ভয় ও আশাও পার্থিব ও অপার্থিব বা লৌকিক ও অলৌকিক হতে পারে। জাগতিক ভাবে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী সকলেই কোনো ব্যক্তি বস্ত্ত বা দ্রব্যের ভয় বা আশা করতে পারেন। অলৌকিক নির্ভরতা, ভয়, আশা ইত্যাদি কোনো নাস্তিক বা অবিশ্বাসী করেন না। ধর্ম-বিশ্বাসী যার মধ্যে অলৌকিক মঙ্গল-অমঙ্গলের ক্ষমতা, নেক-নযর রাখার ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করেন তার অলৌকিক নেক-নযর বা সাহায্যের আশা রাখেন বা ভয় করেন। কুরআন-হাদীসে এরূপ ভয়, আশা, ভালবাসা একমাত্র আল্লাহর নিমিত্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
وَإِيَّايَ فَارْهَبُونِ
‘‘এবং তোমরা কেবলমাত্র আমাকেই ভয় কর।’’[1]
মহান আল্লাহর দয়ার আশায় হৃদয়কে উজ্জীবিত রাখা ইবাদত এবং নিরাশ হওয়া কুফর। মহান আল্লাহ বলেন:
إِنَّهُ لا يَيْأَسُ مِنْ رَوْحِ اللهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْكَافِرُونَ
‘‘কাফিরগণ ছাড়া কেউই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না।’’[2]
অলৌকিক ‘ভয় ও আশা’ মিশ্রিত আনুগত্যই যে ইবাদত সে বিষয়ে ‘‘আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম’’ পুস্তিকায় ইমাম আবূ হানীফা বলেন:
اِسْمُ الْعِبَادَةِ اسْمٌ جَامِعٌ يَجْتَمِعُ فِيْهِ الطَّاعَةُ وَالرَّغْبَةُ وَالإِقْرَارُ بِالرُّبُوْبِيَّةِ. وَذَلِكَ أَنَّهُ إِذَا أَطَاعَ اللهَ الْعَبْدُ فِيْ الإِيْمَانِ بِهِ وَدَخَلَ عَلَيْهِ الرَّجَاءُ وَالْخَوْفُ مِنَ اللهِ فَإِذَا دَخَلَ عَلَيْهِ هَذِهِ الْخِصَالُ الثَّلاَثُ فَقَدْ عَبَدَهُ ... اَلْخَوْفُ وَالرَّجَاءُ عَلَى مَنْزِلَتَيْنِ. وَإِحْدَى الْمَنْزِلَتَيْنِ مَنْ كَانَ يَرْجُوْ أَحَداً أَوْ يَخَافُهُ يَرَى أَنَّهُ يَمْلِكُ لَهُ مِنْ دُوْنِ اللهِ ضَرًّا أَوْ نَفْعاً، فَهُوَ كَافِرٌ. وَالْمَنْزِلَةُ الأُخْرَى مَنْ كَانَ يَرْجُوْ أَحَداً أَوْ يَخَافُهُ لِرَجَائِهِ الْخَيْرَ أَوْ مَخَافَةَ الْبَلاَءِ مِنَ اللهِ تَعَالَى عَسَى اللهُ أَنْ يُنْزِلَ بِهِ عَلَى يَدَيْ آَخَرَ أَوْ مِنْ سَبَبِ شَيْءٍ فَإِنَّ هَذَا لاَ يَكُوْنُ كُفْراً؛ لأَنَّ الْوَالِدَ يَرْجُوْ وَلَدَهُ أَنْ يَنْفَعَهُ، وَيَرْجُوْ الرَّجُلُ دَابَّتَهُ أَنْ تَحْمِلَ لَهُ، وَيَرْجُوْ جَارَهُ أَنْ يُحْسِنَ إِلَيْهِ وَيَرْجُوْ السُّلْطَانَ أَنْ يَدْفَعَ عَنْهُ، فَلاَ يَدْخُلُ عَلَيْهِ الْكُفْرُ؛ لأَنَّهُ إِنَّمَا رَجَاؤُهُ مِنَ اللهِ عَسَى أَنْ يَرْزُقَهُ مِنْ وَلَدِهِ أَوْ مِنْ جَارِهِ، وَيَشْرَبُ الدَّوَاءَ عَسَى اللهُ أَنْ يَنْفَعَهُ بِهِ، فَلاَ يَكُوْنُ كَافِراً. وَقَدْ يَخَافُ الشَّرَّ وَيَفِرُّ مِنْهُ مَخَافَةَ أَنْ يَبْتَلِيَهُ اللهُ بِهِ. وَالْقِيَاسُ فِيْ ذَلِكَ مُوْسَى عَلَيْهِ الصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ الَّذِيْ اصْطَفَاهُ اللهُ تَعَالَى بِرِسَالَتِهِ وَخَصَّهُ بِكَلاَمِهِ إِيَّاهُ حَيْثُ لَمْ يَجْعَلْ بَيْنَهُ وَبَيْنَ مُوْسَى رَسُوْلاً، قال: (فَأَخَافُ أَنْ يَقْتُلُونِ) وَسَيِّدُنَا مُحَمَّدٌ ﷺ حَيْثُ فَرَّ إِلَى الْغَارِ، فَلَمْ يَدْخُلْ عَلَيْهِمُ الْكُفْرُ. وَكَذَلِكَ أَيْضاً يَخَافُ الرَّجُلُ مِنَ السَّبُعِ أَوِ الْحَيَّةِ أَوِ الْعَقْرَبِ أَوْ هَدْمِ بَيْتٍ أَوْ سَيْلٍ أَوْ أَذَى طَعَامٍ يَأْكُلُهُ أَوْ شَرَابٍ يَشْرَبُهُ، فَلاَ يَدْخُلُ عَلَيْهِ الْكُفْرُ وَلاَ الشَّكُّ، وَلَكِنْ إِنَّمَا يَدْخُلُ الْجُبْنُ.
‘‘ইবাদত কয়েকটি বিষয়ের সমন্বিত নাম, যার মধ্যে আশা, আনুগত্য ও রুবূবিয়্যাতের স্বীকৃতি একত্রিত। যখন কোনো বান্দা আল্লাহর প্রতি ঈমান-সহ তাঁর আনুগত্য করে এবং তার মধ্যে আল্লাহর প্রতি আশা ও ভয় প্রবেশ করে, যখন এ তিনটি বিষয় তার মধ্যে প্রবেশ করে তখন তা ইবাদতে পরিণত হয়। .... ভয় ও আশার (অপার্থিব ও পার্থিব) দুটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম (অপার্থিব বা অলৌকক) পর্যায় এরূপ যে, সে কারো থেকে আশা করবে বা কাউকে ভয় করবে এভাবে যে, আল্লাহ ছাড়াও সে তার মঙ্গল-অমঙ্গল বা কল্যাণ-অকল্যাণের ক্ষমতা রাখে। এ ব্যক্তি কাফির। দ্বিতীয় (লৌকিক) পর্যায় এই যে, কেউ কারো থেকে আশা করে বা তাকে ভয় পায় এজন্য যে সে হয়ত কোনো উপকার তার করবে, অথবা আল্লাহর নির্ধারিত কোনো বিপদের বিষয়ে সে মনে করে হয়ত বিপদটি এর হাত দিয়েই তার উপর নিপতিত হবে, বা কোনো বিষয় বিপদের কারণে পরিণত হবে। এরূপ আশা ও ভয় কুফর নয়। কারণ একজন পিতা তার সন্তান থেকে আশা করে যে, সন্তান তার উপকার করবে, সে তার বাহন থেকে আশা করে যে, সে তাকে বহন করবে, সে তার প্রতিবেশী থেকে আশা করে যে, সে তার কিছু উপকার করবে, সে শাসক-প্রশাসক থেকে আশা করে যে, সে তাকে নিরাপত্তা দিবে। এ সকল বিষয় কুফরের মধ্যে ঢুকবে না। কারণ সে মূলত আশা করে যে, আল্লাহ হয়ত তার এ সন্তান দ্বারা বা তার প্রতিবেশী দ্বারা তার উপকার করবেন। সে ঔষধ পান করে এবং আশা করে যে, আল্লাহ হয়ত এদ্বারা তার উপকার করবেন। এতে সে কাফির হয় না। কখনো বা ক্ষতির ভয়ে সে পলায়ন করে এ আশঙ্কায় যে আল্লাহ তাকে বিপদগ্রস্ত করবেন এর দ্বারা। এর কিয়াস বা যুক্তি মূসা (আঃ)। আল্লাহ তাঁকে নিজের রাসূল হিসেবে পবিত্র ও বাছাই করেছিলেন এবং তাঁর ও মূসার মাঝে কোনো দূত ছাড়াই সরাসরি তাঁর সাথে কথা বলেছেন। সেই মূসা (আঃ) বলেন: (আমি ভয় করি যে, তারা আমাকে হত্যা করবে)[3]। আমাদের নেতা মুহাম্মাদ (ﷺ) গুহায় আত্মগোপন করেন। এতে তাঁদের উপর কুফর প্রবেশ করে নি। অনুরূপভাবে মানুষ বন্যপ্রাণী, সাপ, বিচ্ছু থেকে ভয় পায়, বাড়ি ভেঙ্গে যাওয়ার ভয় পায়, বন্যার ভয় পায়, যে খাদ্য খাচ্ছে বা যে পানীয় পান করছে তার ক্ষতির ভয় পায়, এগুলির কারণে সে কুফরীতে পতিত হয় না; বরং তার ভীতি, দুর্বলতা বা কাপুরুষতা প্রকাশ পায়।’’[4]
এখানে ইমাম আযম পার্থিব আশা ও ভয় এবং অলৌকিক আশা ও ভয়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝিয়েছেন। মানুষ জাগতিক যে সকল বিষয় আশা করে বা ভয় পায় তা মূলত এগুলির মধ্যে বিদ্যমান জাগতিক ক্ষমতা যা স্বাভাবিকভাবে আল্লাহ প্রদান করেছেন। পক্ষান্তরে আল্লাহ ছাড়া কারো মধ্যে কোনো অলৌকিক, অতিপ্রাকৃতিক বা অপার্থিব মঙ্গল-অমঙ্গল ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করা কুফর ও শিরক।
[2] সূরা (১২) ইউসুফ: ৮৭ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (১৫) হিজর: ৫৬ আয়াত।
[3] সূরা (২৬): শুআরা: ১৪ আয়াত।
[4] ইমাম আবূ হানীফা, আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম, পৃ. ৩৩-৩৪।