হাদী বা কুরবানীর পশু সংক্রান্ত দিক-নির্দেশনা

১. হাদী বা কুরবানীর পশু হতে হবে গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু। যেমন উট, গরু, ভেড়া, ছাগল।

২. উট ও গরুতে সাতজন অথবা তার চেয়ে কমসংখ্যক হাজী শরীক থাকতে পারেন। ছাগল ও ভেড়ায় শরীক হওয়ার সুযোগ নেই। হাজী সাহেবদের জন্য একাধিক হাদী যবেহ করা এমনকি একাধিক কুরবানী করার সুযোগ রয়েছে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজে নিজের পক্ষ থেকে একশত উট যবেহ করেছেন।[1]

৩. পশুর বয়স হতে হবে উটের পাঁচ বছর, গরুর দু’বছর, ছাগলের এক বছর। তবে ভেড়ার বয়স ছয় মাস হলেও চলবে।

৪. যবেহ করার সময় নিম্নোক্ত দো‘আ বলতে হবে,

«بِسْمِ اللَّهِ اللَّهُ أَكْبَرُ ، اللَّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ ، اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنِّي».

(বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাকা, আল্লাহুম্মা তাকাববাল মিন্নী।)

‘আল্লাহ্‌র নামে, আল্লাহ মহান। হে আল্লাহ, আমার পক্ষ থেকে এবং তোমার উদ্দেশ্যে, আল্লাহ, তুমি আমার পক্ষ থেকে কবুল কর’।[2]

৫. হাদী বা কুরবানীর পশু যবেহ বা নহর করার সময় গরু ও ছাগলকে বাম পার্শ্বে কিবলামুখী করে যবেহ করা সুন্নত। আর উটকে দাঁড়ানো অবস্থায় বাম পা বেঁধে নহর করা সুন্নত।[3]

৬. উত্তম হলো, হাজী সাহেব নিজের হাদী নিজ হাতে যবেহ করবেন। তবে বর্তমানে তা অনেকাংশেই সম্ভব হয়ে উঠে না। কারণ যবেহ করার জায়গা অনেক দূরে। তদুপরি সেখানকার রাস্তাঘাট অচেনা। সুতরাং নিজে এ কঠিন কাজটি করতে গিয়ে হজের অন্যান্য ফরয কাজের ব্যাঘাত যেন না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাই হাদী যবেহ করার ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত যেকোন একটি পদ্ধতি অবলম্বন করুন।

  • ব্যাংকের মাধ্যমে হাদী যবেহ করার ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে হজের আগে সৌদি আরবস্থ সরকার অনুমোদিত ব্যাংকের মাধ্যমে হাদীর টাকা জমা দিয়ে তাদেরকে উকীল বানাতে পারেন। তারা সরকারী তত্ত্বাবধানে আলিমদের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী সঠিকভাবে আপনার হাদী যবেহ করার কাজটি সম্পন্ন করবেন। এক্ষেত্রে তারতীব বা সে দিনের কাজগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করার প্রয়োজন নেই। কারণ আপনি উকীল নিযুক্ত করে দায়মুক্ত হয়েছেন। সুতরাং পাথর মারার পর আপনি কোন প্রকার দেরী বা দ্বিধা না করে মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করে হালাল হয়ে যেতে পারবেন। বিশেষ করে আপনি যদি ব্যালটি হাজী হন, তবে এ পদ্ধতিটিই আপনার জন্য বেশি উপযোগী। কেননা ব্যালটি হাজীদের হাদীর টাকা যার যার কাছে ফেরত দেয়া হয়। এ সুযোগে অনেক অসৎ লোক হাজীদের টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য নানা প্রলোভন দেখায়। এতে করে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন।
  • নন-ব্যালটি হাজীগণ বিভিন্ন কাফেলার আওতায় থাকেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রুপ লিডাররা হাদী যবেহ করার দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়ার জন্য করণীয় হলো, বিশ্বস্ত কয়েকজন তরুণ হাজীকে গ্রুপ লিডারের সাথে দিয়ে দেয়া, যারা সরেজমিনে হাদী ক্রয় এবং তা যবেহ প্রক্রিয়া স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবেন এবং অন্যান্য হাজীদেরকে তা অবহিত করবেন।
  • আর যদি মক্কায় কারো বিশ্বস্ত আত্মীয়-স্বজন থাকে, তাহলে তাদের মাধ্যমেও হাদী যবেহ করার কাজটি করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, যার মাধ্যমে হাদী যবেহ করার ব্যবস্থা করছেন, তার যথেষ্ট সময় আছে কি না। কেননা হজ মৌসুমে মক্কায় অবস্থানকারীরা নানা ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।


৭. হাদীস অনুযায়ী হাদী যবেহ করার সময় হচ্ছে চার দিন। কুরবানীর দিন তথা ১০ই যিলহজ এবং তারপর তিনদিন।

৮. উত্তম হলো মিনাতে যবেহ করা। তবে মক্কার হারাম এলাকার ভেতরে যেকোন জায়গায় যবেহ করলে চলবে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«وَكُلُّ مِنًى مَنْحَرٌ وَكُلُّ فِجَاجِ مَكَّةَ طَرِيقٌ وَمَنْحَرٌ»

‘মিনার সব জায়গা কুরবানীর স্থান এবং মক্কার প্রতিটি অলিগলি পথ ও কুরবানীর স্থান।’[4]

৯. কুরবানীদাতার জন্য নিজের হাদীর গোস্ত খাওয়া সুন্নত। কারণ জাবের রা. বর্ণিত হাদীসে এসেছে,

«ثُمَّ انْصَرَفَ إِلَى الْمَنْحَرِ فَنَحَرَ ثَلاَثًا وَسِتِّينَ بِيَدِهِ ثُمَّ أَعْطَى عَلِيًّا فَنَحَرَ مَا غَبَرَ وَأَشْرَكَهُ فِي هَدْيِهِ ثُمَّ أَمَرَ مِنْ كُلِّ بَدَنَةٍ بِبَضْعَةٍ فَجُعِلَتْ فِي قِدْرٍ فَطُبِخَتْ فَأَكَلاَ مِنْ لَحْمِهَا وَشَرِبَا مِنْ مَرَقِهَا»

‘তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পশু যবেহ করার স্থানে গিয়ে তেষট্টিটি উট নিজ হাতে যবেহ করেন। এরপর আলী রা. কে যবেহ করতে দিলেন। আলী রা. অবশিষ্টগুলোকে যবেহ করেন আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলীকে তাঁর হাদীতে শরীক করে নিলেন। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি উট থেকে একটি অংশ কেটে আনতে আদেশ করলেন। এরপর সবগুলো অংশ একসাথে রান্না করা হলো। তিনি তার গোশ্ত খেলেন এবং তার ঝোল পান করলেন।’[5]

১০. হারামের অধিবাসী ও হারামের এরিয়াতে বসবাসকারী মিসকীনদের মধ্যে গোশ্ত বিলিয়ে দেয়া যাবে। তবে কসাইকে এ গোশ্ত দিয়ে তার কাজের পারিশ্রমিক দেয়া যাবে না। বরং অন্য কিছু দিয়ে তার কাজের পারিশ্রমিক দিতে হবে। কিন্তু কসাই যদি গরীব হয়, তাহলে পারিশ্রমিকের সাথে কোনো সম্পর্ক না রেখে তাকে এ গোশ্ত দেয়া যাবে।

১১. তামাত্তু ও কিরান হজকারী যদি হাদী না পায়, কিংবা হাদী ক্রয় করতে সামর্থবান না হয়, তাহলে হজের দিনগুলোতে তিনটি এবং বাড়িতে ফিরে এসে সাতটি, সর্বমোট দশটি রোযা রাখবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَمَن تَمَتَّعَ بِٱلۡعُمۡرَةِ إِلَى ٱلۡحَجِّ فَمَا ٱسۡتَيۡسَرَ مِنَ ٱلۡهَدۡيِۚ فَمَن لَّمۡ يَجِدۡ فَصِيَامُ ثَلَٰثَةِ أَيَّامٖ فِي ٱلۡحَجِّ وَسَبۡعَةٍ إِذَا رَجَعۡتُمۡۗ تِلۡكَ عَشَرَةٞ كَامِلَةٞۗ ذَٰلِكَ لِمَن لَّمۡ يَكُنۡ أَهۡلُهُۥ حَاضِرِي ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِۚ ﴾ [البقرة: ١٩٦]

‘অতপর যে ব্যক্তি উমরার পর হজ সম্পাদনপূর্বক তামাত্তু করবে, সে যে হাদীর পশু সহজ হবে, (তা যবেহ করবে)। কিন্তু যে তা পাবে না সে হজে তিন দিন এবং যখন তোমরা ফিরে যাবে, তখন সাত দিন সিয়াম পালন করবে। এই হল পূর্ণ দশ। এই বিধান তার জন্য, যার পরিবার মসজিদুল হারামের অধিবাসী নয়।’[6]

হজের দিনগুলোতে তিনদিন অর্থাৎ হজের সময় কিংবা হজের মাসে। যেমন যিলহজের ৬,৭, ৮ বা ৭, ৮, ৯ অথবা ১১, ১২, ১৩। তবে কুরবানীর দিন সিয়াম পালন করা যাবে না। বাড়িতে ফিরে এসে সাতটি সিয়াম পালন করবে। এ সাতটি সিয়াম পালনে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা ওয়াজিব নয়। অসুস্থতা বা কোনো উযরের কারণে যদি সিয়াম পালন বিলম্ব হয়, তাহলে দম ওয়াজিব হবে না।

[1]. নিজ হাতে ৬৩ টি অন্যগুলো আলী রা.-এর মাধ্যমে। মুসলিম : ১২১৭।

[2]. মুসলিম : ৩/১৫৫৭; বাইহাকী ৯/২৮৭।

[3]. বুখারী : ৩/৫৫৩; মুসলিম : ২/৯৫৬।

[4]. আবূ দাউদ : ২৩২৪।

[5]. মুসলিম : ৩০০৯।

[6]. বাকারা : ১৯৬।