কাফিরগণ বিশ্বাস করত যে, আল্লাহর এরূপ ‘‘মাহবূব’’ বান্দাগণকে আল্লাহ শাফা‘আত বা শুপারিশ করার ‘‘ক্ষমতা’’ প্রদান করেছেন। তাঁরা তাঁদের ইচ্ছামত যার জন্য খুশি সুপারিশ করে আল্লাহ নিকট থেকে তার প্রয়োজন মিটিয়ে দিতে পারেন। কুরআনে তাদের এ বিশ্বাস খন্ডন করা হয়েছে। শাফাআত বিষয়ক আলোচনায় তা আমরা দেখব, ইনশা আল্লাহ।
৪. ৪. ১. ৪. ইলমুল গাইব বিষয়ক শিরক
মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের অন্যতম দিক তাঁর অনন্ত-অসীম অতুলনীয় ও সামগ্রিক ইলম বা জ্ঞান। তাঁর অন্যতম সিফাত হলো ‘আলিমুল গাইব’ বা ‘অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী’ এবং ‘আলিমুল গাইব ওয়াশ শাহাদাহ’ বা ‘দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী’। কুরআনে একথা বলা হয় নি যে, ‘আল্লাহর মত গাইবী ইলম’ কারো নেই, বরং বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘গাইবের জ্ঞান’-ই আল্লাহ ছাড়া কারো নেই। আল্লাহ ছাড়া কারো এরূপ গাইবের জ্ঞান বা অনাদি-অনন্ত জ্ঞান আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক। ইহূদী-খৃস্টান ও আরবের কাফিরগণ এরূপ শিরকে লিপ্ত ছিল। প্রচলিত বাইবেলেও বারংবার ঘোষণা করা হয়েছে যে, ঈসা মাসীহ গাইবের বিষয় জানতেন না[1]; তবুও খৃস্টানগণ বিশ্বাস করতেন এবং করেন যে, ঈসা (আঃ) গাইবের জ্ঞানের অধিকারী। কাফিরগণ বিশ্বাস করতেন ও করেন যে, জিনগণ এবং তাদের পুরোহিতগণ (কাহিন) গাইবের জ্ঞানের অধিকারী। কুরআন ও হাদীসে এ সকল শিরকী বিশ্বাস খন্ডন করা হয়েছে। এমনকি কোনো কোনো মুসলিম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিষয়ে এরূপ ধারণা প্রকাশ করলে তিনি তার কঠোর প্রতিবাদ করেছেন। আল্লাহ বলেন:
قُلْ لا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ الْغَيْبَ إِلا اللَّهُ
‘‘বল, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে আল্লাহ ব্যতীত কেউ গাইবের জ্ঞান রাখে না।’’[2]
নবী-রাসূলগণ কেউই পৃথিবীতে জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরে কখনো ইলম গাইবের অধিকারী হন না।
এ বিষয়ক কয়েকটি আয়াত দেখুন:
يَوْمَ يَجْمَعُ اللَّهُ الرُّسُلَ فَيَقُولُ مَاذَا أُجِبْتُمْ قَالُوا لا عِلْمَ لَنَا إِنَّكَ أَنْتَ عَلامُ الْغُيُوبِ
‘‘যে দিন (কিয়ামতের দিন) আল্লাহ রাসূলদেরকে একত্র করবেন এবং বলবেন, তোমরা কী উত্তর পেয়েছিলে? তারা বলবে, আমাদের তো কোনো জ্ঞান নেই, আপনিই তো অদৃশ্য সম্মন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।’’[3]
قُلْ لا أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلا أَقُولُ لَكُمْ إِنِّي مَلَكٌ إِنْ أَتَّبِعُ إِلا مَا يُوحَى إِلَيَّ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَفَلا تَتَفَكَّرُونَ
‘‘বল, আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডারসমূহ রয়েছে, অদৃশ্য (গায়েব) সম্বন্ধেও আমি অবগত নই, আর আমি তোমাদেরকে একথাও বলি না যে, আমি ফিরিশতা। আমি তো শুধু আমার প্রতি যে ওহী প্রেরণ করা হয় তারই অনুসরণ করি।’’[4]
قُلْ لا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلا ضَرًّا إِلا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
‘‘বল, আমার নিজের কোনো মঙ্গল বা অমঙ্গল করার ক্ষমতাও আমার নেই, শুধু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত। আমি যদি গাইব (গোপন জ্ঞান) জানতাম তাহলে প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম, আর কোনো অমঙ্গল আমাকে স্পর্শ করতে পারতো না। আমি তো কেবল ভয়প্রদর্শনকারী এবং সুসংবাদদাতা বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য।’’[5]
মহিলা সাহাবী রুবাই’ বিনতু মু‘আওয়িয বলেন:
دَخَلَ عَلَيَّ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ صَبِيحَةَ عُرْسِي وَعِنْدِي جَارِيَتَانِ تُغَنِّيَانِ ... وَتَقُولانِ فِيمَا تَقُولانِ: وَفِينَا نَبِيٌّ يَعْلَمُ مَا فِي غَدٍ، فَقَالَ أَمَّا هَذَا فَلا تَقُولُوهُ، مَا يَعْلَمُ مَا فِي غَدٍ إِلا اللَّهُ
‘‘আমার বিবাহের দিন সকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার ঘরে প্রবেশ করেন, তখন আমার কাছে দু’জন বালিকা বসে গীত গাচ্ছিল।... তারা তাদের কথার মাঝে মাঝে বলছিল: ‘আমাদের মধ্যে একজন নবী রয়েছেন যিনি আগামীকাল (অর্থাৎ ভবিষ্যতে) কি আছে তা জানেন।’ তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদেরকে বলেন: ‘এ কথা বলো না, আগামীতে (ভবিষ্যতে) কি আছে তা আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না।’’[6]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, কিয়ামতের দিন অনেক মানুষ আমার কাছে (হাউযে পানি পানের জন্য) আসবে, যাদেরকে আমি চিনব এবং তারাও আমাকে চিনবে, কিন্তু তাদেরকে আমার কাছে আসতে বাধা দেওয়া হবে। আমি বলব: এরা তো আমারই উম্মত-সহচর। তখন উত্তরে বলা হবে:
إِنَّكَ لاَ تَدْرِيْ مَا عَمِلُوا بَعْدَكَ فَأَقُولُ كَمَا قَالَ الْعَبْدُ الصَّالِحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ: وَكُنْتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا مَا دُمْتُ فِيهِمْ فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِي كُنْتَ أَنْتَ الرَّقِيبَ عَلَيْهِمْ وَأَنْتَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ ...
‘‘‘আপনার পরে তারা কী আমল করেছে তা আপনি জানেন না’। তখন আমি তা-ই বলব নেকবান্দা ঈসা ইবনু মারিয়াম যা বলেন[7]: ‘যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন আমি ছিলাম তাদের শাহীদ-সাক্ষী। কিন্তু যখন আপনি আমাকে তুলে নিলেন তখন আপনিই তো ছিলেন তাদের কার্যকলাপের তত্ত্বাবধায়ক এবং আপনিই সর্ববিষয়ে সাক্ষী (শাহীদ)।’’[8]
এ অর্থের হাদীস আয়েশা, উম্মু সালামা, আসমা বিনত আবী বাকর, ইবনু মাসঊদ, আনাস ইবনু মালিক, আবূ সাঈদ খুদরী, সাহল ইবনু সা’দ, আমর ইবনুল আস, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস প্রমুখ প্রায় দশ জন সাহাবী (রাঃ) থেকে অনেকগুলি সহীহ সনদে ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ে বর্ণিত।[9]
আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَنْ أَتَى كَاهِنًا أَوْ عَرَّافًا فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُولُ فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ
‘‘যে ব্যক্তি কোনো গণক, ভাগ্যবক্তা বা ভবিষ্যদ্বক্তার নিকট গমন করে এবং তার কথা বিশ্বাস করে সে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর অবতীর্ণ দীনের প্রতি কুফরী করে।’’[10]
মোল্লা আলী কারী ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থের ব্যাখ্যায় বলেন:
اِعْلَمْ أَنَّ الأَنْبِيَاءَ عَلَيْهِمُ الصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ لَمْ يَعْلَمُوْا الْمَغِيْبَاتِ مِنَ الأَشْيَاءِ إِلاَّ مَا عَلَّمَهُمُ اللهُ أَحْيَاناً. وَذَكَرَ الْحَنَفِيَّةُ تَصْرِيْحاً بِالتَّكْفِيْرِ بِاعْتِقَادِ أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ يَعْلَمُ الْغَيْبَ؛ لِمُعَارَضَةِ قَوْلِهِ تَعَالَى: (قُلْ لا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ الْغَيْبَ إِلا اللَّهُ)...".
‘‘জেনে রাখ, নবীগণ (আঃ) অদৃশ্য বা গাইবী বিষয়াদির বিষয়ে আল্লাহ কখনো কখনো যা জানিয়েছেন তা ছাড়া কিছুই জানতেন না। হানাফী মাযহাবের আলিমগণ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গাইব জানতেন বলে আকীদা পোষণ করা কুফরী, কারণ তা আল্লাহর এ কথার সাথে সাংঘর্ষিক[11]: ‘‘বল: আল্লাহ ব্যতীত আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই অদৃশ্য (গাইব) বিষয়ের জ্ঞান রাখে না।’’[12]
[2] সূরা (২৭) নাম্ল: ৬৫ আয়াত।
[3] সূরা (৫) মায়িদা: ১০৯ আয়াত।
[4] সূরা (৬) আনআম: ৫০ আয়াত। আরো দেখুন (সূরা ১১ হূদ: ৩১ আয়াত)
[5] সূরা (৭) আ‘রাফ: ১৮৮ আয়াত।
[6] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৪৬৯ (কিতাবুল মাগাযী, বাবু শুহূদিল মালাইকাতি বাদরান); ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ৭/৩১৫।
[7] সূরা (৫) মায়িদা: ১১৭ আয়াত।
[8] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬৯১ (কিতাবুল আম্বিয়া, বাবু কাওলিল্লাহি: ওয়াত্তাখাযাল্লাহু ইবরাহীমা খালীলান); মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৯৩-১৭৯৪ (কিতাবুল জান্নাতি, বাবু ফানাইদ্দুনইয়া)
[9] বিস্তারিত দেখুন, ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান, পৃ. ১৬৭-১৬৯; কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ২০১-২০২।
[10] আহমদ, আল-মুসনাদ ২/৪২৯; আলবানী, সাহীহুত তারগীব ৩/৯৭-৯৮।
[11] সূরা (২৭) নাম্ল: ৬৫ আয়াত।
[12] মোল্লা আলী কারী: শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ২৫৩।