এসব সংশয়ের জবাব দেয়া হচ্ছে এজন্য যে, দশ বৎসর পূর্বে অত্র কিতাবের ভূমিকায় যা লিখেছিলাম। এই অল্প সময়েই আমি মুসলিম যুব সমাজে দীন ও ইবাদতের ক্ষেত্রে ইসলামের স্বচ্ছ প্রস্রবণ কুরআন ও হাদীছের দিকে প্রত্যাবর্তন করা অপরিহার্য হওয়ার দিশা দানে তার চমৎকার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছি। আলহামদুলিল্লাহ তাদের মধ্যে সুন্নাহ মান্যকারী এবং এর মাধ্যমে ইবাদতকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি তারা এই আদর্শে পরিচিতিও লাভ করে ফেলেছে। তবে অন্যদিকে তাদের কিছু সংখ্যককে আবার সুন্নাহ অনুসরণ করা থেকে থেমে থাকতে দেখেছি। আর এমনটি হয়েছে সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশমূলক আয়াত ও ইমামগণের উক্তিসমূহ উল্লেখ করার পর উক্ত নীতির অপরিহার্যতার ব্যাপারে সন্দেহ বশতঃ নয় বরং কিছু মুকাল্লিদের মাশাইখদের কাছ থেকে শ্ৰুত সংশয়ের ভিত্তিতে। তাই আমি সেগুলো উল্লেখ করে তার সমুচিত জবাব দানের প্রয়োজনীয়তা বোধ করি এই আশায় যে, তারাও সুন্নাহ অনুসরণকারীদের সাথে যোগ দিয়ে তার উপর আমল শুরু করে দিবেন। এবং এতে করে তাঁরা আল্লাহর ইচ্ছায় মুক্তিপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন।
প্ৰথম সংশয়ঃ তাদের কেউ কেউ বলেন, আমাদের ধর্মীয় ব্যাপারে আমাদের নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আদর্শ মেনে নেওয়া নিঃসন্দেহে ওয়াজিব। বিশেষ করে নিছক ইবাদতের ক্ষেত্রে গবেষণা ও মতামতের কোন সুযোগ নেই। কেননা এগুলো শুধু দলীল নির্ভর বিষয় যেমন ছলাত, কিন্তু আমি মুকাল্লিদ শাইখদের কারো নিকট থেকে এই বিষয়ে আদেশ দিতে শুনিনি। বরং তাদেরকে দেখেছি তারা মতভেদকে স্বীকার করেন এবং এটাকে জাতির পক্ষে সুবিধাজনক ব্যাপার বলে ধারণা করেন। তারা এর স্বপক্ষে দলীল হিসাবে একটি হাদীছ পেশ করেন যেটিকে প্রায়ই তারা এরকম পরিস্থিতি সামনে আসলে সুন্নতের ঝাণ্ডা বাহীদের প্রতিবাদে আওড়িয়ে থাকে। যা হচ্ছে- اختلاف أمتى رحمة অর্থাৎ- আমার উম্মতের মতানৈক্য রাহমাতস্বরূপ। আমরা দেখছি যে, এ হাদীছ আপনি যে পথের দিকে দাওয়াত দিচ্ছেন তার এবং আপনার অত্র গ্রন্থসহ অন্যান্য গ্রন্থাদির বিরোধিতা করছে। অতএব এ হাদীছ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
উত্তর, দু’ভাবে হবেঃ
প্ৰথম উত্তরঃ হাদীছটি বিশুদ্ধ নয়, বরং তা বাত্বিল, তার কোন ভিত্তি নেই। আল্লামা সুবকী বলেন, আমি এ হাদীছের সূত্র পাইনি- না ছহীহ, না যাঈফ, না জাল হাদীছ।
আমি বলছিঃ বরং এ শব্দে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
....اختلاف أصحابي لكم رحمة
অর্থঃ ... আমার ছাহাবাদের মতভেদ তোমাদের জন্যে রাহমাত।
اصحابي کالنجوم فبأيهم اقتدیتم اهتدیتم
অর্থঃ “আমার ছাহাবাগণ তারকারাজির ন্যায়, তাদের যাকেই তোমরা অনুসরণ করবে। হিদায়াত পেয়ে যাবে।” এই উভয় বাক্যই বিশুদ্ধ নয়, প্রথমটি মারাত্মক দুর্বল, আর দ্বিতীয়টি জাল। আমি সব ক'টিকে “সিলসিলাতুল আহাদীস আয-যঈফা ওয়াল মাওযূ’আহ” গ্রন্থের ৫৮-৫৯, ৬১ নম্বরে যাচাই করে দেখেছি।
দ্বিতীয় উত্তরঃ হাদীছটি যঈফ হওয়ার সাথে সাথে তা কুরআন বিরোধীও বটে। কেননা মতবিরোধ থেকে বিরত ও ঐকমত্য থাকার ব্যাপারে আদেশ সংক্রান্ত আয়াত এত বেশী প্রসিদ্ধ যে, তা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। তবে দৃষ্টান্ত স্বরূপ কিছু উল্লেখ করা যায়। আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ
অর্থঃ আর তোমরা পরস্পরে বিবাদ কর না, তাহলে অকৰ্মান্য হয়ে পড়বে। এবং তোমাদের শক্তি হারিয়ে যাবে।[1] তিনি আরো বলেনঃ
وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ - مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ
অর্থঃ আর মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে না। যারা তাদের দীনে বিভেদ সৃষ্টি করেছে আর নিজেরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে আনন্দিত।[2]
তিনি আরো বলেনঃ
وَلَا يَزَالُونَ مُخْتَلِفِينَ إِلَّا مَنْ رَحِمَ رَبُّكَ
অর্থঃ তোমার পালনকর্তা যাদেরকে আঁনুগ্রহ করেন তারা ব্যতীত অন্যান্যরা সর্বদা মতভেদ করতেই থাকবে।[3]
তোমার প্রতিপালক তাদেরকে অনুগ্রহ করেন যারা মতভেদ করে না, সুতরাং বুঝা গেল। যারা বাত্বিলপন্থী তারাই মতভেদ করে। তবে কোন বিবেক বলবে যে, মতভেদ রাহমাত?
অতএব সাব্যস্ত হল যে, এ হাদীছ বিশুদ্ধ নয়, না সনদের (সূত্রের) দিক দিয়ে আর না মাতনের (শব্দের) দিক দিয়ে।[4] এখনি পরিষ্কার হয়ে গেল যে, এ হাদীছকে সংশয়ের উৎস বানানো বৈধ নয়- কুরআন হাদীছের উপর আমল বন্ধ রাখার জন্য যে ব্যাপারে ইমামগণও আদেশ দিয়েছেন।
[2] সূরা আর রুম ৩১-৩২ আয়াত।
[3] সূরা হুদ ১১৮-১১৯ আয়াত।
[4] যে ব্যক্তি বিস্তারিত জানতে চান এব্যাপারে তার পক্ষে উপরোক্ত গ্রন্থাদি পড়া উচিত।