রামাদানে ‘কিয়ামুল্লাইল’ আদায়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো অধিক তাকিদ প্রদান করেছেন। এজন্য রামাদানের কিয়ামুল্লাইলকে উম্মাতের আলিমগণ অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং ‘সুন্নাত মুআক্কাদা’ বলে গণ্য করেছেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে সাধারণত রামাদান ও অন্য সকল সময়ে প্রথম রাতে সালাতুল ইশা আদায় করে ঘুমিয়ে পড়তেন। এরপর মাঝরাতে উঠে ৩/৪ ঘণ্টা যাবৎ একাকী তাহাজ্জুদ-কিয়ামুল্লাইল আদায় করতেন। একবার তিনি ২৩, ২৫ ও ২৭ রামাদানের রাত্রিতে সাহাবীগণ, তাঁর পরিবারের সদস্যগণ ও স্ত্রীগণকে নিয়ে জামাতে কিয়ামুল্লাইল আদায় করেন। ২৩ তারিখে রাতে এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত (আনুমানিক রাত ৮ টা থেকে ১০/১১ টা পর্যন্ত ২/৩ ঘণ্টা), ২৫ তারিখে মধ্য রাত পর্যন্ত (আনুমানিক রাত ৮-১২= ৪ ঘণ্টা) এবং ২৭ তারিখের রত্রিতে সাহরীর সময় পর্যন্ত (আনুমানিক রাত ৮- ৪= ৮ ঘণ্টা) কিয়ামুল্লাইল আদায় করেন।[1]

এ তিন রাত্রিতে তিনি কত রাকআত কিয়াম করেছিলেন তা সহীহ বর্ণনায় স্পষ্ট নয়। তবে সাধারণত তিনি রামাদান ও অন্যান্য সময়ে তিন রাকআত বিতর ছাড়া ৮ রাকআত কিয়াম আদায় করতেন।[2] এছাড়া তিনি বিভিন্ন সময়ে ২ রাকআত[3], ৪ রাকআত[4], ৬ রাকআত[5], ১০ রাকআত[6], এবং ১২ রাকআত[7] কিয়ামুল্লাইল আদায় করতেন বলে সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তাঁর রাকআত সংখ্যা কমবেশি হলেও, সময়ের পরিমাণ বিশেষ কমবেশি হতো না। সাধারণত তিনি প্রায় ৩/৪ ঘণ্টা ধরে কিয়াম আদায় করতেন। রাকআতের সংখ্যা কমালে দৈর্ঘ্য বাড়াতেন।

সাহাবীগণ রামাদানে তাঁর পিছনে জামাআতে কিয়ামুল্লাইল পালন করতে অতীব আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ফরয হওয়ার আশঙ্কায় তিনি একাকী তা আদায় করতেন এবং সাহাবীদেরকে এভাবে আদায় করতে পরামর্শ দেন।[8] উপরের হাদীসে আমরা দেখলাম যে, কয়েক রাত তিনি তা জামাতে আদায় করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি জামাআতে রামাদানের কিয়াম আদায়ের ফযীলতে বলেন:


مَنْ قَامَ مَعَ الإِمَامِ حَتَّى يَنْصَرِفَ كُتِبَ لَهُ قِيَامُ لَيْلَةٍ


‘‘যে ব্যক্তি ইমামের কিয়ামুল্লাইল শেষ করা পর্যন্ত ইমামের সাথে কিয়ামুল্লাইল আদায় করবে তার জন্য পুরো রাত কিয়াম পালনের সাওয়াব লেখা হবে।’’[9]

সাহাবীগণ ও পরবর্তী প্রজন্মের মুসলিমগণ রামাদানের কিয়ামুল্লাইল আদায়ের বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। যেহেতু শেষ রাতে উঠে তা আদায় করা অনেকের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়, এজন্য অনেকেই সালাতুল ইশার পরেই মসজিদে বা বাড়িতে কিয়ামুল্লাইল আদায় করে ঘুমাতেন। যারা কুরআনের ভাল কারী বা হাফিয ছিলেন না তারা অনেক সময় কোনো ভাল কারী বা হাফিযের পিছনে মসজিদে বা বাড়িতে ছোট জামাত করে তা আদায় করতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সময়ে ও তাঁর ওফাতের পরে প্রায় কয়েক বৎসর এভাবেই চলে।

খলীফা উমার (রা) লক্ষ্য করেন যে, এভাবে মদীনার মসজিদে নববীতে ছোট ছোট জামাতে বা পৃথকভাবে একাকী অনেকেই সালাতুল ইশার পরে কিয়ামুল্লাইল আদায় করছেন। তখন তিনি সাহাবী উবাই ইবন কা’বকে বলেন, মানুষেরা দিবসে সিয়াম পালন করেন, কিন্তু অনেকেই ভাল হাফিয বা কারী নন; কাজেই আপনি তাদেরকে নিয়ে জামাতে কিয়ামুল্লাইল আদায় করেন। পাশাপাশি তিনি সুলাইমান ইবন আবী হাসমাহ (রা) নামক অন্য সাহাবীকে মহিলাদের নিয়ে মসজিদের শেষ প্রান্তে পৃথক জামাতে কিয়ামুল্লাইল আদায় করার নির্দেশ দেন। মহিলাদের জামাতের ইমামতি তামীম দারী (রা) নামক অন্য সাহাবীও করতেন। খলীফা উসমান ইবন আফ্ফনের (রা) সময়ে তিনি সুলাইমান ইবন আবী হাসমাহ (রা)-এর ইমামতিতে পুরুষ ও মহিলাদের এক জামাতে কিয়ামুল্লাইল আদায়ের ব্যবস্থা করেন।[10] অধিকাংশ মানুষ জামাতে কিয়ামুল্লাইল আদায় করতে থাকেন। তবে অনেক সাহাবী, তাবিয়ী ও যারা ভাল হাফিয ও আবিদ ছিলেন তারা সালাতুল ইশার পরে অথবা মধ্য রাতে ও শেষ রাতে একাকী রামাদানের কিয়ামুল্লাইল আদায় করতেন।

[1] তিরমিযী, আস-সুনান ৩/১৬৯ (কিতাবুস সাওম, বাব (৮১) মা জাআ ফী কিয়ামি শাহরি রামাদান)। তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান সহীহ।

[2] বুখারী, আস-সহীহ ১/৩৮৫ (কিতাবু সালাতিত তারাবীহ, বাবু ফাদলি মান কামা রামাদান); মুসলিম, আস-সহীহ ১/৫০৯ (কিতাবু সালাতিল মুসাফিরীন, বাবু সালাতিল লাইল....)

[3] আহমদ, আল-মুসনাদ ৫/৪০০।

[4] আবূ দাউদ, আস-সুনান ২/৪৬ (কিতাবুত তাতাওউ, বাবুন ফী সালাতিল লাইল); নাসাঈ, আস-সুনান ৩/২২৬ (কিতাবু কিয়ামিল লাইল... , বাবু তাসবিয়াতিল কিয়ামি ওয়ার রুকু..)

[5] আবূ দাউদ, আস-সুনান ২/৪৬ (কিতাবুত তাতাওউ, বাবুন ফী সালাতিল লাইল)।

[6] আবূ দাউদ, প্রাগুক্ত ; ইবনুল আসীর, জামিউল উসূল ৬/৪৭।

[7] বুখারী, আস-সহীহ ১/৭৮, ৪০১, (কিতাবুল ওয়াদূ, বাবু কিরাআতিল কুরআন বা’দাল হাদাসি) ১/৪০১, ৪/১৬৬৬, ১৬৬৭; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৫২৬, ৫৩১ (কিতাবু সালাতিল মুসাফিরীন, বাবুদ দুআ ফী সালাতিল লাইলি)

[8] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৫৬ (কিতাবুল জামা‘আত, বাবু সালাতিল্লাইল), ৪/১৬৬৬, ১৬৬৭; মুসলিম, আস-সহীহ ২/১৮৮ (কিতাব সালাতিল মুসাফিরীন, বাবু ইসতিহবাবি সালাতিন নাফিলাতি ফী বাইতিহী)

[9] তিরমিযী ৩/১৬৯ (কিতাবুস সাওম, বাব মা জাআ ফী কিয়ামি শাহরি রামাদান)। হাদীসটি সহীহ।

[10] মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, আল-মুআত্তা (আব্দুল হাই লাখনবী, আত-তালীক আল-মুমাজ্জাদ-সহ) পৃ ১/৩৫৫; ইবনু আবী শাইবা; আল-মুসান্নাফ ২/২২২।