উমরা

বাংলাদেশী হাজীদের অধিকাংশই তামাত্তু হজ করে থাকেন। আর তামাত্তু হজের প্রথম কাজ উমরা আদায় করা। তাই নিম্নে উমরা আদায়ের পদ্ধতি বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

উমরার পরিচয় :

ইহরাম বাঁধা, তাওয়াফ করা, দুই পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়ানো এবং মাথার চুল মুণ্ডানো বা ছোট করা- এই ইবাদত সমষ্টির নাম উমরা। এসবের বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ :

প্রথম. ইহরাম :

যেভাবে ফরয গোসল করা হয় মীকাতে পৌঁছার পর সেভাবে গোসল করা সুন্নত। যায়েদ ইবন সাবিত রা. বর্ণিত হাদীসে যেমন উল্লিখিত হয়েছে :

«أَنَّهُ رَأَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم تَجَرَّدَ لإِهْلاَلِهِ وَاغْتَسَلَ».

তিনি দেখেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরামের জন্য আলাদা হলেন এবং গোসল করলেন।’[1]

ইহরাম-পূর্ব এই গোসল পুরুষ-মহিলা সবার জন্য এমনকি হায়েয ও নিফাসবতী মহিলার জন্যও সুন্নত। কারণ, বিদায় হজের সময় যখন আসমা বিনতে উমাইস রা.-এর পুত্র মুহাম্মদ ইবন আবূ বকর জন্ম গ্রহণ করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উদ্দেশ্যে বলেন,

«اغْتَسِلِى وَاسْتَثْفِرِى بِثَوْبٍ وَأَحْرِمِى».

‘তুমি গোসল করো, কাপড় দিয়ে রক্ত আটকাও এবং ইহরাম বেঁধে নাও।’[2]

অতপর নিজের কাছে থাকা সর্বোত্তম সুগন্ধি মাথা ও দাড়িতে ব্যবহার করবেন। ইহরামের পর এর সুবাস অবশিষ্ট থাকলেও তাতে কোন সমস্যা নেই। আয়েশা সিদ্দিকা রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীস থেকে যেমনটি জানা যায়, তিনি বলেন,

«كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا أَرَادَ أَنْ يُحْرِمَ يَتَطَيَّبُ بِأَطْيَبِ مَا يَجِدُ ثُمَّ أَرَى وَبِيصَ الدُّهْنِ فِى رَأْسِهِ وَلِحْيَتِهِ بَعْدَ ذَلِكَ».

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরামের প্রস্তুতিকালে তাঁর কাছে থাকা উত্তম সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। ইহরামের পরও আমি তাঁর চুল ও দাড়িতে এর তেলের উজ্জ্বলতা দেখতে পেতাম।’[3]

প্রয়োজন মনে করলে এ সময় বগল ও নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবেন; নখ ও গোঁফ কর্তন করবেন। ইহরামের পর যাতে এসবের প্রয়োজন না হয়- যা তখন নিষিদ্ধ থাকবে। এসব কাজ সরাসরি সুন্নত নয়। ইবাদতের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে এসব করা উচিত। ইহরাম বাঁধার অল্পকাল আগে যদি এসব কাজ করে ফেলা হয় তাহলে ইহরাম অবস্থায় আর এসব করতে হবে না। এ থেকে আবার অনেকে ইহরামের আগে মাথার চুল ছোট করাও সুন্নত মনে করেন। ধারণাটি ভুল। আর এ উপলক্ষে দাড়ি কাটার তো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, দাড়ি কাটা সবসময়ই হারাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«خَالِفُوا الْمُشْرِكِينَ وَفِّرُوا اللِّحَى وَأَحْفُوا الشَّوَارِبَ».

‘তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধাচারণ করো। দাড়ি লম্বা করো এবং গোঁফ ছোট করো।’[4]

গোসল, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সুগন্ধি ব্যবহার-এসব পর্ব সমাপ্ত করার পর ইহরামের পোশাক পরবেন। সম্ভব হলে কোন নামাজের পর এটি পরিধান করবেন। যদি এসময় কোন ফরয সালাত থাকে তাহলে তা আদায় করে ইহরাম বাঁধবেন। যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন। নয়তো দু’রাকা‘আত ‘তাহিয়্যাতুল উযু’ সালাত পড়ে ইহরামের কাপড় পরিধান করবেন।

জেনে নেয়া ভালো, পুরুষদের ইহরামের পোশাক হলো, চাদর ও লুঙ্গি। তবে কাপড় দু’টি সাদা ও পরিষ্কার হওয়া মুস্তাহাব। পক্ষান্তরে মহিলারা ইহরামের পোশাক হিসেবে যা ইচ্ছে তা পরতে পারবেন। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে পোশাকটি যেন ছেলেদের পোশাক সদৃশ না হয় এবং তাতে মহিলাদের সৌন্দর্যও প্রস্ফূটিত না হয়। অনুরূপভাবে তারা নেকাব দ্বারা চেহারা আবৃত করবেন না। হাত মোজাও পরবেন না। তবে পর পুরুষের মুখোমুখি হলে চেহারায় কাপড় টেনে দেবেন। ইহরাম অবস্থায় জুতোও পরতে পারবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«وَلْيُحْرِمْ أَحَدُكُمْ فِي إِزَارٍ وَرِدَاءٍ ، وَنَعْلَيْنِ ، فَإِنْ لَمْ يَجِدْ نَعْلَيْنِ فَلْيَلْبَسْ خُفَّيْنِ ، وَلْيَقْطَعْهُمَا حَتَّى يَكُونَا أَسْفَلَ مِنَ الْعَقِبَيْنِ».

‘তোমাদের প্রত্যেকে যেন একটি লুঙ্গি, একটি চাদর ও একজোড়া জুতো পরে ইহরাম বাঁধে। যদি জুতা না থাকে তাহলে মোজা পরবে। আর মোজা জোড়া একটু কেটে নেবে যেন তা পায়ের গোড়ালীর চেয়ে নিচু হয়।’[5]

উল্লিখিত সবগুলো কাজ শেষ হবার পর অন্তর থেকে উমরা শুরুর নিয়ত করবেন। আর বলবেন, لَبَّيْكَ عُمْرَةً (‘লাব্বাইকা উমরাতান’) অথবা لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ عُمْرَةً (‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা উমরাতান’)। উত্তম হলো, বাহনে চড়ার পর ইহরাম বাঁধা ও তালবিয়া পড়া। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মীকাত থেকে রওনা হবার উদ্দেশ্যে বাহনে চড়ে বসেছেন তারপর সেটি নড়ে উঠলে তিনি তালবিয়া পড়া শুরু করেছেন।

আর যে ব্যক্তি উমরার উদ্দেশ্যে ইহরাম বাঁধবে সে যদি রোগ বা অন্য কিছুর আশংকা করেন, যা তার উমরার কাজ সম্পাদনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তাহলে উমরা শুরুর প্রাক্কালে এভাবে নিয়ত করবেন,

«اللَّهُمَّ مَحِلِّي حَيْثُ حَبَسْتَنِي».

(আল্লাহুম্মা মাহাল্লী হায়ছু হাবাসতানী।)

‘হে আল্লাহ, আপনি আমাকে যেখানে আটকে দেবেন, সেখানেই আমি হালাল হয়ে যাব।’[6] অথবা বলবেন,

«لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ ، وَمَحِلِّي مِنَ الأَرْضِ حَيْثُ تَحْبِسُنِي».

(লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, ওয়া মাহাল্লী মিনাল আরদি হায়ছু তাহবিসুনী)

‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। আর যেখানে আপনি আমাকে আটকে দেবেন, সেখানেই আমি হালাল হয়ে যাব।’[7] কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুবা‘আ বিনতে জুবায়ের রা. কে এমনই শিক্ষা দিয়েছেন।

এসব কাজ সম্পন্ন করার পর অধিকহারে তালবিয়া পড়তে থাকুন। কারণ তালবিয়া হজের শব্দগত নিদর্শন। বিশেষত স্থান, সময় ও অবস্থার পরিবর্তনকালে বেশি বেশি তালবিয়া পড়বেন। যেমন : উচ্চস্থানে আরোহন বা নিম্নস্থানে অবতরণের সময়, রাত ও দিনের পরিবর্তনের সময় (সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তকালে), কোন অন্যায় বা অনুচিত কাজ হয়ে গেলে এবং সালাত শেষে- ইত্যাদি সময়ে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তালবিয়া পড়তেন এভাবে :[8]

«لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لاَ شَرِيكَ لَك».

(লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইকা, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি‘মাতা লাকা ওয়াল মুল্ক, লা শারীকা লাক।) কখনো এর সাথে একটু যোগ করে এভাবেও পড়তেন :[9]

لَبَّيْكَ إِلَهَ الْحَقِّ ، لَبَّيْكَ.

(লাব্বাইক ইলাহাল হাক্ক লাব্বাইক)।

ইহরাম পরিধানকারী যদি لَبَّيْكَ ذَا الْمَعَارِجِ (লাব্বাইকা যাল মা‘আরিজ) তালবিয়ায় যোগ করেন, তাও উত্তম। বিদায় হজে সাহাবীরা তালবিয়ায় নানা শব্দ সংযোজন করছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেসব শুনেও তাঁদের কিছু বলেননি।[10]

যদি তালবিয়ায় এভাবে সংযোজন করে :

لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ بِيَدَيْكَ لَبَّيكَ وَالرَّغْبَاءُ إِلَيْكَ وَالْعَمَلُ.

(লাব্বাইক, লাব্বাইকা ওয়া সা‘দাইকা ওয়াল খইরা বিইয়াদাইকা, লাব্বাইকা ওয়ার রগবাউ ইলাইকা ওয়াল আমাল)। তবে তাতেও কোন অসুবিধে নেই। কারণ উমর রা. ও তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ রা. থেকে এ ধরনের বাক্য সংযোজনের প্রমাণ রয়েছে।[11]

পুরুষদের জন্য তালবিয়া উচ্চস্বরে বলা সুন্নত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«أَتَانِى جِبْرِيلُ فَأَمَرَنِى أَنْ آمُرَ أَصْحَابِى وَمَنْ مَعِى أَنْ يَرْفَعُوا أَصْوَاتَهُمْ .بِالإِهْلاَلِ - أَوْ قَالَ – بِالتَّلْبِيَةِ».

‘আমার কাছে জিবরীল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এলেন। তিনি আমাকে (উচ্চস্বরে তালবিয়া পড়তে) নির্দেশ দিলেন এবং এ মর্মে আমার সাহাবী ও সঙ্গীদের নির্দেশ দিতে বললেন যে, তারা যেন ইহলাল অথবা তিনি বলেছেন তালবিয়া উঁচু গলায় উচ্চারণ করে।[12]

তাছাড়া তালবিয়া জোরে উচ্চারণের মাধ্যমে আল্লাহর নিদর্শনের প্রকাশ ঘটে, একত্ববাদের দীপ্ত ঘোষণা হয় এবং শিরক থেকে পবিত্রতা প্রকাশ করা হয়। পক্ষান্তরে মহিলাদের জন্য সকল আলেমের ঐকমত্যে তালবিয়া, যিকির ও দো‘আ ইত্যাদি শাব্দিক ইবাদতে স্বর উঁচু না করা সুন্নত। এটাই পর্দা রক্ষা এবং ফিতনা দমনে সহায়ক।

[1]. তিরমিযী : ৮৩০; ইবন খুযাইমা : ২৫৯৫; বাইহাকী : ৮৭২৬।

[2]. প্রাগুক্ত।

[3]. বুখারী : ৫৯২৩; মুসলিম : ১১৭০।

[4]. বুখারী : ৫৮৯২; মুসলিম : ২৯৫।

[5]. মুসনাদ আহমাদ : ৯৯৮৪; ইবন খুযাইমা : ১০৬২।

[6]. বুখারী : ৫০৮৯; মুসলিম : ১২০৭।

[7]. নাসায়ি : ২৭৬৬।

[8]. বুখারী : ১৫৭৪; মুসলিম : ১২১৮।

[9]. ইবন মাজাহ্‌ : ২৯২০।

[10]. মুসনাদ : ১৪৪৪০।

[11]. বুখারী : ১৫৪৯, মুসলিম : ১১৮৪।

[12]. আবু দাউদ : ১৮১৪।