মানুষের দৃষ্টিতে যদি উদ্দেশ্যকৃত স্থানটি সফর হিসেবে বিবেচিত হয়, তবে তাই তাকে মুসাফির বানাবে। আর তখনই সফরের চারটি রুখসত বা ছাড়ের অধিকারী হবে। সে চারটি বস্তু হচ্ছে:
- কসর তথা চার রাকা‘আত বিশিষ্ট সালাতকে কসর করে দু’ রাকা‘আত পড়া
- জমা তথা দুই সালাতকে এগিয়ে নিয়ে অথবা পিছিয়ে নিয়ে যে কোনো এক ওয়াক্তে আদায় করা।
- মোজার উপর মাসেহ করা, তিন-দিন তিন-রাত্রি পর্যন্ত।
- রমযানের দিনের বেলায় সাওম ভঙ্গ করা।
আর যদি স্থানটি সফরের দূরত্ব কী না এ ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গীগত পার্থক্য দেখা দেয়, অথবা সন্দেহ হয়, তখন দূরত্বের দিকে খেয়াল করতে হবে। তাই দেখতে হবে যদি তোমাদের যাওয়ার স্থানটি তোমাদের সহর থেকে আশি (৮০) কিলোমিটারের অধিক হয়, তাহলে তোমরা মুসাফির বলে বিবেচিত হবে; আর তখন তোমরা উপরোক্ত চারটি রুখসতের অধিকারী হবে। অর্থাৎ দুই সালাতকে জমা করার সুযোগ, চার রাকা‘আত বিশিষ্ট সালাতকে দু’ রাকা‘আতে কসর করার সুযোগ, মোজার উপর তিন-দিন তিন রাত মাসেহ করার সুযোগ এবং রমযানের দিনের বেলায় সাওম ভঙ্গ করার সুযোগ।
আর সফর অবস্থায় কোথাও অবতরণ করলেও তোমরা জমা করা এবং কসর করার সুযোগ পাবে, যদিও তোমরা ভ্রমণরত না থাক। কারণ তোমরা তখনও মুসাফির হিসেবেই খ্যাত থাক, সুতরাং তোমরা সফরের চারটি রুখসত ও ছাড়ের সুযোগ লাভের অধিকারী হবে, যদিও কোথাও সাময়িকভাবে অবস্থান করে থাক। যখন তোমরা জামাআতের সাথে তা আদায় করবে।
এর মধ্যে একটি পার্থক্য এই যে, কসর করা তোমাদের জন্য উত্তম হবে, আর জমা না করা তোমাদের জন্য উত্তম হবে, যদি জমা না করার কারণে কষ্ট অনুভূত না হয়। তবে কষ্ট না থাকলেও জমা করতে দোষ নেই; কারণ তোমাদেরকে তখনও মুসাফিরই বলা হয়ে থাকে।
তার উপর কর্তব্য হচ্ছে সে সালাতকে পূর্ণরূপে আদায় করা। সালাত আদায় করার অবস্থাই এখানে ধর্তব্য হবে। কারণ সে এখন মুকীম বা অবস্থানকারী। তাছাড়া সফরের কারণ তার কাছ থেকে তিরোহিত হয়েছে। আর এটাই শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. এর পছন্দনীয় মত।
তার জন্য কসর করা বিধি-সম্মত। কারণ সে সালাত আদায়ের সময় মুসাফির অবস্থায় আছে। আর এটাই শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যার পছন্দ করা মত।
তখন মুসাফিরের উপর কর্তব্য হবে সে সালাতটি পূর্ণরূপে আদায় করা। সে সালাতের শুরু থেকে পেলো নাকি কেবল এক রাকা‘আত পেলো অথবা দুই রাকা‘আত বা তিন রাকা‘আত পেলো এতে কোনো তারতম্য হবে না। তখন মুসাফিরের জন্য কসর করা জায়েয হবে না। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যেমনটি বুখার ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে,
«إنما جعل الإمام ليؤتم به فلا تختلفوا عليه»
“ইমাম তো নির্ধারণ করা হয়েছে তাকে অনুসরণ অনুকরণ করার জন্য, সুতরাং তোমরা তার সাথে ভিন্নমত করো না”।
তাছাড়া ইমাম মুসলিম ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন, যখন তাক জিজ্ঞেস করা হলো, মুসাফিরের বিধান এমন কেনো যে সে যখন একা পড়ে তখন কসর করে কিন্তু (মুকীম) ইমামের পিছনে চার রাকা‘আত পড়ে? তখন তিনি বললেন,
«تلك هي السنة»
“এটাই হচ্ছে সুন্নাহ তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ”।
তার উপর কর্তব্য হচ্ছে সে সালাত পরিপূর্ণরূপে আদায় করা। সুতরাং যখন মুসাফির ইমাম দু’ রাকা‘আত আদায় করে সালাম ফিরাবে তখন মুকীমের উপর আবশ্যক হচ্ছে বাকী দু’ রাকা‘আত নিজে আদায় করা; যাতে সে তার সালাতকে চার রাকা‘আত বিশিষ্ট করতে পারে।
এখানে একটি নিয়মনীতি জানা দরকার তা হচ্ছে, মুক্তাদী সর্বাবস্থায় তার ইমামের সাথে পূর্ণ সালাত আদায় করবে। তাই
- যদি ইমাম মুকীম হয় আর মুক্তাদীও মুকীম হয় তবে মুক্তাদীর উপর সালাত পূর্ণরূপ আদায় করা ওয়াজিব।
- যদি ইমাম মুকীম হয় আর মুক্তাদী মুসাফির হয়, তবে মুক্তাদীর উপর সালাত পূর্ণরূপ আদায় করা ওয়াজিব।
- যদি ইমাম মুসাফির হয় আর মুক্তাদী হয় মুকীম, তবে মুক্তাদীর উপর ওয়াজিব হচ্ছে পূর্ণ সালাত আদায় করা।
তবে এক অবস্থা এর ব্যতিক্রম, তা হচ্ছে, যদি ইমাম মুসাফির হয় আর মুক্তাদীও মুসাফির হয় আর তারা উভয়ে কসর করতে চান, তখন মুক্তাদী কসর করবেন।
বিশুদ্ধ মত হচ্ছে যে, তিনি ইমামের সাথে ইশার সালাতে প্রবেশ করবেন তবে তিনি নিয়্যত করবেন মাগরিবের সালাতের। এখানে ইমাম ও মুক্তাদীর মধ্যকার নিয়্যতের ভিন্নতা হলেও তাতে কোনো ক্ষতি নেই। সুতরাং যখন ইমাম সাহেব তিন রাকা‘আত আদায় করে চতুর্থ রাকা‘আতের জন্য দাঁড়াবেন, তখন মুক্তাদী বসে পড়বে এবং তাশাহহুদ পড়ে নিবে, আর এমতাবস্থায় তার জন্য দু’টি কাজের একটি করার এখতিয়ার থাকবে, হয় সে বসা অবস্থায় ইমামের অপেক্ষা করবে অতঃপর যখন ইমাম চতুর্থ রাকা‘আত পড়ে এসে সালাম ফিরাবে তখন সেও সালাম ফিরাবে অথবা তার জন্য ইমামের পূর্বেই সালাম ফিরিয়ে ফেলা বৈধ হবে। আর এটি শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যা এর পছন্দনীয় মত।
সে ইমামের সাথে যোহরের সালাতের নিয়তে প্রবেশ করবে, আর সে সে সালাতকে পরিপূর্ণরূপে আাদায় করবে, কোনোরূপ কসর করে নয়। কারণ এ দু’ সালাতের মধ্যে কার্যগত কোনো পার্থক্য নেই। উভয়ের রাকা‘আত সংখ্যা একই, আর তাদের মধ্যে পদ্ধতিগত কোনো পার্থক্যও নেই। আর শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. এ মতটি পছন্দ করেছেন।
এমতাবস্থায় তার উপর পূর্ণরূপ সালাত আদায় করা আবশ্যক নয়, বরং সে কসর করবে, যদিও সে সালাতের শুরু থেকে কসরের নিয়্যত করে নি। কারণ মুসাফিরের সালাতের ব্যাপারে মূল কথা হচ্ছে কসর করা। যেমন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«فرضت الصلاة ركعتين ركعتين في الحضر والسفر فأقرت صلاة السفر وزيد في صلاة الحضر»
“সালাত প্রথমে ভ্রমণ ও অবস্থানকালীন অর্থাৎ সর্বাবস্থায় দু’ রাকা‘আত দু’রাকা‘আত করে ফরয হয়েছিল, অতঃপর সফরের সালাতকে তার অবস্থায় রেখে দেওয়া হয় কিন্তু অবস্থানকালীন সময়ের সালাতে বৃদ্ধি ঘটে।”
আর এ মতটি শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. পছন্দ করেছেন।
তার উপর কর্তব্য হচ্ছে দ্বিতীয় রাকাআতের বসায় ফিরে যাওয়া। কারণ এ লোকটি দু’ রাকা‘আত সালাত আদায় করার জন্যই সালাতে প্রবেশ করেছে, সুতরাং সে দু’ রাকা‘আতই পড়বে, এর বেশি করা তার জন্য জায়েয নেই। সুতরাং তার উপর কর্তব্য হচ্ছে তৃতীয় রাকা‘আত থেকে ফিরে গিয়ে সালাত ফিরানো এবং সালামের পরে সাজদায়ে সাহু প্রদান করবে, কারণ সে সালাতে বর্ধিত কাজ করেছে।
আর এটা শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যা রহ. এর অভিমত।
তাদের সাথে সালাতে প্রবেশ করার আবশ্যকতা তার উপর নেই। কারণ সে সালাত আদায় করে নিয়েছে এবং নিজের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে পেরেছে। সুতরাং তার উপর কর্তব্য নয় তাদের সাথে সালাত আদায় করা; কারণ সে তা আদায় করে নিয়েছে এবং পূর্ববর্তী সালাতে সাথে আগাম জমা করেছে। তবে যদি সে তাদের সাথে নফল সালাতের নিয়্যতে প্রবেশ করে এবং তার থেকে সন্দেহ-সংশয় দূর করতে চায় তবে তা উত্তম।
আর এ মতটি শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. পছন্দ করেছেন।