মুসলিম বলতেই সবারই এ কথা জানা উচিৎ যে, বিষ যেমন শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর তেমনিভাবে গুনাহ্ও অন্তরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তবে তাতে ক্ষতির তারতম্য অবশ্যই রয়েছে। এমনকি দুনিয়া ও আখিরাতে যত অকল্যাণ অথবা ব্যাধি রয়েছে তার মূলে রয়েছে গুনাহ্ ও পাপাচার।
এরই কারণেই আদম ও হাউওয়া’ বা হাওয়া (আলাইহিমাস্ সালাম) একদা জান্নাত থেকে বের হতে বাধ্য হন।
এরই কারণে শয়তান ইব্লীস আল্লাহ্ তা‘আলার রহমত থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়।
এরই কারণে নূহ্ (আঃ) এর যুগে বিশ্বব্যাপী মহা প্লাবন দেখা দেয় এবং কিছু সংখ্যক ব্যক্তি ও বস্ত্ত ছাড়া সবই ধ্বংস হয়ে যায়।
এরই কারণে ’হূদ্ (আঃ) এর যুগে ধ্বংসাত্মক বায়ু প্রবাহিত হয় এবং সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যায়।
এরই কারণে সা’লিহ্ (আঃ) এর যুগে ভয়ঙ্কর চিৎকার শুনে সবাই হৃদয় ফেটে অথবা হৃদয় ছিঁড়ে মারা যায়।
এরই কারণে লুত্ব (আঃ) এর যুগে তাঁরই আবাসভূমিকে উল্টিয়ে তাতে পাথর নিক্ষেপ করা হয় এবং শুধু একজন ছাড়া তাঁর পরিবারের সকলকেই রক্ষা করা হয়। আর অন্যরা সবাই দুনিয়া থেকে একেবারেই নির্মূল হয়ে যায়।
এরই কারণে শু‘আইব (আঃ) এর যুগে আকাশ থেকে আগুন বর্ষিত হয়।
এরই কারণে ফির‘আউন ও তার বংশধররা লোহিত সাগরে ডুবে মারা যায়।
এরই কারণে ক্বারূন তার ঘর, সম্পদ ও পরিবারসহ ভূমিতে ধসে যায়।
এরই কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা বনী ইস্রাঈল তথা ইহুদিদের উপর এমন শত্রু পাঠিয়ে দেন যারা তাদের এলাকায় ঢুকে তাদের ঘর-বাড়ি ধ্বংস করে দেয়, তাদের পুরুষদেরকে হত্যা করে, তাদের মহিলা ও বাচ্চাদেরকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের সকল সম্পদ লুটে নেয়। এভাবে একবার নয়। বরং দু’ দু’ বার ঘটে। পরিশেষে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে কসম করে বলেন:
«وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكَ لَيَبْعَثَنَّ عَلَيْهِمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَنْ يَّسُوْمُهُمْ سُوْءَ الْعَذَابِ».
‘‘(হে নবী!) তুমি স্মরণ করো সে সময়ের কথা যখন তোমার প্রভু ঘোষণা করলেন, তিনি অবশ্যই কিয়ামত পর্যন্ত ইহুদিদের প্রতি এমন লোক পাঠাবেন যারা ওদেরকে কঠিন শাস্তি দিতে থাকবে’’। (আ’রাফ : ১৬৭)
ইব্নু ‘আববাস্ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) গুনাহ্’র অপকার সম্পর্কে বলেন: হে গুনাহ্গার! তুমি গুনাহ্’র কঠিন পরিণাম থেকে নিশ্চিন্ত হয়ো না। তেমনিভাবে গুনাহ্’র সঙ্গে যা সংশ্লিষ্ট তার ভয়াবহতা থেকেও। গুনাহ্’র চাইতেও মারাত্মক এই যে, তুমি গুনাহ্’র সময় ডানে-বামের লেখক ফিরিশ্তাদের লজ্জা পাচ্ছো না। তুমি গুনাহ্ করে এখনো হাসছো অথচ তুমি জানো না যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তোমার সাথে কিয়ামতের দিন কি ব্যবহার করবেন। তুমি গুনাহ্ করতে পেরে খুশি হচ্ছো। গুনাহ্ না করতে পেরে ব্যথিত হচ্ছো। গুনাহ্’র সময় বাতাস তোমার ঘরের দরোজা খুলে ফেললে মানুষ দেখে ফেলবে বলে ভয় পাচ্ছো অথচ আল্লাহ্ তা‘আলা যে তোমাকে দেখছেন তা ভয় করছো না। তুমি কি জানো আইয়ূব (আঃ) কি দোষ করেছেন যার দরুন আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে কঠিন রোগে আক্রান্ত করেন এবং তাঁর সকল সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়। তাঁর দোষ এতটুকুই ছিলো যে, একদা এক মযলুম তথা অত্যাচারিত ব্যক্তি যালিমের বিরুদ্ধে তাঁর সহযোগিতা চেয়েছিলো। তখন তিনি তার সহযোগিতা করেননি এবং অত্যাচারীর অত্যাচার তিনি প্রতিহত করেননি। তাই আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে উক্ত শাস্তি দিয়েছেন।
এ কারণেই ইমাম আওযায়ী (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: গুনাহ্ যে ছোট তা দেখো না বরং কার শানে তুমি গুনাহ্ করছো তাই ভেবে দেখো।
ফুযাইল বিন্ ’ইয়ায (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: তুমি গুনাহ্কে যতই ছোট মনে করবে আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট তা ততই বড় হয়ে দেখা দিবে। আর যতই তুমি তা বড় মনে করবে ততই তা আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট ছোট হয়ে দেখা দিবে।
কখনো কখনো গুনাহ্’র প্রতিক্রিয়া দ্রুত দেখা যায় না। তখন গুনাহ্গার মনে করে থাকে যে, এর প্রতিক্রিয়া আর দেখা যাবে না। তখন সে উক্ত গুনাহ্’র কথা একেবারেই ভুলে যায়। অথচ এটি একটি মারাত্মক ভুল চিন্তা-চেতনা।
আবুদ্দারদা’ (রাঃ) বলেন: তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলার ইবাদত এমনভাবে করো যে, তোমরা তাঁকে দেখতে পাচ্ছো। নিজকে সর্বদা মৃত বলে মনে করো। এ কথা সর্বদা মনে রাখবে যে, যথেষ্ট পরিমাণ স্বল্প সম্পদ অনেক ভালো এমন বেশি সম্পদ থেকে যা মানুষকে বেপরোয়া করে তোলে। নেকী কখনো পুরাতন হয় না এবং গুনাহ্ কখনো ভুলা যায় না। বরং উহার প্রতিক্রিয়া অনিবার্য।
জনৈক বুযুর্গ ব্যক্তি একদা এক অল্প বয়স্ক ছেলের প্রতি দৃষ্টিপাত করে তার সৌন্দর্য সম্পর্কে ভাবতেছিলেন। তখন তাকে স্বপ্নে বলা হলো যে, তুমি এর পরিণতি চল্লিশ বছর পরও দেখতে পাবে।
১. গুনাহ্গার ব্যক্তি ধর্মীয় জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ, ধর্মীয় জ্ঞান হচ্ছে নূর বা আলো যা আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর ইচ্ছানুযায়ী যে কারোর অন্তরে ঢেলে দেন। আর গুনাহ্ সে নূরকে নিভিয়ে দেয়।
২. গুনাহ্গার ব্যক্তি গুনাহ্’র কারণে রিযিক থেকে বঞ্চিত হয়।
সাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
إِنَّ الرَّجُلَ لَيُحْرَمُ الرِّزْقَ بِالذَّنْبِ يُصِيْبُهُ.
‘‘নিশ্চয়ই কোন ব্যক্তি গুনাহ্’র কারণেই রিযিক থেকে বঞ্চিত হয়’’।
(হা’কিম ১৮১৪, ৬০৩৮; আহমাদ ২২৪৪০, ২২৪৬৬, ২২৪৯১; আবূ ইয়া’লা ২৮২; ইব্নু মাজাহ্ ৮৯, ৪০৯৪)
ঠিক এরই বিপরীতে আল্লাহ্ভীরুতাই রিযিক বর্ধনের কারণ হয়। সুতরাং রিযিক পেতে হলে গুনাহ্ অবশ্যই ছাড়তে হবে। উল্লেখ্য যে, কারো কারোর নিকটে উক্ত হাদীস শুদ্ধ নয়।
৩. গুনাহ্’র কারণে গুনাহ্গারের অন্তরে এক ধরনের বিক্ষিপ্ত ভাব সৃষ্টি হয়। যার দরুন আল্লাহ্ তা‘আলা ও তার অন্তরের মাঝে এমন এক দূরত্ব জন্ম নেয় যার ক্ষতিপূরণ আল্লাহ্ তা‘আলা না চায় তো কখনোই সম্ভব নয়।
৪. গুনাহ্’র কারণে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নেককার লোকদের মাঝে ও গুনাহ্গারের মাঝে বিরাট এক দূরত্ব জন্ম নেয়। যার দরুন সে কখনো তাদের নিকটবর্তী হতে চায় না। বরং সর্বদা সে শয়তান প্রকৃতির লোকদের সাথেই উঠা-বসা করা পছন্দ করে। কখনো এ দূরত্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে, তার স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন কিছুই তার ভালো লাগে না। বরং পরিশেষে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়ায় যে, ধীরে ধীরে নিজের উপরও তার এক ধরনের বিরক্তি ভাব জন্ম নেয়। যার পরিণতি কখনোই কারোর জন্য সুখকর নয়।
তাই তো কোন এক বুযুর্গ বলেছিলেন: আমি যখন গুনাহ্ করি তখন এর প্রতিক্রিয়া আমার আরোহণ এমনকি আমার স্ত্রীর মধ্যেও দেখতে পাই।
৫. গুনাহ্’র কারণে গুনাহ্গারের সকল কাজকর্ম তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। ঠিক এরই বিপরীতে কেউ আল্লাহ্ তা‘আলাকে সত্যিকারার্থে ভয় করলে আল্লাহ্ তা‘আলা তার সকল কাজ সহজ করে দেন।
৬. সত্যিকারার্থেই গুনাহ্’র কারণে গুনাহ্গারের অন্তর ধীরে ধীরে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলার আনুগত্য হচ্ছে এক ধরনের নূর। আর গুনাহ্ হচ্ছে এক ধরনের অন্ধকার। উক্ত অন্ধকার যতই বাড়বে তার অস্থিরতাও ততই বাড়বে। তখন সে বিদ্‘আত, শির্ক, কুফর সবই করে ফেলবে অথচ সে তা একটুও টের পাবে না। কখনো কখনো উক্ত অন্ধকার তার চোখেও ছড়িয়ে পড়ে। তখন তা কালো হতে থাকে এবং তার চেহারাও।
এ কারণেই আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আববাস্ (রা.) বলেন: কোন নেক কাজ করলে চেহারায় উজ্জলতা ফুটে উঠে। অন্তরে আলো জন্ম নেয়। রিযিকে সচ্ছলতা, শরীরে শক্তি ও মানুষের ভালোবাসা অর্জন করা যায়। আর গুনাহ্ করলে চেহারা কালো, অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। রিযিকে ঘাটতি আসে এবং মানুষের অন্তরে তার প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষভাব জন্ম নেয়।
৭. ধীরে ধীরে গুনাহ্’র কারণে গুনাহ্গারের অন্তর ও শরীর জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়ে। অন্তরের শীর্ণতা তো একেবারেই সুস্পষ্ট। আর শরীরের জীর্ণতা তো এভাবেই যে, মু’মিনের সত্যিকার শক্তি তো অন্তরেই। যখনই তার অন্তর শক্তিশালী হবে তখন তার শরীরও শক্তিশালী হবে। আর গুনাহ্গার ব্যক্তি তাকে দেখতে যতই শক্তিশালী মনে হোক না কেন কাজের সময় ঈমানদারদের সম্মুখে সে অত্যন্তই দুর্বল। তাই ইসলামী ইতিহাস পড়লে দেখা যায়, পারস্যবাসী ও রোমানরা যতই শক্তিশালী থেকে থাকুক না কেন ঈমানদারদের সম্মুখে তারা এতটুকুও টিকতে পারে নাই।
৮. গুনাহ্গার ব্যক্তি গুনাহ্’র কারণে আল্লাহ্ তা‘আলার আনুগত্য তথা নেক কাজ থেকে বঞ্চিত হয়। নেক কাজের কোন উৎসাহ্ই তার মধ্যে জন্ম নেয় না। আর জন্ম নিলেও তাতে তার মন বসে না। যেমন: কোন রোগী কোন খানা খেয়ে দীর্ঘ সময় অসুস্থ থাকলে অনেক ধরনের ভালো খানা থেকে সে বঞ্চিত হয়।
৯. গুনাহ্ বয়স বা উহার বরকত কমিয়ে দেয় যেমনিভাবে নেক কাজ বয়স বা উহার বরকত বাড়িয়ে দেয়।
সাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
لَا يَرُدُّ الْقَدَرَ إِلاَّ الدُّعَاءُ، وَلَا يَزِيْدُ فِيْ الْعُمْرِ إِلاَّ الْبِرُّ.
‘‘ভাগ্য (যা পরিবর্তন যোগ্য) একমাত্র দো‘আই পরিবর্তন করতে পারে এবং বয়স বা উহার বরকত নেক কাজ করলেই বেড়ে যায়’’।
(হা’কিম ১৮১৪, ৬০৩৮; আহমাদ ২২৪৪০, ২২৪৬৬, ২২৪৯১; আবূ ইয়া’লা ২৮২; ইব্নু মাজাহ্ ৮৯, ৪০৯৪)
জীবন বলতে আত্মার জীবনকেই বুঝানো হয়। আর আত্মার জীবন বলতে সে জীবনকেই বুঝানো হয় যা আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য ব্যয়িত হয়। নেক কাজ, আল্লাহ্ভীরুতা ও তাঁরই আনুগত্য এ জীবনকে বাড়িয়ে দেয়।