এরপর ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেন: ‘‘তিনি তাঁর গুণাবলি এবং নামসমূহ-সহ অনাদি-রূপে বিদ্যমান। তাঁর নাম ও বিশেষণের মধ্যে কোনো নতুনত্ব বা পরিবর্তন ঘটে নি। তিনি অনাদিকাল থেকেই তাঁর জ্ঞানে জ্ঞানী এবং জ্ঞান অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই ক্ষমতাবান এবং ক্ষমতা অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই তাঁর কথায় কথা বলেন এবং কথা অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টি করা অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই তাঁর কর্মে কর্মী, কর্ম অনাদিকাল থেকে তাঁর বিশেষণ। আল্লাহ তাঁর কর্ম দিয়ে যা সৃষ্টি করেন তা সৃষ্ট, তবে আল্লাহর কর্ম সৃষ্ট নয়। তাঁর সিফাত বা বিশেষণাবলি অনাদি। কোনো বিশেষণই নতুন বা সৃষ্ট নয়। যে ব্যক্তি বলে যে, আল্লাহর কোনো সিফাত বা বিশেষণ সৃষ্ট অথবা নতুন, অথবা এ বিষয়ে সে কিছু বলতে অস্বীকার করে, অথবা এ বিষয়ে সে সন্দেহ পোষণ করে, তবে সে আল্লাহর প্রতি ঈমানবিহীন কাফির।’’
কুরআন-হাদীসে উল্লেখকৃত আল্লাহর সকল বিশেষণ সরল অর্থে বিশ্বাস করার আরেকটি দিক এগুলোর অনাদিত্বে বিশ্বাস করা। সাহাবী-তাবিয়ীগণ ও মূলধারার মুসলিমগণ বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ অনাদিকাল থেকেই তাঁর সকল বিশেষণে বিশেষায়িত। তিনি সকল বিশেষণসহই অনাদি ও চিরন্তন। তিনি অনাদিকাল থেকেই তাঁর সকল নাম ও বিশেষণ নিয়ে বিদ্যমান, তবে তাঁর নাম ও গুণাবলি সৃষ্টির কাছে প্রকাশিত হয়েছে পরবর্তী সময়ে।
পক্ষান্তরে মুতাযিলী ও জাহমীগণ যেহেতু মহান আল্লাহর সত্তার অতিরিক্ত কোনো অনাদি-অনন্ত বা চিরন্তন গুণ আছে বলে স্বীকার করতেন না সেহেতু তারা দাবি করতেন যে, মহান আল্লাহর যে সকল বিশেষণ কুরআন-হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলি মূলত তাঁর সৃষ্ট ‘মাখলূক’ মাত্র, তাঁর নিজস্ব কোনো চিরন্তন বিশেষণ নয়। অনাদিকালে তাঁর কোনো ‘বিশেষণ’ ছিল না। যখন তিনি সৃষ্টি করলেন তখন তাঁর জন্য ‘সৃষ্টিকর্তা’ নামক বিশেষণটি জন্ম নিল। ‘সৃষ্টিকর্তা’ নামটি তখন থেকে তাঁর জন্য প্রযোজ্য। এ নামটি তাঁরই একটি সৃষ্টি মাত্র। ‘কথা বলা’ অনাদিকাল থেকে তাঁর ‘বিশেষণ’ নয়; অনাদিকালে তিনি ‘নির্গুণ’ ছিলেন। তিনি যখন শ্রবণের মত প্রাণী সৃষ্টি করলেন তখন তিনি কথা সৃষ্টি করলেন এবং তাঁর কথা তারা শুনলো। কথা তাঁর বিশেষণ নয়, তাঁর সৃষ্টি মাত্র। তাঁর সকল বিশেষণই তাঁরা এভাবে ব্যাখ্যা করেন। তারা দাবি করেন যে, মহান আল্লাহর কোনো অনাদি চিরন্তন বিশেষণ নেই; তাঁর নাম ও বিশেষণগুলো পরবর্তীকালে সৃষ্ট।
তাদের এরূপ বিশ্বাসের একটি বড় কারণ ছিল গ্রীক দর্শনভিত্তিক খৃস্টধর্মীয় বিশ্বাস। মহান আল্লাহ ঈসা (আঃ)-কে তাঁর ‘বাক্য’ বলে আখ্যায়িত করেছেন; কারণ পিতামাতার মাধ্যমে প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক ভাবে তাঁকে সৃষ্টি না করে তিনি তাঁকে ‘কুন’ বা ‘হও’ বাক্য দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু খৃস্টানগণ দাবি করেন যে, আল্লাহর ‘কালিমা’ অর্থাৎ কথা বা বাক্য যেহেতু তাঁর অনাদি বিশেষণ, সেহেতু ঈসা (আঃ) আল্লাহর মতই অনাদি ও চিরন্তন। তিনি অনাদিকাল থেকে আল্লাহর সাথে বিরাজমান ছিলেন এবং মানব রূপ ধারণ করে বা মানব রূপের সাথে মিশ্রিত হয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন। মুসলিমগণ যখন গ্রীক দর্শন অধ্যয়ন শুরু করেন তার আগেই খৃস্টান পন্ডিতগণ তাদের এ উদ্ভট আকীদা theory of Logos বা ‘বাক্যতত্ত্ব’ নামে গ্রীক দর্শনের সাথে মিশ্রিত করেছেন। মুতাযিলী পন্ডিতগণ মহান আল্লাহর সাথে শিরকের এ পথ বন্ধ করার জন্য দার্শনিক যুক্তিতর্ক দিয়েই প্রমাণ করতে সচেষ্ট হলেন যে, মহান আল্লাহর কোনো বিশেষণই অনাদি বা চিরন্তন নয়, বরং সবই তাঁর সৃষ্টি।
তাঁদের উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক, বাস্তবে তারা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হন। তারা ইসলামী বিশ্বাসের মধ্যে একটি ‘বিদআত’ বা নব-উদ্ভাবিত বিশ্বাসের অনুপ্রবেশ ঘটান যা কুরআন, হাদীস ও সাহাবীগণের বিশ্বাসের মধ্যে ছিল না। সর্বোপরি এরূপ বিশ্বাস কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক। মহান আল্লাহর বিশেষণকে সৃষ্ট বলে দাবি করার অর্থ তাঁর অনাদি-অনন্ত ও চিরন্তন পূর্ণতাকে অস্বীকার করা। মহান আল্লাহ তাঁর সকল বিশেষণ ও কর্মসহ অনাদি ও চিরন্তন। আর তিনি তাঁর বিশেষণ বা কর্মের দ্বারা যা সৃষ্টি করেন তা সৃষ্ট। কাজেই মহান আল্লাহর ‘কালিমা’ বা বাক্য অনাদি হলেও বাক্য দ্বারা সৃষ্ট ঈসা (আঃ) অনাদি নন। বিষয়টি এভাবে অনুধাবন করলেই মহান আল্লাহর চিরন্তন পূর্ণতা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি একাধিক অনাদি সত্তায় বিশ্বাসের শিরক অপনোদন হয়।
লক্ষণীয় যে, গ্রীক দর্শনের অনুপ্রবেশই খৃস্টধর্মকে বিকৃত করে। সাধু পলের উদ্ভাবিত দর্শনভিত্তিক এ আকীদা বাদ দিয়ে যদি খৃস্টানগণ প্রচলিত চার ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান মহান আল্লাহর বক্তব্য ও ঈসা মাসীহের বক্তব্যের কাছে আত্মসমর্পন করতেন তবে তারাও এ সকল শিরক থেকে রক্ষা পেতেন। বর্তমানে প্রচলিত ও বহুভাবে বিকৃত চার-ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান এ সকল বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ঈসা মাসীহ আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, তিনি আল্লাহর বান্দা। আল্লাহর অবতার বা আল্লাহর কোনো বিশেষণের দেহরূপ হওয়া তো অনেক দূরের কথা, কোনো গাইবী ইলম বা মানুষকে মুক্তি দেওয়ার ক্ষমতাও তাঁর নেই। ঈসা মাসীহের নামে অতিভক্তিতে মুক্তি মিলবে না, বরং তাওহীদ ও রিসালাতের বিশ্বাস ও শরীয়ত পালনই মুক্তির একমাত্র পথ।[1]