পূর্বোল্লিখিত কারণ সাপেক্ষে ইমামগণের অনুসারীদের-
وَقَلِيلٌ مِنَ الْآخِرِينَ ٭ عَلَىٰ سُرُرٍ مَوْضُونَةٍ
পূর্ববর্তদের অধিক সংখ্যক এবং পরবর্তদের অল্প সংখ্যক[1] লোক স্বীয় ইমামদের সব কথা গ্ৰহণ করতেন না। বরং তাদের অনেক কথাই তারা বাদ দিয়েছেন যখন সুন্নাহ বিরোধী বলে সাব্যস্ত হয়েছে। এমনকি ইমামদ্বয় মুহাম্মদ ইবনুল হাসান ও আবু ইউসুফ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁদের শাইখ আবু হানীফার (রহঃ) প্রায় এক তৃতীয়াংশ মাযহাব-এ বিরোধিতা করেছেন।[2] ফিকহের কিতাবগুলোই একথার বর্ণনার জন্য যথেষ্ট ।
এ ধরনের কথা ইমাম মুযানী[3] ও ইমাম শাফিঈর অন্যান্য অনুসারীদের বেলায়ও প্রযোজ্য। আমরা যদি এর উপর দৃষ্টান্ত পেশ করতে যাই তবে কথা দীর্ঘ হয়ে যাবে এবং এই বইয়ে আমি সংক্ষেপস্থানের যে উদেশ্য পোষণ করেছি তা থেকেও বেরিয়ে পড়ব ।
তাই দুটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হবঃ
১। ইমাম মুহাম্মদ তাঁর “মুওয়াত্তা”[4] গ্রন্থে বলেন (১৫৮ পৃঃ) আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) ইসতিস্কার কোন ছলাত আছে বল মনে করতেন না। তবে আমার কথা হচ্ছে যে, ইমাম লোকজনকে নিয়ে দুরাকাআত ছলাত পড়বেন, অতঃপর দুআ করবেন এবং স্বীয় চাদর পাল্টাবেন শেষ পর্যন্ত।
২। ইছাম বিন ইউসুফ আল বালখী যিনি ইমাম মুহাম্মদ এর সাথী ছিলেন[5] এবং ইমাম আবু ইউসুফ এর সংশ্রবে থাকতেন[6] তিনি ইমাম আবু হানীফার কথার বিপরীত অনেক ফাতাওয়া প্ৰদান করতেন, কেননা (আবু হানীফা) যেগুলোর দলীল জানতেন না অথচ তার কাছে অন্যদের দলীল প্ৰকাশ পেয়ে যেত, তাই সেমতেই ফাতাওয়া দিয়ে দিতেন।[7] তাই তিনি রুকুতে গমনকালে ও রুকু থেকে উঠার সময় হস্তযুগল উত্তোলন (রফউল ইয়াদাইন) করতেন।[8] যেমনটি নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে মুতাওয়াতির বর্ণনায় এসেছে। তাঁর তিন ইমাম কর্তৃক এর বিপরীত বক্তব্য তাকে এ সুন্নাত মানতে বাধা দেয়নি। এই নীতির উপরেই প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তিকে অটল থাকা ওয়াজিব, তার ইমাম ও অন্যান্যদের সাক্ষ্য দ্বারা এটাই ইতিপূর্বে প্রতীয়মান হয়েছে।
সারকথাঃ আমি আশা করব কোন মুকাল্লিদ (ভাই) তাড়াহুড়া করে এই কিতাবে অনুসৃত পন্থার উপর আঘাত হানবেন না এবং স্বীয় মাযহাবের বিরোধিতার অজুহাত পেশ করে এতে সন্নিবেশিত সুনান (হাদীছ) সমূহের উপর আমল পরিত্যাগ করবেন না।
বরং আমি আশা করি তিনি আবশ্যকীয়ভাবে সুন্নাত প্রতিপালনে ও ইমামদের সুন্নাত বিরোধী কথা পরিত্যাগের ব্যাপারে পূর্বোল্লিখিত ইমামদের উক্তিগুলো স্মরণ করবেন। জানা উচিত যে, এই পদ্ধতির (দৃষ্টিভঙ্গির) উপর অপবাদ হানা অন্ধভাবে অনুসৃত ইমামের উপরেই অপবাদ হানার নামান্তর, তিনি যে ইমামই হোন, কেননা আমি এই পদ্ধতি তাদের (ইমামদের) থেকেই গ্ৰহণ করেছি, যেমন ইতিপূর্বে তার বর্ণনা অতিবাহিত হল। তাই যে ব্যক্তি এই পথে তাদের থেকে দিক নির্দেশনা গ্ৰহণ না করল সে মহাবিপদের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হল। কেননা তা সুন্নাত থেকে বিমুখ হওয়াকে নিশ্চিত করে, অথচ মতানৈক্যের ক্ষেত্রে হাদীছ অনুসরণ করতে এবং তার উপর ভরসা রাখতে আমরা আদিষ্ট হয়েছি। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
অর্থঃ তোমার রবের শপথ তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদে তোমাকে বিচারক মেনে নিবে, অতঃপর তোমার মীমাংসায় নিজেদের অন্তরে কোনরূপ সংকীর্ণতা পোষণ করবে না, এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নিবে।[9]
আল্লাহ্র কাছে দু’আ করছি তিনি যেন আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন যাদের ব্যাপারে তিনি বলেছেনঃ
إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ٭ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَخْشَ اللَّهَ وَيَتَّقْهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ
অর্থঃ মুমিনদেরকে যখন তাদের মধ্যে বিচার মীমাংসার জন্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে আহবান করা হয় তখন তাদের বক্তব্য এই হওয়া উচিত যে, তারা বলবেঃ আমরা শুনলাম এবং মানলাম আর তারাই হচ্ছে সফলকাম। আর যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করে, আর আল্লাহকে ভয় করে ও তার শাস্তির বিষয়ে আতঙ্কিত থাকে তারাই কৃতকার্য[10]
[2] ইবনু আবিদীন “আল-হাশিয়া” এর (১/১৬২ পৃঃ), লক্ষনোভী “আন-নাফিউল কাবীর” (৯৩ পৃঃ), উক্ত কথার সম্বন্ধ গাযালীর দিকে করেছেন।
[3] তিনি তার শাফেঈ ফিকহ সংক্ষেপায়ন “মুখতাসার ফী ফিকহিশ শাফেঈ” গ্রন্থের শুরুতে বলেন, যা ইমাম শাফিঈর গ্ৰন্থ “আল-উম্ম” এর টীকায় ছাপানো হয়েছে। কথাটি হচ্ছে, আমি এই কিতাবটি সংক্ষেপ করেছি। মুহাম্মদ বিন ইদ্রীস আশশাফি'ঈ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ইলম থেকে এবং তার কথার মর্ম নিয়ে যাতে করে আগ্রহী ব্যক্তির নিকটবর্তী করে দিতে পারি। সাথে সাথে জানিয়ে দিয়েছি ইমাম সাহেব কর্তৃক তাঁর বা অন্য কারো অন্ধ অনুসরণের নিষেধাজ্ঞার কথা যাতে করে সে তার দ্বীনের ব্যাপারে বিবেচনা করতে পারে এবং তার ব্যাপারে নিজের সার্থেই সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে।
[4] তিনি এই গ্রন্থে প্রায় বিশটা বিষয়ে স্বীয় ইমামের বিরোধিতা করেন, এর স্থানগুলোর প্রতি (পৃষ্ঠা উল্লেখ করতঃ) ইঙ্গিত করে দিচ্ছি- ৪২, ৪৪, ১০৩, ১২০, ১৫৮, ১৬৯, ১৭২, ১৭৩, ২২৮, ২৩০, ২৪০, ২৪৪, ২৭৪, ২৭৫, ২৮৪, ৩১৪, ৩৩১, ৩৩৮, ৩৫৫, ৩৫৬, মুওয়াত্বা মুহাম্মদ এর টীকা “আত-তা’লীকুল মুমাজ্জাদ আলা মুওয়াত্তা মুহাম্মাদ” থেকে সংগৃহীত।
[5] তার কথা ইবনু আবিদীন তার “আল-হাশিয়া” তে উল্লেখ করেন (১/৭৪) ও “রসমুল মুফতী” গ্রন্থে (১/১৭) কুরাশী এটিকে “আল জাওয়াহিরুল মুযীয়াহ কী তবাকাতিল হানাফিয়াহ” (৩৪৭ পৃঃ)-তে উল্লেখ করেন এবং বলেনঃ তিনি হাদীছের অনুসারী বিশ্বস্ত লোক ছিলেন, তিনি ও তাঁর ভাই ইবরাহীম স্বীয় যুগে বলখের দুই শাইখ ছিলেন।
[6] আল-ফাওয়াইদুল বাহীইয়াহ কী তারাজিমিল হানাফিয়াহ
[7] “আল-বাহরুর রা’ইক” (৬/৯৩), রসমুল মুফতী (১/২৮ পৃঃ)
[8] “আল ফাওয়াইদ” (১১৬ পৃঃ) অতঃপর সুন্দর টীকা সংযোজন করে বলেনঃ আমি বলছি, এ থেকে জানা গেল আবু হানীফা (রহঃ) থেকে মাকহুলের এ বর্ণনাটির বাতিল হওয়ার কথা যাতে রয়েছেঃ যে ব্যক্তি ছলাতে রাফউল ইয়াদাইন করবে তার ছলাত বিনষ্ট হবে। এ সেই বর্ণনা যেটি নিয়ে আমীর কাতিব আল ইতকানী বিভ্রান্ত হয়েছেন। যেমনটি তার জীবনীতে বর্ণিত হয়েছে। কেননা ইছাম বিন ইউসুফ আবু ইউসুফ এর সহচরবৃন্দের অন্তর্ভুক্ত হয়েও তিনি রাফউল ইদাইন করতেন। অতএব যদি এই বর্ণনার কোন ভিত্তি থাকত তবে আবু ইউসুফ ও ইছাম তা জানতেন। তিনি বলেনঃ এ থেকে আরো জানা যায় যে, যদি কোন হানাফী কোন এক বিষয়ে স্বীয় ইমামের মাযহাব পরিত্যাগ করে প্রতিপক্ষের দলীল শক্তিশালী হওয়ার ভিত্তিতে- তবে এর কারণে তিনি তাঁর তাকলীদ থেকে বেরিয়ে পড়েন না। বরং তা হবে তাকলীদ পরিহারের রূপধারী প্রকৃত তাকলীদ। তুমি কি দেখনা ইছাম বিন ইউসুফ তিনি রাফউল ইয়াদাইন না করার ব্যাপারে আবু হানীফার মাযহাব পরিত্যাগ করেন। তার পরেও তাকে হানাফী গণনা করা হয়? তিনি বলেন, অভিযোগ আল্লাহর কাছেই পেশ করছি আমাদের যুগের অজ্ঞ লোকদের ব্যাপারে। কারণ কেউ শক্তিশালী দলীলের ভিত্তিতে ইমামের একটি মাসআলা পরিহার করলে তারা তাকে দোষারোপ করে। এমনকি মাযহাব থেকে বহিষ্কার করে দেয়। তবে তারা যেহেতু সাধারণ পাবলিক তাই তাদের ব্যাপারে আশ্চর্যের কিছু নেই, আশ্চর্য হতে হয় তাদের বেলায় যারা উলামাদের বেশ ধরেও তাদের (অজ্ঞদের) চালচলনের মত চালচলন প্রদর্শন করে যেন চতুস্পদ জন্তু।
[9] সূরা আন-নিসা ৬৫ আয়াত।
[10] সূরা আন-নূর ৫১-৫২ আয়াত।