শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
الحمْدُ للهِ الَّذي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَكَفَى بِاللهِ شَهِيدًا وأَشْهَدُ أَن لاَّ إلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لا شَرِيكَ لَهُ إِقْرَارًا بِهِ وَتَوْحِيدًا وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ وَسَلَّمَ تسليمًا مَزِيدًا
‘‘সেই আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা, যিনি তাঁর রাসূলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন। যেন তাকে সমস্ত দ্বীনের উপর বিজয়ী করেন৷ আর এ সম্পর্কে আল্লাহর সাক্ষ্যই যথেষ্ট। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য মাবুদ নেই। তাঁর কোন শরীক নেই। আমি তাওহীদের এই স্বীকৃতি প্রদান করছি এবং সাক্ষ্য দিচ্ছি।
আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলার বান্দা এবং তাঁর রাসূল। আল্লাহ তাঁর উপর, তাঁর পরিবার এবং তাঁর সাহাবীদের উপর অপরিমিত সালাত ও শান্তির ধারা বর্ষণ করুন।
ব্যাখ্যা: শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) এই মূল্যবান কিতাবটি আল্লাহর প্রশংসা, তাওহীদ, রেসালাতের সাক্ষ্য এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর সালাত ও সালাম পেশ করার মাধ্যমে শুরু করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ করেছেন। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সকল আলোচনা ও ভাষণ আল্লাহর প্রশংসা, তাওহীদ ও রেসালাতের সাক্ষ্য এবং তাঁর নিজের প্রতি সালাত ও সালাম পেশ করার মাধ্যমেই শুরু করতেন। সেই সাথে শাইখুল ইসলাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঐ হাদীছের উপরও আমল করেছেন, যেখানে তিনি বলেছেন,
«كل أمر ذي بال لا يبدأ فيه بحمد الله فهو أقطع»
‘‘প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ যেই কাজ আল্লাহ তাআলার প্রশংসা দিয়ে শুরু করা হয়না, তা বরকতশূণ্য। ইমাম আবু দাউদ এবং অন্যান্য ইমামগণ এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[1] অন্য বর্ণনায় আল্লাহর প্রশংসার স্থলে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম এসেছে।
أقطع শব্দের অর্থ হচ্ছে বরকতশূণ্য হওয়া ও বরকত থেকে খালী হওয়া। হাদীছের এই উভয় বর্ণনাকে এইভাবে একত্রিত করা যেতে পারে যে, বিসমিল্লাহ দ্বারা শুরু করা হচ্ছে হাকীকী। আর আলহামদুলিল্লাহ দ্বারা শুরু করা হচ্ছে নিসবী ইযাফী।[2]
الحمد لله : এখানে আলিফ লাম ইস্তেগরাক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ সকল প্রশংসার একমাত্র মালিক এবং হকদার হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা।[3]
الحمد প্রশংসা: শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, উত্তম গুণাবলী ও ভাল কর্মের প্রশংসা করা। আর ইসলামের পরিভাষায় হামদ এমন কাজের নাম, যার মাধ্যমে নেয়ামত প্রদানকারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ঘোষণা করে। এটি ذم (নিন্দার) বিপরীত অর্থবোধক শব্দ।
الله আল্লাহ: একটু পূর্বে আল্লাহর সম্মানিত এই নামের ব্যাখ্যা সংক্ষিপ্তভাবে অতিক্রান্ত হয়েছে।
الذي أرسل رسوله যিনি তাঁর রাসূলকে পাঠিয়েছেন: অগণিত নেয়ামতের কারণে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার প্রশংসা করা আবশ্যক। আমাদেরকে আল্লাহ তাআলা যত নেয়ামত দিয়েছেন, তার মধ্যে সর্বাধিক বড় নেয়ামত হচ্ছে তিনি তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমাদের জন্য প্রেরণ করেছেন।
الرسول রাসূল: আভিধানিক অর্থে রাসূল এমন পুরুষ ব্যক্তিকে বলা হয়, যাকে রেসালাত তথা বার্তাসহ পাঠানো হয়। আর ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় এমন পুরুষকে রাসূল বলা হয়, যার প্রতি কোন একটি আসমানী শরীয়তের অহী পাঠানো হয়েছে এবং তাকে সেই শরীয়তের তাবলীগ করার আদেশ প্রদান করা হয়েছে।[4]
الهدى হেদায়াত: হেদায়াত হচ্ছে উপকারী ইলম। আল্লাহ্ তাআলার পক্ষ হতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসব সত্য খবর, কল্যাণকর আদেশ-নিষেধ এবং অন্যান্য উপকারী বিধানমালা নিয়ে এসেছেন, তার সবগুলোই হেদায়াতের মধ্যে শামিল।
হেদায়াতের প্রকারভেদ: হেদায়াত শব্দটি দেখিয়ে দেয়া ও বর্ণনা করা অর্থে ব্যবহৃত হয়। এই অর্থেই আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
﴿وَأَمَّا ثَمُودُ فَهَدَيْنَاهُمْ فَاسْتَحَبُّوا الْعَمَىٰ عَلَى الْهُدَىٰ فَأَخَذَتْهُمْ صَاعِقَةُ الْعَذَابِ الْهُونِ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ﴾
‘‘আর আমি সামূদ জাতির সামনে হেদায়াত পেশ করেছিলাম, কিন্তু তারা পথ দেখার চেয়ে অন্ধ হয়ে থাকা পছন্দ করলো৷ অবশেষে তাদের কৃতকর্মের কারণে তাদের উপর লাঞ্ছনাকর আযাবের বজ্র ঝাঁপিয়ে পড়লো’’ (সূরা হামীম সাজদাহ: ১৭) সুতরাং এই কাজ অর্থাৎ সঠিক রাস্তা দেখানো রাসূলদের কাজ। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ﴿وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ﴾ নিশ্চয়ই তুমি সরল-সঠিক পথ প্রদর্শন করো’’। (সূরা শুরা: ৫২)
হেদায়াতের দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে সঠিক পথ কবুল করার তাওফীক দেয়া এবং ইলহাম করা। এটি কোন রাসূল করতে পারেন না। বরং আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কেউ এটি করতে সক্ষমও নয়। নিম্নের আয়াতে এই প্রকার হেদায়াতের বর্ণনা এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَن يَشَاءُ ۚ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ﴾
‘‘হে নবী! তুমি যাকে চাও তাকে হেদায়াত দান করতে পারবেনা; কিন্তু আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়াত করেন এবং যারা হেদায়াত গ্রহণ করে তাদেরকে তিনি খুব ভাল করেই জানেন’’। (সূরা কাসাসঃ ৫৬)
دين الحقসত্য দ্বীন: এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে সৎ আমল। দ্বীন শব্দটি কখনো সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়; কিন্তু এর দ্বারা প্রতিদান ও বিনিময় উদ্দেশ্য হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ ‘‘প্রতিদান দিবসের মালিক’’। (সূরা ফাতিহাঃ ৪) আবার কখনো সাধারণভাবে ব্যবহৃত হলেও এর দ্বারা এবাদত করা (বশ্যতা স্বীকার ও নত হওয়া) উদ্দেশ্য হয়। দ্বীনকে হকের দিকে সম্বোধিত করা মাওসুফকে সিফাতের দিকে এযাফতের অন্তর্ভূক্ত। অর্থাৎ মূলতঃ الدين الحق ছিল। الحق শব্দটি حق يحق-এর মাসদার। এর অর্থ সুসাব্যস্ত হয়েছে, সত্যে পরিণত হয়েছে, আবশ্যক হয়েছে। হকের বিপরীত হচ্ছে বাতিল।
لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ যাতে তিনি সকল দ্বীনের উপর সত্য দ্বীনকে বিজয়ী করেন: অর্থাৎ যাতে আল্লাহ তাআলা দলীল-প্রমাণ, সুস্পষ্ট বর্ণনা এবং জিহাদের মাধ্যমে এই দ্বীনকে সকল দ্বীনের উপর সমুন্নত করেন এবং পৃথিবীর অধীবাসীদের মধ্য হতে যারা এই দ্বীনের বিরোধীতা করবে, তাদের উপর তিনি এই দ্বীনকে বিজয়ী করবেন। চাই তারা আরব হোক কিংবা অনারব হোক অথবা অন্য কোন দ্বীনের অনুসারী হোক। আল্লাহর এই ওয়াদা বাস্তবায়ন হয়েছে। মুসলিমগণ আল্লাহর রাস্তায় উত্তমভাবে জিহাদ করেছেন। এতে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে বিজয় দান করেছেন। এর মাধ্যমে ইসলামী সাম্রাজ্যের সীমানা সুপ্রশস্ত হয়েছে। পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিমসহ সকল দিকেই এই দ্বীন ছড়িয়ে পড়েছে।
وَكَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا সাক্ষ্য হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট: অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলকে সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন। আল্লাহই এর সাক্ষী। তিনি সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল। তিনি তাঁর রাসূলের সকল অবস্থা ও কর্ম সম্পর্কে অবগত এবং শত্রুদের মোকাবেলায় তিনি তার সাহায্যকারী। আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সাহায্য করেছেন এবং তাঁর দাওয়াতকে শক্তিশালী করে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করেছেন। এতে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন আল্লাহর সত্য রাসূল। তিনি যদি মিথ্যুক হতেন, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে পৃথিবীতেই দ্রুত কঠিন শাস্তি দিতেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
﴿وَلَوْ تَقَوَّلَ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيل لَأَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِينِ ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِينَ﴾
‘‘যদি এ নবী নিজে কোন কথা বানিয়ে আমার কথা বলে চালিয়ে দিতো তাহলে আমি তার ডান হাত ধরে ফেলতাম এবং ঘাড়ের রগ কেটে দিতাম’’। (সূরা আলহাক্কাহ: ৪৪-৪৫)
وأَشْهَدُ أَن لاَّ إلَهَ إِلاَّ اللهُ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য মাবুদ নেই: অর্থাৎ আমি অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করার পর জবান দিয়ে স্বীকারোক্তি প্রদান করছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য মাবুদ নেই।
وَحْدَهُ لا شَرِيكَ لَهُ তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই: ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাক্ষ্য প্রদানের মধ্যে ইতি বাচক ও নেতিবাচক যেই অর্থ রয়েছে, এই শব্দ দু’টির মধ্যে তারই তাগীদ রয়েছে। অর্থাৎ وَحْدَهُ لا شَرِيكَ لَهُ -এর মাধ্যমে তাওহীদের সাক্ষ্য প্রদানের মর্মার্থকে শক্তিশালী করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সকল মাবুদ হতে উলুহীয়াতকে অস্বীকার করা হয়েছে এবং শুধু আল্লাহর জন্যই তাকে সাব্যস্ত করা হয়েছে। সুতরাং وحده(তিনি এক) এটি হচ্ছে ইছবাত তথা এবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যই, -এই কথার তাগীদ। لا شَرِيكَ لَه তাঁর কোন শরীক নেই, এটি হচ্ছে নফীর জন্য তাগীদ স্বরূপ।
إِقْرَارًا بِهِ وَتَوْحِيدًا আমি তাওহীদের এই স্বীকৃতি প্রদান করছি: إقرارا ও توحيدا এ শব্দ দু’টি হলো মাসদার। এ দু’টি শব্দ পূর্বোক্ত তাওহীদের সাক্ষ্যوأَشْهَدُ أَن لاَّ إلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لا شَرِيكَ لَهُ -এর মর্মাথকে শক্তিশালী করেছে। অর্থাৎ আমি জবানের মাধ্যমে বলিষ্ঠ ভাষায় তাওহীদের স্বীকারোক্তি প্রদান করছি এবং আমার প্রতিটি এবাদতকে আল্লাহর জন্য খালেস করছি। চাই সে এবাদত মুখের কথার মাধ্যমে হোক কিংবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের মাধ্যমে হোক অথবা অন্তরের বিশ্বাসের মাধ্যমে হোক।
وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল: অর্থাৎ আমি অন্তর দ্বারা বিশ্বাস করছি এবং জবানের মাধ্যমে স্বীকার করছি যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সমস্ত মানুষের নিকট রাসূল হিসাবে প্রেরণ করেছেন। রাসূলের রেসালাতের এই সাক্ষ্যকে আল্লাহ তাআলার তাওহীদের সাক্ষ্য প্রদানের সাথে মিলিয়ে উল্লেখ করেছেন। এই দু’টি সাক্ষ্য প্রদানের একটি অন্যটির পক্ষ হতে যথেষ্ট নয়। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল, এই কথার দ্বারা আহলে ইফরাত তথা রাসূলকে নিয়ে বাড়াবাড়িতে লিপ্তদের প্রতিবাদ করা হয়েছে। সেই সাথে আহলে তাফরীত অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বীনকে প্রত্যাখ্যান কারীদের এবং তা থেকে যারা এমনভাবে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে, যাতে মনে হয় তিনি আল্লাহর রাসূলই নন, এর মাধ্যমে তাদেরও প্রতিবাদ করা হয়েছে। সুতরাং তিনি আল্লাহর বান্দা, -এই সাক্ষ্য তাঁকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করাকে এবং তাঁর নিজস্ব মর্যাদার উপরে উঠানোকে অস্বীকার করেছে।
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল, -এই সাক্ষ্য দেয়ার দাবী হচ্ছে, তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন করা, তিনি যে আদেশ করেছেন, তাতে তাঁর আনুগত্য করা, তিনি যেই সংবাদ দিয়েছেন তা সত্যায়ন করা, তিনি যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকা এবং আল্লাহর পক্ষ হতে তিনি যেই শরীয়ত নিয়ে এসেছেন, তাতে কেবল তাঁরই অনুসরণ করা।
صلى الله عليه وعلى آله وسلم تسليمًا مزيدًاআল্লাহ তাঁর উপর, তাঁর পরিবার এবং সাহাবীদের উপর অপরিমিত সালাত ও শান্তির ধারা বর্ষণ করুন: সালাত শব্দের আভিধানিক অর্থ দুআ। আল্লাহর পক্ষ হতে রাসূলের উপর সালাত পেশ করার অর্থ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তার মধ্যে সর্বাধিক বিশুদ্ধ হলো, যা ইমাম বুখারী (রঃ) আবুল আলীয়া হতে স্বীয় সহীতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলের উপর দুরূদ পেশ করেন, এর অর্থ হলো আল্লাহ তাআলা নৈকট্যশীল ফেরেশতাদের কাছে রাসূলের প্রশংসা করেন।
وعلى آله তাঁর পরিবারের উপর: কোন ব্যক্তির ‘আল’ বলতে ঐ সমস্ত লোককে বুঝানো হয়, যারা তার সাথে আত্মীয়তার মজবুত বন্ধনে বা অন্য কোন গভীর সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ‘আল’ দ্বারা কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? এ বিষয়ে একাধিক মত রয়েছে। তার মধ্যে সর্বোত্তম মত হচ্ছে, এখানে আল দ্বারা ঐ সমস্ত লোক উদ্দেশ্য, যারা দ্বীনের ক্ষেত্রে তাঁর অনুসরণ করে।
وأصحابه এবং তাঁর সাহাবীগণের উপর: أصحاب শব্দটি صاحب শব্দের বহুবচন। অর্থাৎ সাহাবীগণ। এখানে আমের (ব্যাপকার্থবোধক শব্দের) উপর খাসকে (নির্দিষ্ট অর্থবোধক শব্দকে) আতফ করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রথমে ‘আল’ উল্লেখ করা হয়েছে। ‘আলে’র মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবী এবং পরবর্তীতে যারা আগমণ করবে ও তাঁর দ্বীন পালন করবে তারাও শামিল।
যেই মুসলিম ঈমানদার অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছেন এবং ঈমানদার অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছেন, তিনিই হলেন সাহাবী।
وسلم تسليمًا مزيدًا আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীর উপর অগণিত সালাম বর্ষণ করুন: سلام (সালাম) শব্দটি ইসলামের অভিবাদন, সম্মান, শ্রদ্ধা এবং শুভেচ্ছা প্রদান অর্থে ব্যবহৃত হয়। অথবা সালাম অর্থ মুক্ত ও নিরাপদ হওয়া। অর্থাৎ সকল ত্রুটি ও মন্দ স্বভাব থেকে মুক্ত হওয়া। مزيدا শব্দটি زيادة ক্রিয়ামূল হতে ইসমে মাফউল। ‘যিয়াদাহ’ অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি হওয়া।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
﴿إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا﴾
‘‘আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি সালাত পেশ করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি সালাত ও সালাম পাঠাও। (সূরা আহযাব: ৫৬)[5] আল্লাহ তাআলার এই বাণীর অনুসরণ করতে গিয়ে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) এখানে সালাত ও সালামকে একসাথে মিলিয়ে উল্লেখ করেছেন।
[1] - তবে হাদীছের সনদ দুর্বল। দেখুনঃ যাঈফু সুনানে আবী দাউদ। হাদীছ নং- ১৮৯৪, ইরাউল গালীল, হাদীছ নং- ২।
[2] - কিতাব লিখার শুরুতে সর্বপ্রথম যা দিয়ে শুরু করা হয় এবং যার পূর্বে অন্য কিছু থাকেনা তাকে ইবতেদায়ে হাকীকী প্রকৃত প্রথম বা শুরু বলা হয়। আর যার পূর্বে অন্য কিছু থাকে, তাকে ইবতেদায়ে নিসবী ইযাফী বা তুলনামূলক প্রথম বা শুরু বলা হয়। সুতরাং কোন কিতাব বা ভাষণ বিসমিল্লাহ দ্বারা শুরু করা হচ্ছে ইবতেদায়ে হাকীকী। এরপর অন্য কিছু লিখা বা বলার আগে আলহামদুলিল্লাহ যুক্ত করা হচ্ছে ইবতেদায়ে ইযাফী। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বিসমিল্লাহ দ্বারা কিতাবটি লিখা শুরু করেছেন। বিসমিল্লাহ’র পূর্বে অন্য কিছু লিখেন নি। সে হিসাবে বিসমিল্লাহ দ্বারা শরু করা হচ্ছে ইবতেদায়ে হাকীকী। অতঃপর তিনি আলহামদুলিল্লাহ লিখেছেন। সে হিসাবে আলহামদুলিল্লাহ্ দ্বারা শুরু করা হচ্ছে ইবতেদায়ে ইযাফী। কারণ তা ‘বিসমিল্লাহ’র পরে এসেছে। ‘আলহামদুলিল্লাহ’র পরে যা লিখা হয়েছে, তার তুলনায় আলহামদুলিল্লাহ হচ্ছে প্রথমে।
সুতরাং যেই হাদীছে বিসমিল্লাহ দ্বারা শুরু করার কথা এসেছে, তা দ্বারা ইবতেদায়ে হাকীকী উদ্দেশ্য। আর যেখানে আলহামদুলিল্লাহ দ্বারা শুরু করার কথা এসেছে, সেখানে ইবতেদায়ী ইযাফী উদ্দেশ্য। আলেমগণ কুরআনের অনুসরণ করে এভাবেই বিসমিল্লাহ দ্বারা শুরু করার হাদীছ এবং আলহামদুলিল্লাহ্ দ্বারা শরু করার হাদীছের মধ্যে বাহ্যিক দ্বন্ধের সমন্বয় করেছেন। কুরআন মজীদও প্রথমে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম দ্বারা শুরু করা হয়েছে। অতঃপর সূরা ফাতিহার প্রথম আয়াত আলহামদুলিল্লাহ রাবিবল আলামীন দ্বারা শুরু করা হয়েছে।
[3] - সকল নেয়ামত যেহেতু আল্লাহর পক্ষ থেকে, তাই সকল প্রশংসাও আল্লাহর জন্যই হওয়া আবশ্যক। حمد (হামদ) শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে প্রশংসা করা। এটি ذم (নিন্দা)এর বিপরীত। হামদ এবং شكر পরস্পর সমার্থবোধক হলেও হামদ شكر -এর চেয়ে অধিকতর ব্যাপক অর্থ প্রদান করে। শোকর সাধারণত নেয়ামত ও অনুগ্রহের বিনিময়েই হয়ে থাকে। কিন্তু হামদএর জন্য তা শর্ত নয়। অর্থাৎ হামদ হচ্ছে নেয়ামত প্রদানকারীর সৌন্দর্য বর্ণনা করা। তা নেয়ামতের বিনিময়ে হোক বা নেয়ামত ছাড়া হোক। অর্থাৎ সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর নেয়ামত এত ব্যাপক যে, তা গণনা করে শেষ করা যাবেনা। সুতরাং প্রত্যেকবার حمد (প্রশংসা) করার পূর্বে যে আল্লাহর নেয়ামত পেতে হবে, এমনটি নয়। বরং আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির প্রতি যে নেয়ামত সর্বদা প্রসারিত করে রেখেছেন, তার জন্য সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রশংসা করাকে পরিভাষায় হামদ বলা হয়। আর নির্দিষ্ট কোন নেয়ামত প্রাপ্ত হয়ে যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়, তাকে পরিভাষায় شكر বলা হয়। কেউ কেউ حمدএর সংজ্ঞায় বলেনঃ هو الثناء باللسان على الجميل الاختياري অর্থাৎ জবানের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় কৃত অনুগ্রহের উপর প্রশংসা বর্ণনা করাকে হামদ বলা হয়। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃفالحمد إخبار عن محاسن المحمود مع حبه وإجلاله وتعظيمه ভালবাসা ও সম্মানের সাথে প্রশংসিত সত্তার সৌন্দর্য বর্ণনা করাকে হামদ বলা হয়। হামদ ও শোকরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, (১) শোকর শুধু নেয়ামতের বিনিময়েই হয়ে থাকে, কিন্তু হামদের জন্য নেয়ামত শর্ত নয়। নেয়ামত ছাড়াও তা হতে পারে। (২) হাম্দ শুধু জবানের কথার মাধ্যমে হয়, কিন্তু শোকর জবান, হাত, অন্তর এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমেও হয়। (আল্লাহই অধিক জানেন)
[4] - আর এমন পুরুষকে নবী বলা হয়, যার প্রতি অহী প্রেরণ করা হয়েছে, কিন্তু তাবলীগ ও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার আদেশ করা হয়নি। সে হিসাবে كل رسول نبي وليس العكس অর্থাৎ প্রত্যেক রাসূলই নবী। কিন্তু প্রত্যেক নবীই রাসূল নন। নবী কেবল পূর্বের রাসূলদের শরীয়ত অনুযায়ী স্বীয় উম্মতকে আল্লাহর পথে পরিচালিত করেন। যেমন বনী ইসরাঈলের অধিকাংশ নবীই তাদের পূর্বের শরীয়ত অনুযায়ী লোকদেরকে পরিচালিত করতেন। তাদেরকে মুসা (আঃ)এর শরীয়ত মেনে চলা ও তাওরাতের অনুসরণ করা এবং বনী ইসরাঈলকে তা শিক্ষা দেয়ার আদেশ করা হয়েছে। আর রাসূলকে স্বতন্ত্র শরীয়ত দিয়ে প্রেরণ করা হয় এবং তাকে তা প্রচার করার এবং বিরোধীদের সাথে জিহাদ ও কিতাল করার হুকুমও করা হয়।
[5] - আভিধানিক দিক থেকে সালাত শব্দটি দুআ অর্থে ব্যবহৃত হলেও ব্যবহারের স্থান অনুযায়ী সালাতের বিভিন্ন অর্থ রয়েছে। আল্লাহর পক্ষ হতে নবী-রাসূল কিংবা সৎ বান্দাদের প্রতি সালাত অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের নিকট তাঁর নবীর ও সৎবান্দাদের প্রশংসা করেন, তাদের নাম বুলন্দ করেন, তাদের কাজে বরকত দেন এবং তাদের প্রতি নিজের রহমত বর্ষণ করেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿هُوَ الَّذِي يُصَلِّي عَلَيْكُمْ وَمَلَائِكَتُهُ لِيُخْرِجَكُم مِّنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَكَانَ بِالْمُؤْمِنِينَ رَحِيمًا﴾
‘‘তিনিই তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তাঁর ফেরেশতারা তোমাদের জন্য দুআ করেন, যাতে তিনি তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর মধ্যে নিয়ে আসেন, তিনি মুমিনদের প্রতি বড়ই মেহেরবান’’ (সূরা আহযাব: ৪৩)
সালাত শব্দটি ফেরেশতাদের পক্ষ হতে আল্লাহর নবীর জন্য ব্যবহৃত হলে অর্থ হবে তারা আল্লাহর কাছে তাঁর জন্য দুআ করেন। আল্লাহ যেন তাকে সর্বাধিক উচ্চ মর্যাদা দান করেন, তার শরীয়াতকে প্রসার ও বিস্তৃতি দান করেন এবং একমাত্র তাকে মাকামে মাহমুদ তথা সর্বোচ্চ প্রশংসিত স্থানে পৌঁছিয়ে দেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
﴿إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا﴾
‘‘আল্লাহ ও তার ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দুরূদ পাঠান৷ হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দুরূদ ও সালাম পাঠাও’’। (সূরা আহযাবঃ ৫৬)
আর ফেরেশতাদের পক্ষ হতে সাধারণ মুমিনদের জন্য যখন সালাত শব্দটি ব্যবহৃত হবে, তখনো এর দ্বারা মুমিনদের জন্য ফেরেশতাদের দুআ ও মাগফিরাত কামনা উদ্দেশ্য।
আর সালাত শব্দটি যদি এক মুমিনের পক্ষ হতে অন্য মুমিনের জন্য ব্যবহৃত হয়, তখনো এর দ্বারা দুআ উদ্দেশ্য হয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
﴿خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِم بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ إِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ﴾
‘‘হে নবী! তাদের ধন-সম্পদ থেকে যাকাত নিয়ে তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করো এবং তাদের জন্য রহমতের দুআ করো৷ তোমার দুআ তাদের সান্তনার কারণ হবে৷ আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও জানেন’’। (সূরা তাওবাঃ ১০৩)
আর সালাত শব্দটি যখন বান্দার পক্ষ হতে আল্লাহর জন্য ব্যবহৃত হবে তখন এর দ্বারা মুসলিমদের নিকট পরিচিত সেই এবাদত উদ্দেশ্য হবে, যা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট নিয়মে কতিপয় কাজ ও কথার মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। এর শুরু তাকবীরে তাহরীমাহ দ্বারা এবং শেষ হয় সালামের দ্বারা। আল্লাহ তাআলা বলেনঃفَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘‘কাজেই তুমি নিজের রবের জন্যই সালাত সম্পাদন করো এবং তাঁর জন্যই কুরবানী করো’’। (সূরা কাওছারঃ ২)