উপদেশ ২৭. জান্নাত ও জাহান্নাম আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ ১ টি

মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় সৌভাগ্যবান ওরা, যারা মরণের পর জান্নাত লাভ করবে। আর সবচেয়ে হতভাগ্য ওরাই, যারা মরণের পর জাহান্নামে যাবে। জান্নাত এক অনাবিল শান্তির জায়গা। জান্নাতের শান্তির পূর্ণ বিবরণ দেওয়া মানুষের সাধ্যের বাহিরে। তাই জান্নাতের কিছু নমুনা সহ আনুসঙ্গিক বিষয়াদিও বর্ণনা পেশ করা হ’ল।

জান্নাতীদের বর্ণনায় মহান আল্লাহ বলেন,

اُولَئِكَ لَهُمْ رِزْقٌ مَعْلُوْمٌ فَوَاكِهُ وَهُمْ مُّكْرَمُوْنَ فِىْ جَنَّتِ النَّعِيْمِ عَلَى سُرُرٍ مُّتَقَابِلِيْنَ يُطَافُ عَلَيْهِم بِكَأْسٍ مِن مَّعِينٍ بَيْضَاءَ لَذَّةٍ لِّلشَّارِبِيْنَ لَافِيْهَا غَوْلٌ وَلَاهُمْ عَنْهَايُنْزَفُوْنَ وَعِنْدَهُمْ قَاصِرَاتِ الطَّرْفِ عِيْنٌ كَأَنَّ هُنَّ بَيْضٌ مَّكْنُوْن.

‘তাদের জন্যই রয়েছে নির্ধারিত রুযী ফল-মূল এবং তারা সম্মানিত। তাদের জন্য রয়েছে নেয়ামতের বাগান সমূহ। তারা মুখোমুখি হয়ে আসনে আসীন থাকবে। তাদেরকে ঘুরে ফিরে পরিবেশন করা হবে স্বচ্ছ পানপাত্র। তা হবে উজ্জ্বল পানীয় পানকারীদের জন্য সুপেয় সুস্বাদু। তার দরুন তাদের দেহে কোন ক্ষতি হবে না এবং তাদের জ্ঞান বুদ্ধিও নষ্ট হবে না। তাদের নিকট দৃষ্টি সংরক্ষণকারী সুন্দর চক্ষু বিশিষ্ট নারীগণ থাকবে। তারা এমন স্বচ্ছ যেমন ডিমের খোসার নীচে লুকানো ঝিল্লি’ (ছাফফাত ৪১-৪৯)। জান্নাতে মানুষের জন্য রুযী রয়েছে। তাদের জন্য ফল বাগান রয়েছে। তারা হুরদের নিয়ে মুখোমুখি উঁচু আসনে বসে থাকবে। তাদের সামনে উৎকৃষ্টমানের শরাব পরিবেশন করা হবে। তাতে বিবেকের কোন ক্ষতি হবে না। তাদের উপভোগের জন্য হরিণ নয়না সুদর্শনা নারীগণ থাকবেন। তারা এত সচ্ছ ও নরম যেমন ডিমের খোসার নীচে লুকানো ঝিল্লি।

শরবের এ পানপাত্র নিয়ে ঘুরতে থাকবে সুশ্রী বালকেরা। আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَيَطُوْفُ عَلَيْهِمْ غِلْمَانٌ لَّهُمْ كَأَنَّهُمْ لُؤْلُؤٌ مَّكْنُونٌ ‘তাদের খেদমতের জন্য ঘুরতে থাকবে তাদের জন্য নিযুক্ত সেবক বালক। তারা যেন লুকানো মুক্তা’ (তুর ২৪)। আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَيَطُوفُ عَلَيْهِمْ وِلْدَانٌ مُّخَلَّدُونَ إِذَا رَأَيْتَهُمْ حَسِبْتَهُمْ لُؤْلُؤًا مَّنثُورًا ‘তাদের সেবার জন্য ঘুরতে থাকবে এমন সব ছেলে যারা সব সময় বালকই থাকবে। তোমরা তাদেরকে দেখলে বিক্ষিপ্ত মণি-মুক্তা বলেই মনে করবে’ (দাহর ১৯)

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,

ادْخُلُوا الْجَنَّةَ أَنتُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ تُحْبَرُونَ يُطَافُ عَلَيْهِم بِصِحَافٍ مِّن ذَهَبٍ وَأَكْوَابٍ وَفِيهَا مَا تَشْتَهِيهِ الْأَنفُسُ وَتَلَذُّ الْأَعْيُنُ وَأَنتُمْ فِيهَا خَالِدُونَ وَتِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِي أُورِثْتُمُوهَا بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ لَكُمْ فِيْهَا فَاكِهَةٌ كَثِيْرَةٌ مِّنْهَا تَأْكُلُوْنَ.

‘তোমরা এবং তোমাদের স্ত্রীরা জান্নাতে প্রবেশ কর তোমাদেরকে সন্তুষ্ট করে দেওয়া হবে। তাদের সামনে সোনার থালা ও পানপাত্রসমূহ পরিবেশন করা হবে এবং মন ভুলানো ও দৃষ্টির পরিতৃপ্তকারী জিনিস সমূহ সেখানে থাকবে। তাদেরকে বলা হবে এখন তোমরা চিরদিন এখানেই থাক। তোমরা পৃথিবীতে যে নেক আমল করেছিলে সে সব আমলের দরুন তোমরা এ জান্নাতের উত্তরাধিকারী হয়েছ। তোমাদের জন্য এখানে প্রচুর ফল-ফলাদী রয়েছে যা তোমরা খাবে’ (যুখরূফ ৭০-৭৩)। আল্লাহ তাআ‘লা অন্যত্র বলেন,

مَثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِي وُعِدَ الْمُتَّقُونَ فِيهَا أَنْهَارٌ مِّن مَّاء غَيْرِ آسِنٍ وَأَنْهَارٌ مِن لَّبَنٍ لَّمْ يَتَغَيَّرْ طَعْمُهُ وَأَنْهَارٌ مِّنْ خَمْرٍ لَّذَّةٍ لِّلشَّارِبِينَ وَأَنْهَارٌ مِّنْ عَسَلٍ مُّصَفًّى وَلَهُمْ فِيهَا مِن كُلِّ الثَّمَرَاتِ وَمَغْفِرَةٌ مِّن رَّبِّهِمْ.

‘মুত্তাকী লোকদের জন্য যে জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছে, তার পরিচয় তো এই যে, তাতে স্বচ্ছ ও সুমিষ্ট পানির ঝরণাধারা প্রবাহমান রয়েছে। এমন দুধের ঝর্ণাধারা প্রবাহমান রয়েছে যার স্বাদ ও বর্ণ কখনও বিকৃত হবে না। এমন পানির ঝর্ণাধারা প্রবাহমান থাকবে, যা পানকারীদের জন্য সুস্বাদু ও সুপেয় হবে। আর এমন মধুর ঝর্ণাধারা প্রবাহমান রয়েছে, যা অতীব স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন। সেখানে তাদের সর্ব প্রকারের ফল থাকবে এবং তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে রয়েছে ক্ষমা’ (মুহাম্মাদ ১৫)। আল্লাহ আরো বলেন,

وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ، ذَوَاتَا اَفْنَانٍ، فِيْهِمَا عَيْنَانِ تَجْرِيَانِ، فِيْهِمَا مِنْ كُلِّ فَاكِهَةٍ زَوْجَانٌ.

‘আর যারা আপন প্রতিপালকের সামনে আসার ব্যাপারে ভয় পোষণ করে তাদের প্রত্যেকের জন্যই দু’টি করে বাগান রয়েছে’ (রহমান ৪৭)। উভয় বাগানই সবুজ-সতেজ ডাল-পালায় পরিপূর্ণ (রহমান ৪৯)। দু’টি বাগানেই ঝর্ণাধারা সদাসর্বদা প্রবাহমান রয়েছে (রহমান ৫১)। উভয় বাগানের ফলসমূহের অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন হবে (রহমান ৫২)। আল্লাহ আরো বলেন,

مُتَّكِئِينَ عَلَى فُرُشٍ بَطَائِنُهَا مِنْ إِسْتَبْرَقٍ وَجَنَى الْجَنَّتَيْنِ دَانٍ- فِيهِنَّ قَاصِرَاتُ الطَّرْفِ لَمْ يَطْمِثْهُنَّ إِنسٌ قَبْلَهُمْ وَلَا جَانٌّ- كَأَنَّهُنَّ الْيَقُوْتُ وَالْمَرْجَانُ- وَمِنْ دُوْنِهِمَا جَنَّتَانِ- مُدْهَامَّتاَنِ- فِيْهِمَا عَيْنَانِ نَضَّاخَتَانِ- فِيْهِمَا فَاكِهَةٌ وَّنَخْلٌ وَّرُمَّانٌ- فِيْهِنَّ خَيْرَاتٌ حِسَانٍ.

‘জান্নাতী লোকেরা এমন শয্যার উপর ঠেস দিয়ে বসে থাকবে যার আবরণ মোটা রেশমের তৈরী হবে আর বাগানের ডাল-পালা ঝুঁকে নুয়ে থাকবে (রহমান ৫৪)। এ অফুরন্ত নিয়ামত সমূহের মধ্যে লজ্জাবনত নয়না ললনারাও থাকবে। তাদেরকে এ জান্নাতী লোকদের পূর্বে কোন মানুষ বা জ্বিন স্পর্শ করেনি (রহমান ৫৬)। তারা এমনই সুন্দরী রূপসী যেমন হীরা ও মণি-মুক্তা (রহমান ৫৮)। জান্নাতী লোকদের পূর্ববর্তী দু’টি বাগান ছাড়াও আরও দু’টি বাগান দেওয়া হবে, যা হবে ঘন-সন্নিবেশিত সবুজ-শ্যামল ও সতেজ। দু’টি বাগানে দু’টি উৎক্ষিপ্তমান ঝর্ণাধারা থাকবে (রহমান ৬৬)। তাতে বিপুল পরিমাণ ফল, খেজুর ও আনার থাকবে। এসব নিয়ামতের মধ্যেই থাকবে স্বচরিত্রের অধিকারী সুদর্শনা স্ত্রীগণ (রহমান ৭০)

حُورٌ مَّقْصُورَاتٌ فِي الْخِيَامِ- لَمْ يَطْمِثْهُنَّ إِنسٌ قَبْلَهُمْ وَلَا جَانٌّ- مُتَّكِئِينَ عَلَى رَفْرَفٍ خُضْرٍ وَعَبْقَرِيٍّ حِسَانٍ.

তাবুসমূহের মধ্যে সুরক্ষিত থাকবে বড় চোখবিশিষ্ট শ্বেত সুন্দরী নারীগণ। তাদেরকে কোন মানুষ বা জ্বিন স্পর্শ করেনি (রহমান ৭৪)। তারা অস্বাভাবিক উৎকৃষ্টমানের উত্তম সবুজ গালিচা এবং সুন্দর সুসজ্জিত শয্যায় হেলান দিয়ে অবস্থান করবে (রহমান ৭৭)

اِنَّ الْمُتَّقِيْنَ فِىْ مَقَامٍ اَمِيْنٍ فِىْ جَنَّتٍ وَعُيُوْنٍ يَلْبَسُوْنَ مِنْ سُنْدُسٍ وَّاِسْتَبْرَقٍ مُّتَقَابِلِيْنَ كَذَلِكَ وَزَوَّجْنَاهُمْ بِحُوْرٍ عِيْنٍ.

‘আল্লাহভীরু লোকেরা দুশ্চিন্তা ও ভয়ভীতি মুক্ত নিরাপদ ও শান্তিময় স্থানে থাকবে। তা হবে বাগ-বাগিচা ও ঝর্ণাধারা পরিবেষ্টিত জায়গা। চিকন রেশম ও মুখমলের পোশক পরে সামনা-সামনি আসীন হবে। এটাই হবে তাদের জাঁকজমকের অবস্থা। সুন্দরী রুপসী হরিণ নয়না নারীদেরকে তাদের স্ত্রী করে দিবে’ (দুখান ৫১-৫৪)

وَالسَّابِقُونَ السَّابِقُونَ اُولَئِكَ الْمُقَرَّبُوْنَ فِىْ جَنَّتٍ النَّعِيْمِ ثُلَّةٌ مِّنَ الْأَوَّلِينَ وَقَلِيْلٌ مِنَ الْاَخِرِيْنَ عَلىَ سُرُرٍ مَوْضُوْنَةٍ مُتَّكِئِينَ عَلَيْهَا مُتَقَابِلِينَ يَطُوفُ عَلَيْهِمْ وِلْدَانٌ مُّخَلَّدُونَ بِأَكْوَابٍ وَأَبَارِيقَ وَكَأْسٍ مِّن مَّعِينٍ لَايُصَدَّعُوْنَ عَنْهَا وَلَا يُنْزَفُوْنَ وَفَاكِهَةٍ مِّمَّا يَتَخَيَّرُونَ وَلَحْمِ طَيْرٍ مِّمَّا يَشْتَهُونَ وَحُوْرٍ عِيْنٍ كَأَمْثَالٍ اللُّؤْلُوٍ الْمَكْنُوْنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنُ لَايَسْمَعُوْنَ فِيْهَا لَغْوًا وَلَا تَأْثِيْمًا اِلَّا قِيْلًا سَلَامًا سَلَامَا وَأَصْحَابُ الْيَمِيْنِ مَاأَصْحَابُ الْيَمِيْنِ فِىْسِدْرٍ مَّخْضُوْدٍ وَطَلْحٍ مَنْضُوْدٍ وَظِلِّ مَمْدُوْدٍ وَمَاءٍ مَسْكُوْبٍ وَفَاكِهَةٍ كَثِيْرَةٍ لَاَمَقْطُوْعَةٍ وَّلَا مَمْنُوْعَةٍ وَفُرُشٍ مَّرْفُوْعَةٍ اِنَّا أَنْشَائْنَاهُنَّ اِنْشَاءَ فَجَعَلْنَاهُنَّ أَبْكَارًا عُرُبًا أَتْرَابًا.

‘আর অগ্রবর্তী লোকেরা তো সব ব্যাপারেই অগ্রবর্তী থাকবে। তারাই তো সান্নিধ্য লাভকারী লোক। তারা নিয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাতে অবস্থান ও বসবাস করবে। পূর্ববর্তী লোকদের মধ্যে বেশিসংখ্যক আর পরবর্তী লোকদের মধ্যে কমসংখ্যক, তারা মণিমুক্তা খচিত আসন সমূহের উপর হেলান দিয়ে মুখোমুখি হয়ে বসে থাকবে। চির কিশোরীগণ তাদের সামনে প্রবাহমান ঝর্ণার সুরায় ভরা পানপাত্র পরিবেশন করবে। হাতলধারী বড় বড় সুরাভান্ড, হাতলবিহীন পানপাত্র নিয়ে দৌড়া দৌড়ি করতে থাকবে। এসব পানীয় পান করে তাদের মাথা ঘুরবে না, তাদের বিবেক বুদ্ধিও লোপ পাবে না। আর চির কিশোরীগণ তাদের সামনে নানা রকমের সুস্বাদু ফল পরিবেশন করবে। যেন ইচ্ছামত নিতে পারে। আর তাদের জন্য সুন্দর চক্ষুধারী নারীগণও থাকবে। তারা লুকিয়ে রাখা মুক্তার মত সুশ্রী, সুন্দরী হবে। এসব কিছু তাদের সেই আমলের শুভ প্রতিফল যা তারা দুনিয়ার জীবনে করেছিল। তারা সেখানে কোন বাজে কথা বা পাপের কথা শুনতে পাবে না। যা কথা হবে তা ঠিক ঠিক ও যথাযথ হবে। আর ডান বাহুর লোকেরা, ডান বাহুর লোকদের সৌভাগ্যের কথা আর কি বলা যায়। তাদের জন্য থাকবে কাটাবিহীন কুল বৃক্ষসমূহ, থরে থরে সাজানো কলা সমূহ, বিস্তীর্ণ এলাকাব্যাপী ছায়া, সর্বদা প্রবাহমান পানি, আর প্রচুর পরিমাণে ফল থাকবে। যা কোনদিন শেষ হবে না, খেতে কোন বাধা বিপত্তি ঘটবে না। তারা উচ্চ আসনসমূহে সমাসীন থাকবে। তাদের স্ত্রীগণকে আমি বিশেষভাবে সম্পূর্ণ নতুন করে সৃষ্টি করব এবং তাদেরকে কুমারী করে দিব। তারা নিজেরদের স্বামীদের প্রতি থাকবে আসক্ত। আর তারা বয়সে সবাই সমান হবে’ (ওয়াক্বিয়া ১০-৩৭)। (أبْكَارَ) শব্দটি মহিলাদের অতীব উত্তম নারীসুলভ সৌন্দর্য-বৈশিষ্ট্য বুঝাবার জন্য ব্যবহার হয়। অর্থাৎ এমন সব মহিলাকে বুঝাই যারা নারীত্বে উত্তম, উন্নতমান, শুভ আচার-আচরণ মিষ্ট-ভদ্র কথা-বার্তা ও নারীসূলভ প্রেম-ভালবাসা ও হৃদয়াবেগে ভরপুর। যারা নিজেদের স্বামীগণকে মন-প্রাণ দিয়ে পেতে চায়, কামনা করে, ভালবাসে এবং তাদের স্বামীরাও তাদের প্রতি অকৃত্রিম প্রেমিক।