ইমাম আ’যম আবূ হানীফা নু’মান ইবন সাবিত (রাহ) বলেন:
لاَ يُشْبِهُ شَيْئاً مِنَ الأَشْيَاءِ مِنْ خَلْقِهِ، وَلاَ يُشْبِهُهُ شَيْءٌ مِنْ خَلْقِهِ. لَمْ يَزَلْ وَلاَ يَزَالُ بِأَسْمَائِهِ وَصِفَاتِهِ الذَّاتِيَّةِ وَالْفِعْلِيَّةِ. أَمَّا الذّاتِيَّةُ فَالْحَيَاةُ وَالْقُدْرَةُ وَالْعِلْمُ وَالْكَلاَمُ وَالسَّمْعُ وَالْبَصَرُ وَالإِرَادَةُ، وَأَمَّا الْفِعْلِيَّةُ فَالتَّخْلِيْقُ وَالتَّرْزِيْقُ وَالإِنْشَاءُ وَالإِبْدَاعُ وَالصُّنْعُ وَغَيْرُ ذَلِكَ مِنَ صِفَاتِ الْفِعْلِ. لَمْ يَزَلْ وَلاَ يَزَالُ بِأَسْمَائِهِ وَصِفَاتِهِ لَمْ يَحْدُثْ لَهُ اسْمٌ وَلاَ صِفَةٌ. لَمْ يَزَلْ عَالِماً بِعِلْمِهِ وَالْعِلْمُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ، وَقَادِراً بِقُدْرَتِهِ وَالْقُدْرَةُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ، وَمُتَكَلِّماً بِكَلاَمِهِ وَالْكَلاَمُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ، وَخَالِقاً بِتَخْلِيْقِهِ وَالتَّخْلِيْقُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ، وَفَاعِلاً بِفِعْلِهِ وَالْفِعْلُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ، وَالْفَاعِلُ هُوَ اللهُ تَعَالَي وَالْفِعْلُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ، وَالْمَفْعُوْلُ مَخْلُوْقٌ وَفِعْلُ اللهِ تَعَالَي غَيْرُ مَخْلُوْقٍ. وَصِفَاتُهُ فِيْ الأَزَلِ غَيْرُ مُحْدَثَةٍ وَلاَ مَخْلُوْقَةٍ. وَمَنْ قَالَ إِنَّهَا مَخْلُوْقَةٌ أَوْ مُحْدَثَةٌ أَوْ وَقَفَ أَوْ شَكَّ فِيْهِمَا فَهُوَ كَافِرٌ بِاللهِ تَعَالَي.
وَالْقُرْآنُ كَلاَمُ اللهِ تَعَالَي فِيْ الْمَصَاحِفِ مَكْتُوْبٌ، وَفِيْ الْقُلُوْبِ مَحْفُوْظٌ، وَعَلَي الأَلْسُنِ مَقْرُوْءٌ، وَعَلَي النَّبِيِّ ﷺ مُنَزَّلٌ، وَلَفْظُنَا بِالْقُرْآنِ مَخْلُوْقٌ وَكِتَابَتُنَا لَهُ مَخْلُوْقَةٌ وَقِرَاءَتُنَا لَهُ مَخْلُوْقَةٌ وَالْقُرْآنُ غَيْرُ مَخْلُوْقِ. وَمَا ذَكَرَهُ اللهُ تَعَالَى فِيْ الْقُرْآنِ حِكَايَةً عِنْ مُوْسَي وَغَيْرِهِ مِنَ الأَنْبِيَاءِ عَلَيْهِمُ السَّلاَمُ، وَعَنْ فِرْعَوْنَ وَإِبْلِيْسَ، فَإِنَّ ذَلِكَ كُلَّهُ كَلاَمُ اللهِ تَعَالَي إِخْبَاراً عَنْهُمْ، وَكَلاَمُ اللهِ تَعَالَي غَيْرُ مَخْلُوْقٍ، وَكَلاَمُ مُوْسَي وَغَيْرِهِ مِنَ الْمَخْلُوْقِيْنَ مَخْلُوْقٌ، وَالْقُرْآنُ كَلاَمُ اللهِ تَعَالَي فَهْوَ قَدِيْمٌ، لاَ كَلاَمُهُمْ. وَسَمِعَ مُوْسَي عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَلاَمَ اللهِ تَعَالَي كَمَا فِيْ قَوْلِهِ تَعَالَي: "وَكَلَّم َاللهُ مُوْسيَ تَكْلِيْمًا". وَقَدْ كَانَ اللهُ تَعَالَي مُتَكَلِّماً وَلَمْ يَكُنْ كَلَّمَ مُوْسَي عَلَيْهِ السَّلاَمُ، وَقَدْ كَانَ اللهُ تَعَالَي خَالِقاً فِيْ الأَزَلِ وَلَمْ يَخْلُقِِ الْخَلْقَ، لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ. فَلَمَّا كَلَّمَ اللهُ مُوْسَي كَلَّمَهُ بِكَلاَمِهِ الَّذِيْ هُوَ لَهُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ.
وَصِفَاتُهُ كُلُّهَا بِخِلاَفِ صِفَاتِ الْمَخْلُوْقِيْنَ. يَعْلَمُ لاَ كَعِلْمِنَا، وَيَقْدِرُ لاَ كَقُدْرَتِنَا، وَيَرَي لاَ كَرُؤْيَتِنَا، وَيَسْمَعُ لاَ كَسَمْعِنَا وَيَتَكَلَّمُ لاَ كَكَلاَمِنَا، وَنَحْنُ نَتَكَلَّمُ بِاْلآلاتِ وَالْحُرُوْفِ وَاللهُ تَعَالَي يَتَكَلَّمُ بِلاَ آلَةٍ وَلاَ حُرُوْفٍ، وَالْحُرُوْفُ مَخْلُوْقَةٌ، وَكَلاَمُ اللهِ تَعَالَي غَيْرُ مَخْلُوْقٍ.
وَهُوَ شَيْءٌ لاَ كَالأَشْيَاءِ وَمَعْنَي الشَّيْءِ إِثْبَاتُهُ بِلاَ جِسْمٍ وَلاَ جَوْهَرٍ وَلاَ عَرْضٍ وَلاَ حَدَّ لَهُ وَلاَ ضِدَّ لَهُ وَلاَ نِدَّ لَهُ "فَلاَ تَجْعَلُوْا للهِ أَنْدَاداً" وَلاَ مِثْلَ لَهُ. وَلَهُ يَدٌ وَوَجْهٌ وَنَفْسٌ فَمَا ذَكَرَهُ اللهُ تَعَالَى فِيْ الْقُرْآنِ مِنْ ذِكْرِ الْوَجْهِ وَالْيَدِ وَالنَّفْسِ فَهُوَ لَهُ صِفَاتٌ بِلاَ كَيْفٍ. وَلاَ يُقَالُ: إِنَّ يَدَهُ قُدْرَتُهُ أَوْ نِعْمَتُهُ؛ لأَنَّ فِيْهِ إِبْطَالَ الصِّفَةِ. وَهُوَ قَوْلُ أَهْلِ الْقَدَرِ وَالاِعْتِزَالِ، وَلَكِنَّ يَدَهُ صِفَتُهُ بِلاَ كَيْفٍ، وَغَضَبُهُ وَرِضَاهُ صِفَتَانِ مِنْ صِفَاتِهِ تَعَالَى بِلاَ كَيْفٍ.
خَلَقَ اللهُ تَعَالَى الأَشْيَاءَ لاَ مِنْ شَيْءٍ، وَكَانَ اللهُ تَعَالَى عَالِماً فِيْ الأَزَلِ بِالأَشْيَاءِ قَبْلَ كَوْنِهَا، وَهُوَ الَّذِيْ قَدَّرَ الأَشْيَاءَ وَقَضَاهَا، أَلاَ يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَلاَ يَكُوْنُ فِيْ الدُّنْيَا وَلاَ فِيْ الآَخِرَةِ شَيْءٌ إِلاَّ بِمَشِيْئَتِهِ وَعِلْمِهِ وَقَضَائِهِ وَقَدَرِهِ وَكَتْبِهِ فِيْ اللَّوْحِ الْمَحْفُوْظِ، وَلَكِنَّ كَتْبَهُ بِالْوَصْفِ لاَ بِالْحُكْمِ. وَالْقَضَاءُ وَالْقَدَرُ وَالْمَشِيْئَةُ صِفَاتُهُ فِيْ الأَزَلِ بِلاَ كَيْفٍ. يَعْلَمُ اللهُ تَعَالَى الْمَعْدُوْمَ فِيْ حَالِ عَدَمِهِ مَعْدُوْماً، وَيَعْلَمُ أَنَّهُ كَيْفَ يَكُوْنُ إِذَا أَوْجَدَهُ، وَيَعْلَمُ اللهُ الْمَوْجُوْدَ فِيْ حَالِ وُجُوْدِهِ مَوْجُوْداً، وَيَعْلَمُ أَنَّهُ كَيْفَ يَكُوْنُ فَنَاؤُهُ. وَيَعْلَمُ اللهُ تَعَالَى الْقَائِمَ فِيْ حَالِ قِيَامِهِ قَائِماً، وَإِذَا قَعَدَ قَاعِداً فِيْ حَالِ قُعُوْدِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَتَغَيَّرَ عِلْمُهُ أَوْ يَحْدُثَ لَهُ عِلْمٌ وَلَكِنَّ التَّغَيُّرَ اخْتِلاَفُ الأَحْوَالِ يَحْدُثُ فِيْ الْمَخْلُوْقِيْنَ.
خَلَقَ اللهُ تَعَالَى الْخَلْقَ سَلِيْماً مِنَ الْكُفْرِ وَالإِيْمَانِ، ثُمَّ خَاطَبَهُمْ وَأَمَرَهُمْ وَنَهَاهُمْ، فَكَفَرَ مَنْ كَفَرَ بِفِعْلِهِ وَإِنْكَارِهِ وَجُحُوْدِهِ الْحَقَّ بِخُذْلاَنِ اللهِ تَعَالَى إِيَّاهُ، وَآَمَنَ مَنْ آَمَنَ بِفِعْلِهِ وَإِقْرَارِهِ وَتَصْدِيْقِهِ، بِتَوْفِيْقِ اللهِ تَعَالَى إِيَّاهُ وَنُصْرَتِهِ لَهُ. أَخْرَجَ ذُرِّيَّةَ آَدَمَ مِنْ صُلْبِهِ عَلَى صُوَرِ الذَّرِّ، فَجَعَلَهُمْ عُقَلاَءَ فَخَاطَبَهُمْ "أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ؟ قَالُوْا بَلَى" وَأَمَرَهُمْ بِالإِيْمَانِ وَنَهَاهُمْ عَنِ الْكُفْرِ فَأَقَرُّوا لَهُ بِالرُّبُوْبِيَّةِ، فَكَانَ ذَلِكَ مِنْهُمْ إِيْمَاناً فَهُمْ يُوْلَدُوْنَ عَلَى تِلْكَ الْفِطْرَةِ "إِمَّا شَاكِراً وَإِمَّا كَفُوْراً" وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَقَدْ بَدَّلَ وَغَيَّرَ، وَمَنْ آَمَنَ وَصَدَّقَ فَقَدْ ثَبَتَ عَلَيْهِ وَدَاوَمَ. وَلَمْ يُجْبِرْ أَحَداً مِنْ خَلْقِهِ عَلَى الْكُفْرِ وَلاَ عَلَى الإِيْمَانِ، وَلاَ خَلَقَهُمْ مُؤْمٍناً وَلاَ كَافِراً، وَلَكِنْ خَلَقَهُمْ أَشْخَاصاً، وَالإِيْمَانُ وَالْكُفْرُ مِنْ فِعْلِ الْعِبَادِ. وَيَعْلَمُ اللهُ مَنْ يَكْفُرُ فِيْ حَالِ كُفْرِهِ كَافِراً، فَإِذَا آمَنَ بَعْدَ ذَلِكَ عَلِمَهُ مُؤْمِناً فِيْ حَالِ إِيْمَانِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَتَغَيَّرَ عِلْمُهُ وَصِفَتُهُ.
وَجَمِيْعُ أَفْعَالِ الْعِبَادِ مِنَ الْحَرَكَةِ وَالسُّكُوْنِ كَسْبُهُمْ عَلَى الْحَقِيْقَةِ، وَاللهُ تَعَالَى خَالِقُهَا، وَهِيَ كُلُّهَا بِمَشِيْئَتِهِ وَعِلْمِهِ وَقَضَائِهِ وَقَدَرِهِ. وَالطَّاعَاتُ كُلُّهَا كَانَتْ وَاجِبَةً بِأَمْرِ اللهِ تَعَالَى وَبِمَحَبَّتِهِ وَبِرِضَاهُ وَعِلْمِهِ وَمَشِيْئَتِهِ وَقَضَائِهِ وَتَقْدِيْرِهِ. وَالْمَعَاصِيْ كُلُّهَا بِعِلْمِهِ وَقَضَائِهِ وَتَقْدِيْرِهِ وَمَشِيْئَتِهِ، لاَ بِمَحَبَّتِهِ وَلاَ بِرِضَاهُ وَلاَ بِأَمْرِهِ.
বঙ্গানুবাদ
তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়। তিনি তাঁর সৃষ্টির কোনো কিছুর মত নন। তিনি অনাদি কাল থেকে অনন্ত কাল বিদ্যমান, তাঁর নামসমূহ এবং তাঁর যাতী (সত্তীয়) ও ফি’লী (কর্মীয়) সিফাত (বিশেষণ)সমূহসহ। তাঁর সত্তীয় বিশেষণসমূহ: হায়াত (জীবন), কুদরাত (ক্ষমতা), ইলম (জ্ঞান), কালাম (কথা), সাম’ (শ্রবণ), বাসার (দর্শন) ও ইরাদা (ইচ্ছা)। আর তাঁর ফি’লী সিফাতসমূহের মধ্যে রয়েছে: সৃষ্টি করা, রিয্ক প্রদান করা, নবসৃষ্টি করা, উদ্ভাবন করা, তৈরি করা এবং অন্যান্য কর্মমূলক সিফাত বা বিশেষণ। তিনি তাঁর গুণাবলি এবং নামসমূহ-সহ অনাদিরূপে বিদ্যমান। তাঁর নাম ও বিশেষণের মধ্যে কোনো নতুনত্ব বা পরিবর্তন ঘটে নি। তিনি অনাদিকাল থেকেই তাঁর জ্ঞানে জ্ঞানী এবং জ্ঞান অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই ক্ষমতাবান এবং ক্ষমতা অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই তাঁর কথায় কথা বলেন এবং কথা অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টি করা অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই তাঁর কর্মে কর্মী, কর্ম অনাদিকাল থেকে তাঁর বিশেষণ। আল্লাহ তাঁর কর্ম দিয়ে যা সৃষ্টি করেন তা সৃষ্ট, তবে আল্লাহর কর্ম সৃষ্ট নয়। তাঁর সিফাত বা বিশেষণাবলি অনাদি। কোনো বিশেষণই নতুন বা সৃষ্ট নয়। যে ব্যক্তি বলে যে, আল্লাহর কোনো সিফাত বা বিশেষণ সৃষ্ট অথবা নতুন, অথবা এ বিষয়ে সে কিছু বলতে অস্বীকার করে, অথবা এ বিষয়ে সে সন্দেহ পোষণ করে, তবে সে আল্লাহর প্রতি ঈমান-বিহীন কাফির।
কুরআন আল্লাহ তা‘আলার কালাম, মুসহাফগুলোর মধ্যে লিপিবদ্ধ, হৃদয়গুলোর মধ্যে সংরক্ষিত, জিহবাসমূহ দ্বারা পঠিত এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপরে অবতীর্ণ। কুরআন পাঠে আমাদের জিহবার উচ্চারণ সৃষ্ট, কুরআনের জন্য আমাদের লিখনি সৃষ্ট, আমাদের পাঠ সৃষ্ট, কিন্তু কুরআন সৃষ্ট নয়। মহান আল্লাহ কুরআনের মধ্যে মূসা (আঃ) ও অন্যান্য নবী (আঃ) থেকে এবং ফিরাউন এবং ইবলীস থেকে যা উদ্ধৃত করেছেন তা সবই আল্লাহর কালাম (কথা), তাদের বিষয়ে সংবাদ হিসেবে। আল্লাহর কথা সৃষ্ট নয়, মূসা (আঃ) ও অন্য সকল মাখলূকের কথা সৃষ্ট। কুরআন আল্লাহর কথা কাজেই তা অনাদি, মাখলূকগণের কথা সেরূপ নয়। মূসা (আঃ) আল্লাহর কথা শুনেছিলেন, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: ‘‘মূসার সাথে আল্লাহ প্রকৃত বাক্যালাপ করেছিলেন’’[1] মূসা (আঃ)-এর সাথে কথা বলার আগেই- অনাদিকাল থেকেই- মহান আল্লাহ তাঁর কালাম বা কথার বিশেষণে বিশেষিত ছিলেন, যেমন সৃষ্টজগত সৃষ্টি করার পূর্বেই- অনাদিকাল থেকেই- তিনি সৃষ্টিকর্তার বিশেষণে বিশেষিত ছিলেন। ‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়, তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’’[2] যখন তিনি মূসা (আঃ)-এর সাথে কথা বলেন তখন তিনি তাঁর সেই অনাদি বিশেষণ কথার বিশেষণ দ্বারা কথা বলেন।
তাঁর সকল বিশেষণই মাখলূকদের বা সৃষ্টপ্রাণীদের বিশেষণের ব্যতিক্রম। তিনি জানেন, তবে তাঁর জানা আমাদের জানার মত নয়। তিনি ক্ষমতা রাখেন, তবে তাঁর ক্ষমতা আমাদের ক্ষমতার মত নয়। তিনি দেখেন, তবে তাঁর দেখা আমাদের দেখার মত নয়। তিনি কথা বলেন, তবে তাঁর কথা বলা আমাদের কথা বলার মত নয়। তিনি শুনেন, তবে তাঁর শোনা আমাদের শোনার মত নয়। আমরা বাগযন্ত্র ও অক্ষরের মাধ্যমে কথা বলি, আর মহান আল্লাহ বাগযন্ত্র এবং অক্ষর ছাড়াই কথা বলেন। অক্ষরগুলি সৃষ্ট। আর আল্লাহর কথা (কালাম) সৃষ্ট নয়।
তিনি ‘শাইউন’: ‘বস্ত্ত’ বা ‘বিদ্যমান অস্তিত্ব’, তবে অন্য কোনো সৃষ্ট ‘বস্ত্ত’ বা ‘বিদ্যমান বিষয়ের’ মত তিনি নন। তাঁর ‘শাইউন’- ‘বস্ত্ত’ হওয়ার অর্থ তিনি বিদ্যমান অস্তিত্ব, কোনো দেহ, কোনো জাওহার (মৌল উপাদান) এবং কোনো ‘আরায’ (অমৌল উপাদান) ব্যতিরেকেই। তাঁর কোনো সীমা নেই, বিপরীত নেই, সমকক্ষ নেই, তুলনা নেই। ‘‘অতএব তোমরা কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বানাবে না।’’[3] তাঁর ইয়াদ (হস্ত) আছে, ওয়াজহ (মুখমণ্ডল) আছে, নফস (সত্তা) আছে, কারণ আল্লাহ কুরআনে এগুলো উল্লেখ করেছেন। কুরআনে আল্লাহ যা কিছু উল্লেখ করেছেন, যেমন মুখমণ্ডল, হাত, নফস ইত্যাদি সবই তাঁর বিশেষণ, কোনো ‘স্বরূপ’ বা প্রকৃতি নির্ণয় ব্যতিরেকে। এ কথা বলা যাবে না যে, তাঁর হাত অর্থ তাঁর ক্ষমতা অথবা তাঁর নিয়ামত। কারণ এরূপ ব্যাখ্যা করার অর্থ আল্লাহর বিশেষণ বাতিল করা। এরূপ ব্যাখ্যা করা কাদারিয়া ও মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের রীতি। বরং তাঁর হাত তাঁর বিশেষণ, কোনো স্বরূপ নির্ণয় ব্যতিরেকে। তাঁর ক্রোধ এবং তাঁর সন্তুষ্টি তাঁর দুটি বিশেষণ, আল্লাহর অন্যান্য বিশেষণের মতই, কোনো ‘কাইফ’ বা ‘কিভাবে’ প্রশ্ন করা ছাড়াই।
মহান আল্লাহ সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব প্রদান করেছেন। সকল কিছুর সৃষ্টির আগেই অনাদিকাল থেকে তিনি এগুলোর বিষয়ে অবগত ছিলেন। সকল কিছুই তিনি নির্ধারণ করেছেন এবং বিধান দিয়েছেন। দুনিয়ায় ও আখিরাতে কোনো কিছুই তাঁর ইচ্ছা, জ্ঞান, বিধান, নির্ধারণ ও লাওহে মাহফূযে লিপিবদ্ধ-করণ ছাড়া ঘটে না। তাঁর লিখনি বর্ণনামূলক, নির্দেশমূলক নয়। বিধান প্রদান, নির্ধারণ ও ইচ্ছা তাঁর অনাদি বিশেষণ, কোনো স্বরূপ, কিরূপ বা কিভাবে অনুসন্ধান ছাড়া। সিদ্ধান্ত, নির্ধারণ ও ইচ্ছা তাঁর অনাদি-অনন্ত বিশেষণ, কোনো স্বরূপ জিজ্ঞাসা ছাড়া। মহান আল্লাহ অস্তিত্বহীন বিষয়কে অস্তিত্বহীন অবস্থায় অস্তিত্বহীন হিসেবে জানেন, এবং তিনি জানেন যে, তিনি তাকে অস্তিত্ব দিলে তা কিরূপ হবে। আল্লাহ অস্তিত্বশীল বিষয়কে তার অস্তিত্বশীল অবস্থায় জানেন এবং তিনি জানেন যে, তা কিভাবে বিলোপ লাভ করবে। আল্লাহ দন্ডায়মানকে দন্ডায়মান অবস্থায় দন্ডায়মান রূপে জানেন। এবং যখন সে উপবিষ্ট হয় তখন তিনি তাঁকে উপবিষ্ট অবস্থায় উপবিষ্ট জানেন। এরূপ জানায় তাঁর জ্ঞানের মধ্যে কোনোরূপ পরিবর্তন হয় না বা তাঁর জ্ঞানভান্ডারে কোনো নতুনত্ব সংযোজিত হয় না। পরিবর্তন ও নতুনত্ব সবই সৃষ্টজীবদের অবস্থার মধ্যে।
মহান আল্লাহ সৃষ্টজগত সৃষ্টি করেছেন ঈমান ও কুফর থেকে বিমুক্ত অবস্থায়। অতঃপর তিনি তাদেরকে সম্বোধন করেছেন এবং আদেশ ও নিষেধ প্রদান করেছেন। যে ব্যক্তি কুফরী করেছে সে নিজের কর্ম দ্বারা, অস্বীকার করে, সত্যকে অমান্য করে এবং আল্লাহর সাহায্য, রহমত ও তাওফীক থেকে বঞ্চিত হয়ে কুফরী করেছে। আর যে ব্যক্তি ঈমান এনেছে সে তার কর্ম দ্বারা, স্বীকৃতি দ্বারা, সত্য বলে ঘোষণা করে এবং আল্লাহর তাওফীক ও সাহায্য লাভের মাধ্যমে ঈমান এনেছে।
তিনি আদমের পিঠ থেকে তাঁর বংশধরদেরকে পরমাণুর আকৃতিতে বের করে তাদেরকে বোধশক্তি প্রদান করেন এবং তাদেরকে সম্বোধন করেন ‘‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলে: হ্যাঁ’’[4]। তিনি তাদেরকে ঈমানের নির্দেশ দেন এবং কুফর থেকে নিষেধ করেন। তারা তাঁর রুবূবিয়্যাতের স্বীকৃতি দিয়েছে। এ ছিল তাদের পক্ষ থেকে ঈমান। আদম সন্তানগণ এই ফিতরাতের উপরেই জন্মলাভ করে। এরপর যে কুফরী করে সে নিজেকে পরিবর্তন ও বিকৃত করে। আর যে ঈমান আনে এবং সত্যতার ঘোষণা দেয় সে তার সহজাত ঈমানের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকে।
তিনি তাঁর সৃষ্টির কাউকে কুফরী করতে বাধ্য করেন নি এবং ঈমান আনতেও বাধ্য করেন নি। তিনি কাউকে মুমিনরূপে বা কাফিররূপে সৃষ্টি করেন নি। তিনি তাদেরকে ব্যক্তিরূপে সৃষ্টি করেছেন। ঈমান ও কুফর বান্দাদের কর্ম। কাফিরকে আল্লাহ তার কুফরী অবস্থায় কাফির হিসেবেই জানেন। যখন সে এরপর ঈমান আনয়ন করে তখন আল্লাহ তাকে তার ঈমানের অবস্থায় মুমিন হিসেবে জানেন এবং ভালবাসেন। আর এতে আল্লাহর জ্ঞান ও বিশেষণে কোনো পরিবর্তন হয় না।
বান্দাদের সকল কর্ম ও নিষ্কর্মতা- অবস্থান ও সঞ্চলন সবই প্রকৃত অর্থেই তাদের উপার্জন, আল্লাহ তা‘আলা সে সবের স্রষ্টা। এ সবই তাঁর ইচ্ছায়, জ্ঞানে, ফয়সালায় ও নির্ধারণে। আল্লাহর আনুগত্যের সকল কর্ম আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে জরুরী এবং তা আল্লাহর মহববত, সন্তুষ্টি, জ্ঞান, ইচ্ছা, ফয়সালা ও নির্ধারণ অনুসারে। সকল পাপকর্ম আল্লাহর জ্ঞান, ফয়সালা, নির্ধারণ ও ইচ্ছার মধ্যে সংঘটিত, তবে তা আল্লাহর মহববত, সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে সংঘটিত নয়।
[2] সূরা (৪২) শূরা: ১১ আয়াত।
[3] সূরা (২) বাকারা: ২২ আয়াত।
[4] সূরা (৭) আ’রাফ: ১৭২ আয়াত।