‘ইসতিদরাজ’ শব্দটি আরবী ‘দারাজা’ (درَج) ক্রিয়ামূল থেকে গৃহীত, যার অর্থ চলা, হাঁটা, অগ্রসর হওয়া, ক্রমান্বয়ে এগোনো ইত্যাদি। ‘দারাজাহ’ (الدرجة) অর্থ ধাপ বা পর্যায়। ইসতিদরাজ (الاستدراج) অর্থ ক্রমান্বয়ে এগিয়ে নেওয়া, ক্রমান্বয়ে উপরে তোলা বা নিচে নামান, ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। কোনো পাপী বা অবিশ্বাসী ব্যক্তি থেকে কোনো অলৌকিক কর্ম প্রকাশিত হলে তাকে ইসলামের পরিভাষায় ‘ইসতিদরাজ’ বলা হয়।

এথেকে আমরা বুঝি যে, সকল অলৌকিক কর্মই কারামত নয় এবং কোনো অলৌকিক কর্মই কারো ‘ওলীত্বে’-র প্রমাণ নয়। কারণ একই প্রকার অলৌকিক কর্ম মুমিন থেকে প্রকাশিত হতে পারে এবং ফাসিক বা কাফির থেকেও প্রকাশিত হতে পারে। ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো অলৌকিক কর্ম কোনো মানুষের বিলায়াত তো দূরের কথা, ঈমানেরও প্রমাণ নয়। বরং মানুষের ঈমান, তাকওয়া, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ﷺ আনুগত্য ও সদা সর্বদা ফরয ও নফল ইবাদত পালন করাই বিলায়াতের প্রমাণ। যদি এরূপ ব্যক্তি থেকে কোনো অলৌকিক কর্ম প্রকাশিত হয় তবে তাকে কারামত বলা হবে। আর যদি কোনো ব্যক্তির ঈমান, তাকওয়া বা ইত্তিবায়ে সুন্নাত না থাকে কিন্তু তিনি বিভিন্ন অলৌকিক কর্ম সম্পাদন করেন তবে তাকে ‘ইসতিদরাজ’ বলা হবে।

কাফিরও সাধনার মাধ্যমে এক প্রকার ‘কাশফ‘ অর্জন করে বা জিনের সহযোগিতা লাভ করে। একে সাধারণ মানুষ ‘‘অলৌকিক ক্ষমতা’’ মনে করে বিভ্রান্ত হন। মোল্লা আলী কারী বলেন: ‘‘ফিরাসাত বা অন্তর্দৃষ্টি তিন প্রকার। (১) ঈমানী ফিরাসাত। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত নূর যা আল্লাহ তাঁর বান্দার অন্তরে নিক্ষেপ করেন। হঠাৎ অনুভূতি হিসেবে তা মানুষের অন্তরে হামলা করে, যেমন সিংহ তার শিকারের উপরে হামলা করে। .... (২) সাধনার মাধ্যমে অর্জিত ফিরাসাত। এ প্রকারের ফিরাসাত অর্জিত হয় ক্ষুধা, রাত্রি-জাগরণ, নির্জনবাস ইত্যাদির মাধ্যমে। কারণ মানুষের নফস যখন জাগতিক সম্পর্ক ও সৃষ্টির সাথে যোগাযোগ থেকে বিমুক্ত হয় তখন তার বিমুক্তির মাত্রা অনুসারে তার মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি ও কাশফ সৃষ্টি হয়। এ প্রকার ফিরাসাত কাফির ও মুমিন উভয়েরই হতে পারে। এ প্রকার কাশফ বা ফিরাসাত ঈমান বা বেলায়াত প্রমাণ করে না। এর দ্বারা কোনো কল্যাণ বা সঠিক পথও জানা যায় না।... (৩) সৃষ্টিগত ফিরাসাত। এ হলো চিকিৎসক ও অন্যান্য পেশার মানুষের ফিরাসাত যারা সৃষ্টিগত আকৃতি থেকে প্রকৃতি ও আভ্যন্তরীণ অবস্থা অনুমান করতে পারেন।’’[1]

দাজ্জাল ‘কারামত’ নামের অলৌকিকতা দেখিয়ে মানুষদেরকে ঈমান-হারা করবে। যুগে যুগে অগণিত সাধারণ মুমিন-মুসলিম ‘অলৌকিকতার’ খপ্পরে পড়ে ঈমান হারা হয়েছেন। বিশেষত, রোগ-ব্যাধি ও অশান্তির বিষয়ে ‘তদবির’ দিয়ে ‘ভাল করা’, ‘দুআ’ দিয়ে ধনী বানিয়ে দেওয়া, মনের কথা বা গোপন প্রয়োজন বলে দেওয়া, আগামী আগন্তুকের বিষয়ে সংবাদ দেওয়া ইত্যাদি বিষয়কে ‘কারামত’ মনে করে ঈমান-হারা হয়েছেন ও হচ্ছেন অগণিত সাধারণ মুসলিম। খৃস্টান পাদরি-প্রচারক, হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসী ও মুসলিম নামধারী ‘দয়াল বাবা’, ‘দয়াল মা’, ‘পাগলা বাবা’, ‘জটাধারি’ ইত্যাদির পিছনে ঘুরে, তাদেরকে ‘ওলী’ মনে করে প্রতারিত ও বিভ্রান্ত হচ্ছেন তারা। এ বিষয়ে মুমিনকে সচেতন করতে ইমাম আযম ও অন্যান্যরা কারামত প্রসঙ্গে ইসতিদরাজ নিয়ে আলোচনা করেছেন।

[1] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১৩২-১৩৩।