মিথ্যা বলা অথবা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া একটি মারাত্মক অপরাধ।
কোন বিষয়ে নিশ্চিত জানাশোনা না থাকা সত্ত্বেও সে বিষয়ে অনুমান ভিত্তিক কোন কথা বলা সত্যিই অপরাধ এবং তা অধিকাংশ সময় মিথ্যা হতেই বাধ্য।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ، إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُوْلَآئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْؤُوْلًا»
‘‘যে বিষয়ে তোমার পরিপূর্ণ জ্ঞান নেই সে বিষয়ের পেছনে পড়ো না তথা অনুমানের ভিত্তিতে কখনো পরিচালিত হয়ো না। নিশ্চয়ই তুমি কর্ণ, চক্ষু, হৃদয় এ সবের ব্যাপারে (কিয়ামতের দিন) জিজ্ঞাসিত হবে’’।
(ইস্রা’/বানী ইস্রাঈল : ৩৬)
আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন:
«قُتِلَ الْـخَرَّاصُوْنَ»
‘‘(অনুমান ভিত্তিক) মিথ্যাচারীরা ধ্বংস হোক’’। (যারিয়াত : ১০)
মিথ্যুক আল্লাহ্ তা‘আলার লা’নত পাওয়ার উপযুক্ত।
মুবাহালার আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَعْنَةَ اللهِ عَلَى الْكَاذِبِيْنَ»
‘‘অতঃপর আমরা সবাই (আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট) এ মর্মে প্রার্থনা করি যে, মিথ্যুকদের উপর আল্লাহ্ তা‘আলার লা’নত পতিত হোক’’।
(আ’লি ’ইমরান : ৬১)
মুলা‘আনার আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَالْـخَامِسَةُ أَنَّ لَعْنَةَ اللهِ عَلَيْهِ إِنْ كَانَ مِنَ الْكَاذِبِيْنَ»
‘‘পঞ্চমবার পুরুষ এ কথা বলবে যে, তার উপর আল্লাহ্ তা‘আলার লা’নত পতিত হোক যদি সে (নিজ স্ত্রীকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয়ার ব্যাপারে) মিথ্যাবাদী হয়ে থাকে’’।
(নূর : ৭)
মিথ্যা কখনো কখনো মিথ্যাবাদীকে জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয় এবং মিথ্যা বলতে বলতে পরিশেষে সে আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট মিথ্যুক হিসেবেই পরিগণিত হয়।
‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্’ঊদ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
عَلَيْكُمْ بِالصِّدْقِ فَإِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِيْ إِلَى الْبِرِّ، وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِيْ إِلَى الْـجَنَّةِ، وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَصْدُقُ وَيَتَحَرَّى الصِّدْقَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ صِدِّيْقًا، وَإِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ فَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِيْ إِلَى الْفُجُوْرِ، وَإِنَّ الْفُجُوْرَ يَهْدِيْ إِلَى النَّارِ، وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَكْذِبُ وَيَتَحَرَّى الْكَذِبَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ كَذَّابًا.
‘‘তোমরা সত্যকে আঁকড়ে ধরো। কারণ, সত্য পুণ্যের পথ দেখায় আর পুণ্য জান্নাতের পথ। কোন ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বললে এবং সর্বদা সত্যের অনুসন্ধানী হলে সে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট সত্যবাদী হিসেবেই লিখিত হয়। আর তোমরা মিথ্যা থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকো। কারণ, মিথ্যা পাপাচারের রাস্তা দেখায় আর পাপাচার জাহান্নামের রাস্তা। কোন ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা বললে এবং সর্বদা মিথ্যার অনুসন্ধানী হলে সে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট মিথ্যাবাদী রূপেই লিখিত হয়’’।
(মুসলিম ২৬০৭)
সামুরাহ্ বিন্ জুন্দুব (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: ’’একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদেরকে নিজ স্বপ্ন বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন: গত রাত আমার নিকট দু’ জন ব্যক্তি এসেছে। তারা আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললো: চলুন, তখন আমি তাদের সাথেই রওয়ানা করলাম। যেতে যেতে আমরা এমন এক ব্যক্তির নিকট পৌঁছুলাম যে চিত হয়ে শায়িত। অন্য আরেক জন তার পাশেই দাঁড়িয়ে একটি মাথা বাঁকানো লোহা হাতে। লোকটি বাঁকানো লোহা দিয়ে শায়িত ব্যক্তির একটি গাল, নাকের ছিদ্র এবং চোখ ঘাড় পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলছে। এরপর সে উক্ত ব্যক্তির অন্য গাল, নাকের ছিদ্র এবং চোখটিকেও এমনিভাবে ছিঁড়ে ফেলছে। লোকটি শায়িত ব্যক্তির এক পার্শ্ব ছিঁড়তে না ছিঁড়তেই তার অন্য পার্শ্ব পূর্বাবস্থায় ফিরে যাচ্ছে এবং লোকটি শায়িত ব্যক্তিটির সাথে সে ব্যবহারই করছে যা পূর্বে করেছে। ফিরিশ্তাদ্বয় উক্ত ঘটনার ব্যাখ্যায় বলেন: উক্ত ব্যক্তির দোষ এই যে, সে ভোর বেলায় ঘর থেকে বের হয়েই মিথ্যা কথা বলে বেড়ায় যা দুনিয়ার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে’’। (বুখারী ৭০৪৭; মুসলিম ২২৭৫)
বিশেষ আফসোসের ব্যাপার এই যে, অনেক রসিক ব্যক্তি শুধুমাত্র মানুষকে হাসানোর জন্যই মিথ্যা কথা বলে থাকেন। তাতে তার ইহলৌকিক অন্য কোন ফায়েদা নেই। অথচ সে অন্যকে ফুর্তি দেয়ার জন্যই এমন জঘন্য কাজ করে থাকে।
’হিযাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
وَيْلٌ لِلَّذِيْ يُحَدِّثُ بِالْـحَدِيْثِ، لِيُضْحِكَ بِهِ الْقَوْمَ فَيَكْذِبُ، وَيْلٌ لَهُ، وَيْلٌ لَهُ.
‘‘অকল্যাণ হোক সে ব্যক্তির যে মানুষকে হাসানোর জন্যই মিথ্যা কথা বলে। অকল্যাণ হোক সে ব্যক্তির; অকল্যাণ হোক সে ব্যক্তির’’।
(তিরমিযী ২৩১৫)
অনেকের মধ্যে তো আবার মিথ্যা স্বপ্ন তথা স্বপ্ন বানিয়ে বলার প্রবণতা রয়েছে। বর্তমানে নতুন নতুন মাযার তৈরির এই তো হচ্ছে একমাত্র পুঁজি। কোন পীর-বুযুর্গের নাম-গন্ধও নেই অথচ মাযার উঠার অলীক স্বপ্ন আউড়িয়ে নতুন নতুন মাযারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হচ্ছে। একে তো মাযার উঠানো আবার তা তথা কথিত অলীক স্বপ্নের ভিত্তিতে। আল্লাহ্ তা‘আলা কিয়ামতের দিন এ জাতীয় মানুষকে দু’টি যব একত্রে জোড়া দিতে বাধ্য করবেন অথচ সে তা করতে পারবে না।
‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আববাস্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
مَنْ تَحَلَّمَ بِحُلْمٍ لَمْ يَرَهُ كُلِّفَ أَنْ يَّعْقِدَ بَيْنَ شَعِيْرَتَيْنِ، وَلَنْ يَّفْعَلَ.
‘‘যে ব্যক্তি কোন স্বপ্ন দেখেছে বলে দাবি করলো অথচ সে তা দেখেনি তা হলে তাকে দু’টি যব একত্রে জোড়া দিতে বাধ্য করা হবে অথচ সে তা কখনোই করতে পারবে না’’।
(বুখারী ৭০৪২; তিরমিযী ২২৮৩)
‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’উমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
إِنَّ مِنْ أَفْرَى الْفِرَى أَنْ يُّرِيَ عَيْنَيْهِ مَا لَمْ تَرَ.
‘‘সর্ব নিকৃষ্ট মিথ্যা এই যে, কেউ যা স্বপ্নে দেখেনি তা সে দেখেছে বলে দাবি করছে’’। (বুখারী ৭০৪৩)
তবে অতি প্রয়োজনীয় কোন কল্যাণ অর্জনের জন্য অথবা নিশ্চিত কোন অঘটন থেকে বাঁচার জন্য; যা সত্য বললে কোনভাবেই হবে না এবং তাতে কারোর কোন অধিকারও বিনষ্ট করা হয় না অথবা কোন হারামকেও হালাল করা হয় না এমতাবস্থায় মিথ্যা বলা জায়িয। তবুও এমতাবস্থায় এমনভাবে মিথ্যাটিকে উপস্থাপন করা উচিৎ যাতে বাহ্যিকভাকে তা মিথ্যা মনে হলেও বাস্তবে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয় না। কারণ, কথাটি বলার সময় তার ধ্যানে সত্য কোন একটি দিক তখনো উদ্ভাসিত ছিলো। আরবী ভাষায় যা তাওরিয়া বা মা‘আরীয নামে পরিচিত।
’ইমরান বিন্ ’হুস্বাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
إِنَّ فِيْ الْـمَعَارِيْضِ لَـمَنْدُوْحَةً عَنِ الْكَذِبِ.
‘‘ঘুরিয়ে কথা বললে জাজ্বল্য মিথ্যা বলা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়’’।
(বায়হাক্বী ১০/১৯৯ ইব্নু ‘আদী ৩/৯৬)
উম্মে কুল্সূম বিন্তে ’উক্ববাহ্ (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
لَيْسَ الْكَذَّابُ الَّذِيْ يُصْلِحُ بَيْنَ النَّاسِ، وَيَقُوْلُ خَيْرًا وَيَنْمِيْ خَيْرًا.
‘‘সে ব্যক্তি মিথ্যুক নয় যে মানুষের পরস্পর বিরোধ মীমাংসা করে এবং সে উক্ত উদ্দেশ্যেই ভালো কথা বলে এবং তা বানিয়ে বলে’’।
(বুখারী ২৬৯২; মুসলিম ২৬০৫)
উম্মে কুল্সূম বিন্তে ’উক্ববাহ্ (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধুমাত্র তিনটি ব্যাপারেই মিথ্যা বলার সুযোগ দিয়েছেন। তিনি বলতেন:
لَا أَعُدُّهُ كَاذِبًا : الرَّجُلُ يُصْلِحُ بَيْنَ النَّاسِ، يَقُوْلُ الْقَوْلَ وَلَا يُرِيْدُ بِهِ إِلاَّ الْإِصْلَاحَ، وَالرَّجُلُ يَقُوْلُ فِيْ الْـحَرْبِ، وَالرَّجُلُ يُحَدِّثُ اِمْرَأَتَهُ، وَالْـمَرْأَةُ تُحَدِّثُ زَوْجَهَا.
‘‘আমি মিথ্যা মনে করি না যে, কোন ব্যক্তি মানুষের পরস্পর বিরোধ মীমাংসার জন্য কোন কথা বানিয়ে বলবে। তার উদ্দেশ্য কেবল বিরোধ মীমাংসাই। অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি শত্রু পক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে জেতার জন্য কোন কথা বানিয়ে বলবে। তেমনিভাবে কোন পুরুষ নিজ স্ত্রীর সঙ্গে এবং কোন মহিলা নিজ স্বামীর সঙ্গে কোন কথা বানিয়ে বলবে’’।
(আবূ দাউদ ৪৯২১)
ইব্নু শিহাব যুহ্রী বলেন: আমার শুনাজানা মতে তিন জায়গায়ই মিথ্যা কথা বলা যায়। আর তা হচ্ছে যুদ্ধ, মানুষের পরস্পর বিরোধ মীমাংসা এবং স্বামী-স্ত্রীর পরস্পর কথা।
মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানও কবীরা গুনাহ্গুলোর অন্যতম।
আল্লাহ্’র খাঁটি বান্দাহ্দের বৈশিষ্ট্য তো এই যে, তারা কখনো মিথ্যা সাক্ষ্য দিবেন না। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَالَّذِيْنَ لَا يَشْهَدُوْنَ الزُّوْرَ»
‘‘আর যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না’’। (ফুরকান : ৭২)