“আর তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে হত্যা করিও না।” (৪-সূরা আন নিসাঃ আয়াত-২৯)
“এবং নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করিও না।” (২-সূরা বাকারাঃ আয়াত-১৯৫)
এ তথ্য ফাঁস হয়ে গিয়েছিল যে ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান সাংঘাতিক হতাশার শিকার হয়েছিলেন। তার এ অবস্থার কারণ ছিল তার সত্তোরোর্ধ বয়স হওয়া সত্ত্বেও বিশাল বিশাল মানসিক চাপযুক্ত কার্য সম্পাদন করা এবং বারবার শল্য চিকিৎসার অধিনস্থ হওয়া।
“তোমরা যেখানেই থাক না কেন, এমনকি সুরক্ষিত (দৃঢ় ও সুউচ্চ) দুর্গেও যদি তোমরা থাক তবুও মৃত্যু তোমাদেরকে পেয়ে বসবেই।” (৪-সূরা আন নিসা: আয়াত-৭৮)
অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ বিশেষ করে কলা বিভাগের লোকজন হতাশায় ভুগেন। কবি সালেহ জাহীনের মৃত্যুর একমাত্র কারণ না হলেও প্রধান কারণ ছিল হতাশা। একথাও বলা হয়েছে যে, নেপোলিয়ান বোনাপার্ট নির্বাসনে থাকাকালে হতাশ অবস্থায় মারা যান।
“তারা কাফের থাকা অবস্থায় তাদের আত্মা তাদের দেহ ত্যাগ করবে।” (৯-সূরা তাওবা: আয়াত-৫৫)
অল্পকিছু দিন আগে এক জার্মান মহিলা তার তিন তিনটি সন্তানকে হত্যা করে ফেলেছে। পরে এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে, সে এ জঘন্য কাজ করেছিল হতাশার কারণে। সে তার সন্তানদেরকে খুবই ভালোবাসত এবং সে এই ভয় করত যে, সে জীবনে যে ব্যাথা-বেদনা-দুঃখ-কষ্ট ও সংকটের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে তার সন্তানদেরও সেরূপ ব্যথা-বেদনা-দুঃখ-কষ্ট ও সংকট ভোগ করতে হবে। এ কারণে সে তাদেরকে শান্তি দিতে ও “তাদের প্রত্যেককে” জীবনের জটিলতা ও উত্থান-পতনের হাত হতে “রক্ষা করতে” সিদ্ধান্ত নেয়। তাদেরকে হত্যা করে সে নিজেও আত্মহত্যা করে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হতাশা রোগগ্রস্তদের) যে সংখ্যা প্রচার করেছে তাতে অবস্থার ভয়াবহতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এ সংস্থা ১৯৭৩ সালে প্রচার করে যে পৃথিবী মোট জনসংখ্যার শতকরা তিনভাগ লোক হতাশাগ্রস্ত। সংখ্যাটি নাটকীয়ভাবে বেড়ে গিয়ে ১৯৭৮ সালে তা শতকরা পাঁচ ভাগে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছু লোকের, যা আশ্চর্যজনক মনে হতে পারে তা হলো যে, কিছু কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতি চারজন আমেরিকানের মধ্য থেকে একজন (অর্থাৎ ২৫% আমেরিকান) হতাশায় ভুগছে। ১৯৮১ সালে আমেরিকায় শিকাগোতে অনুষ্ঠিত মানসিক রোগ সম্মেলনে সম্মেলনের সভাপতি ঘোষণা দেন যে, পৃথিবীতে ১০ (দশ) কোটি লোক হতাশায় ভুগছে। কিছু কিছু লোকের নিকট যা আশ্চর্যজনক মনে হতে পারে তা হলো এই যে, অধিকাংশ হতাশার রোগী উন্নত তথা ধনী দেশের। অন্য গবেষণায় দেখা গেছে যে, বিশ কোটি লোক হতাশায় ভুগছে।
“তারা কি দেখে না যে, তাদেরকে (বিভিন্ন ধরনের বালা-মুসিবত, দুর্বিপাক, রোগ-শোক ও দুর্ভিক্ষ দ্বারা) প্রতি বছর একবার বা দু’বার পরীক্ষা করা হচ্ছে।” (৯-সূরা তাওবা: আয়াত-১২৬)
বলা হয় যে, “যে ব্যক্তি তার লভ্যাংশকে বাড়াতে সক্ষম সে বুদ্ধিমান নয় বরং যে ব্যক্তি তাঁর লোকসানকে লাভে পরিণত করে সে বুদ্ধিমান।”
যা শেষ হয়ে গেছে তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত নয়। কেননা, এমন কাজ শুধু উদ্বিগ্নতা, দুশ্চিন্তা ও সময়ের অপচয়ই ঘটাবে। করার মতো কোন কাজ না থাকলে বিভিন্ন উপকারী কাজ করে সময়কে কাজে লাগানো যায়। আমলে সালেহ বা সৎকাজ করা, অন্যদেরকে সাহায্য করা, রোগী দেখতে যাওয়া, কবর যেয়ারত করতে যাওয়া (শেষ ঠিকানার কথা মনে করা ও তা নিয়ে ধ্যান করার জন্য)। মসজিদের কাজে সাহায্য সহযোগিতা করা, দান কার্যে অংশগ্রহণ করা, শারীরিক ব্যায়াম, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা করতে যাওয়া, কাজ কর্মকে সাজানো-গুছানো এবং বৃদ্ধ, গরীব ও দুর্বলদেরকে সাহায্য করা হলো এ ধরনের কিছু ভালো কাজ।
“নিশ্চয় তুমি (তোমার ভালো-মন্দ কাজসহ) তোমার প্রভুর নিকট ফিরে যাচ্ছ-এ এক নিশ্চিত প্রত্যাবর্তন।” (৮৪-সূরা আল ইনশিকাকঃ আয়াত-৬)
একজন আরব কবি বলেছেন- “মহৎ কাজ তার মিষ্ট স্বাদে ও সুন্দর চেহারায় অনন্য।”
কোনও একটি ইতিহাসের বই খুলে দেখুন, এর পাতায় পাতায় ব্যাথা বেদনা, অভাব-অনটন ও দুঃখ-দুর্দশার কথা দেখতে পাবেন। একজন আরব কবি বলেছেন- “ইতিহাস পড়, কেননা এতে শিক্ষণীয় ঘটনা আছে। সে জাতি ধ্বংস হয়ে যায় যে জাতি নিজেদের খবর রাখে না।”
“নবীদের যে সব ঘটনা আমি তোমার নিকট বর্ণনা করি তা দিয়ে আমি তোমার অন্তরকে দৃঢ় করি।” (১১-সূরা হুদঃ আয়াত-১২০)
“নিশ্চয় তাদের ঘটনাবলিতে বুদ্ধিমান লোকদের জন্য শিক্ষা রয়েছে।” (১২-সূরা ইউসুফ: আয়াত-১১১)
“অতএব, ঘটনা বর্ণনা কর যাতে করে তার চিন্তা-ভাবনা করে।” (৭-সূরা আল আরাফ: আয়াত-১৭৬)
উমর (রাঃ) বলেছেন, “বর্তমানে আমার উদ্দেশ্য শুধু আমার তকদীরকে উপভোগ করা।” এটা এমন এক বর্ণনা যা থেকে আল্লাহর তকদীরের প্রতি তার সন্তুষ্টির প্রমাণ পাওয়া যায়।
এক প্লেগে এক বছরের মধ্যে আবু যুয়াইব হাযালির আটজন ছেলে মারা গেছে। তিনি কী বলেছেন বলে আপনি মনে করেন? তিনি আল্লাহর হুকুমের প্রতি ঈমান রেখেছেন, আত্মসমর্পণ করেছেন ও অনুগত থেকেছেন এবং বলেছেন “যারা আমার দুঃখে আনন্দ করেছে তাদেরকে আমি ধৈর্য প্রদর্শন করবই, যুগের উত্থান-পতনে আমি বিচলিত হব না। মৃত্যু যখন তার থাবা মারে, তখন কোন তাবিজই একে ফিরিয়ে দিতে পারে না।”
مَا أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ
“আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোন মুসিবতই আসে না।” (৬৪-সূরা আত তাগাবুনঃ আয়াত-১১)
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন এবং নিজে নিজে (কবিতা আকারে) এ সান্ত্বনার বাণী বলতেন-
“যদিও আল্লাহ আমার চোখের জ্যোতি ছিনিয়ে নেন,
তবুও আমার অন্তর আলোকিত আছে;
আমার হৃদয় বুঝতে পারে ও মন বিপথগামী নয়,
আর আমার জিহ্বা উন্মুক্ত তরবারীর ফলার মতো ধারালো।”
মাত্র একটি নেয়ামত হারানোর পর আল্লাহর যে অসংখ্য নেয়ামত তার নিকট ছিল তা স্মরণ করে তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিতেন।
উরওয়াহ ইবনে যুবাইর (রাঃ) তার একটি পা হারান এবং একই দিনে তাকে সংবাদ দেয়া হয় যে, তার পুত্রও মারা গেছে। এত সবের পর তিনি বললেন- “হে আল্লাহ! সকল প্রশংসা তোমার। আপনি যদি নিয়ে থাকেন তবে তো আপনিই দিয়েছিলেন। আপনি যদি আমাকে কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা করে থাকেন তবে তো আপনি রক্ষাও করেছেন এবং যত্নও করেছেন। আপনি আমাকে চার চারটি অঙ্গদান করেছেন এবং মাত্র একটি নিয়ে গেছেন। আপনি তো আমাকে চার চারটি ছেলে দান করেছেন আর মাত্র একটি নিয়ে গেছেন।”
“তারা যে ধৈর্য ধরেছে এজন্য তাদের পুরস্কার হলো জান্নাত ও রেশমী পোশাক।” (৭৬-সূরা আদ দাহর বা ইনসানঃ আয়াত-১২)
“তোমরা ধৈর্য ধরেছ এজন্য তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।” (১৩-সূরা রাআদঃ আয়াত-২৪)
ইমাম শাফিয়ী (রহঃ) নিম্নোক্ত সান্ত্বনার বাণী বলতেন-
دَعِ الأَيَّامَ تَفْعَل مَا تَشَاءُ ٭ وطب نفساً إذا حكمَ القضاءُ
إِذَا نَزَلَ القَضَاء بارض قوم ٭ فَلاَ أَرْضٌ تَقِيهِ وَلاَ سَماءُ
অর্থাৎ “দিনসমূহকে যাচ্ছে তাই করতে দাও, আর যখন কোন হুকুম বর্তায় তখন সন্তুষ্ট থাক; যখন কোন জাতির দেশে কোন হুকুম অবতরণ করে, তখন জমিনও সে জাতিকে বাঁচাতে পারে না আর আসমানও পারে না।”
কতবারই না আমরা মৃত্যুকে ভয় পেয়েছি কিন্তু কিছুই হয়নি? কতবারই না আমরা শেষ মুহুর্তকে অতি নিকটে মনে করেছি তবুও আমরা আগের চেয়ে আরো জোরালো হয়ে গেছি? কতবারই না আমরা নিজেদেরকে সংকটাবস্থায় পেয়েছি তবু কিছু সময় পর আমরা আরাম ও উপশমের মিষ্টস্বাদ উপভোগ করতে পেরেছি।
“(হে মুহাম্মদ!) আপনি বলে দিন। আল্লাহ তোমাদেরকে এই বিপদ থেকে এবং প্রতিটি বিপদ থেকে রক্ষা করেন।” (৬-সূরা আল আন’আম : আয়াত-৬৪)
কেবলমাত্র স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার হওয়ার জন্যই আমরা কতবারই না অসুস্থ হই।
“আর আল্লাহ যদি তোমার কোন ক্ষতি সাধন করেন তবে তিনি ছাড়া অন্য কেউ তা দূর করতে পারবে না।” (৬-সূরা আল আন’আমঃ আয়াত-১৭)
যখন কেউ নিশ্চিতভাবে একথা জানে যে, আল্লাহ সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তখন সে কিভাবে আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করতে পারে? এবং যখন কেউ আল্লাহকে ভয় করে তখন কিভাবে আল্লাহর সাথে অন্যদেরকে ভয় করতে পারে? বিশেষ করে আল্লাহর এই বাণী বিবেচনা করে-
“অতএব তাদেরকেও ভয় করিও না বরং আমাকে ভয় কর।” (৩-সূরা আলে ইমরানঃ আয়াত-১৭৫)
وَإِنَّ جُندَنَا لَهُمُ الْغَالِبُونَ
“আর নিশ্চয় (তারা) আমার বাহিনী; নিশ্চয় তারাই বিজয়ী হবে।” বা “আর নিশ্চয় আমার বাহিনীরাই বিজয়ী হবে।” (৩৭-সূরা আস সাফফাতঃ আয়াত-১৭৩)
“নিশ্চয় আমি আমার রাসূলদেরকে সাহায্য করব (ফলে তারা বিজয়ী হবে) এবং তাদেরকেও সাহায্য করব (ফলে তারাও বিজয়ী হবে) যারা এ দুনিয়ার জীবনে ঈমান রাখে এবং সেদিনের প্রতিও ঈমান রাখে যেদিন সাক্ষীগণ (সাক্ষী দেয়ার জন্য) দাঁড়াবে।” (৪০-সূরা আল মু'মিন: আয়াত-৫১)
আল্লামা ইবনে কাসীর তার তফসীরে একটি হাদীসে কুদসী উল্লেখ করেছেন। তাতে আছে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
“আমি আমার ইজ্জতের কসম ও আমার মাহাত্ম্যের কসম করে বলছি, আমার বান্দা যখন আমার উপর নির্ভর করে তখন আমি আসমান ও জমিনের মাঝে তার জন্য স্বচ্ছলতা ও মুক্তির পথ করে দেই। আমি আমার ইজ্জতের ও আমার মাহাত্ম্যের কসম করে বলছি, আমার বান্দা যখন আমাকে বাদ দিয়ে অন্যের উপর নির্ভর করে তখন তার দু'পায়ের নিচের জমিনকে আমি তার উপর ক্রুদ্ধ করে দেই।”
ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ বলেছেন-
لا حَوْلَ وَلا قُوَّةَ إِلا بِاللَّهِ
অর্থাৎ “আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সৎকাজ করার কোন শক্তি নেই ও পাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকার কোন ক্ষমতা নেই।”
এই কালিমা দ্বারা অতি ভারী জিনিস বহন করা যায়, সকল বাধা দূর করা যায় এবং সম্মান অর্জন করা যায়। সুতরাং এই কালেমা সর্বদা স্মরণ করুন, কেননা, এটা বেহেশতের সম্পদসমূহের একটি এবং সুখ ও পরিতুষ্টির একটি খুঁটি।