হজের মূল কাজ শুরু হয় ৮ যিলহজ থেকে। যিনি হজের নিয়তে এসেছেন তিনি তামাত্তুকারী হলে পূর্বেই উমরা সম্পন্ন করেছেন। এখন তাকে শুধু হজের কাজগুলো সম্পাদন করতে হবে। তিনি পরবর্তী কাজগুলো নিচের ধারাবাহিকতায় সম্পন্ন করবেন।
১. তারবিয়া[1]র দিন অর্থাৎ ৮ যিলহজ তামাত্তু হজকারী এবং মক্কাবাসিদের মধ্য থেকে যারা হজ করতে ইচ্ছুক তারা হজের জন্য ইহরাম বেঁধে মিনায় গমন করবেন। পক্ষান্তরে যারা মীকাতের বাইরে থেকে ইফরাদ বা কিরান হজের জন্য ইহরাম বেঁধে এসেছেন তারা ইহরামে বহাল থাকা অবস্থায় মিনায় গমন করবেন।
২. নতুন করে ইহরাম বাঁধার আগে ইহরামের সুন্নত আমলসমূহ যেমন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া, গোসল করা, সুগন্ধি ব্যবহার করার চেষ্টা করবেন। যেমনটি পূর্বে মীকাত থেকে উমরার ইহরাম বাঁধার সময় করেছেন।
৩. অতঃপর নিজ নিজ অবস্থানস্থল থেকেই ইহরামের কাপড় পরিধান করবেন।
৪. তারপর যদি কোনো ফরয সালাতের পর ইহরাম বাঁধা যায় তবে তা ভালো। আর যদি তখন কোনো সালাত না থাকে, তবে ওযু করা সম্ভব হলে ওযুর পর দু’রাক‘আত তাহিয়্যাতুল ওযুর নামায পড়ে ইহরাম বাঁধা ভালো। আর যদি তাও সম্ভব না হয় তাতে কোনো অসুবিধা নেই, শুধু নিয়ত করে নিলেই চলবে।
৫. তারপর মনে মনে হজের নিয়ত করে لَبَّيْكَ حَجًّا (লাব্বাইকা হাজ্জান্) বলে হজের কাজ শুরু করবেন।
৬. যদি হজ পূর্ণ করার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতার আশংকা করেন, তাহলে তালবিয়ার পরপরই বলবেন,
اللَّهُمَّ مَحِلِّي حَيْثُ حَبَسْتَنِي
(আল্লাহুম্মা মাহাল্লী হাইছু হাবাসতানী)
‘হে আল্লাহ, আপনি আমাকে যেখানে আটকে দেবেন, সেখানেই আমি হালাল হয়ে যাব।’[2]
৭. যদি বদলী হজ হয় তাহলে মনে মনে তার নিয়ত করে বদলী হজকারীর পক্ষ থেকে বলবেন,
عَنْ .. لَبَّيْكَ حَجًّا (লাব্বাইকা হাজ্জান্ আন....) (উমুক পুরুষ/মহিলার পক্ষ থেকে লাব্বাইক পাঠ করছি।) [3]
৮. মিনায় গিয়ে যোহর-আসর, মাগরিব-এশা ও পরদিন ফজরের সালাত আদায় করবেন। এ কয়টি সালাত মিনায় আদায় করা সুন্নত। প্রতিটি সালাতই তার নির্ধারিত ওয়াক্তে আদায় করবেন। চার রাকাআত বিশিষ্ট সালাতকে দু’রাকাআত করে পড়বেন। এখানে সালাত জমা করবেন না অর্থাৎ দুই ওয়াক্তের সালাত একসাথে আদায় করবেন না। কারণ রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিনায় একসাথে দু’ওয়াক্তের সালাত আদায় করেননি।
৯. মুস্তাহাব হলো, এ দিন বিশ্রাম নিয়ে হজের প্রস্তুতি গ্রহণ করা, যিক্র ও ইস্তেগফার করা এবং বেশি করে তালবিয়া পড়া। সময়-সুযোগ পেলে হজের মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কে পড়াশোনা করবেন। বিজ্ঞ আলেমগণের ওয়াজ-নসীহত ও হজ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুনবেন।
১০. ৯ যিলহজ রাতে মিনায় রাত্রি যাপন করা সুন্নত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই রাত মিনায় যাপন করেছেন। কোনো কারণে রাত্রি যাপন করা সম্ভব না হলে কোনো সমস্যা নেই। আল্লাহ তা‘আলা নিয়ত অনুযায়ী সওয়াব দেবেন ইনশাআল্লাহ।
[2]. বুখারী : ৫০৮৯; মুসলিম : ১২০৭।
[3]. আবূ দাউদ : ১৮১১; ইবন মাজাহ্ : ২৯০৩।
১. নফল তাওয়াফের মাধ্যমে হজের অগ্রিম সাঈ করে নেয়া
৮ যিলহজ হজের ইহরামের পর তাওয়াফ-সাঈ করা। অনেক তামাত্তু হজকারী হজের এই ইহরামের পর নফল তাওয়াফ করে সাঈ করে নেন। এরূপ করার কথা হাদীসে নেই। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যেও কেউ এরূপ করেছেন বলে কোনো প্রমাণ নেই। যেহেতু হাদীসে এবং সাহাবায়ে কিরাম ও সালফে সালেহীনের যুগে এরূপ করার কোনো প্রমাণ নেই, তাই এ বিষয়টি অবশ্যই বর্জন করতে হবে। নতুবা সুন্নতের জায়গায় বিদ‘আত কায়েম হবে। তাই ইহরাম বেঁধে বা ইহরাম বাদে কোনভাবেই সেদিন তাওয়াফ-সাঈ করতে যাবেন না। যেসব সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তামাত্তু করেছিলেন, তারা ৮ যিলহজ ইহরাম বাঁধার পূর্বে বা পরে কোনো প্রকার সাঈ করা তো দূরের কথা তাওয়াফও করেন নি। আয়েশা রা. বলেন, ‘বিদায় হজের বছর আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বের হলাম... যারা উমরার জন্য ইহরাম বেঁধেছিলেন, তারা তাওয়াফ ও সাঈ করে হালাল হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর মিনা থেকে ফেরার পর তারা হজের জন্য তাওয়াফ করেন।’[1] যদি ৮ তারিখের দিনে তাওয়াফ বা সাঈ করার সুযোগ থাকত, তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা অবশ্যই সাহাবীগণকে জানাতেন। আর সাহাবীগণও এটা ত্যাগ করতেন না। হানাফী ফিকহের প্রসিদ্ধ কিতাব বাদায়িউস্সানায়ে’তে লিখা হয়েছে :
وَإِذَا أَحْرَمَ الْمُتَمَتِّعُ بِالْحَجِّ فَلَا يَطُوفُ بِالْبَيْتِ ، وَلَا يَسْعَى فِي قَوْلِ أَبِي حَنِيفَةَ ، وَمُحَمَّدٍ ؛ لِأَنَّ طَوَافَ الْقُدُومِ لِلْحَجِّ لِمَنْ قَدِمَ مَكَّةَ بِإِحْرَامِ الْحَجِّ ، وَالْمُتَمَتِّعُ إنَّمَا قَدِمَ مَكَّةَ بِإِحْرَامِ الْعُمْرَةِ لَا بِإِحْرَامِ الْحَجِّ ، وَإِنَّمَا يُحْرِمُ لِلْحَجِّ مِنْ مَكَّةَ ، وَطَوَافُ الْقُدُومِ لَا يَكُونُ بِدُونِ الْقُدُومِ ، وَكَذَلِكَ لَا يَطُوفُ ، وَلَا يَسْعَى أَيْضًا ؛ لِأَنَّ السَّعْيَ بِدُونِ الطَّوَافِ غَيْرُ مَشْرُوعٍ ، وَلِأَنَّ الْمَحَلَّ الْأَصْلِيَّ لِلسَّعْيِ مَا بَعْدَ طَوَافِ الزِّيَارَةِ ؛ لِأَنَّ السَّعْيَ وَاجِبٌ ، وَطَوَافُ الزِّيَارَةِ فَرْضٌ ، وَالْوَاجِبُ يَصْلُحُ تَبَعًا لِلْفَرْضِ ، فَأَمَّا طَوَافُ الْقُدُومِ فَسُنَّةٌ . وَالْوَاجِبُ لَا يَتْبَعُ السُّنَّةَ إلَّا أَنَّهُ رَخَّصَ تَقْدِيمَهُ عَلَى مَحَلِّهِ الْأَصْلِيّ عَقِيبَ طَوَافِ الْقُدُومِ فَصَارَ وَاجِبًا عَقِيبَهُ بِطَرِيقِ الرُّخْصَةِ ، وَإِذَا لَمْ يُوجَدْ طَوَافُ الْقُدُومِ يُؤَخَّرُ السَّعْيُ إلَى مَحَلِّهِ الْأَصْلِيِّ فَلَا يَجُوزُ قَبْلَ طَوَافِ الزِّيَارَةِ.
‘তামাত্তু হজকারী যখন হজের ইহরাম বাঁধে তখন সে বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করবে না। সাঈও করবে না। এটা হল ইমাম আবু হানীফা রহ. ও ইমাম মুহাম্মদ রহ.-এর অভিমত। কারণ তাওয়াফে কুদূম ওই ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত যে হজের ইহরাম নিয়ে মক্কায় আগমন করল। পক্ষান্তরে তামাত্তু হজকারী উমরার ইহরাম নিয়ে মক্কায় আগমন করেছে। হজের ইহরাম নিয়ে আগমন করেনি। তামাত্তু হজকারী ব্যক্তি মক্কা থেকেই হজের ইহরাম বাঁধে। আর তাওয়াফে কুদূম বাইর থেকে আগমন ব্যতীত হয় না। তাওয়াফ-সাঈ এ জন্যেও করবে না যে, তাওয়াফ ব্যতীত সাঈ করা শরীয়তসম্মত নয়। কেননা সাঈর মূল জায়গা তাওয়াফে যিয়ারতের পর। কেননা সাঈ হল ওয়াজিব। আর তাওয়াফে যিয়ারত হল ফরয। ওয়াজিব, ফরযের তাবে’ বা অনুবর্তী হতে পারে। পক্ষান্তরে তাওয়াফে কুদূম হচ্ছে সুন্নত। আর ওয়াজিব সুন্নতের তাবে’ বা অনুবর্তী হতে পারে না। তবে তাওয়াফে কুদূমের ক্ষেত্রে সাঈকে তার মূল জায়গা হতে এগিয়ে নিয়ে আসার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই অনুমতির কারণে তাওয়াফে কুদূমের পর ‘ওয়াজিব’ আদায়যোগ্য হয়েছে। তাই তাওয়াফে কুদূমের অনুপস্থিতিতে সাঈকে তার মূল জায়গায় পিছিয়ে নিতে হবে। সুতরাং তাওয়াফে যিয়ারতের পূর্বে সা‘ঈ আদায় করা জায়েয হবে না।[2]
উক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, আমাদের বাংলাদেশী হাজীগণ মিনায় যাওয়ার সময় ইহরাম বেঁধে, নফল তাওয়াফ করে, যেভাবে হজের সাঈ অগ্রিম সেরে নেন, তা আদৌ শরীয়তসম্মত নয়। কেননা এর পেছনে কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবীগণের আমল থেকে কোনো দলীল- প্রমাণ নেই। সুতরাং এ শরীয়তবিরোধী বিদ‘আত কাজটি পরিত্যাগ করুন।
২. মসজিদে হারামে গিয়ে ইহরাম বাঁধা
মসজিদে হারামে গিয়ে ইহরাম বাঁধা।[3] বিদায় হজে সাহাবায়ে কিরাম নিজ নিজ অবস্থানস্থল থেকে ইহরাম বেঁধেছিলেন। যদি মসজিদে হারামের ভেতরে বা বাইরের কোনো নির্দিষ্ট জায়গা থেকে ইহরাম বাঁধার বিধান থাকতো, তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে এ ব্যাপারে নির্দেশ দিতেন এবং সাহাবায়ে কিরাম অগ্রাধিকারভিত্তিতে তা আমলে নিতেন।
৩. ৮ তারিখ মিনায় পৌঁছা পর্যন্ত ইহরাম বিলম্বিত করা। এটি জায়েয; কিন্তু উত্তম নয়। কেননা বিদায় হজে সাহাবীরা নিজ নিজ অবস্থানস্থল থেকে ইহরাম বেঁধেছেন। অতঃপর মিনার দিকে রওনা হয়েছেন।[4]
৪. কোনো কোনো হাজী মনে করেন, উমরায় পরিহিত ইহরামের কাপড় না ধুয়ে হজের জন্য পরিধান করা বৈধ নয়। এটি ভুল ধারণা। কেননা ইহরামের কাপড় নতুন ও পরিষ্কার থাকা শর্ত নয়। পরিষ্কার থাকলে ভালো। কিন্তু ওয়াজিব নয়।
৫. অনেক হাজী সাহেব মিনায় রওনা হবার সময় তালবিয়া উচ্চস্বরে পাঠ করেন না। অথচ উচ্চস্বরে পাঠ করা সুন্নত। কেননা,
ক. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
أَتَانِي جِبْرِيلُ ، فَقَالَ : إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكَ أَنْ تَأْمُرَ أَصْحَابَكَ أَنْ يَرْفَعُوا أَصْوَاتَهُمْ بِالتَّلْبِيَةِ ، فَإِنَّهَا مِنْ شِعَارِ الْحَجِّ .
‘জিবরীল আমার কাছে আগমন করে বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ আপনাকে আদেশ দিচ্ছেন, যাতে আপনি আপনার সাহাবীগণকে নির্দেশ দেন, তারা যেন উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করে। কেননা এটি হজের শ্লোগানের অন্তর্ভুক্ত।’[5]
খ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল, কোন হজ উত্তম? তিনি বললেন, ‘আল-‘আজ্জু ওয়াছ-ছাজ্জু।’[6] আল-আজ্জু হচ্ছে তালবিয়ার মাধ্যমে আওয়াজ উচ্চ করা, আর আছছাজ্জু হচ্ছে হাদী বা কুরবানীর পশুর রক্ত প্রবাহিত করা।
গ. সাহাবায়ে কিরাম এই আদেশ পালন করেছেন। তাঁরা উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করেছেন। রীতিমত চড়া গলায় তাঁরা তালবিয়া পড়েছেন। এমনকি এর ফলে তাঁদের গলার স্বর ভেঙ্গে গিয়েছিল।[7] ইমাম নববী রহ. তালবিয়ার আওয়াজ উচ্চ করা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটি সর্বসম্মত মত। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, পরিমিতভাবে উচ্চ করা যাতে নিজের কষ্ট না হয়।
আর মহিলারা এমন আওয়াজে পড়বে যাতে তারা নিজেরা শুনতে পায়। কেননা তাদের উচ্চ আওয়াজে ফিতনার আশংকা রয়েছে।’[8] ইবন আবদিল বার বর্ণনা করেন, ‘এ বিষয়ে সর্বসম্মত মত হচ্ছে, মহিলারা অতি উঁচুস্বরে তালবিয়া পাঠ করবে না। বরং এমন আওয়াজে পড়বে যাতে নিজেরা শুনতে পায়।’[9] এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম থেকেও বর্ণনা এসেছে। ইবন আব্বাস রা. বলেন, ‘মহিলারা তালবিয়া উচ্চস্বরে পড়বে না।’[10] ইবন উমর রা. বলেছেন, মহিলাদের জন্যে অনুমতি নেই যে, তারা উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করবে।’[11]
৬. কোনো কোনো হাজী মিনায় দুই ওয়াক্তের সালাত একত্র করে আদায় করেন। আবার কেউ কেউ চার রাক‘আত বিশিষ্ট সালাতে কসর করেন না। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি মিনায় দুই ওয়াক্তের সালাত একত্রে আদায় না করে পৃথক পৃথকভাবে কসর করেছেন। আর মুসলমানদের যাবতীয় কাজে সুন্নতের অনুসরণ করা একান্ত প্রয়োজন।
[2]. আল কাসানী : বাদায়িউস্সানায়ে’: ২/৩৪৭।
[3]. মনে রাখবেন, ইহরাম বাঁধার ক্ষেত্রে সুন্নত হচ্ছে দু’টি। এক. পবিত্র মক্কায় হারামের সীমারেখায় অবস্থিত আপনার অবস্থানস্থল থেকে ইহরাম বাঁধা। দুই. ৮ তারিখ সূর্যোদয়ের পর থেকে তা হেলে পড়ার পূর্বেই যেকোনো সময়ে ইহরাম বাঁধা।
[4]. তবে যদি ৭ তারিখ কোনো কারণে কাউকে মিনা চলে যেতে হয়, তবে তার জন্য উত্তম হলো, ৮ তারিখ তিনি যেখানে থাকবেন সেখান থেকে ইহরাম বাঁধা। যদিও তা মিনা হয়। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৮ তারিখ ইহরাম বেঁধেছেন। তার আগে নয়।
[5]. আহমাদ : ২১৭২২, ইবন হিব্বান : ৩৮০৩।
[6]. হাকেম : ১৬৫৫, বায়হাকী : ৩৯৭৪।
[7]. মুছান্নাফ ইবন আবী শাইবা : ৪/৪৬৪।
[8]. শারহু মুসলিম লিন-নাবাবী : ৪/৩৫১।
[9]. আল-ইসতিযকার : ৪/৫৭; বিদায়াতুল মুজতাহিদ : ১/৪৬৭।
[10]. মুছান্নাফে ইবন আবী শাইবা : ৪/৪১৬; সুনানে বায়হাকী : ৫/৪৬।
[11]. মুছান্নাফে ইবন আবী শাইবা : ৪/৪১৬; উমদাতুল কারী : ৯/১৭১।
‘আরাফার প্রতি আমার হৃদয় কোণে এমন এক টান ও আকর্ষণ সদা বর্তমান, যা আমাকে বারবার এর কাছে ফিরে আসতে বলে। এর পথে-প্রান্তরে রাত্রি যাপনে আগ্রহী করে তোলে এবং তওবা-ইস্তেগফার ও তালবিয়া-শুকরিয়ার মাধ্যমে সেখানে সময় কাটাতে অস্থির করে তোলে। এ এমন এক স্থান, যে স্থানটির মতো আল্লাহর প্রতি প্রকাশ না পাওয়া নিখাঁদ একাগ্রতা ও সমুজ্জ্বল নিষ্ঠা জীবনে আর কোথাও খুঁজে পাইনি। আল্লাহর ভালোবাসায় উদ্বেল যে ভ্রাতৃত্বের প্রেরণা এখানে দেখা যায়, তার নমুনাও আজীবন কোথাও পাইনি।’[1]
-মুহাম্মদ হুসাইন হাইকাল
আরাফা দিবসের ফযীলত
যিলহজ মাসের ৯ তারিখকে ‘ইয়াওমু আরাফা’ বা আরাফা দিবস বলা হয়। এই দিবসে আরাফায় অবস্থান করা হজের শ্রেষ্ঠতম আমল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘হজ হল আরাফা।’[1] সুতরাং আরাফায় অবস্থান করা ফরয। আরাফায় অবস্থান ছাড়া হজ সহীহ হবে না। এ দিনের ফযীলত ইয়াউমুন-নহর বা কুরবানীর দিনের কাছাকাছি। প্রত্যেক হাজী ভাইয়ের উচিত, এ দিনে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আমল করা। এ দিনের ফযীলত সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীস বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে তার কিছু উল্লেখ করা হল :
১. আল্লাহ তা‘আলা আরাফার দিন বান্দার নিকটবর্তী হন এবং বান্দাদের সবচে’ বেশি সংখ্যককে তিনি জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেন। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللَّهُ فِيهِ عَبْدًا مِنَ النَّارِ مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ وَإِنَّهُ لَيَدْنُو ثُمَّ يُبَاهِى بِهِمُ الْمَلاَئِكَةَ فَيَقُولُ مَا أَرَادَ هَؤُلاَءِ»
‘এমন কোন দিন নেই যেদিনে আল্লাহ তা‘আলা আরাফার দিন থেকে বেশি বান্দাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেন। আল্লাহ সেদিন নিকটবর্তী হন এবং তাদেরকে নিয়ে ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করে বলেন, ওরা কী চায়?[2]
২. আল্লাহ তা‘আলা আরাফায় অবস্থানকারীদেরকে নিয়ে আকাশবাসীদের সাথে গর্ব করেন। আবূ হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يُبَاهِى بِأَهْلِ عَرَفَاتٍ أَهْلَ السَّمَاءِ فَيَقُولُ لَهُمُ : انْظُرُوا إِلَى عِبَادِى جَاءُونِى شُعْثًا غُبْرًا»
‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা আরাফায় অবস্থানকারীদের নিয়ে আকাশবাসীদের সাথে গর্ব করেন। তিনি তাদেরকে বলেন, আমার বান্দাদের দিকে তাকিয়ে দেখ, তারা আমার কাছে এসেছে উস্কোখুস্কো ও ধূলিমলিন অবস্থায়।’[3]
৩. আরাফার দিন মুসলিম জাতির জন্য প্রদত্ত আল্লাহর দীন ও নিয়ামত পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির দিন। তারিক ইবন শিহাব বলেন, ‘ইহূদীরা উমর রা. কে বলল, আপনারা একটি আয়াত পড়েন থাকেন, যদি তা আমাদের ওপর নাযিল হতো তাহলে তা নাযিল হবার দিন আমরা উৎসব পালন করতাম। উমর রা. বললেন, আমি অবশ্যই জানি কী উদ্দেশ্যে ও কোথায় তা নাযিল হয়েছে এবং তা নাযিল হবার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথায় ছিলেন। তা ছিল আরাফার দিন। আর আল্লাহর কসম! আমরা ছিলাম আরাফার ময়দানে। (দিনটি জুমাবার ছিল) (আয়াতটি ছিল
﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ ﴾ [المائدة: ٣]
‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে আমি পরিপূর্ণ করে দিলাম’)।[4]
৪. জিবরীল আলাইহিস সালাম আল্লাহর পক্ষ থেকে আরাফায় অবস্থানকারী ও মুযদালিফায় অবস্থানকারিদের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর নিকট সালাম পৌঁছিয়েছেন এবং তাদের অন্যায়ের জিম্মাদারী নিয়ে নিয়েছেন। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার ময়দানে সূর্যাস্তের পূর্বে বিলাল রা.-কে নির্দেশ দিলেন মানুষদেরকে চুপ করাতে। বিলাল রা. বললেন, আপনারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর জন্য নীরবতা পালন করুন। জনতা নীরব হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«يَا مَعْشَرَ النَّاسِ أَتَانِيْ جِبْرِيْلُ آنِفًا فَأَقَرَأَنِيْ مِن رَّبِيْ السَّلاَمُ لأَهْلِ عَرَفَاتَ وَأَهْلِ الْمَشْعَرِ الْحَرَامِ وَضَمِنَ عَنْهُمْ التَّبِعَاتِ».
‘হে লোকসকল, একটু পূর্বে জিবরীল আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি আমার রবের পক্ষ থেকে আরাফায় অবস্থানকারী ও মুযদালিফায় অবস্থানকারিদের জন্য আমার কাছে সালাম পৌঁছিয়েছেন এবং তাদের অন্যায়ের যিম্মাদারী নিয়েছেন। উমর রা. দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা কি শুধু আমাদের জন্য? তিনি বললেন, এটা তোমাদের জন্য এবং তোমাদের পর কিয়ামত পর্যন্ত যারা আসবে তাদের জন্য। উমর রা. বললেন, আল্লাহর রহমত অঢেল ও উত্তম।’[5]
৫. আরাফায় অবস্থানকারিদেরকে আল্লাহ তা‘আলা বিশেষভাবে ক্ষমা করে দেন। ইবন উমর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَأَمَّا وُقُوفُكَ بِعَرَفَةَ فَإِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَنْزِلُ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا فَيُبَاهِي بِهِمُ الْمَلائِكَةَ، فَيَقُولُ:هَؤُلاءِ عِبَادِي جَاءُونِي شُعْثًا غُبْرًا مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ يَرْجُونَ رَحْمَتِي، وَيَخَافُونَ عَذَابِي، وَلَمْ يَرَوْنِي، فَكَيْفَ لَوْ رَأَوْنِي؟ فَلَوْ كَانَ عَلَيْكَ مِثْلُ رَمْلِ عَالِجٍ، أَوْ مِثْلُ أَيَّامِ الدُّنْيَا، أَوْ مِثْلُ قَطْرِ السَّمَاءِ ذُنُوبًا غَسَلَ اللَّهُ عَنْكَ».
‘আর আরাফায় তোমার অবস্থান, তখন তো আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন। অতপর ফেরেশতাদের সাথে আরাফায় অবস্থানকারীদেরকে নিয়ে গর্ব করে বলেন, এরা আমার বান্দা, এরা উস্কোখুস্কো ও ধূলিমলিন হয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আমার কাছে এসেছে। এরা আমারই রহমতের আশা করে এবং আমার শাস্তিকে ভয় করে। অথচ এরা আমাকে দেখেনি। আর যদি দেখতো তাহলে কেমন হতো? অতঃপর বিশাল মরুভূমির বালুকণা সমান অথবা দুনিয়ার সকল দিবসের সমান অথবা আকাশের বৃষ্টির কণারাশির সমান পাপও যদি তোমার থাকে, আল্লাহ তা ধুয়ে মুছে সাফ করে দেবেন।’[6]
৬. আরাফা দিবসের দো‘আ সর্বোত্তম দো‘আ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«خَيْرُ الدُّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ».
‘উত্তম দো‘আ হল আরাফা দিবসের দো‘আ।’[7]
৭. যারা হজ করতে আসেনি তারা আরাফার দিন সিয়াম পালন করলে তাদের পূর্বের এক বছর ও পরের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। আবূ কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আরাফা দিবসের সিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,
«يُكَفِّرُ السَّنَةَ الْمَاضِيَةَ وَالْبَاقِيَةَ».
‘আরাফা দিবসের সিয়াম পালন পূর্বের এক বছর ও পরের এক বছরের গুনাহ মোচন করে দেয়।’[8]
তবে এ সিয়াম হাজীদের জন্য নয়, বরং যারা হজ করতে আসেনি তাদের জন্য। হাজীদের জন্য আরাফার দিবসে সিয়াম পালন সুন্নত পরিপন্থী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের সময় আরাফা দিবসে সিয়াম পালন করেননি; বরং সবার সামনে তিনি দুধ পান করেছেন।’[9] ইকরামা বলেন, আমি আবূ হুরায়রা রা. এর বাড়িতে প্রবেশ করে আরাফা দিবসে আরাফার ময়দানে থাকা অবস্থায় সিয়াম পালনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার ময়দানে আরাফা দিবসের সিয়াম পালন করতে নিষেধ করেছেন।[10] বরং এ দিন হাজী সাহেব সিয়াম পালন না করলে তা বেশি করে দো‘আ, যিকর, ইস্তেগফার ও আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।
[2]. মুসলিম : ১৩৪৮।
[3]. মুসনাদ আহমদ : ২/২২৪।
[4]. বুখারী : ৪৬০৬। ‘আরাফা দিবসে দীন পরিপূর্ণ করে দেয়ার ব্যাখ্যায় ইবন রজব রহ. বলেন, ওই দিনে কয়েকভাবে দীনকে পরিপূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। এক. হজ ফরয হওয়ার পর সম্পূর্ণ ইসলামী আবহে মুসলমানরা ইতোপূর্বে আর কখনো হজ পালন করেন নি। অধিকাংশ আলিম এ অভিমতই ব্যক্ত করেছেন। দুই. আল্লাহ তাআলা হজকে (এই দিনে) ইবরাহীমী ভিত্তিতে ফিরিয়ে আনেন এবং শিরক ও মুশরিকদেরকে বিচ্ছিন্ন করেন। অতঃপর আরাফার ওই স্থানে তাদের কেউই মুসলমানদের সাথে মিলিত হয়নি। আর নিয়ামতের পরিপূর্ণতা ঘটেছে আল্লাহর ক্ষমা ও মার্জনা লাভের মাধ্যমে। কেননা আল্লাহর ক্ষমা ছাড়া নিয়ামত পরিপূর্ণ হয় না। এর উদাহরণ, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে বলেন,
لِيَغْفِرَ لَكَ اللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ وَيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكَ وَيَهْدِيَكَ صِرَاطًا مُسْتَقِيمًا
‘যাতে আল্লাহ ক্ষমা করেন তোমার অতীতের ও ভবিষ্যতের ত্রুটি এবং পূর্ণ করে দেন তোমার ওপর তাঁর নিয়ামত। আর প্রদর্শন করেন তোমাকে সরল পথ (ফাতহ : ২)’। লাতায়েফে মা‘আরেফ : ৪৮৬।
[5]. সহীহুত-তারগীব ওয়াত-তারহীব : ১১৫১।
[6]. আবদুর রাযযাক, মুসান্নাফ : ৮৮৩০।
[7]. তিরমিযী : ২৮৩৭; মুআত্তা মালেক : ১/৪২২।
[8]. মুসলিম : ১১৬৩।
[9]. মুসলিম : ১১২৩; মুসনাদে আহমদ : ২/৩০৪।
[10]. মুসনাদে আহমদ : ২/৩০৪।
১. সুন্নত হলো ৯ যিলহজ ভোরে ফজরের সালাত মিনায় আদায় করা।[1] সূর্যোদয়ের পর ‘তালবিয়া’ পড়া অবস্থায় ধীরে সুস্থে আরাফার দিকে রওয়ানা হওয়া। তাকবীর পড়লেও কোনো অসুবিধা নেই। আনাস রা. বলেন,
«كَانَ يُلَبِّي الْمُلَبِّي لاَ يُنْكَرُ عَلَيْهِ وَيُكَبِّرُ الْمُكَبِّرُ فَلاَ يُنْكَرُ عَلَيْهِ».
‘তালবিয়া পাঠকারী তালবিয়া পাঠ করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাতে কোন দোষ মনে করেননি। আবার তাকবীর পাঠকারী তাকবীর পাঠ করতেন। তাতেও তিনি দোষ মনে করেননি।’[2]
২. সুন্নত হলো সূর্য হেলে পড়ার পরে মসজিদে নামিরায় যোহর আসর একসাথে হজের ইমামের পিছনে আদায় করে আরাফার ময়দানে প্রবেশ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যোহরের সময়ের পূর্বে নামিরায় অবস্থান করেছেন। এতে তাঁর জন্য নির্মিত তাবুতে তিনি যোহর পর্যন্ত বিশ্রাম নিয়েছেন। নামিরা আরাফার বাইরে। তবে আরাফার সীমানায় অবস্থিত। অতপর সূর্য হেলে পড়লে তিনি যোহর ও আসরের সালাত যোহরের প্রথম ওয়াক্তে আদায় করে আরাফায় প্রবেশ করেন।’[3]
বর্তমান সময়ে এ সুন্নতের ওপর আমল করা প্রায় অসম্ভব। তবে যদি কারো পথঘাট ভালো করে চেনা থাকে; একা একা আরাফায় সাথিদের কাছে ফিরে আসতে পারবে বলে নিশ্চিত থাকে, অথবা একা একাই মুযদালিফা গমন, রাত্রিযাপন ও সেখান থেকে মিনার তাঁবুতে ফিরে আসার মতো শক্তি-সাহস ও আত্মবিশ্বাস থাকে তবে তার পক্ষে নামিরার মসজিদে এ সুন্নত আদায় করা সম্ভব।
৩. সুন্নত হলো হজের ইমাম হাজীদের উদ্দেশ্যে সময়োপযোগী খুতবা প্রদান করবেন। তিনি এতে তাওহীদ ও ইসলামের প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান সম্পর্কে আলোচনা করবেন। হাজীদেরকে হজের আহকাম সম্পর্কে সচেতন করবেন। তাদেরকে তওবার কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন, কুরআন-সুন্নাহর ওপর অটল থাকার আহবান জানাবেন। যেমনটি করেছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফাতে তাঁর বিদায় হজের খুতবার সময়।
৪. সুন্নত হলো যোহর আসর কসর করে একসাথে যোহরের সময়ে আদায় করা এবং সুন্নত বা নফল কোন সালাত আদায় না করা। এ নিয়ম সব হাজী সাহেবের জন্যই প্রযোজ্য। মক্কাবাসী বা আরাফার আশপাশে বসবাসকারী কিংবা দূরের হাজী সাহেবের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কিরামকে নিয়ে যোহর-আসর কসর করে একসাথে যোহরের সময়ে আদায় করেছিলেন। উপস্থিত সকল হাজী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে কসর করে সে দুই ওয়াক্তের সালাত একসাথে আদায় করেছেন। তিনি কাউকে পূর্ণ সালাত আদায় করার আদেশ দেননি। অবশ্য কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কাবাসিদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,
«يَا أَهْلَ مَكَّةَ ، أَتِمُّوا ؛ فَإِنَّا قَوْمٌ سَفْرٌ».
‘হে মক্কাবাসী, তোমরা (সালাত) পূর্ণ করে নাও। কারণ আমরা মুসাফির।’[4] কিন্তু বিদায় হজের সময় তা বলেননি। তাই বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, এ সময়ের সালাতের কসর ও দুই সালাত জমা‘ তথা একত্র করা সুন্নত। কসর ও জমা‘ না করা অন্যায়। বিদায় হজ সম্পর্কে জাবের রা. বলেন,
«أَنَّ رسول اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَتَى بَطْنَ الوَادِيْ فَخَطَبَ النَّاسَ، ثُمَّ أَذَّنَ، ثُمَّ أَقَامَ فَصَلَّى الظُّهْرَ، ثُمَّ أَقَامَ فَصَلَّى الْعَصْرَ وَلَمْ يُصَلِّ بَيْنَهُمَا شَيْئًا».
‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপত্যকার মধ্যখানে এলেন। তিনি লোকজনের উদ্দেশ্যে খুতবা দিলেন। অতঃপর (বিলাল) আযান ও ইকামত দিলেন এবং তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যোহরের সালাতের ইমামত করলেন। পুনরায় (বিলাল) ইকামত দিলেন এবং তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসরের সালাত আদায় করলেন। এ দু’য়ের মাঝখানে অন্য কোনো সালাত আদায় করলেন না।[5]
৫. ইবন উমর রা. হজের ইমামের পেছনে জামাত না পেলেও যোহর-আসর একসাথে জমা করতেন, সহীহ বুখারীতে একটি বর্ণনা এসেছে,
«وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا إِذَا فَاتَتْهُ الصَّلاَةُ مَعَ الإِمَامِ جَمَعَ بَيْنَهُمَا».
‘ইবন উমর রা. ইমামের সাথে সালাত ছুটে গেলেও দুই সালাত একসাথে পড়তেন।’[6]
প্রসিদ্ধ হাদীস বর্ণনাকারী নাফে‘ রহ. বলেন, ‘ইবন উমর রা. আরাফা দিবসে ইমামকে সালাতে না পেলে, নিজ অবস্থানের জায়গাতেই যোহর-আসর একত্রে আদায় করতেন।’[7]
হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ দুই ইমাম, ইমাম মুহাম্মদ রহ. ও ইমাম আবূ ইউসুফ রহ.ও একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন :
مُحَمَّدٌ قَالَ: أَخْبَرَنَا أَبُوْ حَنِيْفَةَ، عَنْ حَمَّادٍ، عَنْ إِبْرَاهِيْمَ، قَالَ: إِذَا صَلَّيتَ يَوْمِ عَرَفَةَ فِيْ رِحْلِِكَ فَصَلِّ كُلَّ وَاحِدَةٍ مِنَ الصَّلاَتَيْنِ لِوَقْتِهَا، َوتَرْتَحِلُ مِنْ مُنْزِلٍ حَتَّى تَفْرُغَ مِنَ الصَّلاَةِ، قَالَ مُحَمَّدٌ: وَبِهَذَا كَانَ يَأْخُذُ أَبُوْ حَنِيْفَةَ، فَأَمَّا فِيْ قَوْلِنَا فَإِنَّهُ يُصَلِّيْهَا فِيْ رِحْلِهِ كَمَا يُصَلِّيْهَا مَعَ الإِمَامِ، يَجْمَعُهُمَا جَمِيْعًا بِأَذَانٍ وَإِقَامَتَيْنِ، لأَنَّ الْعَصْرَ إِِنَّمَا قُدِّمَتْ لِلْوُقُوْفِ وَكَذَلِكَ بَلَغَنَا عَنْ عَائِشَةَ أُمِّ الْمُؤْمِنِيْنَ، وَعَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ، وَعَنْ عَطَاءَ بْنِ أَبِيْ رَبَاحٍ، وَعَنْ مُجَاهِدٍ .
‘ইমাম মুহাম্মদ রহ. বলেন, (ইমাম) আবূ হানীফা রহ. আমাদেরকে হাম্মাদ-ইবরাহীম সূত্রে অবহিত করেছেন। তিনি বলেন, আরাফার দিন যদি তুমি নিজের অবস্থানের জায়গায় সালাত আদায় কর তবে দুই সালাতের প্রত্যেকটি যার যার সময়ে আদায় করবে এবং সালাত থেকে ফারেগ হয়ে নিজের অবস্থানের জায়গা থেকে প্রস্থান করবে। (ইমাম) মুহাম্মদ রহ. বলেন, (ইমাম) আবূ হানীফা রহ. এ মত গ্রহণ করেন। তবে আমাদের কথা এই যে, (হাজী) তার উভয় সালাত নিজের অবস্থানের জায়গায় ঠিক একইরূপে আদায় করবে যেভাবে আদায় করে ইমামের পেছনে। উভয় সালাতকে এক আযান ও দুই ইকামাতের সাথে একত্রে আদায় করবে। কেননা সালাতুল আসরকে উকুফের স্বার্থে এগিয়ে আনা হয়েছে। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. আবদুল্লাহ ইবন উমর, আতা ইবন আবী রাবাহ ও মুজাহিদ রহ. থেকে এরূপই আমাদের কাছে পৌঁছেছে।’[8]
তাই হজের ইমামের পেছনে জামাতের সাথে সালাত আদায় সম্ভব হোক বা না হোক, সর্বাবস্থায় যোহর-আসর একত্রে পড়া সুন্নত।
৬. হাজীগণ সালাত শেষে আরাফার ভেতরে প্রবেশ না করে থাকলে প্রবেশ করবেন। যারা মসজিদে নামিরাতে সালাত আদায় করবেন তারা এ বিষয়টি অবশ্যই লক্ষ্য রাখবেন। কেননা মসজিদে নামিরার কিবলার দিকের অংশটি আরাফার সীমারেখার বাইরে অবস্থিত। মনে রাখবেন, আরাফার বাইরে অবস্থান করলে হজ হবে না।
৭. অতঃপর দো‘আ ও মুনাজাতে লিপ্ত হবেন। দাঁড়িয়ে-বসে-চলমান তথা সর্বাবস্থায় দো‘আ ও যিকর করতে থাকবেন। সালাত আদায়ের পর থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত দু’হাত তুলে অনুচ্চস্বরে বেশি করে দো‘আ, যিকর ও ইস্তেগফারে লিপ্ত থাকবেন। উসামা ইবন যায়েদ রা. বলেন,
«كُنْتُ رَدِيفَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم بِعَرَفَاتٍ فَرَفَعَ يَدَيْهِ يَدْعُو فَمَالَتْ بِهِ نَاقَتُهُ فَسَقَطَ خِطَامُهَا فَتَنَاوَلَ الْخِطَامَ بِإِحْدَى يَدَيْهِ وَهُوَ رَافِعٌ يَدَهُ الأُخْرَى».
‘আমি আরাফায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর পেছনে উটের পিঠে বসা ছিলাম। তখন তিনি তাঁর দু’হাত তুলে দো‘আ করছিলেন। অতঃপর তাঁর উষ্ট্রী তাঁকে নিয়ে ঝুঁকে পড়ল। এতে তাঁর উষ্ট্রীর লাগাম পড়ে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এক হাত দিয়ে লাগামটি তুলে নিলেন এবং তাঁর অন্য হাত উঠানো অবস্থায়ই ছিল।’[9]
রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,
«خَيْرُ الدُّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ وَخَيْرُ مَا قُلْتُ أَنَا وَالنَّبِيُّونَ مِنْ قَبْلِى. لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِير».
‘উত্তম দো‘আ হচ্ছে আরাফার দিনের দো‘আ; আর উত্তম সেই বাক্য যা আমি ও আমার পূর্ববতী নবীগণ বলেছি, তা হচ্ছে, (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদীর।) ‘আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই, রাজত্ব ও সমস্ত প্রশংসা তাঁর জন্য। তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান।’[10]
কুরআন তিলাওয়াত, ওয়াজ নসীহতের বৈঠকে শরীক হওয়া ইত্যাদিও আরাফায় অবস্থানের আমলের মধ্যে শামিল হবে। তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে কেবল বসে বসে নিম্নস্বরে দো‘আ-যিকর ও কুরআন তিলাওয়াতের নির্দেশ রয়েছে। দিনের শেষ সময়টিকে বিশেষভাবে কাজে লাগাবেন। পুরোপুরিভাবে দো‘আয় মগ্ন থাকবেন।
৮. আরাফার পুরো জায়গাটাই হাজীদের অবস্থানের জায়গা। মনে রাখবেন, উরানা উপত্যকা আরাফার উকূফের স্থানের বাইরে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«كُلُّ عَرَفَةَ مَوْقِفٌ ، وَارْتَفِعُوا عَنْ بَطْنِ عُرَنَةَ»
‘আরাফার সব স্থানই অবস্থানস্থল। তবে বাতনে উরানা থেকে তোমরা উঠে যাও।’[11]
বর্তমান মসজিদে নামিরার একাংশ ও এর পার্শ্বস্থ নিম্ন এলাকাই বাতনে উরনা বা উরনা উপত্যকা। সুতরাং কেউ যেন সেখানে উকূফ না করে। মসজিদে নামিরায় সালাত আদায়ের পর মসজিদের যে অংশ আরাফার ভেতরে অবস্থিত সে দিকে গিয়ে অবস্থান করুন। বর্তমানে মসজিদের ভেতরেই নীল বাতি দিয়ে আরাফা নির্দেশক চিহ্ন দেয়া আছে। অতএব এ সম্পর্কে সচেতন থাকুন।
[2]. বুখারী : ৯৭৫; মুসলিম : ১২৮৫।
[3]. বুখারী : ১৬৬০; মুসলিম : ১২১৮।
[4]. বাইহাকী : ৩/১৩৫; মুসনাদ আহমদ : ৪/৪৩২। (হাদীসটির সনদ দুর্বল। তবে মুআত্তা মালেকে এটি উমর রা. থেকে তার কথা হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। তিনি একবার মক্কায় আগমন করে সাথিদের নিয়ে সালাত কসর করে আদায় করেছিলেন। তারপর তার সাথে স্থানীয় যারা সালাত আদায় করেছিল তাদেরকে পূর্ণ করার আদেশ দিয়েছিলেন। মুআত্তা : ১/১৪০, ২০২।)
[5]. মুসলিম : ১২১৮।
[6]. বুখারী : ১৬৬২।
[7]. জা‘ফর আহমদ উসমানী, এ‘লাউসসুনান, ৭/৩০৭৩, দারুল ফিকর, বৈরূত, ২০০১।
[8]. জা‘ফর আহমদ উসমানী, প্রাগুক্ত।
[9]. মুসনাদ আহমদ : ২১৮৭০; সুনানে নাসাঈ : ৩০১১।
[10]. তিরমিযী : ৩৫৭৫।
[11]. মুআত্তা মালেক : ৩০১; মুসনাদে আহমদ : ১৬৭৯৭।
- আলিমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, ইয়াওমুন নাহর বা ১০ই যিলহজের দিন সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত আরাফার মাঠে অবস্থানের সময়সীমা প্রলম্বিত। যদি কেউ ৯ তারিখ দিবাগত রাত (দশ তারিখের রাত)-এর সুবহে সাদিক পর্যন্ত আরাফার মাঠে পৌঁছতে না পারে, তার হজ হবে না।
- আর যদি কেউ ৯ তারিখ দিবাগত রাত (দশ তারিখের রাত) সুবহে সাদিকের আগে আরাফার মাঠে যত অল্প সময়ই হোক না কেন, এমনকি যদি কেবল সে মাঠ অতিক্রম করে যায় তাতেই আরাফায় অবস্থান সম্পন্ন হয়ে যাবে। কারণ হাদীসে এসেছে, সাহাবী উরওয়া ইবন মুদ্বাররিস দেরি করে হজে আগমন করেন। তিনি বিভিন্ন উপত্যকা পেরিয়ে রাতের বেলায় আরাফায় অবস্থান করে মুযদালিফায় এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজের হজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন,
«مَنْ أَدْرَكَ مَعَنَا هَذِهِ الصَّلاَةَ وَقَدْ وَقَفَ قَبْلَ ذَلِكَ بِعَرَفَة لَيْلاً أَوْ نَهَارًا فَقَدْ تَمَّ حَجُّهُ وَقَضَى تَفَثَهُ»
‘যে ব্যক্তি আমাদের সাথে এই সালাত (মুযদালিফায় ফজর) আদায় করবে। আর এর পূর্বে রাতে বা দিনে আরাফায় অবস্থান করেছে তার হজ পূর্ণ হয়েছে এবং সে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়েছে।’[1]
অপর হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নজদের কিছু লোক হজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাদের বলেন,
«الْحَجُّ عَرَفَةُ ، فَمَنْ جَاءَ عَرَفَة قَبْلَ صَلاَةِ الْفَجْرِ ، لَيْلَةَ جَمْعٍ ، فَقَدْ تَمَّ حَجُّهُ»
‘হজ হচ্ছে আরাফা। যে কেউ মুযদালিফার রাত্রিতে ফজরের সালাতের পূর্বে আরাফায় হাযির হতে পারবে তার হজ পূর্ণ হবে।’[2]
- আরাফার মাঠে ঐ ব্যক্তিই পূর্ণভাবে অবস্থান করতে সক্ষম হয়েছেন, যিনি যোহরের পর থেকে সূর্যাস্তের পর কিছুটা অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত আরাফার মাঠে অবস্থান করেছেন।
- যদি কেউ শুধু দিনের অংশে অবস্থান করে। যেমন সূর্যাস্তের পূর্বেই বের হয়ে গেল। তার ব্যাপারে আলিমগণ বিভিন্ন মত দিয়েছেন। ইমাম মালেক রহ. বলেন, তার হজই হবে না। পক্ষান্তরে ইমাম আবূ হানীফা রহ., শাফেঈ ও আহমদ রহ. এর মতে তার হজ শুদ্ধ হলেও তাকে এর জন্য দম দিতে হবে।
- অধিকাংশ আলিমের মতে, আরাফার মাঠে অবস্থানের সময় শুরু হয় সূর্য হেলে যাওয়ার পর; এর পূর্বে নয়। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা-ই করেছেন। ইমাম আহমদ রহ. বলেন, উকূফে আরাফার সময় ৯ তারিখ দিনের শুরু থেকেই আরম্ভ হয়।
- কোনো ব্যক্তি যদি আরাফায় অবস্থানকালে অজ্ঞান হয়ে যায়, তাহলে তার আরাফায় অবস্থান (উকূফ) শুদ্ধ হবে।
মনে রাখবেন, আরাফার পাহাড়ে আরোহন করা হজের কোনো কাজ নয়। এটি দুনিয়ার অন্যান্য পাহাড়ের মতোই একটি পাহাড়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ পাহাড়ে উঠেননি। তিনি উটের ওপর সওয়ার ছিলেন। সেটি পাহাড়ের পাদদেশে বড় পাথরগুলোর কাছে দণ্ডায়মান ছিল। সুতরাং পাহাড়ে ওঠা পুণ্যের কাজ নয়। অথচ এ পাহাড়ে উঠতে গিয়ে অনেকে মারাত্মকভাবে আহত, অসুস্থ বা সাথিদের হারিয়ে ফেলার মতো ঘটনার শিকার হন। যা একেবারে অনাকাঙ্ক্ষিত ও সুন্নত বিরোধী কাজ।
[2]. নাসাঈ : ৩০১৬।
মুযদালিফায় অবস্থানের ফযীলত
মুযদালিফায় অবস্থানকারিদের ওপর আল্লাহ তা‘আলা অনুকম্পা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ اللهَ تَطَوَّلَ عَلَيْكُمْ فِي جَمْعِكُمْ هَذَا، فَوَهَبَ مُسِيئَكُمْ، لِمُحْسِنِكُمْ، وَأَعْطَى مُحْسِنَكُمْ مَا سَأَلَ».
‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের এই (মুযদালিফার) সমাবেশে তোমাদের ওপর অনুকম্পা করেছেন, তাই তিনি গুনাহ্গারদেরকে নেককারদের কাছে সোপর্দ করেছেন। আর নেককাররা যা চেয়েছে তা তিনি দিয়েছেন।’[1]
মুযদালিফার পথে রওয়ানা
১. যিলহজের ৯ তারিখ সূর্য ডুবে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর হাজী সাহেব ধীরে-সুস্থে শান্তভাবে আরাফা থেকে মুযদালিফার দিকে রওয়ানা করবেন। হাজীদেরকে কষ্ট দেয়া থেকে দূরে থাকবেন। চেঁচামেচি ও খুব দ্রুত হাঁটাচলা পরিহার করবেন। ইবন আব্বাস রা. বলেন, ‘তিনি আরাফার দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আরাফা থেকে মুযদালিফা গিয়েছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পেছনে উট হাঁকানোর ধমক ও চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পেলেন। তখন তিনি তাঁর বেত দিয়ে লোকদেরকে ইশারা করে বললেন,
«أَيُّهَا النَّاسُ عَلَيْكُمْ بِالسَّكِينَةِ ، فَإِنَّ الْبِرَّ لَيْسَ بِالإِيضَاعِ»
‘হে লোকসকল! তোমাদের শান্তভাবে চলা উচিত। কেননা দ্রুত চলাতে কোনো কল্যাণ নেই।’[2]
২. রাস্তায় জায়গা পাওয়া গেলে দ্রুতগতিতে চলাতে কোনো দোষ নেই। উরওয়া রহ. বলেন, ‘উসামা রা. কে জিজ্ঞেস করা হল, ‘বিদায় হজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে পথ অতিক্রম করছিলেন? তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মধ্যম গতিতে পথ অতিক্রম করছিলেন। আর যখন জায়গা পেয়েছেন তখন দ্রুত গতিতে চলেছেন।’[3]
৩. মাগরিবের সালাত আরাফার ময়দানে কিংবা মুযদালিফার সীমারেখায় প্রবেশের আগে কোথাও আদায় করবেন না।
৪. আরাফার সীমরেখা পার হয়ে প্রায় ৬ কি.মি. পথ অতিক্রম করার পর মুযদালিফা সীমারেখা শুরু হয়। মুযদালিফার শুরু ও শেষ নির্দেশকারী বোর্ড রয়েছে। বোর্ড দেখেই মুযদিলাফায় প্রবেশ করেছেন কিনা তা নিশ্চিত হবেন। তাছাড়া বড় বড় লাইটপোস্ট দিয়েও মুযদালিফা চিহ্নিত করা আছে। তা দেখেও নিশ্চিত হতে পারেন।
মুযদালিফায় করণীয়
১. মুযদালিফায় পৌঁছার পর ‘ইশার সময়ে বিলম্ব না করে মাগরিব ও ইশা এক সাথে আদায় করবেন। মাগরিব ও ইশা উভয়টা এক আযান ও দুই ইকামাতে আদায় করতে হবে। জাবের রা. বলেন,
«حَتَّى أَتَى الْمُزْدَلِفَةَ فَصَلَّى بِهَا الْمَغْرِبَ وَالْعِشَاءَ بِأَذَانٍ وَاحِدٍ وَإِقَامَتَيْنِ وَلَمْ يُسَبِّحْ بَيْنَهُمَا شَيْئًا ثُمَّ اضْطَجَعَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم حَتَّى طَلَعَ الْفَجْرُ»
‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় এলেন, সেখানে তিনি মাগরিব ও ইশা এক আযান ও দুই ইকামতসহ আদায় করলেন। এ দুই সালাতের মাঝখানে কোনো তাসবীহ (সুন্নত বা নফল সালাত) পড়লেন না। অতঃপর তিনি শুয়ে পড়লেন। ফজর (সুবহে সাদেক) উদিত হওয়া পর্যন্ত তিনি শুয়ে থাকলেন।’[4]
আযান দেয়ার পর ইকামত দিয়ে প্রথমে মাগরিবের তিন রাক‘আত সালাত আদায় করতে হবে। এরপর সুন্নত-নফল না পড়েই ‘ইশার সালাতের ইকামত দিয়ে ‘ইশার দু’রাক‘আত কসর সালাত আদায় করতে হবে। ফরয সালাত আদায়ের পর বেতরের সালাতও আদায় করতে হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফর ও মুকীম কোনো অবস্থায়ই এ সালাত ত্যাগ করতেন না।
২. সালাত আদায়ের পর বিলম্ব না করে বিশ্রাম নেবেন এবং শুয়ে পড়বেন। কেননা ওপরের হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় সুবহে সাদেক পর্যন্ত শুয়ে আরাম করেছেন। যেহেতু ১০ যিলহজ হাজী সাহেবকে অনেক পরিশ্রম করতে হবে তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফার রাতে আরাম করার বিধান রেখেছেন। সুতরাং হাজীদের জন্য মুযদালিফার রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর সুন্নতের পরিপন্থি।
৩. মুযদালিফায় পৌঁছার পর যদি ইশার সালাতের সময় না হয় তবে অপেক্ষা করতে হবে। হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে,
«إِنَّ هَاتَيْنِ الصَّلاَتَيْنِ حُوِّلَتَا عَنْ وَقْتِهِمَا فِى هَذَا الْمَكَانِ الْمَغْرِبَ وَالْعِشَاءَ»
‘এ স্থানে (মুযদালিফায়) এ সালাত দু’টি মাগরিব ও ইশাকে তাদের সময় থেকে পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে।’[5]
৪. সুন্নত হলো সুবহে সাদেক উদিত হলে আওয়াল ওয়াক্তে ফজরের সালাত আদায় করে কেবলামুখী হয়ে হাত তুলে দো‘আ করা। আকাশ ফর্সা হওয়া পর্যন্ত দো‘আ ও যিকরে মশগুল থাকা। আকাশ ফর্সা হবার পর সূর্যোদয়ের আগেই মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করা। জাবের রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে,
«فَلَمْ يَزَلْ وَاقِفًا حَتَّى أَسْفَرَ جِدًّا فَدَفَعَ قَبْلَ أَنْ تَطْلُعَ الشَّمْسُ»
‘আকাশ ভালভাবে ফরসা হওয়া পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উকূফ (অবস্থান) করেছেন। অতঃপর সূর্যোদয়ের পূর্বে তিনি (মুযদালিফা থেকে মিনার দিকে) যাত্রা আরম্ভ করেছেন।’[6]
তাই প্রত্যেক হাজী সাহেবের উচিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে মুযদালিফায় রাতযাপন করেছেন, ফজরের পর উকূফ করেছেন, ঠিক সেভাবেই রাতযাপন ও উকূফ করা।
৫. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাত আদায়ের পর ‘কুযা’ পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে উকূফ করেছেন। বর্তমানে এই পাহাড়ের পাশে মাশ‘আরুল হারাম মসজিদ অবস্থিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَقَفْتُ هَاهُنَا وَجَمْعٌ كُلُّهَا مَوْقِفٌ»
‘আমি এখানে উকূফ করলাম তবে মুযদালিফা পুরোটাই উকূফের স্থান।’[7]
তাই সম্ভব হলে উক্ত মসজিদের কাছে গিয়ে উকূফ করা ভাল। সম্ভব না হলে যেস্থানে রয়েছেন সেটা মুযদালিফার সীমার ভেতরে কি না তা দেখে নিয়ে সেখানেই অবস্থান করুন।’
[2]. বুখারী : ১৬৭১।
[3]. প্রাগুক্ত।
[4]. মুসলিম ১২১৮।
[5]. বুখারী : ১৬৮৩।
[6]. মুসলিম: ১২১৮।
[7]. মুসলিম : ১২১৮।
১. মুযদালিফায় উকূফ করা ওয়াজিব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَإِذَآ أَفَضۡتُم مِّنۡ عَرَفَٰتٖ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ عِندَ ٱلۡمَشۡعَرِ ٱلۡحَرَامِۖ وَٱذۡكُرُوهُ كَمَا هَدَىٰكُمۡ وَإِن كُنتُم مِّن قَبۡلِهِۦ لَمِنَ ٱلضَّآلِّينَ ١٩٨ ﴾ [البقرة: ١٩٨]
‘তোমরা যখন আরাফা থেকে প্রত্যাবর্তন করবে, মাশ‘আরুল হারামের নিকট পৌঁছে আল্লাহকে স্মরণ করবে এবং তিনি যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন ঠিক সেভাবে তাঁকে স্মরণ করবে। যদিও তোমরা ইতিপূর্বে বিভ্রান্তদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে।’[1]
২. ইমাম আবূ হানীফা রহ. বলেছেন, ফজর থেকে মূলত মুযদালিফায় উকূফের সময় শুরু হয়। তাঁর মতানুসারে মুযদালিফায় রাত যাপন করা সুন্নত। আর ফজরের পরে অবস্থান করা ওয়াজিব। যদি কেউ ফজরের আগে উযর ছাড়া মুযদালিফা ত্যাগ করে, তার ওপর দম (পশু যবেহ করা) ওয়াজিব হবে। কুরআনুল কারীমের আদেশ এবং মুযদালিফায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামের আমলের দিকে তাকালে ইমাম আবূ হানীফা রহ.-এর মতটি এখানে বিশুদ্ধতম মত হিসেবে প্রতীয়মান হয়।’[2]
৩. দুর্বল ব্যক্তি ও তার দায়িত্বশীল, মহিলা ও তার মাহরাম এবং হজ সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তির জন্য মধ্যরাতের পর চাঁদ ডুবে গেলে মুযদালিফা ত্যাগ করার অনুমতি রয়েছে। কারণ,
ক. ইবন আব্বাস রা. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দুর্বল লোকদেরকে দিয়ে রাতেই মুযদালিফা থেকে পাঠিয়ে দিলেন।’[3]
খ. ইবন উমর রা. তাঁর পরিবারের মধ্যে যারা দুর্বল তাদেরকে আগে নিয়ে যেতেন। রাতের বেলায় তারা মুযদালিফায় মাশ‘আরুল হারামের নিকট উকূফ করতেন। সেখানে তারা যথেচ্ছা আল্লাহর যিকর করতেন। অতপর ইমামের উকূফ ও প্রস্থানের পূর্বেই তারা মুযদালিফা ত্যাগ করতেন। তাদের মধ্যে কেউ ফজরের সালাতের সময় মিনায় গিয়ে পৌঁছতেন। কেউ পৌঁছতেন তারও পরে। তারা মিনায় পৌঁছে কঙ্কর নিক্ষেপ করতেন। ইবন উমর রা. বলতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এদের ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন।’[4]
গ. আসমা রা.-এর মুক্তদাস আবদুল্লাহ রহ. আসমা রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, আসমা রা. রাত্রি বেলায় মুযদালিফায় অবস্থান করলেন। অতঃপর সালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। এরপর বললেন, ‘হে বৎস, চাঁদ কি ডুবে গেছে?’ আমি বললাম, না। অতপর আরো এক ঘন্টা সালাত পড়ার পর তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বৎস, চাঁদ কি ডুবে গেছে?’ আমি জবাব দিলাম, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, চল। তখন আমরা রওয়ানা হলাম। অতঃপর তিনি জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করলেন এবং নিজ আবাসস্থলে পৌঁছে ফজরের সালাত আদায় করলেন। তখন আমি বললাম, ‘হে অমুক, আমরা তো অনেক প্রত্যুষে বের হয়ে গেছি। তিনি বললেন, হে বৎস, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহিলাদের জন্য এ ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন।’[5]
[2]. ইমাম শাফেঈ রহ. ও ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রহ.-এর মতে মধ্যরাত পর্যন্ত উকূফ করা ওয়াজিব। মধ্য রাতের পূর্বে মুযদালিফা ত্যাগ করলে দম ওয়াজিব হবে। ইমাম মালেক রহ.-এর মতে মাগরিব ও ইশার সালাত আদায় করতে যতটুকু সময় লাগে ততটুকু সময় মুযদালিফায় অবস্থান করলেই উকূফ হয়ে যাবে। খালিসুল জুমান : পৃ.২১৪।
[3]. বুখারী : ১৬৭৮, মুসলিম : ১২৯৪।
[4]. বুখারী : ১৫৬৪।
[5]. বুখারী : ১৬৭৯, মুসলিস : ১২৯১।
১. হাজী সাহেবের যদি ভয় হয় যে, মুযদালিফায় পৌঁছে তিনি ইশার সময়ের মধ্যে মাগরিব ও ইশার সালাত আদায় করতে পারবেন না, তাহলে পথেই তিনি ইশার সময় থাকতেই মাগরিব ও ইশা একসাথে আদায় করে নেবেন।
২. বর্তমানে মুযদালিফার কিছু অংশ মিনা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ননব্যালটি অধিকাংশ বাংলাদেশী হাজীর মিনার তাঁবু মুযদালিফায় অবস্থিত। এ জায়গাটুকু মিনা হিসেবে ব্যবহৃত হলেও যেহেতু মৌলিকভাবে তা মুযদালিফার অংশ তাই এ অংশে রাত্রিযাপন করলেও মুযদালিফায় রাত্রিযাপন হয়ে যাবে।
৩. অনেক হাজী সাহেব মনে করেন, মুযদালিফা থেকে কঙ্কর কুড়ানো ফযীলতপূর্ণ কাজ। এটা একেবারে ভুল ধারণা। বরং যেখান থেকে সহজ হয় সেখান থেকেই তা সংগ্রহ করা যাবে। তবে বর্তমানে মিনায় গিয়ে কঙ্কর খুঁজে পাওয়া রীতিমতো কষ্টের ব্যাপার। তাই মুযদালিফা থেকে তা কুড়িয়ে নিলে কোনো অসুবিধা নেই।
৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু প্রথম দিনের কঙ্করই মুযদালিফা থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন। তাই শুধু প্রথম দিনের সাতটি কঙ্কর কুড়িয়ে নিলেই হবে। পরবর্তীগুলো মিনা থেকে নিলে চলবে। আর যদি মনে করেন যে, একবারে সব দিনের পাথর নিয়ে নেবেন তবে তাও নিতে পারেন। সে হিসেবে যদি মিনায় ১৩ তারিখ থাকার ইচ্ছা থাকে তবে ৭০টি কঙ্কর নেবেন। নতুবা ৪৯টি পাথর নেবেন। তবে একেবারে সমান সমান না নিয়ে দু’একটি বেশি নেয়া ভাল। কারণ নিক্ষেপের সময় কোনটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে তখন কম পড়ে যাবে। আর সেখানে কঙ্কর পাবেন না।
৫. বুটাকৃতির কঙ্কর নেবেন, যা আঙুল দিয়ে নিক্ষেপ করা যায়।
৬. কঙ্কর পানি দিয়ে ধুতে হবে এমন কোনো বিধান নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঙ্কর ধুয়েছেন বলে কোনো হাদীসে পাওয়া যায় না।
দশম দিবসের ফযীলত :
১. এই দিন ‘ইয়াওমুল হাজ্জিল আকবার’ অর্থাৎ মহান হজের দিন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَأَذَٰنٞ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦٓ إِلَى ٱلنَّاسِ يَوۡمَ ٱلۡحَجِّ ٱلۡأَكۡبَرِ أَنَّ ٱللَّهَ بَرِيٓءٞ مِّنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ وَرَسُولُهُۥۚ﴾ [التوبة: ٣]
‘আর মহান হজের দিনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে লোকদের প্রতি ঘোষণা করে দেয়া হচ্ছে যে, আল্লাহ মুশরিকদের থেকে দায়িত্বমুক্ত এবং তাঁর রাসূলও।’[1]
ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন বলেন,
«أَىُّ يَوْمٍ هَذَا، قَالُوا يَوْمُ النَّحْرِ. قَالَ هَذَا يَوْمُ الْحَجِّ الأَكْبَرِ».
‘এটা কোন দিন?’ তারা বলল, ‘কুরবানীর দিন।’ তিনি বললেন, ‘এটা বড় হজের দিন।’[2] কেননা এই দিনে হজের চারটি মৌলিক কাজ সম্পন্ন করতে হয়। কাজগুলো হলো, বড় জামরায় পাথর মারা; কুরবানী করা, হলক বা কসর করা এবং বায়তুল্লাহ্র ফরয তাওয়াফ করা।
২. এই দিন বছরের সবচে’ বড় তথা মহৎ দিন। আবদুল্লাহ ইবন কুর্ত রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«إِنَّ أَعْظَمَ الأَيَّامِ عِنْدَ اللَّهِ يَوْمُ النَّحْرِ ثُمَّ يَوْمُ الْقَرِّ»
‘আল্লাহ তা‘আলার নিকট সবচে’ বড় দিন হল কুরবানীর দিন তারপর এগারো তারিখের দিন।’[3]
কেননা এই দিনে সালাত ও কুরবানী একত্রিত হয়েছে। এ দু’টি আমল সালাত ও সদকার চেয়ে উত্তম। এ-কারণে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই বলে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘আমি তোমাকে কাওসার[4] দান করেছি, তাই তুমি তোমার রবের সন্তুষ্টি লাভের জন্য শুকরিয়া স্বরূপ সালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর।[5]
[2]. আবূ দাঊদ : ১৯৪৫
[3]. আবূ দাউদ : ১৭৬৫; মুসনাদে আহমদ : ১৯০৯৮।
[4]. অনেক কল্যাণ ও জান্নাতের বিশেষ র্ঝণাধারা। (আদওয়াউল বায়ান তাফসীর গ্রন্থে সূরা কাউসারের ব্যাখ্যা)।
[5]. লাতাইফুল মা‘আরিফ : ২৮২-২৮৩।