ইতিহাসে এ জাতীয় শত শত ‘ইমাম মাহদী’-র সন্ধান পাওয়া যায় যাদের মাধ্যমে হাজার হাজার মুসলিম বিভ্রান্ত হয়েছেন, হত্যাকারী বা নিহত হয়েছেন এবং অনেকে ঈমানহারা হয়েছেন। মাহদী দাবিদার ও তাদের অনুসারীদের মধ্যে অনেক ভণ্ড ও প্রতারক থাকলেও তাদের মধ্যে অনেক আলিম, আবিদ ও নেককার মানুষও ছিলেন। তাদের বিভ্রান্তির পিছনে তিনটি মৌলিক কারণ কার্যকর বলে আমরা দেখি:
(১) সমাজ পরিবর্তনের অন্ধ আবেগ। সকল সমাজেই পাপ ও জুলুম বিদ্যমান। পাপাচারী, জালিম ও ধর্মহীনদের সংখ্যা সবসময়ই ধার্মিকদের চেয়ে বহুগুণ বেশি। আবেগী ধার্মিক মানুষ, বিশেষত যুবক, এ সকল অন্যায় দূর করে ‘আদর্শ’ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। স্বাভাবিকভাবে ইলম প্রসার ও দাওয়াতের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন ‘কষ্টকর’, ‘দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ’ ও ‘অসম্ভব’ বলে মনে হয়। এজন্য ‘জিহাদ’ বা ‘ইমাম মাহদী’ বিষয়টি খুবই আকর্ষণীয় বলে গণ্য করেন অধিকাংশ আবেগী ধার্মিক মানুষ। ফলে এ জাতীয় কোনো কথা শুনলে বাছবিচার না করেই শরীক হয়ে যান তারা।
অষ্টম-নবম শতকের সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী ইবন খালদূন আব্দুর রাহমান ইবন মুহাম্মাদ (৭৩২-৮০৮ হি) মাহদীর প্রত্যাশায় শীয়া ও সূফীগণের বিভিন্ন মত আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, মাহদীর ধারণার সাথে মুজাদ্দিদের ধারণা মিশ্রিত হয়ে গিয়েছে। সকলেই অপেক্ষা করেন, এই তো মুজাদ্দিদ বা মাহদী এসে ধর্ম, দেশ, জাতি ও সমাজকে ভাল করে ফেলবেন।[1] এগুলো সবই পলায়নী মনোবৃত্তির প্রকাশ। ফলাফলের চিন্তা না করে দীন পালন ও প্রচারের দায়িত্ব সাধ্যমত আঞ্জাম দেওয়াই মুমিনের কাজ। দুনিয়ায় ফলাফল যা-ই হোক না কেন এরূপ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মুমিন আখিরাতের অফুরন্ত নিয়ামত ও মর্যাদা লাভ করেন। মাহদী বা মুজাদ্দিদ অনুসন্ধান বা অনুসরণের নামে মুমিন মূলত নিজের এ দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়ান।
(২) স্বপ্ন-কাশফের উপর নির্ভর করা। মাহদী দাবিদার অধিকাংশ ব্যক্তি ও তার অনুসারীগণ আল্লাহর কসম করে দাবি করেছেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) উক্ত ব্যক্তিকে মাহদী বলে স্বপ্নে বা কাশফ-ইলহামের মাধ্যমে তাদেরকে জানিয়েছেন। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে স্বপ্নে দেখার কথা শুনলেই মুমিন দুর্বল হয়ে পড়েন। অথচ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, শয়তান তাঁর আকৃতি গ্রহণ করতে পারে না; তাঁর নাম ধরে জালিয়াতি করতে পারে না- তা তিনি বলেন নি। স্বপ্নে যদি তাঁকে হুবহু দুনিয়ার আকৃতিতে দেখা যায় তবেই তাঁকে দেখা বলে গণ্য হবে। তারপরও স্বপ্নের বক্তব্য অনুধাবন ও ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে। এছাড়া স্বপ্নে বা জাগ্রত অবস্থায় শয়তান নিজেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দাবি করে মিথ্যা বলতে পারে। বস্ত্তত, মুসলিমদের বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ স্বপ্ন, ইলহাম ইত্যাদিকে দীনের দলীল হিসেবে গণ্য করা।
বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আমরা বিশ্বাস করি যে, শেষ যুগে একজন ন্যায়পরায়ণ সুপথপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান মুসলিম বিশ্ব শাসন করবেন। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করার প্রমাণ কী? যদি কারো নাম, পিতার নাম, বংশ, আকৃতি, বাইতুল্লাহর পাশে বাইয়াত গ্রহণ ইত্যাদি সব মিলে যায় তারপরও তাকে ‘মাহদী’ বলে বিশ্বাস করার কোনোরূপ দলীল নেই। কারণ মাহদীর মধ্যে এ সকল বৈশিষ্ট্য থাকবে, কিন্তু এ সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেই তিনি মাহদী নন।
কোনো হাদীসে কোনোভাবে বলা হয় নি যে, মহান আল্লাহ কাউকে মাহদী বা মুজাদ্দিদ হিসেবে গ্রহণ করলে তাকে বিষয়টি জানিয়ে দিবেন। কাজেই যিনি নিজেকে মাহদী বা মুজাদ্দিদ বলে দাবি করেন তিনি নিঃসন্দেহে মিথ্যাচারী প্রতারক বা প্রতারিত। তিনি কিভাবে জানলেন যে, তিনি মাহদী বা মুজাদ্দিদ? একমাত্র ওহীর মাধ্যমেই কারো বিষয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানা যায়। নবীগণ ওহীর মাধ্যমে তাঁদের নুবুওয়াতের কথা জেনেছেন। এ সকল দাবিদার কিভাবে তাদের বিষয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানলেন?
সাধারণত তারা ওহীর দাবি করেন না; কারণ তাতে মুসলিম সমাজে তারা ভণ্ড নবী বলে গণ্য হবেন। এজন্য তারা স্বপ্ন বা কাশফের মাধ্যমে তা জানার দাবি করেন। সরলপ্রাণ মুসলিমগণ এতে প্রতারিত হন। অথচ স্বপ্ন বা কাশফের মাধ্যমে কারো মাহদী বা মুজাদ্দিদ হওয়ার দাবি করা আর ওহীর লাভের দাবি একই। কারণ যে ব্যক্তি তার স্বপ্ন বা কাশফের বিষয়কে নিজের বা অন্যের বিশ্বাসের বিষয় বানিয়ে নিয়েছেন তিনি নিঃসন্দেহে তার স্বপ্ন বা কাশফকে নবীদের স্বপ্নের মত ওহীর সম-পর্যায়ের বলে দাবি করেছেন। অনুরূপভাবে কারো মাহদী বা মুজাদ্দিদ হওয়ার স্বপ্ন-কাশফ নির্ভর দাবি বিশ্বাস করার অর্থ মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পরে কাউকে ওহীপ্রাপ্ত বলে বিশ্বাস করা।
মাহদী ও অন্য সকল বিষয়ে মুমিন শুধু কুরআন ও হাদীসের কথায় বিশ্বাস করেন। মাহদী ও কিয়ামতের আলামত বিষয়ক হাদীসগুলো বর্ণনামূলক। ভূমিধ্বস হবে, পাহাড় স্থানচ্যুত হবে... অন্যান্য বিষয়ের মত মাহদীর রাজত্বও আসবে। কিয়ামতের কোনো আলামত ঘটিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব মুমিনের নয়। অন্যান্য আলামতের মত এ ক্ষেত্রেও ঘটে যাওয়ার পরে মুমিন বলবেন যে, আলামতটি প্রকাশ পেয়েছে। যখন কোনো শাসকের বিষয়ে হাদীসে নির্দেশিত সকল আলামত প্রকাশিত হবে এবং মুসলিমগণ তাকে মাহদী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মেনে নিবেন তখনই মুমিন তাকে মেনে নিবেন।
মুমিনের হয়ত মনে হতে পারে যে, মাহদীকে সাহায্য করা আমাদের দায়িত্ব। চিন্তাটি ভিত্তিহীন। যদি কেউ নিজেকে মাহদী বলে দাবি করেন তবে নিশ্চিতভাবে জানতে হবে যে তিনি মিথ্যাবাদী। আর যদি দাবি-দাওয়া ছাড়াই কারো মধ্যে মাহদীর অনেকগুলো আলামত প্রকাশ পায় তবে তার থেকে সতর্কতার সাথে দূরে থাকতে হবে, অবশিষ্ট আলামতগুলো প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত। কারণ তিনি যদি সত্যিকার মাহদী হন তবে আল্লাহই ভূমিধ্বস ও অন্যান্য অলৌকিক সাহায্যের মাধ্যমে তাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় পৌঁছে দেবেন। সকল আলামত প্রকাশ পাওয়ার পরে অর্থাৎ চূড়ান্ত বিজয় ও সকল দেশের মুসলিমগণ তাকে মেনে নেওয়ার পরেই শুধু মুমিনের দায়িত্ব তার বাইয়াত করা।
(৩) ব্যাখ্যার নামে ওহীর সরল অর্থ পরিত্যাগ। আকীদার অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় মাহদী বিষয়েও ওহীর অপব্যাখ্যা বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ। উপরে আলোচিত মাহদীগণের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে, নাম, পিতার নাম, বংশ, আকৃতি, বাইয়াতের স্থান, রাজত্বলাভ, জুলুম দূর করে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি আলামতগুলোর অধিকাংশ বা কোনোটিই পাওয়া যায় না। তারপরও হাজার হাজার মুসলিম তাদের দাবি নির্বিচারে বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হয়েছেন ও হচ্ছেন। হাদীসের স্পষ্ট বক্তব্যগুলো তারা নানান ব্যাখ্যা করে বাতিল করছেন। কারো বিষয়ে একবার সুধারণা প্রতিষ্ঠিত হলে তার সকল দাবিই ভক্তরা নানা অজুহাতে মেনে নেয়। এজন্য প্রতারকগণ প্রথমে ইবাদত-বন্দেগি, দরবেশি, নির্লোভতা, কাশফ-কারামত ইত্যাদি দেখিয়ে মানুষদের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। এরপর নিজেদের দাবি-দাওয়া পেশ করে। ফলে তাদের ব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তিও ভক্তগণ নির্বিচারে বিশ্বাস করেন। ঈমানী দুর্বলতার কারণেই প্রতারকগণ সফল হয়। আমরা দেখেছি, ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য দাবি যে, আমরা তাঁর কথা ছাড়া আর কারো কথাই নির্বিচারে গ্রহণ করব না। প্রত্যেকের প্রতিটি কথা সুন্নাত দিয়ে যাচাই করব। আর এটিই মুমিনের রক্ষাকবজ।