জা’দ ইবন দিরহাম (১১৮ হি) নামক একজন নতুন প্রজন্মের পারসিক মুসলিম মহান আল্লাহর গুণাবলি অস্বীকার করে তাঁকে ‘নির্গুণ’ বলে দাবি করতে থাকেন। তার ছাত্র জাহম ইবন সাফওয়ান সামারকান্দী (১২৮ হি)। তিনি এ মতটিকে জোরালোভাবে প্রচার করতে থাকেন এবং এর সাথে অনেক দর্শনভিত্তিক মতবাদ তিনি প্রচার করেন। জাহমের মতবাদ নিম্নরূপ:
(ক) বিশেষণের অস্বীকৃতি। তার মতে যে সকল বিশেষণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা কখনো স্রষ্টার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। তবে যে বিশেষণগুলো আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, সেগুলি তাঁর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে, যেমন স্রষ্টা, জীবনদাতা, মৃত্যুদাতা... ইত্যাদি। কাজেই এ কথা বলা যাবে না যে, মহান আল্লাহ দেখেন, শুনেন, কথা বলেন, দয়া করেন, ক্রোধান্বিত হন, তিনি আরশের উপরে অধিষ্ঠিত, তাঁর হাত, চক্ষু বা মুখমণ্ডল বিদ্যমান, তাঁকে আখিরাতে দেখা যাবে....। কারণ এ সকল বিশেষণ আল্লাহর ক্ষেত্রে আরোপ করলে তাঁর অতুলনীয়ত্ব নষ্ট হয় এবং তাঁকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা হয়।
(খ) কুরআন সৃষ্ট। উপরের যুক্তির ভিত্তিতেই তিনি আল্লাহর কথার অনাদিত্ব অস্বীকার করতেন। তার মতে, আল্লাহর কালাম আল্লাহর সৃষ্টি। কাজেই কখনোই বলা যাবে না যে আল্লাহ কথা বলেছেন, বরং বলতে হবে যে, আল্লাহ কথা সৃষ্টি করেছেন।
(গ) আল্লাহ সর্বস্থানে। বিরোধীরা তাকে বলেন, কোনো বিশেষণই যখন আল্লাহর ক্ষেত্রে আরোপ করা যায় না তাহলে আমরা কিভাবে তাঁকে অনুভব করব? তিনি বলেন: আল্লাহ আত্মা বা বাতাসের মত, তিনি সর্বত্র বিরাজমান। সকল স্থানেই তিনি রয়েছেন।
(ঘ) মারিফাতই সব। তার মতে মারিফাত বা জ্ঞানই ঈমান এবং জাহালত বা অজ্ঞতা-ই কুফর। অন্তরে মারিফাত বা জ্ঞান এসে গেলে মুখে স্বীকারোক্তি বা কর্মের কোনো প্রয়োজন থাকে না। এটি মুরজিয়া মতের ভিত্তি।
(ঙ) মানুষের অক্ষমতা। তিনি প্রচার করতেন যে, মানুষের কোনোরূপ ক্ষমতা নেই। চাঁদ, সূর্য ইত্যাদি যেমন ইচ্ছাহীনভাবে আবর্তন করে, মানুষও তেমনি ইচ্ছাহীন ক্ষমতাহীন ভাবে কলের পুতুলের মত চলমান।
(ঙ) জান্নাত-জাহান্নামের বিলুপ্তি। তার মতে এগুলোর বিলুপ্তি ঘটবে।[1]
এ সময়েই মুতাযিলী মতবাদের উদ্ভব হয়। ওয়াসিল ইবন আতা গাজ্জাল (৮০-১৩১ হি), আমর ইবন উবাইদ ইবন বাব (৮০-১৪৪ হি) এবং তাদের ছাত্রগণ এ মতের প্রতিষ্ঠা ও প্রচার করেন। জাহমীদের মত তাঁরাও মহান আল্লাহর বিশেষণগুলো অস্বীকার বা ব্যাখ্যা করতেন। তাদের বিশ্বাস যে, মহান আল্লাহর সত্তার অতিরিক্ত কোনো অনাদি-অনন্ত বিশেষণ বা কর্ম (attribute) নেই। শুধু তাঁর অস্তিত্ব ও সত্তাই অনাদি-অনন্ত। তাঁর সকল কর্ম ও বিশেষণ তাঁর সৃষ্টি মাত্র। তাদের মতে, অনাদি-অনন্ত হওয়াই মহান আল্লাহর মূল বিশেষণ। আল্লাহর কোনো বিশেষণকে অনাদি বিশ্বাস করার অর্থ একাধিক অনাদি সত্তায় বিশ্বাস করা এবং আল্লাহর এ মূল বিশেষণে শরীক করা।
এছাড়া তাদের মতে কুরআনে উল্লেখিত অধিকাংশ বিশেষণ আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করলে মহান আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা হয়। আর মহান আল্লাহ অতুলনীয়। এজন্য এ সকল বিশেষণের ব্যাখ্যা করা জরুরী। মহান আল্লাহকে জ্ঞান, ক্ষমতা, শ্রবণ, দর্শন ইত্যাদি কোনো বিশেষণে বিশেষিত করা যায় না। এ সকল বিশেষণ ব্যাখ্যা করতে হবে। বিভিন্নভাবে তারা ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ বলেছেন: আল্লাহ জ্ঞানী অর্থ তিনি মুর্খ নন। কেউ বলেছেন: আল্লাহ জ্ঞানী অর্থ তাঁর সত্তার নাম বা অংশ জ্ঞান...।
আমরা আগেই বলেছি, তাদের মতে আকীদার সত্য জানার জন্য ‘‘আকল’’ (জ্ঞান-বুদ্ধি)-ই একমাত্র সুনিশ্চিত পথ। আকলের নির্দেশনা একীনী অর্থাৎ সুনিশ্চিত। পক্ষান্তরে ওহীর নির্দেশনা যান্নী, অর্থাৎ অস্পষ্ট’। ওহীর নির্দেশনা যদি আকল-সম্মত হয় তাহলে তা গ্রহণ করতে হবে। আর যদি তা না হয় তাহলে তা ব্যাখ্যা করে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। তাদের মতে আকল প্রমাণ করে যে, মহান আল্লাহ ‘জিসম’ বা দেহধারী নন। কাজেই কুরআন বা হাদীসে যে সকল বিশেষণ তাঁকে দেহবিশিষ্ট বলে মনে করায় সেগুলি ব্যাখ্যা করা বাধ্যতামূলক। যেমন মহান আল্লাহর হস্ত, চক্ষু, মুখমণ্ডল, কথা বলা, ক্রোধ, ভালবাসা, আরশে সমাসীন হওয়া, আখিরাতে তাঁর দর্শন, ইত্যাদি বিশেষণ। তাদের মতে এগুলো বাহ্যিক অর্থে বিশ্বাস করা কুফর; কারণ এরূপ বিশ্বাসের অর্থই আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা এবং তাঁকে দেহ বিশিষ্ট বলে বিশ্বাস করা।[2]
[2] কাযী আব্দুল জাববার ইবনু আহমদ হামাযানী, শারহুল উসূলিল খামসা, পৃষ্ঠা ২২৬-২২৯; আল-মুখতাসার ফী উসূলিদ্দীন: রাসয়িলুল আদলি ওয়াত তাওহীদ, গামিদী, আহমদ আতিয়্যা, আল-ইমাম আল-বাইহাকী ওয়া মাওকিফুহূ মিনাল ইলাহিয়্যাত, পৃষ্ঠা ১১২।