মানুষ সভ্য জাতি। সৌন্দর্যের সাথে সৌরভ মানুষের মনে আনন্দ আনে। যেমন নিজে আনন্দ পাওয়া যায়, তেমনি অপরকেও আনন্দ দেওয়া যায়, আকৃষ্ট করা যায়। এ জন্যই ইসলামী শরীয়তে নারী-পুরুষ সকলের জন্য সুগন্ধি ব্যবহার বৈধ। আল্লাহর রসূল (ﷺ) আতর ব্যবহার করতেন এবং তিনি তা খুব পছন্দ করতেন।
তিনি বলেন, ‘‘তোমাদের দুনিয়ার মধ্যে আমার কাছে স্ত্রী ও খোশবুকে প্রিয় করা হয়েছে। আর নামাযকে করা হয়েছে আমার চক্ষুশীতলতা।’’[1]
অবশ্য এই ব্যবহারের রয়েছে কিছু বিধান।
স্ত্রীর মন আকর্ষণ করার জন্য আতর ব্যবহার বিধেয়। যেহেতু স্বামী-স্ত্রীর মনই এক অপরকে নানাভাবে আকর্ষণ করে। আর বিশেষ করে আতর তাদের প্রেমের সমুদ্রে জোয়ার আনে।
যেমন সমাজে যেতে হলে সৌন্দর্য অবলম্বনের সাথে সাথে সুগন্ধি ব্যবহার বিধেয়। ঈদের জামাআতে হাজির হতে খোশবু ব্যবহার বিধেয়।
ইমাম মালেক বলেন, ‘আমি আহলে ইল্মদের কাছে শুনেছি, তাঁরা প্রত্যেক ঈদে সাজসজ্জা ও সুগন্ধি ব্যবহারকে মুস্তাহাব মনে করতেন।’
জুমআর জামাআতে হাজির হওয়ার জন্যও আতর ব্যবহার বিধেয়।
রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘‘প্রত্যেক সাবালকের জন্য জুমআর দিন গোসল করা, মিসওয়াক করা এবং যথাসাধ্য সুগন্ধি ব্যবহার করা কর্তব্য।’’[2]
আল্লাহর রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি জুমআর দিন গোসল করে, তার স্ত্রীর সুগন্ধি (আতর) থাকলে তা ব্যবহার করে, উত্তম লেবাস পরিধান করে, অতঃপর (মসজিদে এসে) লোকেদের কাতার চিরে (আগে অতিক্রম) করে না এবং ইমামের উপদেশ দানকালে কোন বাজে কর্ম করে না, সে ব্যক্তির জন্য তা উভয় জুমআর মধ্যবর্তী কৃত পাপের কাফ্ফারা হয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি অনর্থক কর্ম করে এবং লোকেদের কাতার চিরে সামনে অতিক্রম করে সে ব্যক্তির জুমআহ যোহরে পরিণত হয়ে যায়।’’[3]
বিশেষ বিশেষ জায়গায় শরীয়ত আমাদেরকে সুগন্ধি ব্যবহার করতে নিষেধ করে। যেমন হজ্জ বা উমরাহ করতে গিয়ে ইহরাম অবস্থায় সর্বপ্রকার সুগন্ধি ব্যবহার নিষিদ্ধ।
সেন্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখার বিষয় যে, সেন্টে যেন কোহল বা স্পিরিট মিশ্রিত না থাকে; থাকলে তা ব্যবহার (অনেকের নিকট) বৈধ নয়।[4] অবশ্য এমন সময় ঐ শ্রেণীর সেন্ট্ দেহে ব্যবহার করা দূষণীয় নয়, যে সময় ব্যবহারের পর তা গোসলের মাধ্যমে ধোয়া যাবে।
যে সুগন্ধিতে রঙ আছে, তা পুরুষের জন্য নিষিদ্ধ। রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘‘(রহমতের) ফিরিশ্তাবর্গ তিন ব্যক্তির নিকটবর্তী হন না; নাপাক ব্যক্তি, নেশাগ্রস্ত (মাতাল) ব্যক্তি এবং খালূক মাখা ব্যক্তি।’’[5]
খালূক জাফরান প্রভৃতি থেকে প্রস্ত্তত মহিলাদের ব্যবহার্য একপ্রকার সুগন্ধিদ্রব্য বিশেষ। এটি ব্যবহার করলে দেহে বা পোশাকে লালচে হলুদ রং প্রকাশ পায়। তাই তা পুরুষদের জন্য ব্যবহার নিষিদ্ধ।
পরিশেষে বলি যে, বাহ্যিক সাজ-সজ্জার সাথে সাথে মানুষকে নিজ হৃদয় ও রসনার সৌন্দর্যের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা উচিত। নচেৎ বাহ্যিক চমকের কোন দাম থাকে না। মুখ খুললেই তার আসল রূপ ধরা পড়ে যায়। আর তখন তার বাহ্যিক সাজ-সজ্জা তার জন্য হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়।
জালিনুস এক ব্যক্তিকে দেখলেন, খুব আভিজাত্যসম্পন্ন পোশাক পরে আছে, কিন্তু কথা বলার সময় ভুল বলছে। তা দেখে তিনি তাকে বললেন, ‘তুমি যে শ্রেণীর কাপড় পরে আছ ঠিক তেমন ভাবের কথাবার্তা বল, নচেৎ এমন শ্রেণীর কাপড় পর, যেমন ভাবের তোমার কথাবার্তা।’
যেমন কারো বাহ্যিক রূপ-সজ্জা দেখে ধোকা খাওয়াও উচিত নয়। যেহেতু অনেক মানুষ আছে যাদের বাহ্যিক রূপ না থাকলেও আভ্যন্তরিক রূপ অনেক। পক্ষান্তরে আর এক শ্রেণীর মানুষ আছে ঠিক এর বিপরীত; যাদের বাহ্যিক রূপের বাহার আছে, কিন্তু ভিতরে সে বড় কুৎসিত। অথচ একটা কুৎসিত মনের চাইতে কুৎসিত চেহারা অনেক ভালো।
একদা নাখ্খার উযরী হযরত মুআবিয়ার নিকট এলেন। তাঁর গায়ে ছিল একটি আলখাল্লা। তা দেখে মুআবিয়ার মনে যেন তাচ্ছিল্য ভাব এল। নাখ্খার সে কথা তাঁর চেহারায় অনুমান করে নিলেন ও বললেন, ‘হে আমীরুল মু’মেনীন! এ আলখাল্লা আপনার সাথে কথা বলবে না, আপনার সাথে কথা বলবে তার পরিধায়ী।’ অতঃপর তিনি এমন সুন্দর কথা বললেন, যাতে হযরত মুআবিয়া মুগ্ধ হলেন। তারপর যখন নাখ্খার উঠে গেলেন, তখন তিনি বললেন, ‘এমন মানুষ কখনো দেখিনি, যে প্রথমে ঘxণ্য হয় এবং পরে সম্মানার্হ হয়।’
সত্যই তো সুন্দর পোশাক পরিহিত ব্যক্তি মাত্রই ভদ্রলোক নয়। সুতরাং লোকের পরহেযগারীর পোশাক দেখে ধোকা খাবেন না, গোড়ালীর অনেক উপরে কাপড় পরা দেখে অবাক হবেন না এবং কপালে সিজদার কালো দাগ দেখে চমকিত হবেন না। বরং সংসার ও টাকা-পয়সার ব্যাপারে দেখুন, তার পরহেযগারী কতটুক?
এক ব্যক্তি হযরত উমারকে বলল, অমুক লোকটা বড় খাঁটি লোক। তিনি বললেন, তা তুমি কিরূপে জানলে? ওর সাথে কোন সময় সফর করেছ? বলল, না। বললেন, তোমার ও ওর মাঝে কোনদিন তর্ক বা মতবিরোধ হয়েছিল? বলল, না। বললেন, ওর কাছে কোনদিন কিছু আমানত রেখেছিলে? বলল, না। বললেন, তাহলে ওর সম্পর্কে তুমি কিছুই জান না। আমার মনে হয়, তুমি ওকে মসজিদে মাথা হিলাতে দেখেছ।[6]
আবার বলি যে, মানুষের বেশভূষা ও বাহ্যিক আড়ম্বর দেখে ধোকা খাওয়া উচিত নয়। মুর্দার উপর বহু মূল্যের কাফন থাকলে কি তার মান বাড়ে?
[2]. মুসলিম আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা হা/৮৪৬
[3]. আবূ দাঊদ, ইবনে খুযাইমাহ, সহীহ তারগীব ৭২০
[4] (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ ২০/১৮৫, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ ১/২০৩
[5]. বায্যার, সহীহ তারগীব ১৬৭
[6]. উয়ূনুল আখবার ৩/১৫৮