إِنَّ الْـحَمْدَ للهِ، نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنَعُـوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا، وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَّهْدِهِ اللهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُّضْلِلِ اللهُ فَلَا هَادِيَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ.
নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য। আমরা সবাই তাঁরই প্রশংসা করছি, তাঁরই নিকট সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তাঁরই নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি প্রবৃত্তির অনিষ্ট ও খারাপ আমল থেকে। যাকে আল্লাহ্ তা‘আলা হিদায়াত দিবেন তাকে পথভ্রষ্ট করার আর কেউ নেই এবং যাকে আল্লাহ্ তা‘আলা পথভ্রষ্ট করবেন তাকে হিদায়াত দেয়ারও আর কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া সত্য কোন মা’বূদ নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্ তা‘আলার বান্দাহ্ ও একমাত্র তাঁরই প্রেরিত রাসূল।
আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষের উপর যা যা ফরয করে দিয়েছেন তা অবশ্যই করতে হবে এবং যা যা হারাম করে দিয়েছেন তা অবশ্যই ছাড়তে হবে।
আবূ সা’লাবাহ্ খুশানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
إِنَّ اللهَ فَرَضَ فَرَائِضَ فَلَا تُضَيِّعُوْهَا، وَحَرَّمَ حُرُمَاتٍ فَلَا تَنْتَهِكُوْهَا، وَحَدَّ حُدُوْدًا فَلَا تَعْتَدُوْهَا، وَسَكَتَ عَنْ أَشْيَاءَ مِنْ غَيْرِ نِسْيَانٍ، فَلَا تَبْحَثُوْا عَنْهَا.
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা কিছু কাজ ফরয তথা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন যার প্রতি তোমরা কখনোই অবহেলা করবে না এবং আরো কিছু কাজ তিনি হারাম করে দিয়েছেন যা তোমরা কখনোই করতে যাবে না, আরো কিছু সীমা (তা ওয়াজিব, মুস্তাহাব, মুবাহ্ যাই হোক না কেন) তিনি তোমাদেরকে বাতলিয়ে দিয়েছেন যা তোমরা কখনোই অতিক্রম করতে যাবে না। তেমনিভাবে তিনি কিছু ব্যাপারে চুপ থেকেছেন (তা ইচ্ছে করেই) ভুলে নয়। সুতরাং তোমরা তা খুঁজতে যাবে না’’।
(দারাক্বুত্বনী/ আর্-রাযা’ ৪২; ত্বাবারানী/ কাবীর ৫৮৯; বায়হাক্বী ১৯৫০৯)
অনুরূপভাবে আল্লাহ্ তা‘আলা যা যা হালাল করে দিয়েছেন তা হালাল বলে মনে করতেই হবে এবং যা যা তিনি হারাম করে দিয়েছেন তা হারাম মনে করে অবশ্যই বর্জন করতে হবে।
আবুদ্দারদা’ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
مَا أَحَلَّ اللهُ فِيْ كِتَابِهِ فَهُوَ حَلَالٌ، وَمَا حَرَّمَ فَهُوَ حَرَامٌ، وَمَا سَكَتَ عَنْهُ فَهُوَ عَافِيَةٌ فَاقْبَلُوْا مِنَ اللهِ الْعَافِيَةَ، فَإِنَّ اللهَ لَمْ يَكُنْ نَسِيًّا، ثُمَّ تَلَا هَذِهِ الْآيَةَ: «وَمَا كَانَ رَبُّكَ نَسِيًّا».
‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা কুর‘আন মাজীদে যা যা হালাল করে দিয়েছেন তাই হালাল এবং যা যা হারাম করে দিয়েছেন তাই হারাম। আর যে সম্পর্কে তিনি চুপ থেকেছেন তা মানুষের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে বিশেষ ছাড় (যা করাও যাবে ছাড়াও যাবে, তা নিয়ে তেমন কোন চিন্তাও করতে হবে না)। সুতরাং তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে সেগুলোকে সেভাবেই গ্রহণ করো। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা ভুলে যাওয়ার নন। অতঃপর তিনি উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করেন যার অর্থ: তোমার প্রভু কখনো ভুলে যাওয়ার নন’’। (হা’কিম ২/৩৭৫)
হারাম কাজগুলোকেও কুর‘আনের ভাষায় ‘‘’হুদূদ’’ বলা হয় যা করা তো দূরের কথা বরং তার নিকটবর্তী হওয়াও নিষিদ্ধ।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«تِلْكَ حُدُوْدُ اللهِ فَلَا تَقْرَبُوْهَا»
‘‘এগুলো আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে বাতলানো সীমা। অতএব তোমরা সেগুলোর নিকটেও যাবে না’’। (বাক্বারাহ : ১৮৭)
যারা আল্লাহ্ তা‘আলার বাতলানো সীমা অতিক্রম করবে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে জাহান্নামের হুমকি দিয়েছেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَمَنْ يَّعْصِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُوْدَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيْهَا، وَلَهُ عَذَابٌ مُّهِيْنٌ».
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং আল্লাহ্’র দেয়া সীমা অতিক্রম করে আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। তম্মধ্যে সে সদা সর্বদা অবস্থান করবে এবং তাতে তার জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তির ব্যবস্থাও রয়েছে’’।
(নিসা’ : ১৪)
এ কথা সবারই মনে রাখতে হবে যে, নিষিদ্ধ কাজগুলো একেবারেই বর্জনীয়। তাতে কোন ছাড় নেই। তবে আদেশগুলো যথাসাধ্য পালনীয়।
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
إِذَا أَمَرْتُكُمْ بِشَيْءٍ فَأْتُوْا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ، وَإِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَيْءٍ فَدَعُوْهُ.
‘‘যখন আমি তোমাদেরকে কোন কাজের আদেশ করি তখন তোমরা তা সাধ্যানুযায়ী করতে চেষ্টা করবে। তবে যখন আমি তোমাদেরকে কোন কিছু বর্জন করতে বলি তখন তোমরা তা অবশ্যই বর্জন করবে’’।
(মুসলিম ১৩৩৭)
যারা কবীরা গুনাহ্ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের জন্য জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«إِنْ تَجْتَنِبُوْا كَبَآئِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئٰتِكُمْ وَنُدْخِلْكُمْ مُّدْخَلًا كَرِيْمًا».
‘‘তোমরা যদি সকল মহাপাপ থেকে বিরত থাকো যা হতে তোমাদেরকে (কঠিনভাবে) বারণ করা হয়েছে তাহলে আমি তোমাদের সকল (ছোট) পাপ ক্ষমা করে দেবো এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবো খুব সম্মানজনক স্থান তথা জান্নাতে’’। (নিসা’ : ৩১)
আর তা এ কারণেই যে, ছোট পাপগুলো পাঁচ ওয়াক্ত নামায, জুমার নামায এবং রামাযানের রোযার মাধ্যমেই ক্ষমা হয়ে যায়।
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
الصَّلَوَاتُ الْـخَمْسُ، وَالْـجُمْعَةُ إِلَى الْـجُمْعَةِ، وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ، مُكَفِّرَاتٌ لِـمَا بَيْنَهُنَّ، إِذَا اجْتُنِبَتِ الْكَبَائِرُ.
‘‘পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমা থেকে অন্য জুমা, এক রামাযান থেকে অন্য রামাযান এগুলোর মধ্যকার সকল ছোট গুনাহ্’র ক্ষমা বা কাফ্ফারাহ্ হয়ে যায় যখন কবীরা গুনাহ্ থেকে কেউ সম্পূর্ণরূপে রক্ষা পায়’’। (মুসলিম ২৩৩)
সুতরাং কবীরা গুনাহ্ থেকে রক্ষা পাওয়া এবং এরই পাশাপাশি হারাম কাজগুলো থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের একান্ত কর্তব্য। তবে কবীরা গুনাহ্ ও হারাম সম্পর্কে পূর্বের কোন ধারণা না থাকলে তা থেকে বাঁচা কারোর পক্ষে কখনোই সম্ভবপর হবে না। তাই সর্বপ্রথম সে সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞানার্জন করতে হবে এবং তারপরই আমল। নতুবা আপনি না জেনেই তা করে ফেলবেন। অথচ সে কাজটি করার আপনার আদৌ ইচ্ছে ছিলো না।
এ কারণেই হুযাইফাহ্ (রাঃ) একদা বলেছিলেন:
كَانَ النَّاسُ يَسْأَلُوْنَ رَسُوْلَ اللهِ عَنِ الْـخَيْرِ، وَكُنْتُ أَسْأَلُهُ عَنِ الشَّرِّ مَخَافَةَ أَنْ يُّدْرِكَنِيْ.
‘‘সবাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে লাভজনক বস্ত্ত সম্পর্কেই জিজ্ঞাসা করতো। আর আমি তাঁকে শুধু ক্ষতিকর বস্ত্ত সম্পর্কেই জিজ্ঞাসা করতাম যাতে আমি না জেনেই সে ক্ষতিকর বস্ত্ততে লিপ্ত না হই’’।
(বুখারী ৩৬০৬; মুসলিম ১৮৪৭)
বাস্তবে দেখা যায়, কিছু সংখ্যক প্রবৃত্তিপ্রেমী জ্ঞানশূন্য ব্যক্তিরা যখন কোন নসীহতকারী ব্যক্তির মুখ থেকে এ কথা শুনে যে, অমুক কাজ কবীরা গুনাহ্ অথবা অমুক বস্ত্ত হারাম তখন সে বিরক্তির সুরে বলে থাকে: সবই তো হারাম। আপনারা আর আমাদের জন্য এমন কি রাখলেন যা হারাম করেননি। আপনারা তো আমাদেরকে বিরক্ত করেই ছাড়লেন। সকল স্বাদকে বিস্বাদ করে দিলেন। জীবনকে একটু মনের মতো করে উপভোগ করতে দিচ্ছেন না। আপনাদের কাছে শুধু হারামই হারাম। অথচ ইসলাম একেবারেই সহজ। আর আল্লাহ্ তা‘আলা অবশ্যই ক্ষমাশীল।
বান্দাহ্ হিসেবে আমাদের সকলকে এ কথা অবশ্যই মানতে হবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা যাই চান তাই বান্দাহ্’র জন্য বিধান করেন। তাতে কারোর কোন কিছু বলার নেই। তিনি ভালোমন্দ সব কিছুই জানেন। তিনি হলেন হিকমত ওয়ালা। কখন এবং কার জন্য তিনি কি বিধান করবেন তা তিনি ভালোভালেই জানেন। তিনি যা চান হালাল করেন আর যা চান হারাম করেন। বান্দাহ্ হিসেবে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে সন্তুষ্টচিত্তে সেগুলো মেনে চলা।
আল্লাহ্ তা‘আলার সকল বিধি-বিধান সত্য ও ইনসাফ ভিত্তিক। তাতে কারোর প্রতি কোন যুলুম নেই। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَتَمَّتْ كَلِمَةُ رَبِّكَ صِدْقًا وَّعَدْلًا، لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ، وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ».
‘‘তোমার প্রতিপালকের বাণী সত্যতা ও ইনসাফে পরিপূর্ণ। তাঁর বাণী পরিবর্তনকারী কেউই নেই। তিনি সবকিছু শুনেন ও জানেন’’।
(আন্‘আম : ১১৫)
আল্লাহ্ তা‘আলা কুর‘আন মাজীদে হালাল ও হারামের একটি সহজ ও সরল সূত্র বাতলিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَيُحِلُّ لَـهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْـخَبَائِثَ».
‘‘সে (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের জন্য সকল পবিত্র বস্ত্ত হালাল করে দেয় এবং সকল অপবিত্র ও খারাপ বস্ত্ত তাদের উপর হারাম করে দেয়’’।
(আ’রাফ : ১৫৭)
সুতরাং সকল পবিত্র বস্ত্ত হালাল এবং সকল অপবিত্র বস্ত্ত হারাম। আর হালাল ও হারাম নির্ধারণের অধিকার একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলারই। অতএব কেউ নিজের জন্য উক্ত অধিকার দাবি করলে অথবা সে অধিকার আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারোর জন্য রয়েছে বলে স্বীকার করলে সে কাফির ও মুশ্রিক হয়ে যাবে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«أَمْ لَـهُمْ شُرَكَآءُ شَرَعُوْا لَـهُمْ مِّنَ الدِّيْنِ مَا لَـمْ يَأْذَنْ بِهِ اللهُ».
‘‘তাদের কি (আল্লাহ্ ভিন্ন) এমন কতেক শরীক বা দেবতা রয়েছে? যারা তাদের জন্য এমন কোন ধর্মীয় বিধান রচনা করেছে যার অনুমতি আল্লাহ্ তা‘আলা দেননি’’। (শূরা : ২১)
তেমনিভাবে কুর‘আন ও হাদীসের সঠিক জ্ঞান ছাড়া হালাল ও হারামের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত দেয়া অথবা সে ব্যাপারে কোন আলোচনা করাও কারোর জন্য জায়িয নয়। বরং আল্লাহ্ তা‘আলা কুর‘আন মাজীদে এ জাতীয় কর্মের বিশেষ নিন্দা করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَلَا تَقُوْلُوْا لِـمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هٰذَا حَلَالٌ وَّهٰذَا حَرَامٌ لِّتَفْتَرُوْا عَلَى اللهِ الْكَذِبَ إِنَّ الَّذِيْنَ يَفْتَرُوْنَ عَلَى اللهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُوْنَ».
‘‘তোমরা নিজেদের কথার উপর ভিত্তি করে মিথ্যা বলো না যে, এটি হালাল ও এটি হারাম। কারণ, তাতে আল্লাহ্ তা‘আলার উপর মিথ্যারোপ করা হবে। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ্ তা‘আলার উপর মিথ্যারোপ করে তারা কখনোই সফলকাম হবে না’’।
(নাহ্ল : ১১৬)
আল্লাহ্ তা‘আলা কুর‘আন মাজীদের মাধ্যমে কিছু জিনিসকে হারাম করে দিয়েছেন। তেমনিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও কিছু জিনিসকে হারাম করে দিয়েছেন তাঁর হাদীসের মাধ্যমে। যেমন:
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلاَّ تُشْرِكُوْا بِهِ شَيْئًا وَّبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا، وَلَا تَقْتُلُوْا أَوْلَادَكُمْ مِّنْ إِمْلَاقٍ، نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ، وَلَا تَقْرَبُوْا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ، وَلَا تَقْتُلُوْا النَّفْسَ الَّتِيْ حَرَّمَ اللهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ، ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْنَ، وَلَا تَقْرَبُوْا مَالَ الْيَتِيْمِ إِلاَّ بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ حَتَّى يَبْلُغَ أَشُدَّهُ».
‘‘(হে মুহাম্মাদ!) তুমি সবাইকে বলো: আসো! তোমাদের প্রভু তোমাদের উপর যা যা হারাম করে দিয়েছেন তা তোমাদেরকে পড়ে শুনাবো। তা এই যে, তোমরা তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে, দরিদ্রতার ভয়ে নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, কারণ, আমিই তোমাদেরকে ও তাদেরকে রিযিক দিচ্ছি, অশ্লীল কথা ও কাজের নিকটেও যেও না, চাই তা প্রকাশ্যই হোক অথবা গোপনীয়, আল্লাহ্ তা‘আলা যাকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন তাকে অবৈধভাবে হত্যা করো না, এ সব বিষয়ে আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা তা অনুধাবন করতে পারো। ইয়াতীমদের সম্পদের নিকটেও যেও না। তবে একান্ত সদুদ্দেশ্যে তা গ্রহণ করতে পারো যতক্ষণ না তারা বয়:প্রাপ্ত হয়’’। (আন‘আম : ১৫১-১৫২)
জাবির বিন্ আব্দুল্লাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
إِنَّ اللهَ حَرَّمَ بَيْعَ الْـخَمْرِ وَالْـمَيْتَةِ وَالْـخِنْزِيْرِ وَالْأَصْنَامِ.
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা হারাম করে দিয়েছেন মদ, মৃত পশু, শুকর ও মূর্তি বিক্রি’’। (আবূ দাউদ ৩৪৮৬)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন:
إِنَّ اللهَ إِذَا حَرَّمَ شَيْئًا حَرَّمَ ثَمَنَهُ.
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা যখন কোন জিনিস হারাম করেন তখন উহার বিক্রি পয়সাও হারাম করে দেন’’। (দারাক্বুত্বনী ৩/৭; আবূ দাউদ ৩৪৮৮)
কখনো কখনো আল্লাহ্ তা‘আলা নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের হারামসমূহ একত্রে বর্ণনা করেন। যেমন: তিনি খাদ্য সংক্রান্ত হারামসমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
«حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْـمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَـحْمُ الْـخِنْزِيْرِ وَمَآ أُهِلَّ لِغَيْرِ اللهِ بِهٰوَالْـمُنْخَنِقَةُ وَالْـمَوْقُوْذَةُ وَالْـمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيْحَةُ وَمَآ أَكَلَ السَّبُعُ إِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَنْ تَسْتَقْسِمُوْا بِالْأَزْلَامِ ذٰلِكُمْ فِسْقٌ».
‘‘তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে মৃত পশু, (প্রবাহিত) রক্ত, শুকরের গোস্ত, আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারোর নামে উৎসর্গীকৃত পশু, গলায় ফাঁস পড়ে তথা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরা পশু, প্রহারে মৃত পশু, উপর থেকে পড়ে মরা পশু, শিংয়ের আঘাতে মরা ও হিংস্র জন্তুতে খাওয়া পশু। তবে এগুলোর কোনটিকে তোমরা মৃত্যুর পূর্বেই যবেহ করতে সক্ষম হলে তা অবশ্যই খেতে পারো। তোমাদের উপর আরো হারাম করা হয়েছে সে সকল পশু যা দেবীদের আস্তানায় যবেহ করা হয় এবং তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ণয় করাও তোমাদের উপর হারাম। এ সবগুলো পাপ কর্ম’’। (মা’য়িদাহ্ : ৩)
তেমনিভাবে আল্লাহ্ তা‘আলা বিবাহ্ সংক্রান্ত হারামসমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
«حُرِّمَتْ عَلَيْكُمْ أُمَّهَاتُكُمْ وَبَنَاتُكُمْ وَأَخَوَاتُكُمْ وَعَمَّاتُكُمْ وَخَالَاتُكُمْ وَبَنَاتُ الْأَخِ وَبَنَاتُ الْأُخْتِ وَأُمَّهَاتُكُمْ اللاَّتِيْ أَرْضَعْنَكُمْ وَأَخَوَاتُكُمْ مِّنَ الرَّضَاعَةِ وَأُمَّهَاتُ نِسَائِكُمْ وَرَبَآئِبُكُمُ اللاَّتِيْ فِيْ حُجُوْرِكُمْ مِّنْ نِّسَآئِكُمُ اللاَّتِيْ دَخَلْتُمْ بِهِنَّ، فَإِنْ لَّمْ تَكُوْنُوْا دَخَلْتُمْ بِهِنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ، وَحَلَآئِلُ أَبْنَآئِكُمْ الَّذِيْنَ مِنْ أَصْلَابِكُمْ، وَأَنْ تَجْمَعُوْا بَيْنَ الْأُخْتَيْنِ، إِلاَّ مَا قَدْ سَلَفَ، إِنَّ اللهَ كَانَ غَفُوْرًا رَّحِيْمًا، وَالْـمُحْصَنَاتُ مِنَ النِّسَآءِ».
‘‘তোমাদের উপর হারাম করে দেয়া হয়েছে তোমাদের মায়েদেরকে, মেয়েদেরকে, বোনদেরকে, ফুফুদেরকে, খালাদেরকে, ভাইয়ের মেয়েদেরকে, বোনের মেয়েদেরকে, সে মায়েদেরকে যারা তোমাদেরকে স্তন্য দান করেছেন, তোমাদের দুধবোনদেরকে, স্ত্রীদের মায়েদেরকে এবং সে মেয়েদেরকে যাদেরকে লালন-পালন তোমরাই করছো এবং যাদের মায়েদের সাথে তোমরা সহবাসে লিপ্ত হয়েছো, তবে যদি তোমরা তাদের মায়েদের সাথে সহবাস না করে থাকো তা হলে তাদের মেয়েদেরকে বিবাহ্ করতে কোন অসুবিধে নেই এবং তোমাদের ঔরসজাত সন্তানদের স্ত্রীদেরকেও হারাম করে দেয়া হয়েছে। তেমনিভাবে দু’ সহোদরা বোনকে একত্রে বিবাহ্ করাও হারাম। তবে ইতিপূর্বে যা ঘটে গিয়েছে তা আল্লাহ্ তা‘আলা ক্ষমা করে দিবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা ক্ষমাশীল করুণাময়। আরো হারাম করা হয়েছে তোমাদের উপর সধবা নারীগণ তথা অন্যের বিবাহিতা স্ত্রীদেরকে’’। (নিসা’ : ২৩-২৪)
তেমনিভাবে আল্লাহ্ তা‘আলা উপার্জন সংক্রান্ত হারামসমূহের বর্ণনায় বলেন:
«وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا».
‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা হালাল করেছেন ব্যবসা-বাণিজ্য এবং হারাম করেছেন সুদ’’। (বাক্বারাহ্ : ২৭৫)
ঠিক এরই বিপরীতে আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের জন্য খুব দয়া করে অসংখ্য অগণিত অনেক পবিত্র বস্ত্তকে হালাল করে দিয়েছেন এবং তা সামগ্রিকভাবে।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«يَآ أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوْا مِمَّا فِيْ الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا».
‘‘হে মানব! পৃথিবীর অভ্যন্তরের সকল হালাল-পবিত্র বস্ত্ত তোমরা খাও’’। (বাক্বারাহ্ : ১৬৮)
সুতরাং দুনিয়ার যে কোন বস্ত্ত হালাল যতক্ষণ না হারামের কোন দলীল পাওয়া যায়। অতএব আমরা সবাই সদা সর্বদা তাঁরই আনুগত্য, প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবো।
উক্ত হালাল বস্ত্তসমূহ বেশি হওয়ার কারণেই আল্লাহ্ তা‘আলা তা
বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেননি এবং হারাম বস্ত্তসমূহ তিনি বিস্তারিতভাবে এ কারণেই বর্ণনা করেছেন যে, সেগুলো অতীব সীমিত।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَمَا لَكُمْ أَلاَّ تَأْكُلُوْا مِمَّا ذُكِرَ اسْمُ اللهِ عَلَيْهِ، وَقَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَّا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلاَّ مَا اضْطُرِرْتُمْ إِلَيْهِ».
‘‘তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা খাচ্ছো না সে পশুর গোস্ত যা যবাই করা হয়েছে আল্লাহ্ তা‘আলার নাম নিয়ে। অথচ তিনি তোমাদের উপর যা কিছু হারাম করে দিয়েছেন তা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। এমনকি তোমরা নিরুপায় অবস্থায় উক্ত হারাম বস্ত্তও খেতে পারো’’। (আন্‘আম : ১১৯)
ঈমানের দুর্বলতা ও ধর্মীয় জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে যারা হারামের
বিস্তারিত বর্ণনা শুনলে মনে কষ্ট পান তারা কি এমন চান যে, আল্লাহ্ তা‘আলা যেন প্রতিটি হালাল বস্ত্ত বিস্তারিতভাবে আপনাদেরকে বলে দিক। তিনি বলুক যে, উট, গরু, ছাগল, হরিণ, মুরগি, কবুতর, হাঁস, পঙ্গপাল, মাছ সবই হালাল।
সকল ধরনের শাক-সবজি ও ফল-মূল হালাল।
পানি, দুধ, মধু, তেল ইত্যাদি সবই হালাল।
লবন, মসলা, কাঁচা মরিচ ইত্যাদি সবই হালাল।
প্রয়োজনে যে কোন কাজে কাঠ, লোহা, বালি, সিমেন্ট, কঙ্কর, প্লাস্টিক, কাঁচ, রবার ইত্যাদি সবই ব্যবহার করা জায়িয।
বাই সাইকেল, মোটর সাইকেল, গাড়ি, ট্রেন, নৌকা, উড়োজাহাজ ইত্যাদি সবগুলোতেই আরোহণ করা জায়িয।
এসি, ফ্রিজ, কাপড় ধোয়ার মেশিন, কোন কিছু পেষার মেশিন, কোন ফলের রস বের করার মেশিন ইত্যাদি সবই ব্যবহার করা জায়িয।
চিকিৎসা, প্রকৌশল, খনিজ ও হিসাব বিজ্ঞান, নির্মাণ, পানি বিশুদ্ধ করণ, নিষ্কাশন, মুদ্রণ ইত্যাদি সংক্রান্ত সকল আসবাবপত্রই ব্যবহার করা জায়িয।
সুতি, পলিস্টার, টেট্রন, নাইলন, পশম ইত্যাদি জাতীয় সকল পোশাক-পরিচ্ছদ পরা জায়িয।
মৌলিকভাবে যে কোন ব্যবসা-বাণিজ্য, ভাড়া, চাকুরি এবং যে কোন ধরনের পেশা অবলম্বন করা জায়িয। আরো কত্তো কী?
আপনার কি মনে হয় যে, কখনো কারোর পক্ষে এ জাতীয় সকল হালালের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া সম্ভবপর হবে, না এ জাতীয় বর্ণনার আদৌ কোন প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
তাদের আরেকটি কথা, ইসলাম একেবারেই সহজ। তাতে কোন কঠিনতা নেই। তাদের উক্ত কথা শুনতে খুবই সুমধুর। কিন্তু এতে তাদের উদ্দেশ্য একেবারেই ভালো নয়। তারা চায় সহজতার ছুতোয় সব কিছু একেবারেই হালাল করে নিতে। তা কখনোই ঠিক নয়। বরং আমাদের জানা উচিৎ যে, নিজস্ব গতিতে শরীয়ত একেবারেই সহজ। তবে তা কারোর রুচি নির্ভরশীল নয় এবং সাধারণভাবে শরীয়ত তো সহজই বটে। এরপরও শরীয়তের তুলনামূলক কঠিন বিধানগুলোকে প্রয়োজনের খাতিরে আরো সহজ করে দেয়া হয়। যেমন: সফরের সময় দু’ ওয়াক্ত নামায একত্রে পড়া, চার রাক্‘আত বিশিষ্ট নামাযকে দু’ রাক্‘আত করে পড়া এবং পরবর্তীতে আদায়ের শর্তে তখন রোযা না রাখার সুযোগও রয়েছে। তেমনিভাবে মুক্বীম (নিজ বাসস্থানে যিনি রয়েছেন) ও মুসাফির তথা ভ্রমণরত ব্যক্তির জন্য ২৪ ও ৭২ ঘন্টা মোজা মাস্হ করার বিধানও রয়েছে। পানি ব্যবহারে অক্ষম অথবা পানি না পাওয়ার সময় ওযুর পরিবর্তে তায়াম্মুমের ব্যবস্থাও রয়েছে। রোগাক্রান্ত ব্যক্তির জন্য এবং বৃষ্টি পড়ার সময় ফজরের নামায ছাড়া অন্য চার ওয়াক্ত নামায দু’ ওয়াক্ত করে একত্রে পড়া যায়। সত্যিকার বিবাহের নিয়্যাতে বেগানা মেয়েকে দেখা যায়। কসমের কাফ্ফারায় গোলাম আযাদ, খানা খাওয়ানো অথবা কাপড় পরানোর মধ্যে পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। এমনকি কঠিন মুহূর্তে মৃত পশু খাওয়াও জায়িয রাখা হয়েছে। আরো কত্তো কী?
বিশেষ কিছু জিনিসকে হারাম করার রহস্যসমূহের একটি এও যে, আল্লাহ্ তা‘আলা এরই মাধ্যমে তাঁর অনুগত ও অবাধ্যকে পৃথক করতে চান। সুতরাং ঈমানদারগণ আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টি ও সাওয়াবের আশায় বিধানগুলো পালন করে বলেই তাদের জন্য তা সহজ হয়ে যায়। আর মুনাফিকরা অসন্তুষ্ট চিত্তে বিধানগুলো পালন করে বিধায় তা তাদের জন্য অতি কঠিন।
একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য কেউ কোন হারাম পরিত্যাগ করলে সে তার অন্তরে বিশেষ এক ধরনের ঈমানের স্বাদ অনুভব করবে এবং আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে এরই পরিবর্তে আরেকটি ভালো জিনিস দান করবেন।