একজন পশ্চিমা চিন্তাশীল ব্যক্তি বলেছেন, “জেলখানায় থেকেও আকাশের পানে তাকানো ও গোলাপের গন্ধ শোকা আপনার পক্ষে খুবই সম্ভব। সমৃদ্ধি ও আরাম-আয়েশে ভরপুর প্রাসাদে থেকেও পরিবার ও সম্পদের বিষয়ে ক্রুদ্ধ ও অসন্তুষ্ট থাকাও চরমভাবে সম্ভব।
অতএব, সময় ও স্থানভেদে নয়, বরং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও তার আনুগত্যের মাধ্যমেই সুখ নির্ধারিত। আর আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে বদ্ধমূল থাকে। এ বিষয়ে অন্তরের সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব রয়েছে। আল্লাহ অন্তরের দিকেই তাকান (অর্থাৎ তিনি অন্তর দেখেন) ও (অন্তরেরই) পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করেন। অন্তরে বিশ্বাস থাকলে দেহ-মনে সুখ-শান্তি বিরাজ করবে।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) একজন সম্মানিত আলেম ও মেধাবী হাদীস সংকলক ছিলেন। তিনি উৎপাদনশীল জীবন যাপন করতেন, তবুও ধনী ছিলেন না। তার পোশাকে বিভিন্ন স্থানে তালি ছিল এবং যখন এটা নতুন করে ছিড়ত তখনই তিনি হাতে এটাকে সেলাই করে নিতেন। তিনি মাটির তৈরি তিন-ঘরবিশিষ্ট একটি বাড়িতে থাকতেন। তিনি প্রায়ই শুধুমাত্র এক টুকরো রুটি খেতে পেতেন (আরবী পুস্তকে আছে রুটির সাথে একটু তেলও খেতেন। -অনুবাদক) তার জীবনী লেখকগণ উল্লেখ করেছেন যে, তিনি সতের বছর ধরে একই জুতা পরতেন আর তাতে ফাটল দেখা গেলে তিনি নিজ হাতে তাতে প্রায়ই তালি লাগিয়ে নিতেন বা তা সেলাই করে নিতেন। মাসে মাত্র একবার তার পাতে মাংস আসত এবং অধিকাংশ দিনই তিনি রোযা রাখতেন। হাদীসের সন্ধানে তিনি বহু স্থান ভ্রমণ করেছেন। তাকে এতসব কষ্ট পোহাতে হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন তৃপ্ত, তুষ্ট, স্বচ্ছন্দ, সৌম্য, শান্ত ও নিরুদ্বিগ্ন। তার বীরত্বসূচক ধৈর্য, তার চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্বন্ধে তার জ্ঞান, আল্লাহর কাছ থেকে তার পুরষ্কার চাওয়া এবং আখেরাত ও জান্নাতের জন্য তার চেষ্টার কারণেই এসব গুণ সৃষ্টি হয়েছিল।
পক্ষান্তরে তার সময়ের শাসকগণ যেমন- আল-মামুন, আল ওয়াসিক, আল মু'তাসিম ও আল মুতাওয়াক্কিল এরা সবাই প্রাসাদে বাস করত। তারা সোনা-রূপার ভাণ্ডারের মালিক ছিল; একটা গোটা সেনাবাহিনী তাদের অধীনে ছিল; তারা যা চাইত তা সবই পেত। তাদের সকল পার্থিব সম্পদ সত্বেও তারা অশান্তিতে জীবন-যাপন করত। তারা তাদের জীবনকে উদ্বিগ্নতায় ও দুশ্চিন্তায় কাটিয়েছে। যুদ্ধ-বিগ্রহ ও বিদ্রোহ তাদের জীবনে দুর্দশা বয়ে এনেছিল। ইতিহাসের বর্ণনায় আমরা এও পাই যে, তাদের অনেকেই মৃত্যুশয্যায় তাদের অসংযম ও ক্রটি-বিচ্যুতি বুঝতে পেরে পৃথিবীকে তিক্তভাবে (অশান্তির স্থান বলে) ঘোষণা দিত।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ হলেন আরেক উদাহরণ; তিনি এ পৃথিবীতে পরিবারহীন, গৃহহীন, সম্পদহীন ও পদমর্যাদাহীন জীবন কাটিয়েছেন। তার যা ছিল তা হলো কেন্দ্রিয় মসজিদ সংলগ্ন একটি কক্ষ, সারা দিন কাটানোর জন্য এক টুকরো রুটি ও দু’টি জামা, মাঝে মাঝে তিনি মসজিদে ঘুমাতেন। কিন্তু, যেমনটি তিনি নিজেই নিজের অবস্থা সম্বন্ধে বলেছেন, তার অন্তরে তাঁর জান্নাত ছিল, তাঁর হত্যাদেশ ছিল তাঁর জন্য শাহাদাত, কারাবন্দী ছিল শান্তিপূর্ণ নির্জন বাস এবং স্বদেশ থেকে নির্বাসিত হওয়া ছিল পর্যটক হিসেবে বিদেশ ভ্রমণ। তার অন্তরে কেবলমাত্র ঈমানের বৃক্ষের দৃঢ় শিকড় থাকার কারনেই তাঁর মাঝে এ ধরণের মানসিকতা জন্মাতে পেরেছিল। “এর তেল যেন আলো ছড়ায়, যদিও একে আগুন স্পর্শ করেনি। আলোর উপর আলো আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তার নূরের (আলোর) দিকে পথ প্রদর্শন করেন।”
كَفَّرَ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَأَصْلَحَ بَالَهُمْ
“তিনি তাদের থেকে তাদের পাপসমূহ মোচন করে দিবেন এবং তিনি তাদের অবস্থা ভালো করে দিবেন।” (৪৭-সূরা মুহাম্মদ আয়াত-২)
“আর যারা সৎপথ (হেদায়াত) গ্রহণ করে আল্লাহ তাদের সৎপথে থাকার ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন এবং তাদেরকে তাদের তাকওয়া (খোদাভীতি) দান করেন।” (৪৭-সূরা মুহাম্মদঃ আয়াত-১৭)
“তুমি তাদের চেহারায় সুখের আভা দেখতে পাবে।” (৮৩-সূরা আল মুতাফফিফীনঃ আয়াত-২৪)
সাহাবী আবু যর গিফারী (রাঃ) তার সংযমী জীবনযাপন প্রণালীর জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদেরকে সাথে নিয়ে তিনি শহর ছেড়ে এক বিচ্ছিন্ন এলাকায় গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। (সেখানে) তাবু গাড়ার পর তার অধিকাংশ দিন প্রধানত ইবাদত, কুরআন তেলাওয়াত ও গবেষণায় কেটেছে। অধিকাংশ দিন তিনি রোযা রাখতেন। তার পার্থিব সম্পদ বলতে ছিল একটি তাবু, কিছু ভেড়া ও অন্যান্য কিছু তুচ্ছ জিনিসপত্র। একবার তার কয়েকজন বন্ধু তাকে দেখতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “দুনিয়া কোথায় (অর্থাৎ দুনিয়ার আসবাবপত্র যা অন্যান্য মানুষের আছে তা কোথায়)?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “এ পৃথিবীর যা কিছু আমার দরকার সব আমার ঘরে আছে এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আমাদের সামনে (বিচারের দিনে) এক অলঙ্ঘনীয় বাধা আছে এবং কেউ সে বাধা অতিক্রম করতে পারবে না, তবে শুধুমাত্র সে পারবে যার বোঝা হালকা।”
নিদারুণ দরিদ্র জীবনযাপন সত্ত্বেও (তিনি মনে করতেন যে) এ পৃথিবীর যা কিছু তার দরকার ছিল, তার সবকিছুই তার ছিল। প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ সম্বন্ধে তিনি মনে করতেন যে, এগুলো তাকে তার প্রধান উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করে দিবে এবং শুধুমাত্র তার দুশ্চিন্তার কারণ হবে।