ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে এ মর্মে অনেক চমৎকার চমৎকার কথা উদ্ধৃত হয়েছে।[1] তাঁর অনুসারীগণ তাঁর এ সব কথায় অধিক সাড়া দিয়েছেন এবং উপকৃতও হয়েছেন। কথাগুলোর মধ্যে রয়েছে।
مامن أحد إلا وتذهب عليه سنة لرسول الله صلى الله عليه وسلم وتعزب عنه، فمهما قلت من قول، أو أصلت من أصل فيه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم خلاف ما قلت، فالقول ماقال رسول الله صلى الله عليه وسلم، وهو قولي
প্রত্যেক ব্যক্তি থেকেই আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কিছু সুন্নাহ গোপন থাকবেই ও ছাড়া পড়বেই। তাই আমি যত কথাই বলেছি অথবা মৌলনীতি উদ্ভাবন করেছি। সেক্ষেত্রে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে আমার বক্তব্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য পাওয়া গেলে আল্লাহর রাসূলের কথাই হচ্ছে চূড়ান্ত আর এটিই হবে আমার (বরণীয়) কথা।[2]
أجمع المسلمون على أن من استبان له سنة عن رسول الله صلى الله عليه وسلم لم يحل له أن يدعها لقول أحد
(২) মুসলমানগণ এ ব্যাপারে একমত যে, যার কাছে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সুন্নাহ (হাদীছ) পরিষ্কাররূপে প্রকাশ হয়ে যায় তার পক্ষে বৈধ নয় অন্য কারো কথায় তা বর্জন করা।[3]
إذا وجدتم في كتابي خلاف سنة رسول الله صلى الله عليه وسلم فقولوا بسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم ودعوا ماقلت. وفي رواية : فاتبعوها، ولا تلتفتوا إلى قول أحد
(৩) তোমরা যখন আমার কিতাবে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সুন্নাহ্ বিরোধী কিছু পাবে তখন আল্লাহর রাসূলের সুন্নাতানুসারে কথা বলবে, আর আমি যা বলেছি তা ছেড়ে দিবে। অপর বর্ণনায় রয়েছেঃ তোমরা তারই (সুন্নতেরই) অনুসরণ কর, আর অন্য কারো কথার প্রতি ভ্ৰক্ষেপ করা না।[4]
إذا صح الحديث فهو مذهبي (8)
অর্থঃ হাদীছ বিশুদ্ধ সাব্যস্ত হয়ে গেলে এটাই আমার গৃহীত পন্থা (মাযহাব)।[5]
أنتم أعلم بالحديث والرجال مني، فإذا كان الحديث الصحيح، فأعلموني به أي شيء يكون : كوفيا أو بصريا أو شاميا، حتى أذهب إليه إذا کان صحیحا
(৫)আপনারাই[6] হাদীছ বিষয়ে ও তার রিজালের (বর্ণনাকারীদের) ব্যাপারে আমার অপেক্ষা অধিক জ্ঞাত, তাই ছহীহ হাদীছ পেলেই আমাকে জানাবেন চাই তা কুফীদের বর্ণনাকৃত হোক চাই বাছারীর হোক অথবা শামীর (সিরিয়ার) হোক, বিশুদ্ধ হলে আমি তাই গ্ৰহণ করব।
كل مسألة صح فيها الخبر عن رسول الله صلى الله عليه وسلم عند أهل النقل بخلاف ما قلت فأنا راجع عنها فى حياتي وبعد موتي
(৬) যে বিষয়ে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে আমার কথার বিরুদ্ধে হাদীছু বর্ণনাকারীদের নিকট বিশুদ্ধরূপে কোন হাদীছ পাওয়া যাবে আমি আমার জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর তা থেকে প্রত্যাবর্তন করলাম।[7]
اذا رأيتمنى أقول قولا وقد صح عن النبي صلى الله عليه وسلم خلافه فاعلموا أن عقلي قد ذهب
(৭) যখন তোমরা দেখবে যে, আমি এমন কথা বলছি। যার বিরুদ্ধে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে বিশুদ্ধ হাদীছ রয়েছে। তবে জেনে রেখ যে, আমার বিবেক হারিয়ে গেছে।[8]
كل ماقلت فكان عن النبي صلى الله عليه وسلم خلاف قولي مما يصح فحديث النبى أولى فلا تقلدوني
(৮) আমি যা কিছুই বলেছি তার বিরুদ্ধে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে ছহীহ সূত্রে হাদীছ এসে গেলে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর হাদীছই হবে অগ্ৰাধিকারযোগ্য, অতএব আমার অন্ধ অনুসরণ করো না।[9]
كل حديث عن النبي صلى الله عليه وسلم فهو قولي، وإن لم تسمعوه مني
(৯) নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সব হাদীছই আমার বক্তব্য যদিও আমার মুখ থেকে তা না শুনে থাক।[10]
[2] হাকিম স্বীয় অবিচ্ছিন্ন সূত্রে শাফি'ঈ থেকে বর্ণনা করেন যেমন রয়েছে ইবনু আসাকির এর “তারীখে দেমাস্ক” গ্রন্থের (১৫/১/৩ পৃঃ), ইলামুল মুয়াক্কিঈন গ্রন্থে (২/৩৬৩, ৩৬৪ পৃঃ) ও আল ইকায গ্রন্থে (১০০ পৃষ্ঠা)।
[3] ইবনুল কাইয়িম (২/৩৬১), আল ফাল্লানী (৬৮ পূঃ)।
[4] আল হারাবীর “যাম্মুল কালাম” গ্রন্থে (৩/৪৭,১), খতীবের “আল ইহতিজাজু বিশ-শাফেঈ” ইবনু আসাকির (১৫/৯/১), নববীর “আল-মাজমূ” গ্রন্থে (১/৬৩), ইবনুল কাইয়িম (২/৩৬৮), আল ফাললানী (১০০ পৃঃ) অপর বর্ণনাটি আবু নুআইমের “আল-হিলইয়া” গ্রন্থে (৯/১০৭), ইবনু হিব্বানের “আস-সহীহ” গ্রন্থে (৩/২৮৪-ইহসান)। স্বীয় বিশুদ্ধ সনদে ইমাম থেকে তার (আবু নুআইমের) অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
[5] নববীর পূর্বোক্ত কিতাবে, শা’রানী তার গ্রন্থে (১/৫৭ পৃঃ) এটাকে হাকিম বাইহাকীর কথা বলে উল্লেখ করেন। আল ফাল্লানী (১০৭ পৃঃ)।
ইমাম শা’রানীর বলেনঃ হযম বলেন, (বাক্যটির অর্থ) তাঁর নিকট অথবা অন্য কোন ইমামের নিকট (হাদিছটি) বিশুদ্ধ হয়ে গেলে (সেটাই আমার মাযহাব)। আমি বলছিঃ ইমাম সাহেবের সমাগত বাণী সংশ্লিষ্ট কথার পরে স্পষ্টতঃ এই (ইবনু হযমের ব্যাখ্যারই) অর্থই বহন করে।
ইমাম নববীর বক্তব্যের সংক্ষেপ হচ্ছেঃ এই কথার উপর আমাদের সাথীগণ আমল করেছেন ফজরের আযানে “আস সলাতু খাইরুম মিনান নাওম” বলে ছলাতের জন্য মানুষকে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান করার বিষয়ে (যার তিনি বিরোধী ছিলেন) এবং ইহরামের অবস্থা থেকে রোগের উযর সাপেক্ষে হালাল হওয়ার শর্তের ব্যাপারে (যে শর্ত তিনি করেছিলেন, অথচ রোগ ছাড়া অন্য কারণেও ইহরাম মুক্ত হওয়ার সপক্ষে হাদীছ এসেছে)। এতদুভয় বিষয় ছাড়াও আরো যা। (তার) মাযহাবের কিতাবসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে। আমাদের সাথীদের মধ্যে যারা (ইমামের ফাতাওয়ার বিপক্ষে) হাদীছ দ্বারা ফাতাওয়া দিয়েছেন বলে উল্লেখ রয়েছে তারা হচ্ছেনঃ আবু ইয়াকুব আল বুওয়াইত্বী, আবুল কাসিম আদদারিকী, আর যারা (ইমাম সাহেবের এই বাণীকে) আমল দিয়েছেন আমাদের মুহাদ্দিছ সাথীদের মধ্য হতে তারা হচ্ছেনঃ ইমাম আবূ বকর আল বাইহাকী ও অন্যান্যগন। আমাদের পূর্ববর্তীদের একদল এমন ছিলেন যারা কোন বিষয়ে ইমাম শাফিঈর মাযহাবের বিপরীতে হাদীছ পেলে তারা হাদীছের উপরেই আমল করতেন এবং এ দিয়েই ফাতাওয়া প্ৰদান করতেন। আর বলতেনঃ হাদীছের সাথে যা মিলে তাই ইমাম শাফিঈর মাযহাব।
শাইখ আবু আমর বলেন, শাফিঈদের মধ্যে যিনি এমন হাদীছ পান যা স্বীয় মাযহাবের বিরোধিতা করে তখন তিনি ভেবে দেখেন, যদি তাঁর মধ্যে ব্যাপক ইজতিহাদের উপকরণগুলো পরিপূর্ণ থাকে অথবা শুধু এই অধ্যায় বা বিষয়ে তা পাওয়া যায়। তবে হাদীছের উপর আমল করার ক্ষেত্রে তার স্বাধীনতা রয়েছে। আর যদি তার মধ্যে ইজতিহাদের উপায়-উপকরণগুলো না পাওয়া যায়, আর হাদীছ বিরোধী কাজ তাঁর পক্ষে কঠিন মনে হয়। অথচ খুঁজাখুঁজি করে হাদীছের বিপরীত বক্তব্য পোষণকারীর পক্ষে কোন সমুচিত জওয়াব না পাওয়া যায় তবে ইমাম শাফিঈ ছাড়া অন্য কোন স্বয়ংসম্পূর্ণ ইমাম যদি এর উপর আমল করে থাকেন তবে তার এটির উপর আমল করার অধিকার রয়েছে। আর এক্ষেত্রে এ নীতি অবলম্বন ইমামের মাযহাব পরিত্যাগের ব্যাপারে ‘উযর’ বলে বিবেচিত হবে। তাঁর এ কথা সুন্দর ও পালনীয়। আল্লাহ সর্বজ্ঞাত।
আমি বলছিঃ এখানে অপর একটি পরিস্থিতি থেকে গেছে যা ইবনুছ ছালাহ (আবু আমর) উল্লেখ করেননি তা হচ্ছে যখন হাদীছের উপর আমলকারী কাউকে না পাওয়া যায় তখন কী করবে? এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তাকীউদ্দীন সুবকী। তাঁর “মা’না কওলীশ শাফিঈ ... ইযা সাহহাল হাদীছ ...” নামক গ্রন্থে (৩/১০২ পৃঃ) তিনি বলেনঃ আমার নিকট হাদীছ অনুসরণ করাই উত্তম। কেউ ধরে নিক যে, সে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সম্মুখে রয়েছে এবং তার কাছ থেকেই হাদীছ শুনল, তবে কি হাদীছ মান্য করতে দেরী করার কোন অবকাশ থাকবে? আল্লাহর শপথ, থাকবে না। আর প্রত্যেকেই তার বুঝ অনুযায়ী (হাদীছের প্রতি) আমল করতে বাধ্য। উক্ত আলোচনা ও তথ্যের পূর্ণ বিবরণ পাবেন “ই’লামুল মুয়াক্কিঈন” (২/৩০২ ও ৩৭০) এবং ফুল্লানীর কিতাব যার নাম
إيقاظ همم أولي الأبصار للإقتداء بسيد المهاجرين والأنصار وتحذيرهم عن الإبتداع الشائع في القرى والأمصار من تقليد المذاهب مع الحمية والعصبية بين فقهاء الأعصار
) কিতাবটি স্বীয় অধ্যায়ে অতুলনীয়। প্রত্যেক সত্য প্রিয় ব্যক্তির কর্তব্য অনুধাবন ও গবেষণামূলক মানসিকতা নিয়ে এটি পাঠ করা।
[6] সম্বোধনটি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে করেছেন, কথাটি ইবনু আবি হাতিম “আদাবুশ শাফিঈ” গ্রন্থের ৯৪-৯৫ পৃষ্ঠাতে বর্ণনা করেন, আবু নুআইম “আল হিলইয়া” গ্রন্থের (৯/১/০৬)। খতীব “আল ইহতিজাজ বিশ-শাফিঈ” গ্রন্থের (৮/১) খাতীব থেকে ইবনু আসাকির তার গ্রন্থে (১৫/৯/১) পৃষ্ঠা ইবনু আব্দিল বার “আল ইনতিকা” গ্রন্থে পৃষ্ঠা ৭৫। ইবনুল জাউযী “মানাকিব ইমাম আহমাদ” পৃষ্ঠা ৪৯৯ ও আল-হারাবী তার গ্রন্থের (২/৪৭/২) পৃষ্ঠাতে তিনটি সূত্র পথ দিয়ে আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন হাম্বল থেকে তিনি তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, শাফিয়ী তাকে (কথাটি) বলেছেন। সুতরাং কথাটি তাঁর থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত। এজন্যেই ইমাম সাহেবের দিকে এর সম্বন্ধকে সুদৃঢ়ভাবে সাব্যস্ত করেন ইবনুল কাইয়িম “আল-ই’লাম” গ্রন্থের (২/৩২৫) পৃষ্ঠা এবং আল ফুল্লানী “আল-ইকায” এর ১৫২ পৃষ্ঠায়। কথাটি উল্লেখ করতঃ বলেনঃ বাইহাকী বলেন, এজন্যই তাঁর (ইমাম শাফি'ঈর) দ্বারা বেশী হাদীছ গ্ৰহণ সম্ভব হয়, তিনি হিজায, সিরিয়া, ইয়ামন ও ইরাকবাসীকে জমায়েত করেন, তার কাছে যে হাদীছই বিশুদ্ধ সাব্যস্ত হয়েছে তাই গ্ৰহণ করেছেন। এতে কোনরূপ পক্ষপাতিত্ব করেননি এবং তাঁর স্বদেশী মাযহাবের মিষ্টি কথার দিকে ধাবিত হননি। যখনই তিনি অন্য কারো নিকট হক প্রকাশিত পেয়েছেন তখনই তা গ্ৰহণ করেছেন। তাঁর পূর্বে যারা ছিলেন তাদের কেউ কেউ স্বজাতীয় ও স্বদেশীয় মাযহাবের জানা কথার উপরেই আমল সীমাবদ্ধ রাখেন, এর বিপরীত বিষয়ের বিশুদ্ধতা জানার চেষ্টা করেননি, আল্লাহ আমাদেরকে ও তাদেরকে ক্ষমা করুন।
[7] আবু নুআইম তাঁর “আল-হিলইয়া” গ্রন্থে (৯/১০৭ পৃঃ), আল হারাবী তার গ্রন্থের (১/৪৭ পৃঃ), ইবনুল কাইয়িম “ইলামুল মুয়াক্কিঈন” গ্রন্থের (২/৩৬৩ পৃঃ), আল ফুল্লানী (১০৪ পৃঃ)।
[8] ইবনু আবী হাতিম “আদাবুশ শাফেঈ” গ্রন্থে (৯৩ পৃঃ), আবুল কাসিম আস সামার কান্দি “আল-আমালী” তে, আরো রয়েছে আবু হাফছ আল মুআদ্দাব এর “আল মুনতাকী মিনহা” (১/২৩৪)-তে আবু নুআইম “আল-হিলইয়া” (৯/১০৬ পৃঃ), ইবনু আসাকির (১৫/৯/২) বিশুদ্ধ সনদে।
[9] ইবনু আবী হাতিম (৯৩, পৃঃ), আবু নুআইম ও ইবনু আসাকির (১৫/৯/২) বিশুদ্ধ
সনদে।
[10] ইবনু আবী হাতিম। এর (৯৩-৯৪ পৃঃ)।