জীবন আমাকে এমন কিছু অভ্যেস করার শিক্ষা দিয়েছে যা আমাকে কখনও ব্যর্থ করেনি (আর তা হলো): অন্যদের সম্বন্ধে আমার অনুমোদন সংযত প্রকাশ করা। সব ধরনের লোকের উপরই এই পদ্ধতির ইতিবাচক প্রভাব আছে। কোমল, নরম ও ভদ্র কথা মানুষের অন্তরে বিস্ময়কর ক্রিয়া করে। চাল-চলন, আচার-ব্যবহার ও লেন-দেনে উদার ও সদয় হতে আমাদের ধর্ম (দ্বন) আমাদেরকে শিক্ষা দেয়।
“আল্লাহর রহমতে আপনি কোমল ছিলেন বিধায় (তারা বিপদের সময় আপনার পাশে ছিল)। আর যদি আপনি কর্কশ ও কঠোর হৃদয়ের অধিকারী হতেন তবে তারা অবশ্যই আপনার চারপাশ থেকে সরে পড়ত।” (৩-সূরা আলে ইমরানঃ আয়াত-১৫৯)
“How to Win Friends বা বন্ধুদের মন জয় করার পদ্ধতি” নামক গ্রন্থের গ্রন্থকার বর্ণনা করেন যে, জনগণকে আপনার নিকট আকর্ষণ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ (বা উপায়) হলো তাদের ব্যাপারে অবাধে ও অধিক পরিমাণে প্রশংসা করা। (এ ব্যাপারে) আমি একমত হলাম না; (কেননা) সংযম বা মধ্যমপন্থা এবং ন্যায় বিচার প্রয়োজন।
قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا
“আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের জন্য অবশ্যই মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।” (৬৫-সূরা আত তালাকঃ আয়াত-৩)
তাই কারো উচিত নয় কৃত্রিমভাবে অন্যদের তোষামোদ করা এবং তাদের ব্যাপারে শুষ্ক থাকা (অর্থাৎ একেবারেই তাদের প্রশংসা না করা) ও তাদের থেকে দূরে থাকা (অর্থাৎ তাদের সাথে মধুর সম্পর্ক না রাখা)।
অবশ্যই গর্বিত ও উন্নাসিক মনোভাবের মাধ্যমে আমরা মানুষকে অবজ্ঞা করার পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারতাম; কিন্তু ফলে আমরাই আমাদের বন্ধুদেরকে হারাতাম- তারা আমাদেরকে হারাত না। আপনি যদি বন্ধুসুলভ না হন তবে লোকেরা শীঘ্রই বন্ধুত্ব স্থাপন করার জন্য অন্য কাউকে খুঁজে নিবে।
“আর যে সব মু’মিন আপনাকে অনুসরণ করে তাদের প্রতি আপনি আপনার দয়ার হাতকে বাড়িয়ে দিন (অর্থাৎ তাদের প্রতি সদয় হোন)”। (২৬-সূরা আশ শোয়ারাঃ আয়াত-২১৫)
অন্যদের শ্রদ্ধা অর্জন করাও আপনাকে সুখ বয়ে এনে দিতে অবদান রাখে; মুসলমানগণ পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী এবং তারা একে অপরের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।
“এবং মানুষের সাথে ভালো কথা বল।” (২-সূরা বাকারাঃ আয়াত-৮৩)
যারা অনন্য সাধারণ প্রতিভাধর, অন্যদেরকে প্রভাবিত করার গুণসম্পন্ন এবং অন্যদের ভক্তি আকর্ষণ ও উৎসাহ সঞ্চার করার গুণ আছে এমন লোকদের দ্বারাই জীবনে আমি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছি। মনে হয় যেন তারা তাদের উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে অন্যদেরকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। তাদের মুখে অন্যদের জন্যে সদা হাসি ফুটে থাকে, তারা সত্য কথা বলে এবং তাদের অন্তর হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত।
আল্লাহর ইচ্ছায় পৃথিবীর লোকদের মাঝে সমর্থন অর্জন করা আমাদের সকলের সাধ্যের মধ্যে। এই সমর্থন ধন-সম্পদের মাধ্যমে ক্রয় করা যায় না, বরং আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা, সত্যবাদিতা, আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ভালোবাসা, অন্যদের নিকট কল্যাণ বিস্তারের জন্য ভালোবাসা এবং নিজেকে ছোট মনে করার মাধ্যমেই এটা অর্জন করা যায়।
এসব এবং অন্যান্য উত্তম গুণাবলি অর্জন করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, কেননা, এগুলো অর্জন করতে হলে উপরের দিকে উঠতে হয়। যে ব্যক্তি মন্দ চরিত্র অর্জন করতে চায় সে সহজেই তা অর্জন করতে পারে, কারণ, মন্দ চরিত্র অর্জনের জন্য শুধুমাত্র নিচের দিকে নামার প্রয়োজন হয়।
একজন আরবী কবি বলেছেন- “মন্দ চরিত্রের অধিকারী শীঘ্রই এমন হয়ে যায় যে, সে তার শয়তানী আর অনুভব করতে পারে না, যেমন নাকি মৃত ব্যক্তির দেহে আঘাত কোন ব্যাথা সৃষ্টি করতে পারে না।”
যে ব্যক্তি স্বার্থ চিন্তায় বিভোর মনে মনে নিজেকে তার হীন ও বিষন্ন ভাবার কথা। কিছু লোক আছে যারা যতটা ভাবা উচিত নয় নিজেদেরকে ততটা বড় ভাবে বা নিজেদেরকে যতটা (বড় ভাবা) উচিত তার চেয়ে অনেক বেশি বড় মনে করে। এ ধরনের কিছু লোকের কথা মনে পড়ে, এরা এমন লোক যারা সমাজে কিছু অবদান রাখার চেষ্টা করেছিল পরে তারা ভাবতে শুরু করল যে, তাদের কাজ তাদের জীবনের মহৎ কীর্তির পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য ছিল।
আমি একটি ছাত্রের কথা জানি, যে নাকি তরুণ মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য করে ছোট ছোট কয়েকটি পুস্তিকা লিখেছিল।
আমি তাকে উৎসাহিত করতে চাইলাম, তাই তার প্রচেষ্টার জন্য আমি তার প্রশংসা করলাম। তখন সে তার পুস্তিকাগুলো সম্বন্ধে, সেগুলো কত ব্যাপকভাবে বিতরণ করা হয়েছে সে সম্বন্ধে এবং সেগুলো কত বেশি প্রশংসা কুড়িয়েছে সে সম্বন্ধে সীমাহীনভাবে কথা বলতে শুরু করল। নিজের সম্বন্ধে এ লোকের ধারণা দেখে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম, কিন্তু তার নিকট থেকে আমি এটাও জানলাম যে, মানুষ অবজ্ঞা ও হেয়প্রতিপন্ন হতে কতটা ঘৃণা করে।
আরেকবার আমি এক ছাত্রের বক্তৃতার টেপ রেকর্ড শুনলাম। ইসলামের জ্ঞান অন্বেষণে তার প্রচেষ্টাকে অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে তাকে উৎসাহিত করার জন্য আমি তাকে আমার বাড়িতে আমন্ত্রণ করলাম। আমি যখন টেপ রেকর্ডের কথা উল্লেখ করলাম তখন সে আরো সুযোগ পেয়ে গেল, সমগ্র মুসলিম জাতির কল্যাণের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করার মাধ্যমে সে তার বক্তৃতা শুরু করল। এরপর সে অনবরত ব্যাখ্যা করতে লাগল কীভাবে সে বিষয়টির উপর গবেষণা করেছে। তাকে আহবান করার আগে আমি কখনও তাকে এতটা স্বার্থপর ভাবতে পারিনি। তার সাথে কথা বলে আমি এটাও বুঝতে পেরেছি যে, নিজের যোগ্যতার চেয়ে নিজেকে অনেক বেশি মূল্যায়ন করা মানুষের স্বভাব। অতএব, অন্যকে অবজ্ঞা করা থেকে সতর্ক থাকুন।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّن قَوْمٍ عَسَىٰ أَن يَكُونُوا خَيْرًا مِّنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِّن نِّسَاءٍ عَسَىٰ أَن يَكُنَّ خَيْرًا مِّنْهُنَّ
“কোন পুরুষ (জাতি) যেন অন্য কোন পুরুষকে অবজ্ঞা বা ঘৃণা না করে এবং কোন স্ত্রী (জাতি)ও যেন অন্য কোন স্ত্রীকে ঘৃণা বা অবজ্ঞা না করে। কেননা, এমনও হতে পারে যে, যাদেরকে ঘৃণা বা অবজ্ঞা করা হয় তারা যারা ঘৃণা বা অবজ্ঞা করে তাদের চেয়েও ভালো।” (৪৯-সূরা আল হুজরাতঃ আয়াত-১১)
যদি আপনি মানুষের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন এবং তাদের প্রতি মনোযোগ দেন তবে তারা আপনাকে ভালোবাসবে।
“যারা তাদের প্রতিপালককে সকাল-সন্ধ্যায় ডাকে আপনি তাদেরকে তাড়িয়ে দিবেন না।” (৬-সূরা আল আন’আমঃ আয়াত-৫২)
وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُم بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ
যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে ডাকে তাদের সাথে আপনি ধৈর্য ধরে থাকুন।” (১৮-সূরা আল কাহাফঃ আয়াত-২৮)
(অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ!) আপনার যে সব সাহাবীগণ সালাতে ও অন্যান্য ধর্মীয় কাজে সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে ও তার প্রশংসা করে আপনি ধৈর্য সহকারে তাদের সাথে থাকুন।
“তিনি ভ্রুকুটি করলেন ও উপেক্ষা করলেন, কারণ, তার নিকট একজন অন্ধ লোক এসেছিল। আপনি কীভাবে জানবেন সে হয়তো (পাপ হতে) পবিত্র হতো।” (৮০-সূরা আল আবাসাঃ আয়াত-১-৩)
[নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন এক লোকের নিকট ইসলাম প্রচার করছিলেন তখন উম্মে মাকতুম নামে একজন অন্ধ লোক (পরে তিনি ঈমান এনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবী হয়েছিলেন) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসেছিল আর তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রতি মনোযোগ দেননি। এ কারণে এ আয়াত কয়টি নাযিল করা হয়।]
আমার আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ার বছরগুলোতে আমি শুধুমাত্র কবিতা পড়াশুনাই করতাম না অধিকন্তু কবিতা রচনাও করতাম। একবার অন্য মাদ্রাসার ছাত্ররা আমাদেরকে দেখতে আসল। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমাকে আমার স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতে বলা হলো- (আর এটা বলা হলো) আমার দাবি করার মতো কোন দক্ষতার কারণে নয় বরং এ কারণে যে, আমাদের মাদ্রাসায় একমাত্র আমারই কবিতার প্রতি ঝোঁক ছিল।
আমি আমার স্বরচিত কিছু কবিতা উচ্চস্বরে আবৃতি করলাম আর সাহিত্যের শিক্ষক আমার ধরন ও শব্দের ব্যবহার উভয়েরই প্রশংসা করলেন আর আমি তাকে (আমার সত্যি সত্যি প্রশংসা করেছেন বলে) আসলেই বিশ্বাস করলাম। আমি মনে করেছিলাম যে, আমি প্রতিভামণ্ডিত কোন কিছু লিখেছি; কিন্তু, আমি যখন বয়স্ক হওয়ার পর সেগুলোর দিকে চোখ বুলালাম তখন আমি বুঝতে পারলাম যে, সেগুলো সত্যি সত্যি কতইনা ছাত্রসূলভ (কাঁচা হাতের) ছিল।
অন্যদেরকে অবজ্ঞা করে আমরা একমাত্র যা অর্জন করি তা হলো একজন অতিরিক্ত শক্র। তাই, অন্যের চেষ্টা অনুধাবন করতে মধ্যমপন্থী হোন এবং তাদের গুণের কারণে তাদের প্রশংসা করুন।