খারিজী, বাতিনী, জামাআতুল মুসলিমীন ও অন্যান্য সকল বিভ্রান্ত দল ও গোষ্ঠীর বিভ্রান্তির মূল কারণ দীন পালনে ‘‘সুন্নাতের’’ প্রতি অবহেলা। সুন্নাতের অর্থ, পরিচয়, গুরুত্ব ও প্রয়োগ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘‘এহইয়াউস সুনান’’ গ্রন্থে। এখানে আমরা সংক্ষেপে বলতে পারি যে, সুন্নাত অর্থ কর্মে ও বর্জনে রাসুলুল্লাহ (ﷺ)এর হুবহু অনুকরণ করা। রাসুলুল্লাহ (ﷺ)এর সুন্নাতের ব্যাখ্যায়, পালনে ও পদ্ধতি গ্রহণে খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবীগণের পদ্ধতিও সুন্নাত। কখনোই কোনোভাবে মুমিন নিজেকে সাহাবীগণ ও প্রথম প্রজন্মগুলির মানুষদের চেয়ে অধিক ঈমানদার, অধিক আমলকারী, ইসলাম সম্পর্কে অধিক অভিজ্ঞ বা ইসলাম বুঝার ক্ষেত্রে অধিক অগ্রসর বলে কল্পনা করতে পারেন না।
যে কথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যেভাবে যতটুকু বলেছেন ততটুকুই বলা, যে কর্ম তিনি যেভাবে যতটুকু গুরুত্ব দিয়ে যে পরিমাণ করেছেন ততটুকু গুরুত্ব দিয়ে সে পরিমান করা, যে কথা তিনি বলেন নি এবং যে কর্ম তিনি করেন নি তা না বলা ও না করাই সুন্নাত। কথায়, কর্মে, পালনে ও বর্জনে রাসুলুল্লাহ (ﷺ)হুবহু অনুকরণই সুন্নাত। তিনি যা বলেন নি তা বলা এবং তিনি যা করেন নি তা করা সুন্নাতের ব্যতিক্রম বা খিলাফে সুন্নাত। যে ইবাদত তিনি উন্মুক্তভাবে পালন করেছেন, অর্থাৎ কোনো নিয়ম, সময় বা রীতি নির্দিষ্ট করে দেন নি, সে ইবাদত উন্মুক্তভাবে পালন করাই সুন্নাত। কোনো নিয়ম, রীতি বা পদ্ধতিকে উক্ত ইবাদতের অংশ বলে গণ্য করা খিলাফে সুন্নাত। তিনি যা বলেন নি বা করেন নি এবং বলতে বা করতে নিষেধও করেন নি তা সুন্নাতের ব্যতিক্রম হলেও জায়েয হতে পারে। আর তিনি যা বলেন নি বা করেন নি এবং বলতে বা করতে নিষেধ করেছেন তা না-জায়েয বা অবৈধ। সুন্নাতের ব্যতিক্রম জায়েয বিষয় মুমিন প্রয়োজনে করতে পারেন, তবে তাকে দীনের অংশ বলে কল্পনা করতে পারেন না। সুন্নাতের ব্যতিক্রম বা সুন্নাতের অতিরিক্ত কোনো কথা, কর্ম বা পদ্ধতিকে ঈমান, আকীদা, দীন বা ইবাদতের অংশ বলে গণ্য করা থেকেই সকল বিপর্যয় ও বিভ্রান্তির শুরু।
কুরআন-হাদীস থেকে কোনো ইবাদতের নির্দেশনা গ্রহণ করলেই হবে না, উপরন্তু সে ইবাদত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কিভাবে পালন করেছেন তা জানতে হবে এবং অবিকল তাঁরই অনুকরণে পালন করতে হবে। প্রয়োজনে উপকরণ বা জাগতিক বিষয়ে সুন্নাতের ব্যতিক্রম কোনো বিষয় বলা বা করা যেতে পারে, তবে তাকে উক্ত ইবাদতের অংশ হিসেবে গণ্য করা যাবে না এবং যথাসম্ভব সীমিত পর্যায়ে তা ব্যবহার করতে হবে। এ সকল বিষয় অগণিত উদাহরণসহ বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘‘এহইয়াউস সুনান’’ গ্রন্থে। জঙ্গিবাদ, চরমপন্থা বা উগ্রতা মূলত ইসলামের একটি ইবাদতকে কেন্দ্র করে আবর্তিত, তা হলো: ‘‘অন্যের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা’’। ন্যায়ের আদেশ, অন্যায়ের নিষেধ, দাওয়াত, জিহাদ, বিচার, দীন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি নামে এ ইবাদত পালিত হয়। বিভ্রান্তিতে নিপতিত মানুষেরা এ সকল ইবাদত পালনের নির্দেশ এবং এগুলির ফযীলত বিষয়ক আয়াত ও হাদীস গ্রহণ করেছেন, নিজেদের বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন এবং পালনের পদ্ধতি তৈরি করেছেন। এ সকল ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণের হুবহু অনুকরণের চেষ্টা করেন নি।
সালাত, সিয়াম, যিকর, জানাযা ইত্যাদির ন্যায় দাওয়াত, জিহাদ, দীন প্রতিষ্ঠা, আদেশ, নিষেধ ইত্যাদিও ইবাদত। সকল ইবাদতই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে পালন করেছেন। সাহাবীগণ তাঁর থেকে সরাসরি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন ও পালন করেছেন। পরবর্তী দু প্রজন্ম- যাদের নির্ভরযোগ্যতার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাক্ষ্য দিয়েছেন- তাঁরাও এ সকল ইবাদত পালন করেছেন। আমরা যদি এ সকল ইবাদত সঠিকভাবে পালন করতে চাই, তাহলে আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে যে, আমরা যে ইবাদতের যে নামকরণ করছি, যে গুরুত্ব প্রদান করছি তা তারা করেছেন কিনা? আমরা যে পদ্ধতিকে ইবাদতের অংশ মনে করছি তা তারা করেছেন কিনা? আমরা যে পরিস্থিতিতে যে কথা বলছি বা যে কর্ম করছি সেরূপ পরিস্থিতি বা তার কাছাকাছি পরিস্থিতি তাদের কারো যুগে বিদ্যমান ছিল কিনা? এরূপ পরিস্থিতিতে তারা কি করেছেন? কিভাবে করেছেন?
বিভ্রান্তিতে নিপতিত মানুষেরা এ সকল বিষয় গভীরভাবে জানার কোনো চেষ্টা করেন নি। ফলে তারা বিশ্বাসগত, গুরুত্বগত বা পদ্ধতিগত বিভ্রান্তি ও বিদআতের মধ্যে নিপতিত হয়েছেন। আমরা পরবর্তী পরিচ্ছেদে সুন্নাতের আলোকে তাদের বিভ্রান্তিগুলি অনুধাবনের চেষ্টা করব।