এ পরিচ্ছেদের শুরুতে উদ্ধৃত ‘আল-ফিকহুল আকবার’-এর বক্তব্যে আমরা দেখেছি যে, ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন:
‘‘তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়। তিনি তাঁর সৃষ্টির কোনো কিছুর মত নন। তিনি অনাদি কাল থেকে অনন্ত কাল বিদ্যমান রয়েছেন তাঁর নামসমূহ এবং তাঁর যাতী (সত্তীয়) ও ফি’লী (কর্মীয়) সিফাতসমূহ-সহ।
মুশাবিবহা সম্প্রদায়ের মূল বিভ্রান্তি ছিল মহান আল্লাহর বিশেষণগুলো শব্দগতভাবে মানবীয় বা সৃষ্টিজগতের বিশেষণের মত প্রতীয়মান হওয়ায় তাঁকে সৃষ্টির মত এবং তাঁর গুণাবলিকে সৃষ্টির মত বলে দাবি করা। এভাবে তারা মহান আল্লাহর বিশেষণগুলো বিশ্বাস করার নামে তাঁর ‘অতুনীয়ত্ব’ অবিশ্বাস করেছে। অপরপক্ষে জাহমিয়া-মুতাযিলা সম্প্রদায়ের মূল বিভ্রান্তি ছিল সৃষ্টির সাথে তুলনীয় হওয়ার অজুহাতে আল্লাহর বিশেষণ ব্যাখ্যার নামে অস্বীকার করা। তাদের মতে মহান আল্লাহর কোনো বিশেষণ স্বীকার করার অর্থই তাঁকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা। জ্ঞান, ক্ষমতা, কথা, শ্রবণ, দর্শন, হস্ত, মুখমণ্ডল, চক্ষু ইত্যাদির অধিকারী হওয়া, আরশে সমাসীন হওয়া ইত্যাদি সবই মানবীয় বা সৃষ্টজগতের বিশেষণ। মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টিকে এ সকল বিশেষণে বিশেষিত করা যায়। মহান আল্লাহর এরূপ বিশেষণ আছে বলে বিশ্বাস করলে তাঁকে তাঁর সৃষ্টির সাথে তুলনা করা হয়। যেহেতু আল্লাহ বলেছেন, ‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়’’ সেহেতু আল্লাহর ক্ষেত্রে এরূপ বিশেষণ আরোপ করা যাবে না। কুরআন-হাদীসের কোনো কথা দ্বারা এরূপ বিশেষণ বুঝা গেলে তা ব্যাখ্যা করতে হবে। এভাবে তারা ‘‘অতুলনীয়ত্ব’’ প্রমাণের নামে বিশেষণগুলো অস্বীকার করেছে।
পক্ষান্তরে সাহাবীগণ এবং মূলধারার তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ীগণের মূলনীতি ছিল কুরআন ও হাদীসে মহান আল্লাহর যত বিশেষণ ও কর্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা সবই সরল অর্থে বিশ্বাস করা। সৃষ্টির সাথে তুলনার অজুহাতে আল্লাহর কোনো বিশেষণ ব্যাখ্যা বা অস্বীকার করা যাবে না। বরং বিশেষণকে সরল অর্থে বিশ্বাস করে তুলনাকে অস্বীকার করতে হবে। আল্লাহ বলেছেন যে, কোনো কিছুই তাঁর তুলনীয় নয়। আবার তিনিই সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এ সকল বিশেষণ তাঁর নিজের ক্ষেত্রে উল্লেখ করেছেন। মুমিনের দায়িত্ব আল্লাহর অতুলনীয়ত্ব ও তাঁর বিশেষণ উভয়কে সমানভাবে বিশ্বাস করা।
মুশাবিবহা ও জাহমী-মুতাযিলীদের বিশ্বাস দীনের মধ্যে উদ্ভাবিত ‘বিদআত’ ও কুরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশনার বিপরীত। সাহাবী-তাবিয়ীগণ কখনো কোনো বিশেষণকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করেন নি এবং তুলনার অজুহাতে কোনো বিশেষণকে ব্যাখ্যা করেন নি। কখনো জিজ্ঞাসিত হলে এরূপ ব্যাখ্যার কঠোর বিরোধিতা করেছেন।
এ সকল ‘বিদআত’ থেকে উম্মাতকে রক্ষা করার জন্য ইমাম আবূ হানীফা আল্লাহর সিফাত (বিশেষণ) বিষয়ক মূলনীতি ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর উপরের বক্তব্য থেকে আমরা জানছি যে, আল্লাহর বিশেষণের ‘অতুলনীয়ত্ব’ ও ‘অস্তিত্ব’ সমানভাবে বিশ্বাস করতে হবে। উভয় বিষয়কে মেনে নেওয়া ‘আকল’ বা জ্ঞান-বুদ্ধি ও যুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক নয়। ইমাম আবূ হানীফা বিষয়টি পরবর্তীতে আরো ব্যাখ্যা করবেন।