১. সুন্নত হলো ৯ যিলহজ ভোরে ফজরের সালাত মিনায় আদায় করা।[1] সূর্যোদয়ের পর ‘তালবিয়া’ পড়া অবস্থায় ধীরে সুস্থে আরাফার দিকে রওয়ানা হওয়া। তাকবীর পড়লেও কোনো অসুবিধা নেই। আনাস রা. বলেন,

«كَانَ يُلَبِّي الْمُلَبِّي لاَ يُنْكَرُ عَلَيْهِ وَيُكَبِّرُ الْمُكَبِّرُ فَلاَ يُنْكَرُ عَلَيْهِ».

‘তালবিয়া পাঠকারী তালবিয়া পাঠ করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাতে কোন দোষ মনে করেননি। আবার তাকবীর পাঠকারী তাকবীর পাঠ করতেন। তাতেও তিনি দোষ মনে করেননি।’[2]

২. সুন্নত হলো সূর্য হেলে পড়ার পরে মসজিদে নামিরায় যোহর আসর একসাথে হজের ইমামের পিছনে আদায় করে আরাফার ময়দানে প্রবেশ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যোহরের সময়ের পূর্বে নামিরায় অবস্থান করেছেন। এতে তাঁর জন্য নির্মিত তাবুতে তিনি যোহর পর্যন্ত বিশ্রাম নিয়েছেন। নামিরা আরাফার বাইরে। তবে আরাফার সীমানায় অবস্থিত। অতপর সূর্য হেলে পড়লে তিনি যোহর ও আসরের সালাত যোহরের প্রথম ওয়াক্তে আদায় করে আরাফায় প্রবেশ করেন।’[3]

বর্তমান সময়ে এ সুন্নতের ওপর আমল করা প্রায় অসম্ভব। তবে যদি কারো পথঘাট ভালো করে চেনা থাকে; একা একা আরাফায় সাথিদের কাছে ফিরে আসতে পারবে বলে নিশ্চিত থাকে, অথবা একা একাই মুযদালিফা গমন, রাত্রিযাপন ও সেখান থেকে মিনার তাঁবুতে ফিরে আসার মতো শক্তি-সাহস ও আত্মবিশ্বাস থাকে তবে তার পক্ষে নামিরার মসজিদে এ সুন্নত আদায় করা সম্ভব।

৩. সুন্নত হলো হজের ইমাম হাজীদের উদ্দেশ্যে সময়োপযোগী খুতবা প্রদান করবেন। তিনি এতে তাওহীদ ও ইসলামের প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান সম্পর্কে আলোচনা করবেন। হাজীদেরকে হজের আহকাম সম্পর্কে সচেতন করবেন। তাদেরকে তওবার কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন, কুরআন-সুন্নাহর ওপর অটল থাকার আহবান জানাবেন। যেমনটি করেছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফাতে তাঁর বিদায় হজের খুতবার সময়।

৪. সুন্নত হলো যোহর আসর কসর করে একসাথে যোহরের সময়ে আদায় করা এবং সুন্নত বা নফল কোন সালাত আদায় না করা। এ নিয়ম সব হাজী সাহেবের জন্যই প্রযোজ্য। মক্কাবাসী বা আরাফার আশপাশে বসবাসকারী কিংবা দূরের হাজী সাহেবের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কিরামকে নিয়ে যোহর-আসর কসর করে একসাথে যোহরের সময়ে আদায় করেছিলেন। উপস্থিত সকল হাজী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে কসর করে সে দুই ওয়াক্তের সালাত একসাথে আদায় করেছেন। তিনি কাউকে পূর্ণ সালাত আদায় করার আদেশ দেননি। অবশ্য কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কাবাসিদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,

«يَا أَهْلَ مَكَّةَ ، أَتِمُّوا ؛ فَإِنَّا قَوْمٌ سَفْرٌ».

‘হে মক্কাবাসী, তোমরা (সালাত) পূর্ণ করে নাও। কারণ আমরা মুসাফির।’[4] কিন্তু বিদায় হজের সময় তা বলেননি। তাই বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, এ সময়ের সালাতের কসর ও দুই সালাত জমা‘ তথা একত্র করা সুন্নত। কসর ও জমা‘ না করা অন্যায়। বিদায় হজ সম্পর্কে জাবের রা. বলেন,

«أَنَّ رسول اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَتَى بَطْنَ الوَادِيْ فَخَطَبَ النَّاسَ، ثُمَّ أَذَّنَ، ثُمَّ أَقَامَ فَصَلَّى الظُّهْرَ، ثُمَّ أَقَامَ فَصَلَّى الْعَصْرَ وَلَمْ يُصَلِّ بَيْنَهُمَا شَيْئًا».

‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপত্যকার মধ্যখানে এলেন। তিনি লোকজনের উদ্দেশ্যে খুতবা দিলেন। অতঃপর (বিলাল) আযান ও ইকামত দিলেন এবং তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যোহরের সালাতের ইমামত করলেন। পুনরায় (বিলাল) ইকামত দিলেন এবং তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসরের সালাত আদায় করলেন। এ দু’য়ের মাঝখানে অন্য কোনো সালাত আদায় করলেন না।[5]

৫. ইবন উমর রা. হজের ইমামের পেছনে জামাত না পেলেও যোহর-আসর একসাথে জমা করতেন, সহীহ বুখারীতে একটি বর্ণনা এসেছে,

«وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا إِذَا فَاتَتْهُ الصَّلاَةُ مَعَ الإِمَامِ جَمَعَ بَيْنَهُمَا».

‘ইবন উমর রা. ইমামের সাথে সালাত ছুটে গেলেও দুই সালাত একসাথে পড়তেন।’[6]

প্রসিদ্ধ হাদীস বর্ণনাকারী নাফে‘ রহ. বলেন, ‘ইবন উমর রা. আরাফা দিবসে ইমামকে সালাতে না পেলে, নিজ অবস্থানের জায়গাতেই যোহর-আসর একত্রে আদায় করতেন।’[7]

হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ দুই ইমাম, ইমাম মুহাম্মদ রহ. ও ইমাম আবূ ইউসুফ রহ.ও একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন :

مُحَمَّدٌ قَالَ: أَخْبَرَنَا أَبُوْ حَنِيْفَةَ، عَنْ حَمَّادٍ، عَنْ إِبْرَاهِيْمَ، قَالَ: إِذَا صَلَّيتَ يَوْمِ عَرَفَةَ فِيْ رِحْلِِكَ فَصَلِّ كُلَّ وَاحِدَةٍ مِنَ الصَّلاَتَيْنِ لِوَقْتِهَا، َوتَرْتَحِلُ مِنْ مُنْزِلٍ حَتَّى تَفْرُغَ مِنَ الصَّلاَةِ، قَالَ مُحَمَّدٌ: وَبِهَذَا كَانَ يَأْخُذُ أَبُوْ حَنِيْفَةَ، فَأَمَّا فِيْ قَوْلِنَا فَإِنَّهُ يُصَلِّيْهَا فِيْ رِحْلِهِ كَمَا يُصَلِّيْهَا مَعَ الإِمَامِ، يَجْمَعُهُمَا جَمِيْعًا بِأَذَانٍ وَإِقَامَتَيْنِ، لأَنَّ الْعَصْرَ إِِنَّمَا قُدِّمَتْ لِلْوُقُوْفِ وَكَذَلِكَ بَلَغَنَا عَنْ عَائِشَةَ أُمِّ الْمُؤْمِنِيْنَ، وَعَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ، وَعَنْ عَطَاءَ بْنِ أَبِيْ رَبَاحٍ، وَعَنْ مُجَاهِدٍ .

‘ইমাম মুহাম্মদ রহ. বলেন, (ইমাম) আবূ হানীফা রহ. আমাদেরকে হাম্মাদ-ইবরাহীম সূত্রে অবহিত করেছেন। তিনি বলেন, আরাফার দিন যদি তুমি নিজের অবস্থানের জায়গায় সালাত আদায় কর তবে দুই সালাতের প্রত্যেকটি যার যার সময়ে আদায় করবে এবং সালাত থেকে ফারেগ হয়ে নিজের অবস্থানের জায়গা থেকে প্রস্থান করবে। (ইমাম) মুহাম্মদ রহ. বলেন, (ইমাম) আবূ হানীফা রহ. এ মত গ্রহণ করেন। তবে আমাদের কথা এই যে, (হাজী) তার উভয় সালাত নিজের অবস্থানের জায়গায় ঠিক একইরূপে আদায় করবে যেভাবে আদায় করে ইমামের পেছনে। উভয় সালাতকে এক আযান ও দুই ইকামাতের সাথে একত্রে আদায় করবে। কেননা সালাতুল আসরকে উকুফের স্বার্থে এগিয়ে আনা হয়েছে। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. আবদুল্লাহ ইবন উমর, আতা ইবন আবী রাবাহ ও মুজাহিদ রহ. থেকে এরূপই আমাদের কাছে পৌঁছেছে।’[8]

তাই হজের ইমামের পেছনে জামাতের সাথে সালাত আদায় সম্ভব হোক বা না হোক, সর্বাবস্থায় যোহর-আসর একত্রে পড়া সুন্নত।

৬. হাজীগণ সালাত শেষে আরাফার ভেতরে প্রবেশ না করে থাকলে প্রবেশ করবেন। যারা মসজিদে নামিরাতে সালাত আদায় করবেন তারা এ বিষয়টি অবশ্যই লক্ষ্য রাখবেন। কেননা মসজিদে নামিরার কিবলার দিকের অংশটি আরাফার সীমারেখার বাইরে অবস্থিত। মনে রাখবেন, আরাফার বাইরে অবস্থান করলে হজ হবে না।

৭. অতঃপর দো‘আ ও মুনাজাতে লিপ্ত হবেন। দাঁড়িয়ে-বসে-চলমান তথা সর্বাবস্থায় দো‘আ ও যিকর করতে থাকবেন। সালাত আদায়ের পর থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত দু’হাত তুলে অনুচ্চস্বরে বেশি করে দো‘আ, যিকর ও ইস্তেগফারে লিপ্ত থাকবেন। উসামা ইবন যায়েদ রা. বলেন,

«كُنْتُ رَدِيفَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم بِعَرَفَاتٍ فَرَفَعَ يَدَيْهِ يَدْعُو فَمَالَتْ بِهِ نَاقَتُهُ فَسَقَطَ خِطَامُهَا فَتَنَاوَلَ الْخِطَامَ بِإِحْدَى يَدَيْهِ وَهُوَ رَافِعٌ يَدَهُ الأُخْرَى».

‘আমি আরাফায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর পেছনে উটের পিঠে বসা ছিলাম। তখন তিনি তাঁর দু’হাত তুলে দো‘আ করছিলেন। অতঃপর তাঁর উষ্ট্রী তাঁকে নিয়ে ঝুঁকে পড়ল। এতে তাঁর উষ্ট্রীর লাগাম পড়ে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এক হাত দিয়ে লাগামটি তুলে নিলেন এবং তাঁর অন্য হাত উঠানো অবস্থায়ই ছিল।’[9]

রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,

«خَيْرُ الدُّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ وَخَيْرُ مَا قُلْتُ أَنَا وَالنَّبِيُّونَ مِنْ قَبْلِى. لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِير».

‘উত্তম দো‘আ হচ্ছে আরাফার দিনের দো‘আ; আর উত্তম সেই বাক্য যা আমি ও আমার পূর্ববতী নবীগণ বলেছি, তা হচ্ছে, (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদীর।) ‘আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই, রাজত্ব ও সমস্ত প্রশংসা তাঁর জন্য। তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান।’[10]

কুরআন তিলাওয়াত, ওয়াজ নসীহতের বৈঠকে শরীক হওয়া ইত্যাদিও আরাফায় অবস্থানের আমলের মধ্যে শামিল হবে। তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে কেবল বসে বসে নিম্নস্বরে দো‘আ-যিকর ও কুরআন তিলাওয়াতের নির্দেশ রয়েছে। দিনের শেষ সময়টিকে বিশেষভাবে কাজে লাগাবেন। পুরোপুরিভাবে দো‘আয় মগ্ন থাকবেন।

৮. আরাফার পুরো জায়গাটাই হাজীদের অবস্থানের জায়গা। মনে রাখবেন, উরানা উপত্যকা আরাফার উকূফের স্থানের বাইরে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«كُلُّ عَرَفَةَ مَوْقِفٌ ، وَارْتَفِعُوا عَنْ بَطْنِ عُرَنَةَ»

‘আরাফার সব স্থানই অবস্থানস্থল। তবে বাতনে উরানা থেকে তোমরা উঠে যাও।’[11]

বর্তমান মসজিদে নামিরার একাংশ ও এর পার্শ্বস্থ নিম্ন এলাকাই বাতনে উরনা বা উরনা উপত্যকা। সুতরাং কেউ যেন সেখানে উকূফ না করে। মসজিদে নামিরায় সালাত আদায়ের পর মসজিদের যে অংশ আরাফার ভেতরে অবস্থিত সে দিকে গিয়ে অবস্থান করুন। বর্তমানে মসজিদের ভেতরেই নীল বাতি দিয়ে আরাফা নির্দেশক চি‎হ্ন দেয়া আছে। অতএব এ সম্পর্কে সচেতন থাকুন।

[1]. বর্তমানে হাজীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ফজরের পূর্বেই তাদেরকে আরাফায় নিয়ে যাওয়া হয়। নিশ্চয় এটা সুন্নতের পরিপন্থী। তবে পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে এ সুন্নত ছুটে গেলে কোনো সমস্যা হবে না ইনশাআল্লাহ।

[2]. বুখারী : ৯৭৫; মুসলিম : ১২৮৫।

[3]. বুখারী : ১৬৬০; মুসলিম : ১২১৮।

[4]. বাইহাকী : ৩/১৩৫; মুসনাদ আহমদ : ৪/৪৩২। (হাদীসটির সনদ দুর্বল। তবে মুআত্তা মালেকে এটি উমর রা. থেকে তার কথা হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। তিনি একবার মক্কায় আগমন করে সাথিদের নিয়ে সালাত কসর করে আদায় করেছিলেন। তারপর তার সাথে স্থানীয় যারা সালাত আদায় করেছিল তাদেরকে পূর্ণ করার আদেশ দিয়েছিলেন। মুআত্তা : ১/১৪০, ২০২।)

[5]. মুসলিম : ১২১৮।

[6]. বুখারী : ১৬৬২।

[7]. জা‘ফর আহমদ উসমানী, এ‘লাউসসুনান, ৭/৩০৭৩, দারুল ফিকর, বৈরূত, ২০০১।

[8]. জা‘ফর আহমদ উসমানী, প্রাগুক্ত।

[9]. মুসনাদ আহমদ : ২১৮৭০; সুনানে নাসাঈ : ৩০১১।

[10]. তিরমিযী : ৩৫৭৫।

[11]. মুআত্তা মালেক : ৩০১; মুসনাদে আহমদ : ১৬৭৯৭।