সরকারী কোষাগার চার ধরনের দায়ভার গ্রহণ করতে বাধ্য। যা নিম্নরূপ:
১. কোন মুসলিম ঋণগ্রস্তাবস্থায় মারা গেলে এবং ঋণ পরিশোধ করার মতো কোন সম্পদ সে রেখে না গেলে উক্ত ঋণ তার সরকারই পরিশোধ করবে।
২. কেউ কাউকে ভুলবশত: অথবা তুলনামূলক ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করলে এবং সে ব্যক্তি আর্থিকভাবে সচ্ছল না হলে অথবা তার কোন আত্মীয়-স্বজন না থাকলে উক্ত দিয়াত তার সরকারই পরিশোধ করবে। তবে তার কোন আত্মীয়-স্বজন থাকলে তারাই তা পরিশোধ করবে।
৩. কোন হত্যাকৃত ব্যক্তির ওয়ারিশরা নির্দিষ্ট কোন আলামতের ভিত্তিতে কাউকে সে হত্যার জন্য দায়ী করলে অতঃপর বিচারক তাদেরকে সে ব্যাপারে পঞ্চাশটি কসম করতে বলার পরও তারা তা করতে অস্বীকৃতি জানালে এবং বিবাদীর পক্ষ থেকেও তারা সে জাতীয় কসম গ্রহণ না করলে সরকার কোষাগার থেকেই তার দিয়াত আদায় করবে।
৪. কোন হত্যাকৃত ব্যক্তির হত্যাকারীর পরিচয় পাওয়া না গেলেও সরকার তার দিয়াত বায়তুল্মাল্ থেকেই আদায় করবে।
ইচ্ছাকৃত হত্যা বলতে স্বভাবত: হত্যা করা হয় এমন বস্ত্ত দিয়ে কাউকে হত্যা করাকে বুঝানো হয়।
নিম্নে ইচ্ছাকৃত হত্যার কয়েকটি রূপ উল্লেখ করা হয়েছে:
১. কোন ভারী বস্ত্ত দিয়ে হত্যা।
২. শরীরে ঢুকে যায় এমন বস্ত্ত দিয়ে হত্যা।
৩. হিংস্র পশুর থাবায় নিক্ষেপ করে হত্যা।
৪. আগুনে বা পানিতে নিক্ষেপ করে হত্যা।
৫. গলা টিপে হত্যা।
৬. খানা-পানি না দিয়ে খিদে ও তৃষ্ণায় হত্যা।
৭. বিষ পানে হত্যা।
৮. যাদু করে হত্যা।
৯. হত্যা সংক্রান্ত ব্যাপারে দু’জন মিলে সাক্ষী দিয়ে কাউকে হত্যা করানো।
নিরেট ইচ্ছাকৃত অথবা তুলনামূলক ইচ্ছাকৃত হত্যার দিয়াত হচ্ছে: একশতটি উট। যার মধ্যে চল্লিশটি হবে গর্ভবতী।
আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আমর বিন্ ‘আস্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
أَلَا إِنَّ دِيَةَ الْـخَطَإِ شِبْهِ الْعَمْدِ: مَا كَانَ بِالسَّوْطِ وَالْعَصَا مِئَةٌ مِنَ الْإِبِلِ، مِنْهَا أَرْبَعُوْنَ فِيْ بُطُوْنِهَا أَوْلَادُهَا.
‘‘কাউকে লাঠি ও বেত্রাঘাতে হত্যা করা হলে তথা তুলনামূলক ইচ্ছাকৃত হত্যার দিয়াত হচ্ছে: একশতটি উট। যার মধ্যে চল্লিশটি হবে গর্ভবতী’’।
(আবূ দাউদ ৪৫৪৭, ৪৫৮৮ নাসায়ী : ৮/৪১; ইব্নু মাজাহ্ ২৬৭৬; ইব্নু হিববান ১৫২৬)
‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আমর বিন্ ‘আস্ (রা.) থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
عَقْلُ شِبْهِ الْعَمْدِ مُغَلَّظٌ مِثْلُ عَقْلِ الْعَمْدِ، وَلَا يُقْتَلُ صَاحِبُهُ.
‘‘তুলনামূলক ইচ্ছাকৃত হত্যার দিয়াত ইচ্ছাকৃত হত্যার দিয়াতের ন্যায় বেশি। এ জাতীয় হত্যাকারীকে কখনো হত্যা করা হবে না’’।
(আবূ দাউদ ৪৫৬৫)
ভুলবশত: হত্যার দিয়াত হচ্ছে: বিশটি দু’বছরের মাদি উট, চল্লিশটি তিন বছরের নর ও মাদি উট, বিশটি চার বছরের মাদি উট ও বিশটি পাঁচ বছরের মাদি উট।
‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্’ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
دِيَةُ الْخَطَإِ أَخْمَاسًا: عِشْرُوْنَ حِقَّةً، وَعِشْرُوْنَ جَذَعَةً، وَعِشْرُوْنَ بَنَاتِ مَخَاضٍ، وَعِشْرُوْنَ بَنَاتِ لَبُوْنٍ، وَعِشْرُوْنَ بَنِيْ لَبُوْنٍ.
‘‘ভুলবশত: হত্যার দিয়াত হচ্ছে: বিশটি চার বছরের মাদি উট, বিশটি পাঁচ বছরের মাদি উট, বিশটি দু’ বছরের মাদি উট ও চল্লিশটি তিন বছরের নর ও মাদি উট’’। (দারাক্বুত্বনী, হাদীস ৩৩৩২)
বর্তমান সৌদি রিয়ালের হিসাবানুযায়ী নিরেট ইচ্ছাকৃত অথবা তুলনামূলক ইচ্ছাকৃত হত্যার দিয়াত হচ্ছে: ১,২০, ০০০ (এক লক্ষ বিশ হাজার) রিয়াল এবং ভুলবশত: হত্যার দিয়াত হচ্ছে: ১০০, ০০০ (এক লক্ষ) রিয়াল। তবে সর্ব যুগেই উটের মূল্যের পরিবর্তনের কারণে উক্ত দিয়াতের হার পরিবর্তনশীল।
ইচ্ছাকৃত হত্যার দিয়াত স্বয়ং হত্যাকারীই পরিশোধ করতে বাধ্য। অন্য কেউ উহার সামান্যটুকুও বহন করবে না। তবে তুলনামূলক ইচ্ছাকৃত হত্যা ও ভুলবশত: হত্যার দিয়াত হত্যাকারীর পুরুষ আত্মীয়-স্বজনই পরিশোধ করবে। যদিও হত্যাকারী ধনীই হোক না কেন। তবে বিজ্ঞ বিচারক ব্যক্তি উক্ত দিয়্যাতকে আত্মীয়তার দূরত্ব ও নৈকট্যের কথা বিবেচনা করে সকল আত্মীয়-স্বজনের উপর বন্টন করে দিবে। যা তারা তিন বছরের মধ্যেই সহজ ও সরল কিস্তিতে পরিশোধ করবে।
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
اقْتَتَلَتِ امْرَأَتَانِ مِنْ هُذَيْلٍ، فَرَمَتْ إِحْدَاهُمَا الْأُخْرَى بِحَجَرٍ فَقَتَلَتْهَا وَمَا فِيْ بَطْنِـهَا، فَاخْتَصَمُوْا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ ، فَقَضَى رَسُوْلِ اللهِ أَنَّ دِيَةَ جَنِيْنِهَا غُرَّةٌ: عَبْدٌ أَوْ وَلِيْدَةٌ، وَقَضَى بِدِيَةِ الْـمَرْأَةِ عَلَى عَاقِلَتِهَا.
‘‘হুযাইল্ গোত্রের দু’জন মহিলা ঝগড়া করে একজন অপরজনকে একটি পাথর নিক্ষেপ করে। তাতে অপর মহিলাটি ও তার পেটের সন্তান মরে যায়। মহিলাটির ওয়ারিশরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এ ব্যাপারে বিচার দায়ের করলে তিনি নিম্নোক্ত ফায়সালা করেন:
১. সন্তানের দিয়াত হচ্ছে, একটি গোলাম অথবা একটি বান্দি। যা হত্যাকারিণী মহিলাটি স্বয়ং আদায় করবে। যার পরিমাণ পাঁচটি উট।
২. হত্যাকৃতা মহিলার দিয়াত হত্যাকারিণী মহিলার আত্মীয়-স্বজনরাই আদায় করবে’’। (বুখারী ৫৭৫৮; মুসলিম ১৬৮১)
মিক্বদাম শামী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
أَنَا وَارِثُ مَنْ لَا وَارِثَ لَهُ، أَعْقِلُ عَنْهُ وَأَرِثُهُ، وَالْـخَالُ وَارِثُ مَنْ لَا وَارِثَ لَهُ، يَعْقِلُ عَنْهُ وَيَرِثُهُ.
’’যার ওয়ারিশ নেই তার ওয়ারিশ হবো আমি। আমি তার পক্ষ থেকে দিয়াত দেবো এবং তার ওয়ারিশ হবো। যার ওয়ারিশ নেই তার ওয়ারিশ হবে তার মামা। সে তার পক্ষ থেকে দিয়াত দেবে এবং তার ওয়ারিশ হবে’’। (ইব্নু মাজাহ্ ২৬৮৪)
ইহুদি-খ্রিস্টান অথবা যে কোন চুক্তিবদ্ধ কিংবা নিরাপত্তাপ্রাপ্ত কাফিরের দিয়াত মুসলিমের দিয়্যাতের অর্ধেক। অনুরূপভাবে গোলামের দিয়্যাতও স্বাধীন পুরুষের দিয়্যাতের অর্ধেক। তেমনিভাবে মহিলার দিয়্যাতও পুরুষের দিয়্যাতের অর্ধেক। এ ব্যাপারে আলিমদের ঐকমত্য রয়েছে।
‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আমর বিন্ ‘আস্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
قَضَى رَسُوْلُ اللهِ أَنَّ عَقْلَ أَهْلِ الْكِتَابَيْنِ نِصْفُ عَقْلِ الْـمُسْلِمِيْنَ، وَهُمُ الْيَهُوْدُ وَالنَّصَارَى.
’’ইহুদি-খ্রিস্টানদের সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ফায়সালা এই যে, তাদের দিয়াত মুসলিমদের দিয়্যাতের অর্ধেক’’। (ইব্নু মাজাহ্ ২৬৯৪)
‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আমর বিন্ ‘আস্ (রা.) থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
دِيَةُ الْـمُعَاهَدِ نِصْفُ دِيَةِ الْـحُرِّ.
‘‘চুক্তিবদ্ধ কাফিরের দিয়াত স্বাধীন পুরুষের দিয়্যাতের অর্ধেক’’।
(আবূ দাউদ ৪৫৮৩)
‘আমর বিন্ শু‘আইব থেকে বর্ণিত তিনি তার পিতা থেকে এবং তার পিতা তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
عَقْلُ الْـمَرأَةِ مِثْلُ عَقْلِ الرَّجُلِ، حَتَّى يَبْلُغَ الثُّلُثَ مِنْ دِيَتِهَا.
‘‘মহিলার দিয়াত পুরুষের দিয়্যাতের মতোই। তবে যখন তা তার মূল দিয়্যাতের এক তৃতীয়াংশে পৌঁছুবে তখন তার দিয়াত হবে পুরুষের দিয়্যাতের অর্ধেক’’। (নাসায়ী : ৮/৪৫)
যদি কোন হত্যাকৃত ব্যক্তি কোথাও ক্ষতবিক্ষত অথবা রক্তাক্তাবস্থায় পাওয়া যায় এবং তার হত্যাকারী জানা না যায়। এমনকি হত্যাকারীর ব্যাপারে কোন প্রমাণও মিলেনি। তবুও হত্যাকৃতের ওয়ারিশরা উক্ত হত্যার ব্যাপারে নির্দিষ্ট কাউকে দায়ী করছে এবং তাদের দাবির পক্ষে কিছু আকার-ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। যেমন: হত্যাকৃত ব্যক্তি ও সন্দেহকৃত ব্যক্তির মাঝে পূর্বের কোন শত্রুতা ছিলো অথবা সন্দেহকৃত ব্যক্তির ঘরেই হত্যাকৃত ব্যক্তিকে পাওয়া গেলো অথবা হত্যাকৃতের কোন ব্যবহৃত সম্পদ সন্দেহকৃত ব্যক্তির সাথে পাওয়া গেলো অথবা হত্যার ব্যাপারে বাচ্চাদের সাক্ষী পাওয়া যায় কোন বালিগ পুরুষের নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এমতাবস্থায় বাদী ব্যক্তি সন্দেহকৃত ব্যক্তি যে উক্ত ব্যক্তিকে হত্যা করেছে তা বলে পঞ্চাশটি কসম খাবে। অতঃপর ইচ্ছাকৃত হত্যা বলে প্রমাণিত হলে তার ক্বিসাস্ নেয়া হবে এবং ভুলবশত হত্যা প্রমাণিত হলে উহার দিয়াত নেয়া হবে। আর যদি বাদী ব্যক্তি পঞ্চাশটি কসম খেতে অস্বীকার করে অথবা বাদী পক্ষ মহিলা কিংবা বাচ্চা হয় তখন বিবাদী ব্যক্তি পঞ্চাশটি কসম খেয়ে উক্ত অপবাদ থেকে নিজকে নিষ্কৃত করবে। আর যদি সেও কসম খেতে অস্বীকার করে তা হলে অবশ্যই তাকে হত্যাকারী বলে দোষী সাব্যস্ত করা হবে। আর যদি বিবাদী ব্যক্তি পঞ্চাশটি কসম খেয়ে বসে অথবা বাদী পক্ষ তার কসমে রাজি না হয় তখন হত্যাকারীর দিয়াত সরকারী খাজাঞ্চিখানা থেকে দেয়া হবে।
তবে ’উলামা সম্প্রদায় উক্ত দাবির বিশুদ্ধতার জন্য দশটি শর্ত উল্লেখ করে থাকেন। যা নিম্নরূপ:
১. উক্ত হত্যার দাবি বিশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে কিছু আকার-ইঙ্গিত পাওয়া যেতে হবে। যার কিয়দংশ উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।
২. যার বিরুদ্ধে হত্যার দাবি করা হচ্ছে সে বালিগ ও সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হতে হবে।
৩. যার ব্যাপারে হত্যার সন্দেহ করা হচ্ছে তার পক্ষে কাউকে হত্যা করা সম্ভবপর হতে হবে। যেমন: কারোর হাত-পা অবশ। এমতাবস্থায় তাকে সন্দেহ করা যাবে না।
৪. উক্ত দাবির মধ্যে হত্যার বাস্তব বর্ণনা অবশ্যই থাকতে হবে। যেমন: এমন বলা যে, তার শরীরের ওমুক জায়গায় তলোয়ারের আঘাত রয়েছে।
৫. সমস্ত ওয়ারিশ উক্ত হত্যার দাবির ব্যাপারে একমত হতে হবে। কেউ চুপ থাকলে চলবে না।
৬. সমস্ত ওয়ারিশ উক্ত হত্যার ব্যাপারে একমত হতে হবে। কেউ উক্ত হত্যাকে অস্বীকার করলে চলবে না।
৭. সমস্ত ওয়ারিশ উক্ত দাবি করতে হবে।
৮. সমস্ত ওয়ারিশ এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তিকে দায়ী করতে হবে। এমন যেন না হয়, কেউ বললো: অমুক ব্যক্তি হত্যা করেছে। আরেক জন বললো: না, এ নয় বরং অন্য আরেক জন হত্যা করেছে।
৯. ওয়ারিশদের মধ্যে পুরুষ থাকতে হবে।
১০. দাবি এক ব্যক্তির ব্যাপারে হতে হবে। অনেক জনের ব্যাপারে নয়।
সাহ্ল বিন্ আবূ হাস্মা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি তাঁর বংশের বড়দের মুখ থেকে শ্রবণ করেন যে, আব্দুল্লাহ্ বিন্ সাহ্ল এবং মু’হাইয়েসা (রা.) কোন এক কারণে খাইবার রওয়ানা করেন। কিছুক্ষণ পর উভয় জন ভিন্ন হয়ে যান। অতঃপর মু’হাইয়েসার নিকট এ সংবাদ আসলো যে, ‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ সাহ্লকে হত্যা করে কূপে ফেলে দেয়া হয়েছে। তখন সে ইহুদিদের নিকট এসে বললো: আল্লাহ্’র কসম! তোমরাই ওকে হত্যা করেছো। তারা বললো: আল্লাহ্’র কসম! আমরা ওকে হত্যা করিনি। তখন সে এবং তার ভাই ’হুওয়াইয়েসা এবং আব্দুর রহ্মান বিন্ সাহ্ল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসলো। মু’হাইয়েসা কথা বলতে চাইলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন:
كَبِّرْ كَبِّرْ.
‘‘তোমার বড় ভাইকে কথা বলতে দাও’’।
তখন ’হুওয়াইয়েসা ঘটনাটি বিস্তারিত বললে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
إِمَّا أَنْ يَّدُوْا وَإِمَّا أَنْ يَّأْذَنُوْا بِحَرْبٍ، فَكَتَبَ إِلَيْهِمْ فِيْ ذَلِكَ كِتَابًا، فَكَتَبُوْا: إِنَّا وَاللهِ مَا قَتَلْنَاهُ، فَقَالَ لِـحُوَيِّصَةَ وَمُحَيِّصَةَ وَعَبْدِ الرَّحْمَنْ بِنْ سَهْلٍ: أَتَحْلِفُوْنَ وَتَسْتَحِقُّوْنَ دَمَ صَاحِبِكُمْ؟ قَالُوْا: لَا، قَالَ: فَتَحْلِفُ لَكُمْ يَهُوْدُ؟ قَالُوْا: لَيْسُوْا مُسْلِمِيْنَ، فَوَدَاهُ رَسُوْلُ اللهِ مِنْ عِنْدِهِ، فَبَعَثَ إِلَيْهِمْ مِئَةَ نَاقَةٍ.
‘‘তারা দিয়াত দিবে অথবা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দিবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যপারে তাদের নিকট চিঠি পাঠালে তারা তাঁর কাছে লিখে পাঠায় যে, আল্লাহ্’র কসম! আমরা ওকে হত্যা করিনি। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ’হুওয়াইয়েসা, মু’হাইয়েসা ও আব্দুর রহ্মান বিন্ সাহ্লকে বলেন: তোমরা কি কসম খেয়ে ওর ক্বিসাস্ নিবে? তারা বললো: না। তিনি বললেন: তাহলে ইহুদিরা তোমাদের নিকট কসম খাবে? তারা বললো: তারা মুসলিম নয়। অতএব তাদের কসমের কোন গুরুত্ব নেই। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ পক্ষ থেকে একশতটি উট তাদের নিকট দিয়াত হিসেবে পাঠিয়ে দেন’’। (বুখারী ৭১৯২; মুসলিম ১৬৬৯)
কেউ কাউকে ধোঁকা কিংবা কৌশলে অথবা অভয় দিয়ে হত্যা করলে (চাই তা সম্পদের জন্য হোক কিংবা ইজ্জতহানির জন্যে অথবা কোন রহস্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়) এমনকি স্বামী স্ত্রীকে অথবা স্ত্রী স্বামীকে হত্যা করলেও বিচারক উক্ত হত্যাকারীকে অবশ্যই হত্যা করবে। কোনভাবেই তাকে ক্ষমা করা হবে না। কারণ, সে আল্লাহ্ তা‘আলার যমিনে ফিৎনা সৃষ্টিকারী। অনুরূপভাবে সন্ত্রাসী, দস্যু, তস্কর, ধর্ষক ও শ্লীলতাহানিকারী, ছিনতাইকারী এবং অপহরণকারীর বিধানও একই। চাই তারা কাউকে হত্যা করুক অথবা নাই করুক। তবে তারা কাউকে হত্যা করলে অবশ্যই তাদেরকে হত্যা করতে হবে। আর তারা কাউকে হত্যা না করলে তাদেরকে চারটি শাস্তির যে কোন একটি শাস্তি দেয়া হবে। হত্যা করা হবে অথবা ফাঁসী দেয়া হবে অথবা এক দিকের হাত এবং অপর দিকের পা কেটে ফেলা হবে অথবা অন্য এলাকার জেলে বন্ধী করে রাখা হবে যতক্ষণ না তারা খাঁটি তাওবা করে নেয়। এমনকি একজনকে হত্যা করার ব্যাপারে কয়েকজন অংশ গ্রহণ করলেও তাদের সকলকে হত্যা করা হবে। যদি তারা সরাসরি উক্ত হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণ করে থাকে।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«إِنَّمَا جَزَآءُ الَّذِيْنَ يُحَارِبُوْنَ اللهَ وَرَسُوْلَهُ وَيَسْعَوْنَ فِيْ الْأَرْضِ فَسَادًا أَنْ يُّقَتَّلُوْا أَوْ يُصَلَّبُوْا أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيْهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ مِّنْ خِلَافٍ أَوْ يُنْفَوْ مِنَ الْأَرْضِ، ذَلِكَ لَـهُمْ خِزْيٌ فِيْ الدُّنْيَا وَلَـهُمْ فِيْ الْآخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيْمٌ، إِلاَّ الَّذِيْنَ تَابُوْا مِنْ قَبْلِ أَنْ تَقْدِرُوْا عَلَيْهِمْ فَاعْلَمُوْا أَنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ»
‘‘যারা আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে যুদ্ধ কিংবা প্রকাশ্য শত্রুতা পোষণ করে অথবা আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিধি-বিধানের উপর হঠকারিতা দেখায় এবং (হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ ও ছিনতাইয়ের মাধ্যমে) ভূ-পৃষ্ঠে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের শাস্তি এটাই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা ফাঁসী দেয়া হবে অথবা এক দিকের হাত এবং অপর দিকের পা কেটে ফেলা হবে অথবা অন্য এলাকার জেলে বন্দী করে রাখা হবে (যতক্ষণ না তারা খাঁটি তাওবা করে নেয়)। এ হচ্ছে তাদের জন্য ইহলোকের ভীষণ অপমান এবং পরকালেও তাদের জন্য ভীষণ শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে তোমরা তাদেরকে গ্রেফতার করার পূর্বে যদি তারা স্বেচ্ছায় তাওবা করে নেয় তাহলে জেনে রাখো যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা ক্ষমাশীল ও অত্যন্ত দয়ালু’’। (মা’য়িদাহ্ : ৩৩)
তবে মানুষের হৃত অধিকার তাদেরকে অবশ্যই পূরণ করতে হবে।
আনাস্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
قَدِمَ أُنَاسٌ مِنْ عُرَيْنَةَ عَلَى رَسُوْلُ اللهِ الْـمَدِيْنَةَ، فَاجْتَوَوْهَا، فَقَالَ لَـهُمْ رَسُوْلُ اللهِ : إِنْ شِئْتُمْ أَنْ تَخْرُجُـوْا إِلَى إِبِلِ الصَّدَقَةِ فَتَشْرَبُوْا مِنْ أَلْبَانِهَا وَأَبْوَالِهَا، فَفَعَلُوْا، فَصَحُّوْا، ثُمَّ مَالُوْا عَلَى الرُّعَاةِ فَقَتَلُوْهُمْ وَارْتَدُّوْا عَنِ الْإِسْلَامِ، وَسَاقُوْا ذَوْدَ رَسُوْلِ اللهِ ، فَبَلَغَ ذَلِكَ النَّبِيَّ ، فَبَعَثَ فِيْ أَثَرِهِمْ، فَأُتِيَ بِهِمْ، فَقَطَعَ أَيْدِيَهُمْ وَأَرْجُلَهُمْ، وَسَمَلَ أَعْيُنَهُمْ وَتَرَكَهُمْ فِيْ الْـحَرَّةِ حَتَّى مَاتُوْا.
’উরাইনাহ্ গোত্রের কিছু লোক মদিনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসলো। অসুস্থতার দরুন তারা মদীনায় অবস্থান করতে চাচ্ছিলো না। অতএব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন: যদি তোমাদের মনে চায় তা হলে তোমরা সাদাকার উটের দুধ ও প্রস্রাব পান করতে পারো। তারা তাই করলো। তাতে তারা সুস্থ হয়ে গেলো। অতঃপর তারা উট রাখালদেরকে হত্যা করলো, মুর্তাদ্ হয়ে গেলো এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কয়েকটি উট নিয়ে গেলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যাপারটি জানতে পেরে তাদেরকে ধরে আনার জন্য লোক পাঠালেন। তাদেরকে উপস্থিত করা হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের হাত-পা কেটে দিলেন, তাদের চোখ উঠিয়ে ফেললেন এবং তাদেরকে রোদ্রে বেঁধে রাখলেন যতক্ষণ না তারা মৃত্যু বরণ করে’’।
(বুখারী ৫৬৮৫, ৫৬৮৬; মুসলিম ১৬৭১)
আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’উমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
قُتِلَ غُلَامٌ غِيْلَةً، فَقَالَ عُمَرُ: لَوِ اشْتَرَكَ فِيْهِ أَهْلُ صَنْعَاءَ لَقَتَلْتُهُمْ بِهِ.
‘‘জনৈক যুবককে গুপ্তভাবে হত্যা করা হলে ’উমর (রাঃ) বললেন: পুরো সান্‘আবাসীরাও (বর্তমানে ইয়েমেনের রাজধানী) যদি উক্ত যুবককে হত্যা করায় অংশ গ্রহণ করতো তা হলে আমি তাদের সকলকেই ওর পরিবর্তে হত্যা করতাম। তাদেরকে আমি কখনোই এমনিতেই ছেড়ে দিতাম না’’।
(বুখারী ৬৮৯৬)
তবে একটি প্রশ্ন থেকে যায়। আর তা হলো: কেউ কাউকে হত্যা করে তাওবা করে ফেললে সে দুনিয়া ও আখিরাতের শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে কি না?
এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, তাওবার কারণে দুনিয়ার শাস্তি কখনো ক্ষমা করা হবে না। তবে হত্যাকৃত ব্যক্তির ওয়ারিশরা যদি হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেয় তা হলে তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। অন্যথা নয়।
তবে তাওবার কারণে আখিরাতে তাকে ক্ষমা করা হবে কি না সে ব্যাপারে আলিমদের মতানৈক্য রয়েছে। এ ব্যাপারে তাদের তিনটি মত উল্লেখযোগ্য। যা নিম্নরূপ:
১. তার জন্য আখিরাতের শাস্তি ক্ষমা করা হবে না। কারণ, যাকে হত্যা করা হয়েছে সে তার অধিকার ফিরে পায়নি। অতএব তাকে তা আখিরাতে দেয়া হবে।
২. তাওবার কারণে আখিরাতে তাকে আর শাস্তি দেয়া হবে না। কারণ, তাওবা সকল গুনাহ্ মুছে দেয়। আর হত্যাকৃত ব্যক্তি যখন নিজ অধিকার আদায় করতে সক্ষম নয় সে জন্য তার ওয়ারিশদেরকে এ ব্যাপারে তার প্রতিনিধি বানানো হয়েছে। সুতরাং তাদের ফায়সালা তার ফায়সালা হিসেবেই ধরা হবে। অতএব আখিরাতে তার পাওনা বলতে কিছুই থাকবে না। যার দরুন হত্যাকারীকে শাস্তি পেতে হবে।
প্রথম মতই গ্রহণযোগ্য। কারণ, তাতে আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আববাসের সমর্থন রয়েছে। আর একটি কথা হচ্ছে, হত্যার সঙ্গে তিনটি অধিকার সম্পৃক্ত। আল্লাহ্’র অধিকার, হত্যাকৃত ব্যক্তির অধিকার ও তার ওয়ারিশদের অধিকার। সুতরাং তাওবার কারণে আল্লাহ্ তা‘আলার অধিকার রক্ষা পেলো। ওয়ারিশদের অধিকার ক্বিসাস্ (হত্যার বিনিময়ে হত্যা), দিয়াত (শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ), চুক্তিবদ্ধ সম্পদ অথবা ক্ষমার মাধ্যমে রক্ষিত হয়। তবে হত্যাকৃত ব্যক্তির অধিকার কিছুতেই রক্ষা পায়নি। যা সে পরকালেই পাবে ইন্শাআল্লাহ্।