এর বিপরীতে আমরা দেখি যে, সালাফ সালিহীনের কোনো কোনো অনুসারী আশআরী-মাতুরিদীগণকে ঢালাওভাবে জাহমী বলছেন বা মুতাযিলী, জাহমী, আশআরী, মাতুরিদী সকলকেই এক সারিতে দাঁড় করাচ্ছেন। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:
(ক) আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সাথে ‘জাহমী-মুতাযিলী’ আকীদার পার্থক্য শুধু বিশেষণ বিষয়ে নয়। অনেক বিষয়ের মধ্যে বিশেষণ একটি বিষয়। সকল বিষয়ে বিভ্রান্তি এবং একটি বিষয়ে বিভ্রান্তিকে একই পর্যায়ের বলে গণ্য করা সঠিক নয়।
(খ) বিশেষণ বিষয়েও জাহমী-মুতাযিলীগণের মতবাদ ও আশআরী-মাতুরিদী মতবাদের মধ্যে ব্যাখ্যার বিষয়, পরিধি, মূলনীতি ও প্রকৃতিতে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। এজন্য বিশেষণ বিষয়েও উভয় মতকে এক পর্যায়ভুক্ত করা সঠিক নয়।
(গ) অনেক আলিম ব্যাখ্যাহীন বিশ্বাস ও ব্যাখ্যা উভয় মত স্বীকার করার পাশাপাশি কোনো কোনো বিশেষণ ব্যাখ্যা করেছেন। অনেকে ব্যাখ্যাহীন ও তুলনাহীন বিশ্বাসকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন কিন্তু কোনো কোনো বিশেষণ ব্যাখ্যা করেছেন। অনেকে তাঁদেরকেও ব্যাখ্যাকারী-অস্বীকারকারীদের কাতারভুক্ত করেন। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। আমরা দেখেছি যে, সালাফ সালিহীন এবং তাঁদের অনুসারী কোনো কোনো ইমাম থেকেও এরূপ ব্যাখ্যা বর্ণিত।
(ঘ) আমরা দেখেছি, ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন: ‘‘তাঁর হাত ... অঙ্গ নয়...’’, ‘‘আমরা বাগযন্ত্র ও অক্ষরের মাধ্যমে কথা বলি, আর মহান আল্লাহ বাগযন্ত্র এবং অক্ষর ছাড়াই কথা বলেন’’, ‘‘মহান আল্লাহ আরশের উপর অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন, ... আরশের উপরে স্থিরতা-উপবেশন ব্যতিরেকে’’...।
ইমাম আহমদ বলেছেন: ‘‘মহান আল্লাহ আরশের উপর অধিষ্ঠিত। ... অধিষ্ঠিত হওয়ার অর্থ তিনি এর ঊর্ধ্বে ... অধিষ্ঠানের অর্থ আরশ স্পর্শ করে অবস্থান করা নয়,...’’, ‘‘মহান আল্লাহর ... মুখমণ্ডল প্রতিচ্ছবি বা আকৃতি নয় এবং আঁকানো বস্ত্তর মতও নয়। বরং মুখমণ্ডল তাঁর একটি মহান বিশেষণ। ... মুখমণ্ডল অর্থ দেহ, ছবি বা আকৃতি নয়। ... মহান আল্লাহর দুটি হস্ত বিদ্যমান। ... হস্তদ্বয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নয়, দেহের অংশ নয়, দেহ নয়, দেহ জাতীয় কিছু নয়, সীমা, সংযোজন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জাতীয় কিছুই নয়। ... এতে কনুই, বাহু ইত্যাদি কোনো কিছুর অস্তিত্ব কল্পনার সুযোগ নেই।...।’’
অনেক আবেগী মুমিন এগুলোকে নিন্দনীয় ব্যাখ্যা বলে গণ্য করে প্রশ্ন করেন: তাঁর হস্ত অঙ্গ নয়, তাঁর কথা অক্ষর নয়, তাঁর ইসতিওয়া স্পর্শ নয়, তাঁর মুখমণ্ডল প্রতিচ্ছবি নয়... আমরা কিভাবে জানলাম? যেহেতু ওহীতে এ কথাগুলো নেই, সেহেতু এগুলো বলা যাবে না, বরং শুধু বলতে হবে আল্লাহর হস্ত, মুখমণ্ডল.. ইত্যাদি আছে এবং তা সৃষ্টির মত নয়। প্রকৃতপক্ষে ইমামগণের এ কথা বিশেষণের ব্যাখ্যা বা ওহীর সাথে কোনো সংযোজন নয়, বরং মহান আল্লাহর অতুলনীয়ত্বের ব্যাখ্যা। মহান আল্লাহ তাঁর নিজের বিষয়ে বলেন নি যে, তাঁর মুখমণ্ডল প্রতিচ্ছবি, তাঁর হস্ত অঙ্গ, তাঁর ইসতিওয়া স্পর্শ ...। অথচ এ সকল বিশেষণ বর্ণনা বা শ্রবণ করলে মানবীয় ধারণায় এরূপ চিন্তা চলে আসে। এজন্য অতুলনীয়ত্ব নিশ্চিত করতেই ইমামগণ এরূপ বলেছেন।
(ঙ) ব্যাখ্যাকে ভুল বলা ও ব্যাখ্যাকারীকে বিভ্রান্ত বলা এক নয়। পারিপার্শিকতা বা যুগের প্রভাবে অথবা সাধারণ মানুষদেরকে তুলনায় নিপতিত হওয়া থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে অনেক প্রসিদ্ধ আলিম মহান আল্লাহর কোনো কোনো বিশেষণ ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের ইজতিহাদকে ভুল বলে গণ্য করা আর তাঁদের অবমূল্যায়ন করা এক নয়। ‘তাকফীর’ প্রসঙ্গে আমরা দেখব যে, ইবন তাইমিয়া ও অন্যান্য আলিম বলেছেন: ফিকহী বিষয়ের ন্যায় আকীদার বিষয়ে ইজতিহাদী ভুল ক্ষমাকৃত। এজন্য আমাদের উচিত জ্ঞানবৃত্তিক সমালোচনা করা। আমরা বলতে পারি, অমুকের অমুক বক্তব্য তুলনা বা অস্বীকারের পর্যায়ে চলে যায় বা কথাটি সঠিক নয়। পাশাপাশি সকল মুমিন, বিশেষত আলিমগণের প্রতি হৃদয়ের ভালবাসা ও শ্রদ্ধার প্রকাশ করা, মুমিনের বিষয়ে সুধারণা পোষণ এবং মুমিনের বক্তব্যের ভাল ব্যাখ্যা করাই আমাদের দায়িত্ব।
উপরের দীর্ঘ আলোচনা থেকে আমরা অনুধাবন করছি যে, মহান আল্লাহর অস্তিত্ব প্রতিটি মানুষই তার জন্মগত প্রকৃতি ও সহজাত অনুভূতি দিয়ে অনুভব করে। তবে তাঁর সত্তার ও বিশেষণের প্রকৃতি পরিপূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করা মানবীয় সাধ্যের বাইরে। এক্ষেত্রে ওহীর নিকট আত্মসমর্পনই নিরাপত্তার একমাত্র উপায়। ওহীর মাধ্যমে মহান আল্লাহ তাঁর যে পরিচয় প্রদান করেছেন তাঁকে জানার বা তাঁর মারিফাত অর্জনের সেটিই আমাদের একমাত্র উপায়। পাশাপাশি এ বিষয়ক প্রান্তিকতা পরিহার করা প্রয়োজন।