খারিজী ও বাতিনীগণ কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করলেও সাধারণ মানুষদের মধ্যে তাদের বিভ্রান্তি প্রভাব ফেলতে পারে নি। কিন্তু বর্তমানে একদিকে বিশ্বব্যাপী মুসলিম নিধন, মুসলিম দেশগুলিতে ধার্মিক মানুষদের প্রতি বৈষম্য, হয়রানি ও জুলুম, ইসলামী অনুশাসন বিষয়ক দাবিদাওয়াকে গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে দমন করার প্রচেষ্টা, অন্যদিকে তেমনি ইসলাম সম্পর্কে আবেগ ও ভালবাসার পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণের ব্যবহারিক সুন্নাত সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবে তাদের উগ্র মতামত সমাজের অনেক ধার্মিক মানুষকে প্রভাবিত করছে। নিঃসন্দেহে কুরআন ও হাদীস ইসলামী জ্ঞানের মূল উৎস এবং প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব নিজে কুরআন ও হাদীস অধ্যয়ন করে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা। সকল মুসলিম কুরআন-হাদীস অধ্যয়ন করবেন, কিন্তু সকল মুসলিমই বিশেষজ্ঞ হবেন না।
আরবী ভাষার গভীর জ্ঞান, কুরআনের পরিপূর্ণ অধ্যয়ন, বিশাল হাদীস ভান্ডারের সকল হাদীস অধ্যয়ন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীগণের কর্ম, চিন্তা, মতামত ও কুরআন-হাদীস ব্যাখ্যার প্রক্রিয়া অধ্যয়ন ও সমস্যা সমাধানে সাহাবী, তাবিয়ী ও তাবিতাবিয়ীগণের মতামত ও কর্মধারা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভের পরেই একজন মানুষ প্রকৃত আলিম ও ফকীহ বলে গণ্য হন এবং ব্যক্তিগত, সামাজিক বা রাষ্ট্রিয় সমস্যার ক্ষেত্রে ইসলামী ‘ফাতওয়া’ বা সিদ্ধান্তদানের যোগ্যতা অর্জন করেন। স্বভাবতই এরূপ আলিমদের সংখ্যা সমাজে কম থাকে। এজন্য মুসলিম উম্মাহর আলিমগণের রীতি হলো, জটিল সমস্যার ক্ষেত্রে সমকালীন প্রাজ্ঞ আলিমগণের মতামত গ্রহণের পাশাপাশি পূর্ববর্তী প্রখ্যাত আলিম, ফকীহ ও ইমামদের মতামতের অনুসন্ধান ও তাদের মতামতের আলোকে সিদ্ধান্ত প্রদান। এক্ষেত্রে তাঁরা কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনার আলোকে সাহাবীগণ ও তাঁদের পরবর্তী দুই প্রজন্মের আলিমদের মতামতের বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন।
এ মূলনীতি লঙ্ঘন করার কারণেই এ সকল উগ্র মতের জন্ম হয়। প্রাচীন ও নব্য খারিজীগণ সাহাবীগণের এবং তাঁদের পরে সমাজের মূলধারার আলিমগণের মতামত গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। নিজেদের মতামতকেই তারা চূড়ান্ত বলে মনে করেছে। তবে তারা এরূপ মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির বিশেষ ক্ষমতা বা আল্লাহর সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক, কাশফ, ইলহাম, গোপন জ্ঞান ইত্যাদির কোনো দাবি করে নি। বাতিনীগণ ও শীয়াগণও সর্বদা সাহাবী, তাবিয়ী ও সমাজের মূলধারার মুসলিম আলিমগণকে অবজ্ঞা ও ঘৃণা করেছে এবং কুরআন বা ইসলাম সম্পর্কে নিজেদের ‘‘বুঝ’’ই চূড়ান্ত বলে মনে করেছে। পাশাপাশি তারা বিশেষ ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ গোপন জ্ঞান, কাশফ, ইলহাম, ইলকা, ইলম-লাদুন্নী, আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্ক বা বিশেষ ‘পদাধিকার’ দাবি করেছে। ফলে এ সকল কল্পিত নেতা বা নেতাদের নামে অন্য কেউ তাদের কঠিন বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত করেছে। উভয় পদ্ধতিতেই তাদের মধ্যে ধার্মিকতা, ধর্মপালন ও ধর্মজ্ঞান সম্পর্কে অপ্রতিরোধ্য ‘অহঙ্কার’ সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে তারা ইসলাম সম্পর্কে তাদের বা তাদের নেতৃবৃন্দের ব্যাখ্যা বা মতকেই চূড়ান্ত সত্য বলে গ্রহণ করে বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হয়েছে। বর্তমানে সঠিক ইসলামী শিক্ষার অনুপস্থিতি, বিশেষত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাদির বিষয়ে সঠিক ধারণার অনুপস্থিতিতে আবেগতাড়িত ধ্যানধারণার প্রসারের বিশেষ প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে:
(ক) গত প্রায় অর্ধ-সহস্র বৎসর যাবৎ মুসলিম উম্মাহর সকল দেশেই ইসলামী শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক মানগত অবনতি ঘটেছে। বিশেষত উপনিবেশাধীন সমাজে এবং এর পরে ‘ইসলামী শিক্ষার’ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত মাদ্রাসগুলির শিক্ষার মান কমেছে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমর্থনের অভাব, মেধাবী শিক্ষার্থীর অভাব, গবেষণা উপকরণ ও পরিবেশের অভাব ইত্যাদি কারণে এ সকল প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া অধিকাংশেরই ইসলামী জ্ঞানের গভীরতা কম। সমাজ ও রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক সমর্থন ও মূল্যায়নের অভাবে গবেষণার সুযোগ থেকে তাঁরা বঞ্চিত। পূর্ববর্তী আলিমগণ যে সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন সেগুলি পাঠ ও মুখস্থ করা হলেও, আধুনিক সমস্যাবলিতে ইজতিহাদ ও সমাধান দেওয়ার যোগ্যতা গড়ে তোলার মত কোনো পরিবেশ বা ব্যবস্থা এ সকল প্রতিষ্ঠানে নেই বললেই চলে।
(খ) এ সকল ট্রেডিশনাল আলিমের পাশাপাশি বর্তমান যুগে আরেক শ্রেণীর ইসলামী চিন্তাবিদ রয়েছেন। এরা হচ্ছেন সে সকল ‘সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাপ্রাপ্ত’ শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা সাধারণ মানুষ জীবনের মাঝপথে এসে ধর্ম বিমুখতা থেকে ধার্মিকতার দিকে ফিরে আসেন। এ পর্যায়ে তাঁরা কুরআন, হাদীস ও ইসলামের ইতিহাস চর্চা শুরু করেন। এরা মূলত মেধাবী। এক সময়ে এদের অনেকে তাঁদের মেধা, মনন ও বুদ্ধি দিয়ে কুরআন-হাদীসের বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও ‘ফাতওয়া’ দিতে শুরু করেন। স্বভাবতই তাঁরা বিশাল হাদীস ভান্ডার, সাহাবীগণের কর্মপদ্ধতি ও পূর্ববর্তী আলিমগণের মতামত কিছুই জানেন না বা জানার গুরুত্বও অনুভব করেন না। এ সকল চিন্তাবিদদের মধ্যে যারা আরব তারা সমকালীন আরবী ভাষা জানলেও কুরআন, হাদীস ও ইসলামী ফিকহের পরিভাষার সাথে ততটা পরিচিত নন। বিশেষ করে তাফসীর, হাদীস, ও ফিকহের বিশাল ভান্ডার তাদের কাছে একেবারেই অপরিচিত। আর এদের মধ্যে যারা অনারব তাদের অবস্থা আরো শোচনীয়। কুরআন-হাদীস বুঝার ক্ষেত্রে তাঁরা মূলত অনুবাদ বা অনুবাদকের ‘‘বুঝ’-এর উপরেই নির্ভর করেন। তাঁদের জানা কুরআনের আয়াত এবং সীমিত কিছু হাদীসের শাব্দিক অর্থের সাথে নিজেদের জ্ঞান, বুদ্ধি ও মননশীলতার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তাঁরা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রদান করতে থাকেন। তাঁদের বাগ্মিতা, আধুনিক জগত ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁদের গভীর জ্ঞান সাধারণ মুসলিমদেরকে আকৃষ্ট করে। আধুনিক বিষয়াদি সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞান ও পান্ডিত্য অনেক হলেও আরবী ভাষা, কুরআন, হাদীস, সাহাবীগণের কর্মধারা ও প্রাচীন ইমামগণের মতামতের বিষয়ে তাঁদের জ্ঞানের দৈন্যতা সুস্পষ্ট।
(গ) অধিকাংশ ক্ষেত্রে উভয় শ্রেণীর আলিম ও গবেষক একে অপরকে ভাল চোখে দেখেন না। এছাড়া সাধারণভাবে আলিমউলামা ও গবেষকদের মধ্যে মতবিনিময়, গবেষণা, আলোচনা ইত্যাদির সুযোগ ও আগ্রহ নেই বললেই চলে। ফলে আধুনিক রাষ্টব্যবস্থা, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, নির্বাচন, উপনিবেশোত্তর মুসলিম দেশগুলির ইসলামী অবস্থান, এগুলিতে পরিপূর্ণ ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি, এ সকল রাষ্ট্রের প্রতি মুসলিম নাগরিকের সম্পর্ক, রাষ্ট্র বা সরকারের দীন বিরোধী কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা ও ইসলামী সমাধান প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। প্রত্যেকেই কুরআন ও হাদীস থেকে অল্প বা বেশি উদ্ধৃতি প্রদান করে একটি মত প্রকাশ করছেন। প্রায় সকল ক্ষেত্রে দলিল প্রদান প্রক্রিয়া খারিজীগণের মত হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ কিছু আয়াত ও হাদীসের আলোকে মতামত প্রকাশ করা হলেও, যে বিষয়ে মতামত প্রকাশ করা হচ্ছে, অনুরূপ কোনো বিষয় বা অবস্থা রাসূলুল্লাহ (ﷺ), সাহাবীগণ বা তাবিয়ীগণের সময়ে ছিল কিনা এবং সেক্ষেত্রে তারা কি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সেগুলি বিবেচনা করা হচ্ছে না। এভাবে ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন বিকৃত ধারণা জন্ম নিচ্ছে, যা ইসলামের নামে উগ্রতা সৃষ্টিতে সহায়তা করছে।
(ঘ) উপরের বিষয়গুলির পাশাপাশি রাষ্ট্র, প্রশাসন ও সমাজের অনাচার, পাপ, দুর্নীতি, নগ্নতা, অশ্লীলতা, জুলুম-অত্যাচার ইত্যাদির ক্ষেত্রে অনেক আলিমের নীরবতা ও আলিম-উলামা ও পীর-মাশাইখের পারস্পারিক মতভেদ, দলাদলি ও গালাগালি সমাজের আবেগী যুবকদের হতাশ ও বিক্ষুদ্ধ করে তোলে। এ অবস্থায় উগ্রতার আহবানকারীদের নিষ্ঠা, সততা ও নির্ভীকতা তাদেরকে আকৃষ্ট করে। খারিজীগণ, বাতিনী শিয়াগণ ও জামা‘আতুল মুসলিমীন-এর বিভ্রান্তিআমরা কুরআন কারীম, সুন্নাতে নববী, সাহাবায়ে কেরামের কর্মপদ্ধতি এবং পূর্ববর্তী ইমাম, আলিম ও পীব-মাশাইখের কর্মধারার আলোকে পর্যালোচনা করতে চাই। কারণ ইসলামের নামে উগ্রতায় লিপ্ত মানুষদের তাত্ত্বিক বিভ্রান্তিগুলি প্রায় সবই একই প্রকৃতির। আমরা আল্লাহর তাওফীক প্রার্থনা করছি।
পূর্বোক্ত বিভ্রান্ত গোষ্ঠীগুলির মতামত ও দাবি-দাওয়া পর্যালোচনা করলে আমরা কয়েকটি বিষয় দেখতে পাই:
(১) নিজের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেয়ে অন্যের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া
(২) করণীয় ও বর্জনীয়ের মধ্যে পার্থক্য না বুঝা
(৩) ইসলামী শিক্ষার বিকৃত অনুধাবন ও উপস্থাপন।