যে সমাজে যাদু দ্বারা মানুষের ক্ষতি সাধন করা হয় এবং যাদুর প্রাদুর্ভাব বেশি, বিশেষ করে নব দম্পতির জন্য সেখানে পূর্বেই এর বিপদ থেকে রেহাই পাওয়ার যে সব করণীয় বিষয় আছে তা এখানে বর্ণনা করা হবে। এক্ষেত্রে এক বিশেষ প্রশ্নের গুরুত্ব রাখেঃ নব দম্পতির জন্য কি যাদু প্রতিরোধের কোন উপায় রয়েছে, যার ফলে যদিও তাদের জন্য যাদু করা হয়; কিন্তু তাতে তাদের কোন ক্ষতি হবে না? উত্তরঃ হ্যাঁ অবশ্যই উপায় রয়েছে, যা অচিরেই বর্ণনা করব ইনশাআল্লাহ! কিন্তু তার পূর্বে পাঠকদের জন্য এ ঘটনাটি বর্ণনা করা ভালো মনে করি ।
এক পরহেযগার যুবকের ঘটনা। সে একজন খতীব ও দায়ী, তার গ্রামে ছিল এক যাদুকর। যে মানুষকে যাদুর ভয় দেখিয়ে অর্থ লুটে নিত। গ্রামের যারা বিয়ে করতো বা করাতো তারা সবাই তাকে বিয়ের পূর্বেই টাকা-পয়সা দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট রাখত। সে যেন স্বামী-স্ত্রীর মিলনে বাধা সৃষ্টিকারী যাদুর মাধ্যমে ক্ষতি না করে।
আর এই পর্যহেগার যুবক এই যাদুকরের বিরুদ্ধে খুতবায় ও স্থানে স্থানে মানুষকে বলত এবং যাদুকরের কাছে যেতে নিষেধ করত। আর সে ছিল অবিবাহিত, এখন সে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিল; কিন্তু তার মনে ভয় যাদুকর হয়ত তাকে যাদু করবে। আর গ্রামের লোকজনও তার বিষয়ে আশঙ্কা করছিল। শেষ পর্যন্ত সেই যুবক আমার কাছে এসে তার ঘটনা ও পরিস্থিতি বর্ণনা করল। বলল যে, যাদুকর তাকে ভয় দেখিয়েছে এখন কার জয় হবে গ্রামের মানুষ তার দেখার অপেক্ষায় আছে। আপনি আমাকে কি যাদুর প্রভাব থেকে রক্ষার জন্যে কিছু বলতে পারেন?
যাদুকর আমাকে শক্তিশালী যাদু করবে এবং আপ্রাণ চেষ্টা করবে আমার ক্ষতি করতে। কেননা আমি প্রকাশ্যে তাকে অপমান করেছি। আমি বললাম হ্যাঁ আমি অবশ্যই আপনাকে সাহায্য করব, তবে শর্ত হল যে, আপনি যাদুকরকে জানিয়ে দিবেন যে, আমি অমুক তারিখে বিয়ে করতে যাচ্ছি। আর আমি তোমাকে চ্যালেঞ্জ করছি, তুমি যা ইচ্ছা তাই কর এমনকি সকল যাদুকরকে একত্রিত করে যাদু কর । আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।
যুবক আমার কথায় সামান্য দ্বিধাগ্রস্ত হল এরপর বলল, আপনি কি পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলছেন? আমি বললাম হ্যাঁ অবশ্যই বিজয় ও সফলতা কেবল মু'মিনদের জন্যে আর লাঞ্ছনা ও অবমাননা অপরাধীদের প্রাপ্য ।
অতঃপর বাস্তবে তাই হল যুবক আমার কথা মত চ্যালেঞ্জ করে। আর সেই কঠিন দিনের অপেক্ষা লোকজন করতে থাকে। আমি যুবককে যাদু থেকে রক্ষার জন্যে কিছু আমল বলে দিলাম, যা নিম্নে বর্ণনা করব । এরপর যুবক বিয়ে করে বাসর রাত অতিক্রম করে। আর তা সফলভাবে সম্পন্ন হয়। আর যাদুকর বিফল ও অপদস্থ হয়। এরপর সবার কাছে যুবক সম্মানের পাত্র এবং যাদুকর লোকজনের দৃষ্টিতে অসম্মানিত হয়। আল্লাহু আকবার, তারই সকল প্রশংসা, বিজয় তো এক আল্লাহর পক্ষ হতেই।
সম্ভব হলে মদীনা থেকে আজওয়া খেজুরের ব্যবস্থা করবে আর না হয় যে কোন প্রকারের আজওয়া খেজুর চলবে। আল্লাহর রাসূলের হাদীসে রয়েছেঃ “যে ব্যক্তি সাতটি আজওয়া খেজুর সকাল বেলায় আহার করবে সেদিন তাকে কোন বিষ ও যাদু ক্ষতি করতে পারবে না।" (বুখারীঃ ১০/২৮৭)
কেননা এমন ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে ফেরেশতা নির্ধারত হয়ে থাকে । ইবনে আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ তোমাদের অঙ্গসমূহকে পবিত্র রাখ, আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে পবিত্র করবেন কেননা যে ব্যক্তিই পবিত্র অবস্থায় রাত্রি যাপন করবে পোশাকের ন্যায় তার শরীরে এক হেফাযতকারী ফেরেশতা নির্ধারণ করে দিবেন। রাতের যে মুহুর্তে সে পার্শ্ব পরিবর্তন করবে তখনই ফেরেশতা তার জন্য প্রার্থনা করবে যে, হে আল্লাহ তোমার বান্দাকে ক্ষমা কর সে ওযু অবস্থায় ঘুমিয়েছে।
জামাআতের সাথে নামায পড়লে শয়তানের অনিষ্ট হতে নিরাপদ হওয়া যায়। আর নামায থেকে গাফেল হলে শয়তান তাকে বশীভূত করে ফেলে। আবু দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন যখন কোন গ্রামে অথবা মরুভূমিতে কমপক্ষে তিন ব্যক্তি বিদ্যমান থাকে অতঃপর তারা যদি জামাআতে নামায আদায় না করে তবে শয়তান তাদেরকে বশীভূত করে নেয়।
তাই তোমরা জামাআতের সাথে নামায পড়ার প্রতি গুরুত্ব দিও। কেননা বাঘের শিকার সেই ছাগল হয়ে থাকে, যে পাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
যায়। (বুখারীঃ ৩/৩৪ ও মুসলিমঃ ৬/৬৩)
যে ব্যক্তি নিজেকে যাদুর অনিষ্ট হতে রক্ষা করতে চায় সে যেন রাত্রির কিছু অংশ হলেও রাত্রি জাগরণ করে ইবাদত করে। এ থেকে একেবারে বিমূখ না থাকে কেননা তা থেকে বিমূখ থাকা শয়তানের প্রভাব পড়ার কারণ হয়ে থাকে। আর শয়তান যদি পেয়ে বসে তবে যাদু ক্রিয়া সহজ হয়।
ইবনে মাসউদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকটে এক ব্যক্তির বিষয়ে অভিযোগ করা হয় যে, সে সকাল পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিল। এমনকি ফজরের নামাযও আদায় করতে পারেনি। অতঃপর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, শয়তান তার কানে পেশাব করে দিয়েছে। (বুখারীঃ ৬/৩৩৫, মুসলিমঃ ৬/৬৩)
ইবনে উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, “যে ব্যক্তি বেতের নামায আদায় না করেই সকাল করে সে যেন মাথায় এক ৪০ গজ বিশিষ্ট রশি নিয়ে সকাল করে।" (ইবনে হাজার ফাতহুল বারীতে উল্লেখ করে বলেন তার সূত্র সঠিকঃ ৩/২৫)
বাথরুম ও অনুরূপ অপবিত্র স্থানে শয়তানের আস্তানা গড়ে ওঠে, আর শয়তান মুসলমানের বিরুদ্ধে এ ধরণের জায়গায় সুযোগ খুজে। লেখক বলেন, এক শয়তান জ্বিন আমাকে বলে, আমি এই ব্যক্তিকে আক্রমণ এজন্যে করেছিলাম যে, সে বাথরুমে যাওয়ার পূর্বে আউযুবিল্লাহ পড়ত না। আল্লাহ তায়ালা আমাকে সেই শয়তানের বিরুদ্ধে সাহায্য করেছেন এবং আমি বললাম যে এই ব্যক্তিকে ছেড়ে দাও। আলহামদুলিল্লাহ সে ছেড়ে চলে যায়।
এক জ্বিন আমাকে বলল যে, হে মুসলমানগণ! তোমাদেরকে আল্লাহ তায়ালা শক্তিশালী অস্ত্র দান করেছেন; তোমরা তা দিয়ে আমাদেরকে পরাস্থ করতে পার; কিন্তু তোমরা তা ব্যবহার কর না। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম তা কি? উত্তরে সে বললঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যিকিরসমূহ।
হাদীসে বর্ণিত আছে যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বাথরুমে প্রবেশকালীন সময়ে এই দু'আ পড়তেনঃ
اللهم إني أعوذ بك من الخبث والخبائث
অর্থঃ আল্লাহর নামে শুর করছি, হে আল্লাহ আমি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি দুষ্ট জ্বিন ও দুষ্ট পরি থেকে। (বুখারীঃ ১/২৯২, ফাতহ ও মুসলিমঃ ৪/৭০, নববী)
যুবায়ের বিন মুতয়িম (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত যে, তিনি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে দেখেছেন যে, তিনি নামাযে এই যিকিরসমূহ পড়ছিলেনঃ
الله اكبر كبيرا والحمد لله كثيرا وسبحان الله بكرة واصيلا
আর তিনবারঃ
اعوذ بالله من الشيطان الرجيم من نفخه ونفثه وهمزه
(আবু দাউদঃ ১/২০৩ আলবানী সহীহ বলেছেন)
পুরুষ যখন তার স্ত্রীর কাছে বাসর রাতে যাবে তখন তার কপালে হাত রেখে এই দু'আ পড়বেঃ
اللهم إنى أسألك خيرها وخيرما جبلتها عليه، وأعوذبك من شرها وشرما جبلتها عليه
অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে এই নারীর থেকে মঙ্গল ও কল্যাণকর বস্তু চাই। আর সে যে সন্তান ধারণ করবে তার থেকেও কল্যাণ কামনা করি। (আলবানী হাসান বলেছেন)
আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন যে, যখন তোমার নিকট তোমার স্ত্রী বাসর রাতে আসবে তখন তুমি তাকে নিয়ে দুরাকআত নামায পড় এবং নামাযের পর এই দুআ পড়ঃ
اللهم بارك لى فى أهلي وبارك لهم فى اللهم اجمع بيننا ما جمعت بخير وفرق بيننا إذا فرقت الى الخير
অর্থঃ হে আল্লাহ! আমার জন্যে আমার স্ত্রী ও ভবিষ্যত প্রজন্ম বরকতময় কর এবং আমাকে আমার স্ত্রীর জন্যে বরকতময় করে দাও। হে আল্লাহ যতক্ষণ আমরা উভয়েই একত্রে থাকি ভালভাবেই যেন থাকি আর যদি আমাদের মাঝে কল্যাণ না থাকে তবে আমাদেরকে বিচ্ছেদ করে দিও। (ইমাম তাবরানী বর্ণনা করেছেন আর আলবানী তা সহীহ বলেছেন।)
ইবনে আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ যখন তোমাদের মধ্যে কেউ নিজ স্ত্রীর সাথে সহবাসের জন্যে যাবে তখন এই দু'আ পড়বেঃ
بسم الله اللهم جنبنا الشيطان وجنب الشيطان ما رزقتنا فقضي بينهما ولد لم يضره
অর্থঃ আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি হে আল্লাহ! তুমি আমাদের উভয়কে শয়তান থেকে রক্ষা কর। আর আমাদের সন্তানদেরকেও শয়তান থেকে রক্ষা কর। (বুখারী ১/২৯২)
এই সঙ্গমে যেই সন্তান জন্মলাভ করবে তাকে শয়তান কখনও ক্ষতি করতে পারবে না ।
এক জ্বিন ইসলাম গ্রহণের পর আমাকে বলল যে, সে যেই ব্যক্তিকে ধরেছিল সে যখনই নিজের স্ত্রীর সাথে সহবাস করত তখন আমিও তার সাথে অংশগ্রহণ করতাম। কেননা সে দু'আ পড়ত না। সুবহানাল্লাহ আমাদের কাছে কত মূল্যবান সম্পদ রয়েছে যার মূল্য আমরা দেই না।