‘ওলী’ শব্দটি আরবী (الـوِلايَـة) বিলায়াত/ওয়ালায়াত শব্দ থেকে গৃহীত। আমরা দেখেছি যে, শব্দটির অর্থ নৈকট্য, বন্ধুত্ব বা অভিভাবকত্ব। বিলায়াত অর্জনকারীকে ‘ওলী’/‘ওয়ালী’ (الولي) বলা হয়, অর্থাৎ নিকটবর্তী, বন্ধু, সাহায্যকারী বা অভিভাবক। ইসলামী পরিভাষায় ‘বিলায়াত’ ‘ওলী’ ও ‘মাওলা’ শব্দের বিভিন্ন প্রকারের ব্যবহার রয়েছে। উত্তরাধিকার আইনের পরিভাষায় ও রাজনৈতিক পরিভাষায় এ সকল শব্দ বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত। তবে বেলায়াত বা ওলী শব্দদ্বয় সর্বাধিক ব্যবহৃত (ولاية الله) ‘আল্লাহর বন্ধুত্ব’ ও (ولي الله) ‘আল্লাহর বন্ধু’ অর্থে। আল্লাহর বন্ধুদের পরিচয় দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন:


أَلا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلا هُمْ يَحْزَنُونَ الَّذِينَ آَمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ


‘‘জেনে রাখ! নিশ্চয় আল্লাহর ওলীগণের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিমত্মাগ্রস্থও হবে না- যারা ঈমান এনেছে এবং যারা আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে আত্মরক্ষা করে চলে বা তাকওয়া অবলম্বন করে।’’[1]

ঈমান অর্থ শিরক-কুফর-মুক্ত তাওহীদ ও রিসালাতের বিশ্বাস। তাকওয়া অর্থ আত্মরক্ষা করা। সকল পাপ বর্জনকে তাকওয়া বলা হয়। ঈমান ও তাকওয়া যার মধ্যে যত বেশি ও যত পরিপূর্ণ হবে তিনি আল্লাহর তত বেশি ওলী বলে বিবেচিত হবেন। এজন্য প্রত্যেক মুসলিমই আল্লাহর ওলী। ইমান ও তাকওয়ার গুণ যার মধ্যে যত বেশি থাকবে তিনি তত বেশি ওলী। আমরা দেখব যে, আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহুর মতে ঈমান ও মা’রিফাতের দিক থেকে সকল মুমিনই সমান। বিলায়াতের কমবেশি হয় মূলত তাকওয়া, নেক আমল ও কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণের পূর্ণতার ভিত্তিতে। এজন্য ইমাম আবূ হানীফার আকীদা বর্ণনা করে ইমাম তাহাবী বলেন:


وَالْمُؤْمِنُونَ كُلُّهُمْ أَوْلِيَاءُ الرَّحْمَنِ، وَأَكْرَمُهُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَطْوَعُهُمْ وَأَتْبَعُهُمْ لِلْقُرْآنِ.


‘‘সকল মুমিন করুণাময় আল্লাহর ওলী। তাঁদের মধ্য থেকে যে যত বেশি আল্লাহর অনুগত ও কুরআনের অনুসরণকারী সে ততবেশি আল্লাহর নিকট সম্মানিত (ততবেশি বিলায়াতের অধিকারী)।[2]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, ফরয ইবাদতগুলো পালনের সাথে সাথে অনবরত নফল পালনের মাধ্যমে বান্দা বেলায়াত অর্জন করেন। তিনি বলেন, আল্লাহ বলেছেন:


مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ وَمَا تَقَرَّبَ إِلَيَّ عَبْدِي بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ وَمَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ وَبَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ وَيَدَهُ الَّتِي يَبْطِشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِي يَمْشِي بِهَا وَإِنْ سَأَلَنِي لأُعْطِيَنَّهُ وَلَئِنِ اسْتَعَاذَنِي لأُعِيذَنَّهُ.


‘‘যে ব্যক্তি আমার কোনো ওলীর সাথে শত্রুতা করে আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার নৈকট্য অর্জন বা ওলী হওয়ার জন্য বান্দা যত কাজ করে তন্মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি ভালবাসি যে কাজ আমি ফরয করেছি। (ফরয পালনই আমার নৈকট্য অর্জনের জন্য সবচেয়ে প্রিয় কাজ)। এবং বান্দা যখন সর্বদা নফল ইবাদত পালনের মাধ্যমে আমার বেলায়তের পথে অগ্রসর হতে থাকে তখন আমি তাকে ভালবাসি। আর যখন আমি তাকে ভালবাসি তখন আমি তার শ্রবণযন্ত্রে পরিণত হই, যা দিয়ে সে শুনতে পায়, আমি তার দর্শনেন্দ্রিয় হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখতে পায়, আমি তার হাত হয়ে যাই, যদ্দবার সে আঘাত করে এবং আমি তার পা হয়ে যাই, যদ্দবারা সে হাঁটে। সে যদি আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করে তাহলে আমি অবশ্যই তাকে তা প্রদান করি। সে যদি আমার কাছে আশ্রয় চায় তাহলে আমি অবশ্যই তাকে আশ্রয় প্রদান করি।’’[3]

ঈমান, তাকওয়া ও ফরয-নফল আমলের বাহ্যিক অবস্থার আলোকে আমরা মুসলিমদেরকে আল্লাহর ওলী হিসেবে ধারণা করব। তবে কার ঈমান, তাকওয়া ও আমল আল্লাহ কবুল করছেন তা আমরা জানি না। আমরা দেখেছি যে, এজন্য ওহীর নির্দেশনার বাইরে কাউকে ‘ওলী’ বলে সুনিশ্চিত বিশ্বাস করা বা সাক্ষ্য দেওয়া যায় না।

[1] সূরা (১০) ইউনূস: ৬২-৬৩ আয়াত।

[2] তাহাবী, আল-আকীদাহ (ইবন আবিল ইয্য-এর শারহসহ), পৃ: ৩৫৭-৩৬২।

[3] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২৩৮৪ (কিতাবুর রাকাইক, বাবুত তাওয়াদু)।