার কাজ প্রকৃতপক্ষে বান্দা তার নিজস্ব ইচ্ছাতেই করে। যদিও তা আল্লাহর সৃষ্টি। আমরা সবাই জানি যে, বান্দার হাতে অস্ত্র থাকলে বান্দাই সেটি চালায়। সে অস্ত্র দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে না কি ডাকাতি করবে অথবা নিরপরাধ মানুষকে খুন করবে এ ব্যাপারে সে স্বাধীন। তার হাতে পয়সা থাকলে সে পয়সা দিয়ে মদ ক্রয় করবে? না কুরআনের তাফসীর ক্রয় করবে? এটি তার এখতিয়ারাধীন।

আপনি যদি আপনার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেনঃ কোথায় যাচ্ছো? বন্ধু হয়ত জবাব দিবে জামাআতের সাথে নামায আদায়ের ইচ্ছায় ঘর থেকে বের হয়েছি কিংবা বলবে বাজারে যাওয়ার ইচ্ছা করছি......। সুতরাং জানা গেল যে, বান্দার ইচ্ছাতেই বান্দা কাজ করে। আল্লাহ তাআলা বান্দার মধ্যে সেই ইচ্ছা সৃষ্টি করেছেন।

সুতরাং আল্লাহ তাআলা তাকে যেই স্বাধীনতা দিয়েছেন, তার অপব্যবহার করলে এবং আল্লাহর মর্জির খেলাফ চললে সে নিন্দিত হয়। আর তার ইচ্ছার সঠিক ব্যবহার করলে এবং উহাকে আল্লাহর মর্জি মোতাবেক চালালে আল্লাহ তাআলা তাকে সৎপথে চলতে সাহায্য করেন। (আল্লাহ তাআলাই অধিক অবগত)
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১ পর্যন্ত, সর্বমোট ১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে