আমরা আগেই বলেছি, ধর্মীয় অনুভূতি মানুষের জন্মগত বা সহজাত অনুভূতি। একে নির্মূল করা যায় না এবং নির্মূলের প্রচেষ্টা বুমেরাং হয়। একে সঠিক ও স্বাভাবিক খাতে প্রবাহিত না করতে পারলে তা কখনো কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা বা অনৈতিকতার জন্ম দেয় এবং কখনো উগ্রতার জন্ম দেয়। এগুলির অপসারণ বা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রেক্ষাপটগুলি অনুধাবন প্রয়োজন। আমরা দেখেছি যে, বিশ্বব্যপী মুসলিম নিধন, প্রতিকারের সকল পথ রুদ্ধ হওয়া, হতাশা ও পরিবর্তনের আবেগ অনেক মুসলিমকে উগ্রতার পথ বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করছে। কখনো বা মুমিন পারিপার্শিক অত্যাচার বা নিধনযজ্ঞের প্রতিকার করার কোনো পথ না পেয়ে উগ্র হয়ে পড়েন এবং উগ্রতার পক্ষে কিছু ‘‘দলিল-প্রমাণ’’ খুঁজে নেন। কখনো বা একজন মুসলিম নিজের আবেগে পড়াশোনা করতে যেয়ে এরূপ ব্যাখ্যা ও উগ্রতার মধ্যে নিপতিত হন। এরপর তিনি হয়ত অন্যদেরকেও প্রভাবিত করেন। কখনো বা অন্যের মুখে এরূপ ব্যাখ্যা শুনে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। কখনো বা কোনো ব্যক্তি নিজের ব্যক্তিগত বা দলগত স্বার্থ অর্জন করতে
ইসলামী শিক্ষার বিকৃত উপস্থাপনের মাধ্যমে এরূপ উগ্রতার প্রসার ঘটাতে চেষ্টা করেন।
এছাড়া আমরা জানি যে,, ইহূদী ও খৃস্টান পন্ডিতগণও কুরআন ও হাদীস ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন করেছেন। তাদের পক্ষেও কুরআনের কিছু আয়াত, কিছু হাদীস বা কিছু ফিকহী মতামত বিকৃৃতভাবে উপস্থাপন করে অজ্ঞ আবেগী যুবকদেরকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব। আমরা দেখেছি যে, মুসলিম দেশগুলিকে অশান্ত করে তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক প্রবৃদ্ধি থামিয়ে দেওয়া, সভ্যতার সংঘাতের থিওরির সত্যতা প্রমাণ করা, ‘‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’’ বা জঙ্গিবাদ দমনের নামে মুসলিম দেশগুলিকে দখল করা বা অধীনত রাখা, জঙ্গিবাদ দমনের নামে মুসলিম দেশগুলিতে ইসলামী মূল্যবোধ, ধর্মীয় অনুশাসন ও ইসলামী শিক্ষা সংকোচন করা, ধার্মিক মুসলিম ও আলিমগণের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করা ইত্যাদি বহুবিধ উদ্দেশ্যে ইহূদী-খৃস্টান ও ইসলামবিদ্বেষী পন্ডিতগণ বা সংস্থা ইসলামের ছদ্মাবরণে এরূপ বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করতে পারেন। ইসলামী শিক্ষার এ ধরনের বিকৃতি রোধে বিকৃতি সংশিষ্ট সকল বিষয়ে কুরআন, হাদীস, সাহাবীগণ ও তাঁদের পরের সকল যুগের আলিমগণের মতামত ও কর্মধারার আলোকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সমকালীন আলিম-উলামা, পীর-মাশাইখ, গবেষক ও সমাজসেবকদের সামষ্টিক চেষ্টা প্রয়োজন।
এখানে লক্ষণীয় যে, বিকৃতি সংশিষ্ট বিষয়গুলি আধুনিক। এ সকল বিষয়ে কুরআন, হাদীস ও পূর্ববর্তী আলিমগণের সুস্পষ্ট বা দ্ব্যর্থহীন শিক্ষা ও মতামত না পাওয়াই স্বাভাবিক। যেমন, উপনিবেশোত্তর মুসলিম দেশগুলির বিধান, সমকালীন প্রেক্ষাপটে দারুল ইসলাম বা ইসলামী রাষ্ট্রের পরিচয়, ধর্মরিনপেক্ষ অমুসলিম দেশগুলির বিধান, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, পার্লামেন্ট, সার্বভৌমত্ব, ভোট ব্যবস্থা, এগুলিতে অংশ গ্রহণ বা বর্জন, সমকালীন মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের নেতৃত্বে জিহাদের বিধান, বিদেশী আগ্রাসনের শিকার মুসলিম দেশগুলির আগ্রাসন বিরোধী আন্দোলনের বিধান, এরূপ ক্ষেত্রে সশস্ত্র প্রতিরোধের বিধান ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক সমাধান দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। এ সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতভেদ বা ভুল সিদ্ধান্ত অনেক মানুষকে কঠিন পাপের মধ্যে নিপতিত করতে পারে এবং উম্মাতের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে।
আমরা লক্ষ্য করি যে, এ সকল বিষয়ে সমাজের প্রাজ্ঞ ও সুপ্রসিদ্ধ পীর-মাশাইখ, আলিম ও মুফতীগণের মতামত কম পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে ‘‘চিন্তাবিদ’’ ও ‘‘আবেগী মুজাহিদগণ’’ এ সকল বিষয়ে ঝটপট অনেক সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেন। অনেকেই গতানুগতিক বা ‘ট্রেডিশনাল’ আলিম ও বুজুর্গদের দুর্বলতা বা অজ্ঞতাকে এর কারণ হিসেবে মনে করেন। অনেকে মনে করেন সমাজের সব অন্যায় মেনে নেওয়ার মানসিকতাই এর জন্য দায়ী। এরূপ মত নিঃসন্দেহে অজ্ঞতা ও আবেগপ্রসূত জুলম। বিগত দেড় হাজার বৎসর দীনের ঝান্ডাকে ধরে রেখেছেন আলিমগণ। তাঁদেরই মাধ্যমে আমরা দীন পেয়েছি। সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা সোচ্চার থেকেছেন। তবে সোচ্চার হওয়ার পদ্ধতিতে বিভিন্নতা ছিল। বস্ত্তত এ সকল আধুনিক বিষয়ে ‘‘ট্রেডিশনাল’’ আলিম ও মুফতীগণের সুস্পষ্ট মতামত না থাকার কারণ আধুনিক হওয়াতে এগুলির বিষয়ে কুরআন-হাদীস ও পূর্ববর্তী আলিমগণের সুস্পষ্ট মতামত পাওয়া যায় না। আর প্রাজ্ঞ আলিমগণ এরূপ সুস্পষ্ট মতামতের বাইরে ঝটপট কোনো সিদ্ধান্ত দিতে দ্বিধা করেন। পক্ষান্তরে একজন ‘‘চিন্তাবিদ’’ বা ‘‘আবেগী’’ মানুষ সাধারণত কুরআন হাদীসের দু একটি সাধারণ বক্তব্যকেই তার মত প্রকাশের জন্য যথেষ্ঠ বলে গণ্য করেন; কাজেই সাহাবী-তাবিয়ীগণের মতামত বা পূর্ববর্তী ফকীহগণের মতামতের জন্য তিনি অপেক্ষা করেন না। এমনকি আয়াত বা হাদীসটি কতখানি প্রাসঙ্গিক বা তার বিপরীতে অন্য কোনো আয়াত বা হাদীস রয়েছে কিনা তাও তত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেন না। আলিমগণের মতামত ধীর হলেও তাতে ভুলের সম্ভাবনা কম থাকে। আর চিন্তাবিদ বা আবেগী মানুষের মতামত খুবই দ্রুত ও সুস্পষ্ট হলেও তাদের ভুলের সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি।এছাড়া আমরা সমাজ সংস্কারে পূর্ববতী আলিম-উলামা ও পীর-মাশাইখের কর্মপদ্ধতি পর্যালোচনা করলে দেখব যে, তাঁরা সর্বদা বিনম্রতা, ওয়ায-নসীহত ও জনমত তৈরির মাধ্যমে তা করতে চেষ্টা করেছেন, কখনোই দ্রুত ফল লাভের জন্য ব্যস্ত হন নি। তাদের কর্মধারার আলোকেই সমকালীন প্রসিদ্ধ আলিমগণ মতামত ব্যক্ত করেন। দ্রুত ফললাভে আগ্রহী আবেগী মানুষদের কাছে মনে হয়, এরূপ মতামত ‘‘সবকিছু মেনে নেওয়ার’’ শামিল। এভাবে কি আর কিছু পরিবর্তন করা যাবে? এদের কাছে চিন্তাবিদ ও আবেগী তরুণ মুফতীদের মতামত বেশি পছন্দনীয় বলে মনে হয়।
সকল আবেগ ও চাপের বাইরে থেকে কুরআন, হাদীস, সাহাবীগণের ও তৎপরবর্তী যুগের আলিমগণের কর্মধারার ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে এ সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। দ্রুত ফললাভ, প্রতিশোধ বা অন্য কোনো আবেগের অধীনে অথবা দেশ, দল, গোষ্ঠী বা কারো চাপের অধীনে কুরআন হাদীসের একপেশে সিদ্ধান্ত নিলে তা সঠিক হবে না এবং সংশিষ্ট মানুষদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। উপরন্তু সিদ্ধান্ত ও মতামত প্রাসঙ্গিক তথ্যসমৃদ্ধ হতে হবে। এ ছাড়া যে সকল আয়াত ও হাদীসকে বিকৃতির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয় সেগুলির বিস্তারিত পর্যালোচনা প্রয়োজন।
বর্তমান যুগে এককভাবে গ্রহণযোগ্য আলিম যেমন দুর্লভ, তেমনি এ সকল বিষয়ে এককভাবে ইজতিহাদ করার মত যোগ্যতাসম্পন্ন আলিমও দুর্লভ। এজন্য এ সকল বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আলিম ও ইসলামী চিন্তাবিদগণের মতবিনিময় ও সমবেত ইজতিহাদ প্রয়োজন। সমাজের গতানুগতিক অনেক বিষয়ের পাশাপাশি এ সকল বিষয়ে প্রাজ্ঞ আলিমগণের মতপ্রকাশ খুবই জরুরী। উম্মাতের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা ও দরদ নিয়ে আলিমগণকে একত্রে বসে মতবিনিময়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হবে। সমবেত মতবিনিময়ে নিজের মত, অভিরুচী, প্রয়োজন ও স্বার্থের ঊধ্বে উম্মাতের বৃহত্তর কল্যাণে পূর্ববর্তী ইমাম ও আলিমগণের কর্মধারার আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রথম চার প্রজন্মের এবং বিশেষ করে তিন প্রজন্মের নির্ভরযোগ্যতার সাক্ষ্য দিয়েছেন। এরা হলেন সাহাবীগণ, তাঁদের ছাত্রগণ (তাবিয়ীগণ), তাঁদের ছাত্রগণ (তাবি-তাবিয়ীগণ) ও তাদের ছাত্রগণ (আতবা আতবায়িত তাবিয়ীন)। দীনের সকল বিষয়ে, বিশেষত মতভেদীয় ও জটিল বিষয়ে এ তিন ও চার প্রজন্মের আলিম, ফকীহ, ইমাম ও বুজুর্গগণের মতামতের ও কর্মধারার আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অতীব প্রয়োজন।