কারোর জন্য অন্যের উপর যে কোনভাবে যুলুম, অত্যাচার অথবা অন্যায় মূলক আক্রমণ হারাম ও কবীরা গুনাহ্। কাউকে মারা, হত্যা করা, আহত করা, গালি দেয়া, অভিসম্পাত করা, ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া, দুর্বলের উপর হাত উঠানো চাই সে হোক নিজের কাজের ছেলে কিংবা নিজের কাজের মেয়ে অথবা নিজ স্ত্রী-সন্তান; তেমনিভাবে জোর করে কারোর কোন অধিকার হরণ ইত্যাদি ইত্যাদি যুলুমেরই অন্তর্গত।
যুলুম পারস্পরিক বন্ধুত্ব বিনষ্ট করে। আত্মীয়-স্বজনের মাঝে বৈরিতা সৃষ্টি করে। মানুষের মাঝে হিংসা ও বিদ্বেষের জন্ম দেয় এবং এরই কারণে ধনী ও গরীবের মাঝে ধীরে ধীরে ঘৃণা ও শত্রুতা জেগে উঠে। তখন উভয় পক্ষই দুনিয়ার বুকে অশান্তি নিয়েই জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়।
আল্লাহ্ তা‘আলা যালিমদের জন্য জাহান্নামে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছেন। যা তাকে গ্রহণ করতেই হবে।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِيْنَ نَارًا، أَحَاطَ بِهِمْ سُرَادِقُهَا، وَإِنْ يَّسْتَغِيْثُوْا يُغَاثُوْا بِمَاءٍ كَالْـمُهْلِ يَشْوِيْ الْوُجُوْهَ، بِئْسَ الشَّرَابُ، وَسَاءَتْ مُرْتَفَقًا»
‘‘আমি যালিমদের জন্য জাহান্নাম প্রস্ত্তত রেখেছি। যার বেষ্টনী তাদেরকে পরিবেষ্টন করে থাকবে। তারা পানি চাইলে তাদেরকে দেয়া হবে গলিত ধাতুর ন্যায় পানি। যা তাদের মুখমণ্ডল পুড়িয়ে দিবে। এটা কতই না নিকৃষ্ট পানীয় এবং সে জাহান্নাম কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়’’। (কাহ্ফ : ২৯)
আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন:
«وَسَيَعْلَمُ الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا أَيَّ مُنْقَلَبٍ يَّنْقَلِبُوْنَ»
’’অত্যাচারীরা শীঘ্রই জানবে কোথায় তাদের গন্তব্যস্থল!’’ (শু‘আরা’ : ২২৭)
আবূ যর গিফারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
يَا عِبَادِيْ! إِنِّيْ حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِيْ وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلَا تَظَالَـمُوْا.
‘‘হে আমার বান্দাহ্রা! নিশ্চয়ই আমি আমার উপর যুলুম হারাম করে দিয়েছি অতএব তোমাদের উপরও তা হারাম। সুতরাং তোমরা পরস্পর যুলুম করো না’’। (মুসলিম ২৫৭৭)
কেউ কেউ কোন যালিমকে অনায়াসে মানুষের উপর যুলুম করতে দেখলে এ কথা ভাবে যে, হয়তো বা সে ছাড় পেয়ে গেলো। তাকে আর কোন শাস্তিই দেয়া হবে না। না, ব্যাপারটা কখনোই এমন হতে পারে না। বরং আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে কিয়ামতের দিনের কঠিন শাস্তির অপেক্ষায় রেখেছেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَلَا تَحْسَبَنَّ اللهَ غَافِلًا عَمَّا يَعْمَلُ الظَّالِمُوْنَ، إِنَّمَا يُؤَخِّرُهُمْ لِيَوْمٍ تَشْخَـصُ فِيْهِ الْأَبْصَارُ، مُهْطِعِيْنَ مُقْنِعِيْ رُؤُوْسِهِمْ، لَا يَرْتَدُّ إِلَيْهِمْ طَرْفُهُمْ، وَأَفْئِدَتُهُمْ هَوَاءٌ»
‘‘তুমি কখনো মনে করো না যে, যালিমরা যা করে যাচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলা সে ব্যাপারে গাফিল। বরং তিনি তাদেরকে সুযোগ দিচ্ছেন কিয়ামতের দিন পর্যন্ত। যে দিন সবার চক্ষু হবে স্থির বিস্ফারিত। সে দিন তারা ভীত-বিহবল হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে ছুটোছুটি করবে। তাদের চক্ষু এতটুকুর জন্যও নিজের দিকে ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে একেবারেই আশা শূন্য’’। (ইব্রাহীম : ৪২-৪৩)
কারোর মধ্যে বিনয় ও নম্রতা না থাকলেই সে কারোর উপর উদ্যত ও আক্রমণাত্মক হতে পারে। এ কারণেই আল্লাহ্ তা‘আলা সকলকে বিনয়ী ও নম্র হতে আদেশ করেন।
’ইয়ায বিন্ ’হিমার মুজাশি’য়ী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা খুৎবা দিতে গিয়ে বলেন:
وَإِنَّ اللهَ أَوْحَى إِلَيَّ أَنْ تَوَاضَعُوْا حَتَّى لَا يَفْخَرَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ، وَلَا يَبْغِيَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ.
‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা এ মর্মে আমার নিকট ওহী পাঠিয়েছেন যে, তোমরা নম্র ও বিনয়ী হও; যাতে করে একের অন্যের উপর গর্ব করার পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় এবং একের অন্যের উপর অত্যাচার বা আক্রমণাত্মক আচরণ করার সুযোগ না আসে’’। (মুসলিম ২৮৬৫)
আবূ মাস্’ঊদ্ আন্সারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
كُنْتُ أَضْرِبُ غُلَامًا لِيْ، فَسَمِعْتُ مِنْ خَلْفِيْ صَوتًا : اعْلَمْ، أَبَا مَسْعُوْدٍ ! لَلَّهُ أَقْدَرُ عَلَيْكَ مِنْكَ عَلَيْهِ، فَالْتَفَتُّ فَإِذَا هُوَ رَسُوْلُ اللهِ ، فَقُلْتُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! هُوَ حُرٌّ لِوَجْهِ اللهِ، فَقَالَ: أَمَا لَوْ لَمْ تَفْعَلْ لَلَفَحَتْكَ النَّارُ أَوْ لَمَسَّتْكَ النَّارُ.
’’আমি আমার একটি গোলামকে মারছিলাম এমতাবস্থায় পেছন থেকে শুনতে পেলাম, কে যেন আমাকে বড় আওয়াজে বলছে: শুনো, হে আবূ মাস্’ঊদ্! তুমি এর উপর যতটুকু ক্ষমতাশীল তার চাইতেও অনেক বেশি ক্ষমতাশীল আল্লাহ্ তা‘আলা তোমার উপর। অতঃপর আমি (পেছনে) তাকিয়ে দেখি, তিনি হচ্ছেন স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অতএব আমি বললাম: হে আল্লাহ্’র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! একে আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য স্বাধীন করে দিলাম। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তুমি যদি এমন না করতে তা হলে তোমাকে জাহান্নামের অগ্নি স্পর্শ করতো অথবা পুড়িয়ে দিতো’’।
(মুসলিম ১৬৫৯)
হিশাম বিন্ ’হাকীম (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
إِنَّ اللهَ يُعَذِّبُ الَّذِيْنَ يُعَذِّبُوْنَ النَّاسَ فِيْ الدُّنْيَا.
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা ওদেরকে শাস্তি দিবেন যারা দুনিয়াতে মানুষকে (অন্যায়ভাবে) শাস্তি দেয়’’। (মুসলিম ২৬১৩)
আল্লাহ্ তা‘আলা অত্যাচারী ও কারোর উপর অন্যায় মূলক আক্রমণকারীর শাস্তি দুনিয়াতেই দিয়ে থাকেন। উপরন্তু আখিরাতের শাস্তি তো তার জন্য প্রস্ত্তত আছেই।
আবূ বাক্রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
مَا مِنْ ذَنْبٍ أَجْدَرُ أَنْ يُّعَجِّلَ اللهُ لِصَاحِبِهِ الْعُقُوْبَةَ فِيْ الدُّنْيَا مَعَ مَا يَدَّخِرُ لَهُ فِيْ الْآخِرَةِ مِنَ الْبَغْيِ وَقَطِيْعَةِ الرَّحِمِ.
‘‘দু’টি গুনাহ্ ছাড়া এমন কোন গুনাহ্ নেই যে গুনাহ্গারের শাস্তি আল্লাহ্ তা‘আলা দুনিয়াতেই দিবেন এবং তা দেওয়াই উচিৎ; উপরন্তু তার জন্য আখিরাতের শাস্তি তো আছেই। গুনাহ্ দু’টি হচ্ছে, অত্যাচার তথা কারোর উপর অন্যায় মূলক আক্রমণ এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী’’।
(আবূ দাউদ ৪৯০২; তিরমিযী ২৫১১; ইব্নু মাজাহ্ ৪২৮৬; ইব্নু হিববান ৪৫৫, ৪৫৬ বায্যার, হাদীস ৩৬৯৩; আহমাদ ২০৩৯০, ২০৩৯৬, ২০৪১৪)