হারাম ও কবিরা গুনাহ হারাম ও কবীরা গুনাহ্ পরিচিতি মোস্তাফিজুর রহমান বিন আব্দুল আজিজ আল-মাদানী ১ টি

’’হারাম’’ শব্দের আভিধানিক অর্থ: অবৈধ বা নিষিদ্ধ (বস্ত্ত, কথা, কাজ, বিশ্বাস ও ধারণা)। শরীয়তের পরিভাষায় হারাম বলতে সে সকল গুনাহ্কে বুঝানো হয় যে সকল গুনাহ্গার শরীয়তের দৃষ্টিতে যে কোনভাবে নিন্দিত।

’’কবীরা’’ শব্দের আভিধানিক অর্থ: বড়। শরীয়তের পরিভাষায় কবীরা গুনাহ্ বলতে সে সকল গুনাহ্কে বুঝানো হয় যে সকল গুনাহ্’র ব্যাপারে কুর‘আন বা সহীহ হাদীসে নির্দিষ্ট ঐহিক বা পারলৌকিক শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে অথবা সে সকল গুনাহ্কে কুর‘আন, হাদীস কিংবা সকল আলিমের ঐকমত্যে কবীরা বা মারাত্মক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

কারো কারো মতে কবীরা গুনাহ্ বলতে সে সকল গুনাহ্কে বুঝানো হয় যে সকল গুনাহ্’র ব্যাপারে শাস্তি, ক্রোধ, ঈমানশূন্যতা বা অভিশাপের মারাত্মক হুমকি বা জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে।

আবার কারো কারো মতে কবীরা গুনাহ্ বলতে সে সকল গুনাহ্কে বুঝানো হয় যে সকল গুনাহ্গারকে আল্লাহ্ তা‘আলা বা তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন অথবা যে সকল গুনাহ্গারকে কুর‘আন কিংবা সহীহ হাদীসে ফাসিক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

কারো কারো মতে কবীরা গুনাহ্ বলতে সে সকল কাজকে বুঝানো হয় যে সকল কাজ হারাম হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সকল শরীয়ত একমত।

আবার কারো কারো মতে কবীরা গুনাহ্ বলতে সে সকল কাজকে বুঝানো হয় যে সকল কাজ হারাম হওয়ার ব্যাপারে কুর‘আনের সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে।

কারো কারো মতে কবীরা গুনাহ্ বলতে সে সকল গুনাহ্কে বুঝানো হয় যে সকল গুনাহ্’র বিস্তারিত বর্ণনা আল্লাহ্ তা‘আলা সূরাহ নিসা’র শুরু থেকে নিম্নোক্ত আয়াত পর্যন্ত দিয়েছেন।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«إِنْ تَجْتَنِبُوْا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ، وَنُدْخِلْكُمْ مُّدْخَلًا كَرِيْمًا»

‘‘তোমরা যদি সকল মহাপাপ থেকে বিরত থাকো যা হতে তোমাদেরকে (কঠিনভাবে) বারণ করা হয়েছে তাহলে আমি তোমাদের সকল ছোট পাপ ক্ষমা করে দেবো এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবো খুব সম্মানজনক স্থানে’’। (নিসা’ : ৩১)

অনুরূপভাবে কোন ফরয কাজ পরিত্যাগ করাও কবীরা গুনাহ্’র শামিল।

কবীরা গুনাহ্’র উক্ত সংজ্ঞাদাতারা উহার কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা বর্ণনা করেননি। বরং তাঁরা ওই সকল গুনাহ্কেই কবীরা গুনাহ্ বলে আখ্যায়িত করেন যে সকল গুনাহ্’র মধ্যে উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান।

ঠিক এরই বিপরীতে কিছু সংখ্যক সাহাবা ও বিশিষ্ট আলিম কবীরা গুনাহ্’র নির্দিষ্ট সংখ্যা বর্ণনা করেন।

আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্’ঊদ (রাঃ) বলেন: কবীরা গুনাহ্ সর্বমোট চারটি।

আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’উমর (রাযিয়াল্লাহু ‘আন্হুমা) বলেন: কবীরা গুনাহ্ সর্বমোট সাতটি।

আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আমর বিন্ ‘আস্ (রাযিয়াল্লাহু ‘আন্হুমা) বলেন: কবীরা গুনাহ্ সর্বমোট নয়টি।

কেউ কেউ বলেন: কবীরা গুনাহ্ সর্বমোট এগারোটি।

আবার কারো কারো মতে কবীরা গুনাহ্ সর্বমোট সত্তরটি।

আবূ ত্বালিব মাক্কী (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: কবীরা গুনাহ্ সংক্রান্ত সাহাবাদের সকল বাণী একত্রিত করলে যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে:

অন্তরের সাথে সম্পর্কিত কবীরা গুনাহ্ চারটি: আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করা, কোন গুনাহ্ বার বার করতে থাকার মানসিকতা, যদিও তা একেবারেই ছোট হোক না কেন, আল্লাহ্ তা‘আলার রহমত থেকে সম্পূর্ণরূপে নিরাশ এবং তাঁর পাকড়াও থেকে একেবারেই নিশ্চিন্ত হওয়া।

মুখের সাথে সম্পর্কিত কবীরা গুনাহ্ও চারটি: মিথ্যা সাক্ষী, কোন সতী-সাধ্বী মহিলাকে ব্যভিচারের অপবাধ দেয়া, মিথ্যা কসম ও যাদু।

পেটের সাথে সম্পর্কিত কবীরা গুনাহ্ তিনটি: মদ্য পান, ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ ও সুদ খাওয়া।

লজ্জাস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত কবীরা গুনাহ্ দু’টি: ব্যভিচার ও সমকাম।

হাতের সঙ্গে সম্পর্কিত কবীরা গুনাহ্ও দু’টি: হত্যা ও চুরি।

পায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত কবীরা গুনাহ্ একটি। আর তা হচ্ছে কাফির ও মুশ্রিকের সাথে সম্মুখযুদ্ধ থেকে পলায়ন।

পুরো শরীরের সঙ্গে সম্পর্কিত কবীরা গুনাহ্ও একটি। আর তা হচ্ছে নিজ মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া।

আবার কোন কোন আলিমের মতে সকল পাপই মহাপাপ। কারণ, যে কোন গুনাহ্’র মানেই আল্লাহ্ তা‘আলার সঙ্গে চরম স্পর্ধা প্রদর্শন ও তাঁর একান্ত নাফরমানি।

তাদের ধারণা, কোন গুনাহ্ই তা যে পর্যায়েরই হোক না কেন তা আল্লাহ্ তা‘আলার এতটুকুও ক্ষতি করতে পারে না। সুতরাং সকল গুনাহ্ই আল্লাহ্ তা‘আলার দৃষ্টিতে সমান। সকল গুনাহ্ই তাঁর নাফরমানি বৈ কি?

তারা আরো বলেন: গুনাহ্’র ভয়ঙ্করতা নির্ভরশীল আল্লাহ্ তা‘আলার অধিকার বিনষ্ট ও উহার প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শনের উপরই। তা না হলে যে ব্যক্তি শরীয়তের বিধান না জেনে হালাল মনে করে মদ পান বা ব্যভিচার করেছে তার শাস্তি অনেক বেশি হতো সে ব্যক্তির চাইতে যে ব্যক্তি তা হারাম জেনে সংঘটন করেছে। কারণ, প্রথম ব্যক্তির দোষ দু’টি: মূর্খতা ও হারাম কাজ সংঘটন এবং দ্বিতীয় ব্যক্তির দোষ শুধুমাত্র একটি। আর তা হচ্ছে হারাম কাজ সংঘটন। অথচ দ্বিতীয় ব্যক্তি নির্দিষ্ট শাস্তি পাচ্ছে এবং প্রথম ব্যক্তি তা পাচ্ছে না। আর তা হচ্ছে এ কারণেই যে, প্রথম ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলার অধিকারের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করেনি। কারণ, সে জানেই না যে তা আল্লাহ্ তা‘আলার অধিকার। ঠিক এরই বিপরীতে দ্বিতীয় ব্যক্তি তা আল্লাহ্ তা‘আলার অধিকার জেনেই তার প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে।

তারা আরো বলেন: গুনাহ্ মানেই আল্লাহ্ তা‘আলার আদেশ ও নিষেধকে তুচ্ছ মনে করা এবং তাঁর দেয়া নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে সকল গুনাহ্ই সমান। সবই বড়।

যেমন: জনৈক ব্যক্তি তার একটি গোলামকে ভারী কাজের আদেশ করেছেন আর অন্য জনকে হালকা কাজের। অথচ তাদের কেউই উক্ত আদেশ পালন করেনি। তখন সে ব্যক্তি উভয় গোলামকেই ঘৃণা করবে এবং তাদেরকে বিক্রি করে দিবে।

তারা আরো বলেন: উক্ত কারণেই যে ব্যক্তি মক্কায় অবস্থান করেও হজ্জ করেনি অথবা যে ব্যক্তি মসজিদের পাশে থেকেও নামায পড়েনি তার অপরাধ অনেক বেশি সে ব্যক্তির চাইতে যার ঘর মক্কা বা মসজিদ থেকে অনেক দূরে। ঠিক এরই বিপরীতে অপর দু’ ব্যক্তি সমান দোষী যাদের একজন পঞ্চাশ হাজার টাকার মালিক অথচ সে যাকাত আদায় করেনি। আর অন্য জন দু’ লক্ষ টাকার মালিক তবুও সে যাকাত আদায় করেনি। কারণ, উভয় জনই যাকাত দিচ্ছে না। চাই তাদের কারোর সম্পদ বেশি হোক বা কম। অন্য দিকে যাকাত দিতে তেমন কোন পরিশ্রমও নেই।