রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাদ্যদ্রব্য

সমাজ পতি ও ধনীদের বাড়ীতে খাদ্যের জমজমাট লেগেই থাকে। আর আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আয়াত্তাধীন ছিল রাজ্য ও অসংখ্য জনগণ, তাঁর নিকট আসত উট ভর্তি খাদ্যদ্রব্য, তার সামনে স্বর্ণ-রৌপ্য বয়ে যেত! আপনি কি জানেন! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পানাহার কেমন ছিল?!রাষ্ট্র নায়ক বা রাজাদের মত আরাম আয়েশের ছিল কি? নাকি তাদের চেয়েও বিলাসী?! ভোগ বিলাসে বিভোর ব্যক্তিদের মত ছিল কি তার পানাহার? নাকি পরিপূর্ণ প্রয়োজনীয় ও পরিতৃপ্তপূর্ণ ছিল! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বল্প মাত্রার অভাবী পানাহারের কথা ভেবে আপনি আশ্চর্য হবেন না! আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু আমাদেরকে বর্ণনা করছেন, তিনি বলেন:

« إن النبي - صلى الله عليه وسلم - لم يجتمع عنده غداء ولا عشاء من خبز ولحم إلا على ضفف».

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুপুর ও রাতের খাবারে কখনো রুটি মাংস একত্রে মিলত না, যদিও মিলত তা হত অতি সামান্য।[1]

অর্থাৎ তিনি পরিতৃপ্ত হতেন না, কোন রূপে চালিয়ে নিতেন। যদি মেহমান আসত তবেই তাদের সাথে সৌজন্যমূলক ও তাদের আনন্দের জন্য তৃপ্ত হতেন।

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন:

«ما شبع آل محمد من خبز شعير يومين متتابعين حتى قبض رسول الله - صلى الله عليه وسلم -»

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবার তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত পরস্পর দুই দিন যবের রুটি পেট ভরে পূর্ণ করে খায়নি।[2]

অন্য বর্ণনায় এসেছে:

«ما شبع آل محمد منذ قام المدينة من طعام بر ثلاث ليال تباعًا حتى قبض».

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমণের পর থেকে মৃত্যু বরণ পর্যন্ত তাঁর পরিবার পরস্পর তিন দিন পেট পূর্ণ করে গমের রুটি খায়নি।[3]

বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাবার কিছু না পেয়ে ক্ষুধার্ত পেটে ঘুমিয়ে যেতেন এক লোকমাও তার পেটে কিছু যেত না!

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:

«كان رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يبيت الليالي المتتابعة طاويًا هو وأهله،لا يجدون عشاء، وكان أكثر خبزهم خبز الشعير».

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবার ক্ষুধার্তাবস্থায় পরস্পর কয়েক রাত অতিবাহিত করতেন। রাতের খাবার থাকত না তাদের কাছে, আর বেশীর ভাগ তাদের রুটি ছিল যবের রুটি।[4]

সম্পদ স্বল্পতার কারণে নয়, বরং তাঁর আয়ত্বধীন ছিল প্রচুর সম্পদ এবং খাদ্য ভর্তি কাফেলা তাঁর সমীপে উপস্থিত হত সচরাচর। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থাকে বিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণ হোক তা পছন্দ করেন।

উকবা বিন আল-হারেস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা আমাদের আসরের সালাত পড়ালেন, অত:পর তিনি দ্রুত গতিতে ঘরে প্রবেশ করে কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসলেন। তারপর আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম অথবা কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করল: প্রতি উত্তরে তিনি বলেন:

«كنت خلفت في البيت تبرًا -أي ذهبًا- من الصدقة فكرهت أن أبيته فقسمته».

ঘরে সাদকার কিছু স্বর্ণ ছিল, তা রেখে আমি এক রাত্রি অতিবাহিত করাটা সমীচিন মনে করলাম না, তাই সেটাকে বন্টন করে দিলাম।[5]

আশ্চার্যজনক বদান্যতা ও অবিচ্ছন্ন দানশীলতার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত তো এ উম্মতের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাত হতে যা বের হত।

আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:

ما سئل رسول الله - صلى الله عليه وسلم - على الإسلام شيئًا إلا أعطاه، ولقد جاءه رجل، فأعطاه غنمًا بين جبلين، فرجع إلى قومه فقال: «يا قوم أسلموا، فإن محمدًا يعطي عطاء من لا يخشى الفقر».

কেউ যদি ইসলামের দোহাই দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট কিছু চাইত, তবে অবশ্যই তাকে দিতেন। একবার এক ব্যক্তি এসে তার নিকট চাইলে, তিনি তাকে দুই পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত এক পাল ছাগল দান করলেন। সে ব্যক্তি স্বজাতির নিকট গিয়ে বলল: ওহে আমার জাতি! তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর, কেননা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন দান করেন যে, যাতে অভাবের আশঙ্কা নেই।[6]

এত বড় দানবীর ও দাতা হওয়ার পরেও আমাদের নবীর অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করুন!

আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:

« لم يأكل النبي - صلى الله عليه وسلم - على خوان حتى مات، وما أكل خبزًا مرققًا حتى مات».

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু পর্যন্ত বিলাসী দস্তরখানায় বসে খানা খাননি এবং তিনি মৃত্যু পর্যন্ত কোন নরম [চাপাতী] রুটি খাননি।[7]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন: অনেক দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে এসে বলতেন:

«أعندك غداء»؟ فتقول: لا، فيقول: «إني صائم».

তোমার নিকট খাবার কিছু আছে কি? উত্তরে বলতেন: না, অত:পর তিনি বলতেন: তবে আমি আজ রোযাই রাখলাম।[8]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে এমনও প্রমাণিত আছে যে, أنه كان يقيم الشهر والشهرين، لا يعيشه هو وآل بيته إلا الأسودان: التمر والماء. তিনি এক দুই মাস কাটিয়ে দিয়েছেন কিন্তু তাঁর ও পরিবারের জন্য দুই কাল বস্তু খেজুর ও পানি ব্যতীত জীবন ধারনের জন্য কিছুই জুটত না।[9]

এত স্বল্প খাদ্য ও জীবনোপকরণেরও পরেও তাঁর চরিত্র ছিল মহান, আদর্শ ছিল ইসলামী, আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া করার আহ্বান জানাতেন ও যিনি এ খাদ্য প্রস্তুত করত তাকে ধন্যবাদ জানাতেন এবং এ খাদ্য বানাতে যদি কোন প্রকার ত্রুটি হত তবে তিনি তার প্রতি কঠোরতা করতেন না। সে তো প্রস্তুত করতে অনেক চেষ্টা করেছে, হয়তোবা কোন কারণ বশত তা ভাল হয়নি! এজন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কোন খাদ্যের দোষ বর্ণনা করতেন না এবং কোন বাবুর্চীকেও ভর্ৎসনা করতেন না, যা উপস্থিত আছে তাই গ্রহণ করতেন, ফেরত দিতেন না। আর যা নেই তা কখনো চাইতেন না! ইনিই এ মুসলিম জাতির নবী যার ভূরিভোজনের টার্গেট ছিল না!।

আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:

«ما عاب رسول الله - صلى الله عليه وسلم - طعامًا قط، إن اشتهاه أكله، وإن كرهه تركه».

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কোন খাদ্যের দোষ বর্ণনা করতেন না, ভাল লাগলে খেতেন আর না লাগলে খেতেন না।[10]

যাদেরকে পানাহারের ভোগ-বিলাসিতা পেয়ে বসেছে, সে প্রিয় ভ্রাতৃমন্ডলির জন্য শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার বাণীটি সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা করছি:

আর খাদ্য ও পোশাকের আদর্শ: সর্বোত্তম আদর্শ হল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ। আর খাদ্যের ব্যাপারে তাঁর আদর্শ হল: ভাল লাগলে পরিমিত খেতেন; উপস্থিত কোন খাদ্যকে ফেরত দিতেন না, এবং যা নেই তা কখনো অনুসন্ধান করতেন না, গোশ রুটি উপস্থিত হলে, তাই খেতেন অথবা ফল-মুল, গোশ ও রুটি উপস্থিত হলে, তাই খেতেন, শুধু রুটি বা শুধু খেজুর পেলে সেটাই খেতেন। তাঁর কাছে দুই প্রকার আনা হলে তিনি এ কথা বলতেন না যে, আমি দুই প্রকার খাদ্য গ্রহণ করব না। আর মজাদার ও মিষ্টি খাদ্য গ্রহণ করা থেকেও তিনি বিরত হতেন না। হাদীসে এসেছে: তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: «لكني أصوم وأفطر، وأقوم وأنام، وأتزوج النساء وآكل اللحم فمن رغب عن سنتي فليس مني» কিন্তু আমি তো মাঝে মাঝে নফল রোযা রাখি, আবার মাঝে মাঝে রোযা ছেড়েও দেই। রাত্রে কিছু অংশ জেগে ইবাদাত করি ও কিছু অংশে ঘুমাই, আমি তো বিবাহ করেছি এবং গোশও ভক্ষণ করে থাকি। ওহে আমার উম্মত! তোমরা জেনে রেখো! যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে অবজ্ঞা করে, সে আমার উম্মতভুক্ত নয়।[11]

উত্তম ও পবিত্র খাদ্যসমূহ খাওয়ার ও আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন, যে ব্যক্তি পবিত্র বা হালাল খাদ্যকে হারাম মনে করল সে সীমা লঙ্ঘনকারী আর যে ব্যক্তি আল্লাহর শুকরিয়া করে না সে আল্লাহর হক্ব আদায় করল না বস্তুত তা যেন সে নষ্ট করল। এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ হল সর্বোত্তম ও সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ। আর দুই পন্থায় লোকেরা সে আদর্শচ্যুত হয়ে থাকে:

১। অপচয়কারী যারা ইচ্ছামত গ্রহণ করে, আর তাদের প্রতি অর্পিত দায়িত্বসমূহ হতে বিরত থাকে।

২। উত্তম ও পবিত্র বস্তুসমূহ হারাম সাব্যস্ত করে এবং এমন বৈরাগ্যের প্রচলন ঘটায় যা আল্লাহ তা‘আলা প্রবর্তন করেননি, ইসলামে তো কোন বৈরাগ্য নেই।

তারপর তিনি [রাহেমাহুল্লাহ] বলেন: হালাল বস্তু সবই উত্তম ও পবিত্র, আর সব উত্তম ও পবিত্র বস্তুই হালাল। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জন্য উত্তম ও পবিত্র বস্তুগুলিকেই হালাল করেছেন এবং ঘৃণিত ও অপবিত্র বস্তুগুলিকে আমাদের জন্য হারাম করেছেন। পবিত্র হওয়ার কারণ হল: এগুলি যেমন রুচি সম্মত তেমনি তা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

আর যে বস্তুগুলি আমাদের জন্য ক্ষতিকর আল্লাহ তা‘আলা সেগুলিকে হারাম করেছেন। আর যা আমাদের জন্য উপকারী, আল্লাহ তা‘আলা তাই আমাদের জন্য হালাল করেছেন।

তারপর তিনি [রাহেমাহুল্লাহ] বলেন: পানাহার, পরিধান, ক্ষুধা ও পরিতৃপ্ততায় মানুষের অনেক অবস্থা রয়েছে। আর একজন মানুষের অবস্থাও অনেক প্রকার হতে পারে কিন্তু সর্বোত্তম আদর্শ হল ওটাই যদ্বারা আল্লাহ তা‘আলার অনুসরণ হয় ও যা গ্রহণকারীর পক্ষে উপকার হয় সেটাই।[12]

[1] তিরমিযী, হাদিস: ২৩৫৬

[2] মুসলিম, হাদিস: ২৯৭০

[3] মুসলিম, হাদিস: ২৯৭০

[4] তিরমিযী, হাদিস: ২৩৬০

[5] বুখারি, হাদিস: ১৪৩০

[6] মুসলিম, হাদিস: ২৩১২

[7] বুখারী, হাদিস: ৬৪৫০

[8] তিরমিযি, হাদিস: ৭৩৪

[9] বুখারী,  হাদিস: ২৫৬৭; মুসলিম, হাদিস: ২৯৭২

[10] বুখারী, হাদিস: ৩৫৩৬; মুসলিম, হাদিস: ২০৬৪

[11] মুসলিম, হাদিস: ১৪০১; নাসায়ী, হাদিস: ৩২১৭

[12] মাজমুউল ফাতাওয়া ২২/৩১০ সংক্ষেপিত