হারাম ও কবিরা গুনাহ হারাম ও কবীরা গুনাহ্ পরিচিতি মোস্তাফিজুর রহমান বিন আব্দুল আজিজ আল-মাদানী ১ টি

ধূমপায়ীরা নিজেদের দোষকে ঢাকা দেয়ার জন্য অধূমপায়ীদেরকে ধূমপানের কিছু কাল্পনিক উপকার বুঝাতে চায় যা নিম্নরূপ:

ক. মনের অশান্তি দূর করার জন্যই ধূমপান করা হয়। তাদের এ কথা নিশ্চিতভাবেই জানা উচিৎ যে, একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার যিকিরের মাধ্যমেই মানুষের অন্তরে শান্তির সঞ্চার হয়।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«أَلَا بِذِكْرِ اللهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوْبُ»

‘‘জেনে রাখো, আল্লাহ্ তা‘আলার স্মরণেই অন্তর শান্তি পায়’’। (রা’দ্ : ২৮)

খ. ধূমপান কোন ব্যাপারে গভীর চিন্তা করতে সহযোগিতা করে। মূলত ব্যাপারটা সম্পূর্ণ এর উল্টো। বরং ধূমপান শ্বাসকষ্ট ও গলা শুকিয়ে যাওয়ার দরুন মানুষের চিন্তাশক্তিকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়।

গ. ধূমপান মানুষের স্নায়ুগুলোকে সতেজ করে তোলে। মূলত ব্যাপারটা সম্পূর্ণ এর বিপরীত। বরং ধূমপান মানুষের স্নায়ুগুলোকে দুর্বল করে দেয় এবং এরই প্রভাবে দ্রুত হৃদকম্পন শুরু হয়ে যায়।

ঘ. ধূমপানে বন্ধু বাড়ে। এ কথা একাংশে ঠিক। তবে ধূমপানে ধূমপায়ী বন্ধু বাড়ে, ভালো বন্ধু নয়।

ঙ. ধূমপানে ক্লান্তি দূর হয়। এ কথা একেবারেই ঠিক নয়। বরং ধূমপানে ক্লান্তি আরো বেড়ে যায়। কারণ, ধূমপানে স্নায়ু দৌর্বল্য ও রক্ত চলাচলে সমস্যা সৃষ্টি করে।

আবার কেউ কেউ তো অন্যের অনুকরণে ধূমপান করে থাকে। কাউকে ধূমপান করতে দেখে তার খুব ভালো লেগেছে তাই সেও ধূমপান করে। কিয়ামতের দিন তার এ অনুসরণ কোন কাজেই আসবে না।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«وَبَرَزُوْا لِلهِ جَمِيْعًا، فَقَالَ الضُّعَفَآءُ لِلَّذِيْنَ اسْتَكْبَرُوْا إِنَّا كُنَّا لَكُمْ تَبَعًا، فَهَلْ أَنْتُمْ مُّغْنُوْنَ عَنَّا مِنْ عَذَابِ اللهِ مِنْ شَيْءٍ، قَالُوْا لَوْ هَدَانَا اللهُ لَهَدَيْنَاكُمْ، سَوَآءٌ عَلَيْنَآ أَجَزِعْنَآ أَمْ صَبَرْنَا مَا لَنَا مِنْ مَّحِيْصٍ»

‘‘সবাই আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট উপস্থিত হলে দুর্বলরা অহঙ্কারীদেরকে বলবে, আমরা তো তোমাদের অনুসারীই ছিলাম। অতএব তোমরা কি আমাদেরকে আল্লাহ্ তা‘আলার শাস্তি থেকে এতটুকুও রক্ষা করতে পারবে? তারা বলবে: আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে সঠিক পথ দেখালে অবশ্যই আমরা তোমাদেরকে তা দেখাতাম। এখন আমরা ধৈর্যচ্যুত হই অথবা ধৈর্যশীল হই তাতে কিছুই আসে যায় না। এখন আমাদের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার আযাব থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার আর কোন পথ নেই’’। (ইব্রাহীম : ২১)

আবার কেউ কেউ তো দাম্ভিকতা দেখিয়ে বলেন: আমি বুঝে শুনেই ধূমপান করছি। এতে তোমাদের কি যায় আসে? এ জাতীয় ব্যক্তিদেরকে এখন থেকেই পরকালের পরিণতির কথা চিন্তা করা উচিৎ।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«وَخَابَ كُـلُّ جَبَّارٍ عَنِيْدٍ، مِنْ وَّرَآئِهِ جَهَنَّمُ، وَيُسْقَى مِنْ مَّآءٍ صَدِيْدٍ، يَتَجَرَّعُهُ وَلَا يَكَادُ يُسِيْغُهُ، وَيَأْتِيْهِ الْمَوْتُ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ، وَمَا هُوَ بِمَيِّتٍ، وَمِنْ وَّرَآئِهِ عَذَابٌ غَلِيْظٌ»

‘‘প্রত্যেক উদ্ধত স্বৈরাচারী ব্যর্থকাম হলো। পরিণামে তাদের প্রত্যেকের জন্য রয়েছে জাহান্নাম এবং তাদেরকে পান করানো হবে গলিত পুঁজ। অতি কষ্টেই তারা তা গলাধ:করণ করবে; সহজে নয়। সর্বদিক থেকে মৃত্যু তার দিকে ধেয়ে আসবে; অথচ সে মরবে না এবং এর পরেও তার জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি’’। (ইব্রাহীম : ১৫-১৭)

যেভাবে আপনি ধূমপান ছাড়বেন:

ধূমপানের উপরোক্ত ব্যক্তিগত ও সামাজিক অপকার জানার পর আশাতো আপনি এখনি ধূমপান থেকে তাওবা করতে প্রস্ত্তত। তবে এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ব্যাপার আপনাকে বিশেষ সহযোগিতা করবে যা নিম্নরূপ:

ক. আল্লাহ্ তা‘আলার উপর পূর্ণ ভরসা রেখে ধূমপান ত্যাগের ব্যাপারে কঠিন প্রতিজ্ঞা তথা তাওবা করতে হবে এবং এ ব্যাপারে পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ্ তা‘আলার সহযোগিতা চেয়ে তাঁর কাছে বিশেষভাবে ফরিয়াদ করতে হবে।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«وَتُوْبُوْا إِلَى اللهِ جَمِيْعًا أَيُّهَا الْـمُؤْمِنُوْنَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ»

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা সবাই আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট প্রত্যাবর্তন করো; যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো’’। (নূর : ৩১)

আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন:

«أَمَّنْ يُّجِيْبُ الْـمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوْءَ وَيَجْعَلُكُمْ خُلَفَآءَ الْأَرْضِ، أَإِلَهٌ مَّعَ اللهِ، قَلِيْلًا مَّا تَذَكَّرُوْنَ»

‘‘তিনিই তো উত্তম যিনি আর্তের আহবানে সাড়া দেন যখন সে তাঁকে ডাকে, বিপদ-আপদ দূরীভূত করেন এবং তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেন। আল্লাহ্ তা‘আলার পাশাপাশি অন্য কোন মা’বূদ আছে কি? তোমরা তো অতি সামান্যই উপদেশ গ্রহণ করে থাকো’’। (নাম্ল : ৬২)

খ. ধূমপানের অপকারগুলো দৈনিক নিজে ভাবুন এবং নিজ বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও স্ত্রী-সন্তানদের সামনে এগুলো নিয়ে আলোচনা করুন।

গ. ধূমপায়ীদের সঙ্গ ছেড়ে দিন। অন্ততপক্ষে ধূমপানের মজলিস থেকে বহু দূরে এবং কল্যাণকর কাজে সর্বদা ব্যস্ত থাকুন।

ঘ. ধূমপানকে ঘৃণা করতে চেষ্টা করুন এবং সর্বদা এ কথা ভাবুন যে, কেউ একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য কোন হারাম বস্ত্ত পরিত্যাগ করলে আল্লাহ্ তা‘আলা এর প্রতিদান হিসেবে তাকে এর চাইতে আরো উন্নত ও কল্যাণকর বস্ত্ত দান করবেন।

আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য কেউ কোন হারাম বস্ত্ত পরিত্যাগ করলে তা সহজেই পরিত্যাগ করা সম্ভব। তবে আল্লাহ্ তা‘আলা সর্ব প্রথম আপনাকে অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখবেন যে, আপনি উক্ত হারাম বস্ত্ত পরিত্যাগে কতটুকু সত্যবাদী। তখন আপনি এ ব্যাপারে ধৈর্য ধরতে পারলে তা পরিশেষে সত্যিই মজায় রূপান্তরিত হবে।

ধূমপান পরিত্যাগ করলে প্রথমত: আপনার গভীর ঘুম নাও আসতে পারে। রক্তে ঘাটতি দেখা দিবে। দীর্ঘ সময় কোন কিছু নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে পারবেন না। রাগ ও অস্থিরতা বেড়ে যাবে। নাড়ির সাধারণ গতি কমে যাবে। ব্রেইন কেমন যেন হালকা ও নিস্তেজ হয়ে পড়বে। ধূমপানের জন্য অন্তর কিলবিল করতে থাকবে। তবে তা কিছু দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।

ঙ. কখনো মনের ভেতর ধূমপানের ইচ্ছে জন্মালে সাথে সাথে মিস্ওয়াক করুন অথবা চুইঙ্গাম খেতে থাকুন।

চ. চা ও কপি খুব কমই পান করুন। বরং এরই পরিবর্তে সাধ্যমত ফল-মূলাদি খেতে চেষ্টা করুন।

ছ. প্রতিদিন নাস্তার পর এক গ্লাস লেবু বা আঙ্গুরের জুস পান করুন। তা হলে ধূমপানের চাহিদা একটু করে হলেও হ্রাস পাবে।

জ. যত্ন সহকারে নিয়মিত ফরয নামাযগুলো আদায় করুন।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«وَأَقِمِ الصَّلَاةَ، إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَآءِ وَالْـمُنْكَرِ، وَلَذِكْرُ اللهِ أَكْبَرُ، وَاللهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُوْنَ»

‘‘নামায কায়েম করো। কারণ, নামাযই তো তোমাকে অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। আল্লাহ্ তা‘আলার স্মরণই তো সর্বশ্রেষ্ঠ। তোমরা যাই করছো আল্লাহ্ তা‘আলা তা সবই জানেন’’। (‘আন্কাবূত : ৪৫)

ঝ. বেশি বেশি রোযা রাখার চেষ্টা করুন। কারণ, তা মনোবলকে শক্তিশালী করায় ও কুপ্রবৃত্তি মোকাবিলায় বিশেষ সহযোগিতা করবে।

ঞ. বেশি বেশি কুর‘আন তেলাওয়াত করুন।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«إِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ يَهْدِيْ لِلَّتِيْ هِيَ أَقْوَمُ»

‘‘নিশ্চয়ই এ কুর‘আন সঠিক পথ প্রদর্শন করে’’। (ইস্রা’/বানী ইস্রাঈল : ৯)

আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন:

«يَآ أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَآءَتْكُمْ مَّوْعِظَةٌ مِّنْ رَبِّكُمْ، وَشِفَآءٌ لِّمَا فِيْ الصُّدُوْرِ، وَهُدًى وَّرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِيْنَ»

‘‘হে মানব সকল! তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট উপদেশ, অন্তরের চিকিৎসা এবং মু’মিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত এসেছে’’। (ইউনুস : ৫৭)

চ. বেশি বেশি যিকির করুন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«أَلَا بِذِكْرِ اللهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوْبُ»

‘‘জেনে রাখো, একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার যিকির বা স্মরণেই মানব অন্তর প্রশান্তি লাভ করে’’। (রা’দ্ : ২৮)

ছ. সর্বদা আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করুন। কারণ, শয়তানই তো গুনাহ্সমূহকে মানব সম্মুখে সুশোভিত করে দেখায়।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«تَاللهِ لَقَدْ أَرْسَلْنَآ إِلَى أُمَمٍ مِّنْ قَبْلِكَ فَزَيَّنَ لَـهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَـهُمْ، فَهُوَ وَلِيُّهُمُ الْيَوْمَ، وَلَـهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ»

‘‘আল্লাহ্’র কসম! আমি তোমার পূর্বেও বহু জাতির নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি; কিন্তু শয়তান তাদের (অশোভনীয়) কর্মকান্ডকে তাদের নিকট সুশোভিত করে দেখিয়েছে। সুতরাং শয়তান তো আজ তাদের বন্ধু অভিভাবক এবং তাদেরই জন্য (কিয়ামতের দিন) যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে’’। (নাহ্ল : ৬৩)

আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন:

«وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللهِ، إِنَّهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ»

’’শয়তানের কুমন্ত্রণা যদি তোমাকে প্ররোচিত করে তা হলে তুমি আল্লাহ্ তা‘আলার আশ্রয় কামনা করো। তিনিই তো সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’’।

(আ’রাফ : ২০০)

জ. নেককার লোকদের সাথে চলুন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيْدُوْنَ وَجْهَهُ، وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيْدُ زِيْنَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا، وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ، وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا»

‘‘তুমি সর্বদা নিজকে ওদের সংস্রবেই রাখবে যারা সকাল-সন্ধ্যায় নিজ প্রভুকে ডাকে একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। কখনো তাদের থেকে নিজ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিবে না পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনায়। তবে ওদের অনুসরণ কখনোই করো না যাদের অন্তর আমি আমার স্মরণ থেকে গাফিল করে দিয়েছি এবং যারা নিজ খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে নিজ কর্মকান্ডে সীমাতিক্রম করে’’। (কাহ্ফ : ২৮)

একবার দু’বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেও কখনো নিরাশ হবেন না। কারণ, নিরাশ হওয়া কাফিরের পরিচয়।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«وَلَا تَيْأَسُوْا مِنْ رَّوْحِ اللهِ، إِنَّهُ لَا يَيْأَسُ مِنْ رَّوْحِ اللهِ إِلاَّ الْقَوْمُ الْكَافِرُوْنَ»

‘‘আল্লাহ্ তা‘আলার রহমত থেকে তোমরা কখনো নিরাশ হয়ো না। কারণ, একমাত্র কাফিররাই তো আল্লাহ্ তা‘আলার রহমত থেকে নিরাশ হয়ে থাকে’’। (ইউসুফ : ৮৭)

আপনি দ্রুত ধূমপান ছাড়তে না পারলেও অন্ততপক্ষে তা কমাতে চেষ্টা করুন এবং তা প্রকাশ্য পান করবেন না তা হলে কোন এক দিন আপনি তা সম্পূর্ণরূপে ছাড়তে পারবেন।