রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) যখন আহযাবের তিনটি অঙ্গের মধ্যে দুটি শক্তিশালী অঙ্গকে বিধ্বস্ত করে দিয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত ও স্বস্তিবোধ করলেন, তখন তৃতীয় অঙ্গটির প্রতি পুরোপুরি মনোযোগদানের সুযোগ লাভ করলেন। তৃতীয় অঙ্গ ছিল ঐ সব বেদুঈন যারা নাজদের বালুকাময় প্রান্তরে শিবির স্থাপন করে বসবাস করত এবং মাঝে মাঝে ডাকাতি ও লুট-তরাজে লিপ্ত হত।
যেহেতু এ বেদুঈনগণ স্থায়ী কোন জনপদ কিংবা শহরের অধিবাসী ছিল না এবং তাদের স্থায়ী কোন দূর্গও ছিল না, সেহেতু মক্কা ও খায়বারের অধিবাসীদের ন্যায় তাদের বশীভূত করা কিংবা অন্যায় ও অনিষ্টতা থেকে তাদের বিরত রাখার ব্যাপারটি ছিল অত্যন্ত কঠিন। কাজেই, তাদের শায়েস্তা করার জন্য তাদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের অনুরূপ সন্ত্রাসমূলক ও শাস্তিমূলক কার্যকলাপকেই উপযোগী বলে বিবেচনা করা হচ্ছিল।
এ প্রেক্ষিতে বেদুঈনদের মনে ভয়-ভীতির সঞ্চার, চমক সৃষ্টি এবং মদীনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সমূহে আকস্মিক আক্রমণ পরিচালনার উদ্দেশ্যে একত্রিত বেদুঈনদের বিক্ষিপ্ত করার লক্ষ্যে নাবী কারীম (ﷺ) যে শাস্তিমূলক আক্রমণ পরিচালনা করেন তা ‘যাতুর রিক্বা’ যুদ্ধ’ নামে প্রসিদ্ধ রয়েছে।
সাধারণ যুদ্ধ বিশারদ ইতিহাসবিদগণ ৪র্থ হিজরীতে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ইমাম বুখারী (রঃ) বলেছেন যে, ৭ম হিজরীতে তা সংঘটিত হয়েছিল। যেহেতু এ যুদ্ধে আবূ মুসা আশ’আরী ও আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) অংশ গ্রহণ করেছিলেন সেহেতু এটা প্রমাণিত হয় যে, এ যুদ্ধ খায়বার যুদ্ধের পরে সংঘটিত হয়েছিল (সম্ভবত মাসটি ছিল) রবিউল আওয়াল। কারণ খায়বার যুদ্ধের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন মদীনা হতে বাহির হয়েছিলেন সে সময় আবূ হুরায়রা মদীনায় পৌঁছে ইসলামের ছায়াতলে প্রবিষ্ট হন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি খায়বার গিয়ে যখন খিদমতে নাবাবীতে পৌঁছেন তখন খায়বার বিজয় পর্ব শেষ হয়েছিল।
অনুরূপভাবে আবূ মুসা আশ’আরী (রাঃ) আবিসিনিয়া হতে গিয়ে ঐ সময় খিদমতে নাবাবীতে পৌঁছেছিলেন যখন খায়বার বিজয় সম্পূর্ণ হয়েছিল। যাতুর রিক্বা’ যুদ্ধে সাহাবী (রাঃ) দ্বয়ের অংশগ্রহণ এটাই প্রমাণিত করে যে, এ যুদ্ধ খায়বার যুদ্ধের পর সংঘটিত হয়েছিল।
এ যুদ্ধ সম্পর্কে চরিতলেখকগণ যা কিছু বলেছেন তার সার সংক্ষেপ হচ্ছে, নাবী কারীম (ﷺ) আনমার অথবা বনু গাত্বাফান গোত্রের দুটি শাখা বনু সা’লাবা এবং বনু মোহারেবের লোকজনদের সমবেত হওয়ার সংবাদ পেয়ে আবূ যার কিংবা উসমান ইবনু আফফানের উপর মদীনার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং ৪০০ শ’ কিংবা ৭০০ শ’ সাহাবা (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে নাজদ অভিমুখে যাত্রা করেন। অতঃপর মদীনা হতে দু’ দিনের দূরত্বে অবস্থিত নাখল নামক স্থানে গিয়ে পৌঁছেন। তথায় বনু গাত্বাফান গোত্রের মুখোমুখী হতে হয়, কিন্তু যুদ্ধ হয় নি। তবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐ সময় খাওফের (যুদ্ধাবস্থার) সালাত আদায় করেন।
সহীহুল বুখারীতে আবূ মুসা আশয়ারী হতে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে বাহির হলাম। আমরা ছিলাম ছয় জন। আমাদের সঙ্গে ছিল একটি উট যার উপর আমরা পালাক্রমে সওয়ার হচ্ছিলাম। এ কারণে আমাদেপর পা ছিদ্র হয়ে গিয়েছিল। আমার পা দুটি আহত হয়েছিল এবং নখ ঝরে পড়েছিল। কাজেই আমরা নিজ নিজ পায়ের উপর ছেঁড়া কাপড় দিয়ে পট্টি বেঁধেছিলাম। এ কারণে এ যুদ্ধের নাম দেয়া হয়েছিল যাতুর রিক্বা’ (ছিন্ন বস্ত্রের যুদ্ধ)।[1]
সহীহুল বুখারীতে জাবির (রাঃ) হতে আরও বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, ‘যাতুর রিক্বা’ যুদ্ধে আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে ছিলাম। (নিয়ম ছিল) আমরা যখন ছায়াদানকারী বৃক্ষের নিকট পৌঁছতাম তখন তা নাবী কারীম (ﷺ)-এর জন্য ছেড়ে দিতাম। এক দফা, নাবী কারীম (ﷺ) শিবির স্থাপন করলেন তখন লোকজনেরা বৃক্ষের ছায়ায় বিশ্রাম গ্রহণের জন্য কাঁটাযুক্ত বৃক্ষের মাঝে এদিক সেদিক এলোমেলো অবস্থায় ছড়িয়ে পড়ল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একটি বৃক্ষের নীচে অবতরণ করেন এবং বৃক্ষের সঙ্গে তরবারী খানা ঝুলিয়ে রেখে শুয়ে পড়েন।
জাবির (রাঃ) বলেছেন, ‘আমরা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম এমন সময় এক মুশরিক এসে নাবী কারীম (ﷺ)-এর তরবারী খানা হাতে নিয়ে বলল, ‘তুমি আমাকে ভয় করছ?’ নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‘না’’। সে বলল, ‘তোমাকে আমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে?’ নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‘আল্লাহ’’। জাবির (রাঃ) বলেছেন, ‘রাসূলে কারীম (ﷺ) হঠাৎ আমাকে ডাক দিলেন। আমরা সেখানে পৌঁছে দেখলাম যে একজন বেদুঈন রাসূল (ﷺ)-এর নিকট বসে রয়েছে।
নাবী (ﷺ) বললেন,
(إِنَّ هٰذَا اِخْتَرَطَ سَيْفِيْ وَأَنَا نَائِمٌ، فَاسْتَيْقَظَتْ وَهُوْ فِيْ يَدِهِ صَلْتًا. فَقَالَ لِيْ: مَنْ يَمْنَعُكَ مِنِّيْ؟ قُلْتُ: اللهُ، فَهَا هُوَ ذَا جَالِسٌ)
আমি শুয়েছিলাম এমন সময় এ ব্যক্তি আমার তরবারী খানা টেনে হাতে নিলে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে তরবারী খানা হাতে নিয়ে বলল, ‘আমার হাত থেকে তোমাকে কে রক্ষা করবে?’ আমি বললাম, ‘আল্লাহ’’। এ হচ্ছে সে ব্যক্তি যে বসে রয়েছে।’
অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তাকে কোন প্রকার তিরস্কার করলেন না বা ধমক দিলেন না।
আবূ আওয়ানার (রাঃ) বর্ণনা সূত্রে আরও বিস্তারিত জানা যায় যে, নাবী কারীম (ﷺ) যখন তার উত্তরে বললেন, ‘আল্লাহ’, তখন তরবারীখানা তার হাত থেকে পড়ে গেল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তরবারী খানা নিজ হাতে উঠিয়ে নিয়ে বললেন, ‘এখন তোমাকে আমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে?’ সে বলল, ‘আপনি ভাল ধৃতকারী প্রমাণিত হলেন।’ (অর্থাৎ দয়া করুন) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, (تَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ؟) ‘তুমি কি সাক্ষ্য দিচ্ছ যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোন উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল (ﷺ)।
সে বলল, ‘আমি অঙ্গীকার করছি যে,আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করব না এবং যারা আপনার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবে তাদের সঙ্গেও থাকব না।’
জাবির (রাঃ)-এর বর্ণনায় রয়েছে যে এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে ছেড়ে দেন। অতঃপর সে নিজ সম্প্রদায়ের নিকট গিয়ে বলে, ‘আমি সর্বোত্তম মানুষের নিকট থেকে তোমাদের এখানে আসছি।[2]
সহীহুল বুখারীর বর্ণনায় মুসাদ্দাদ, আবূ আওয়ানা হতে এবং তিনি আবূ বিশর হতে বর্ণনা করেছেন যে, সেই লোকটির নাম ছিল (গাওরাস বিন হারিস)।[3] ইবনু হাজার বলেছেন যে, ওয়াক্বিদীর নিকট এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণে এ কথা বলা হয়েছে যে, এ বেদুঈনের নাম ছিল দু’সুর এবং সে ইসলাম কবূল করে নিয়েছিল। কিন্তু ওয়াকেদির কথা থেকে জানা যায় যে এ দুটি ছিল ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা যা ভিন্ন ভিন্ন যুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল।[4] আল্লাহই ভাল জানেন।
এ যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তন কালে সাহাবীগণ (রাঃ) একজন মুশরিকা মহিলাকে বন্দী করেন। এর প্রেক্ষিতে তাঁর স্বামী মানত করল যে, সে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সাহাবীগণ (ﷺ)-এর মধ্যে থেকে এক জনের রক্ত প্রবাহিত করবে। এ উদ্দেশ্যে সে রাত্রিতে বের হল।
শত্রুদের আক্রমণ ও অনিষ্ট থেকে মুসলিমগণের নিরাপত্তা বিধানের জন্য আববাদ বিন বিশর ও আম্মার বিন ইয়াসিরকে পাহারার কাজে নিয়োজিত করা হয়। বন্দী মহিলার স্বামী যে সময়ে সেখানে এসেছিল সে সময় আববাদ (রাঃ) দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন। তাঁর সালাতের মধ্যেই লোকটি তাঁর প্রতি তীর নীক্ষেপ করে। তিনি সালাত অবস্থায় তাঁর অঙ্গে বিদ্ধ তীরটি বাহির করে নিক্ষেপ করে দেন। অতঃপর সে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তীর নিক্ষেপ করে। কিন্তু তিনি সালাত ত্যাগ না করেই শেষ সালামের মাধ্যমে সালাত সমাপ্ত করেন। অতঃপর স্বীয় সঙ্গীকে জাগ্রত করেন।
অবস্থা বুঝে সুঝে সঙ্গী বললেন, ‘আপনি আমাকে জাগান নি কেন?
তিনি বললেন, ‘আমি একটি সূরাহ পাঠ করছিলাম। সম্পূর্ণ করা থেকে বিরত হওয়াটা আমি পছন্দ করি নি।[5]
পাষাণ হৃদয় বেদুঈনদের ভীত সন্ত্রস্ত্র করার ব্যাপারে এ যুদ্ধের প্রভাব ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে আয়োজিত অভিযানসমূহ সম্পর্কে সমীক্ষা চালালে দেখতে পাওয়া যায় যে, এ যুদ্ধের পর গাত্বাফানদের ঐ সমস্ত গোত্র মাথা উঁচু করার আর সাহস পায় নি। তাদের মনোবল ক্রমে ক্রমে শিথিল হতে হতে শেষ পর্যন্ত তাঁরা পরাভূত হল এবং ইসলাম গ্রহণ করে নিল। এমন কি সে সকল বেদুঈনদের কতগুলো গোত্রকে মক্কা বিজয়ের সময় এবং হুনাইন যুদ্ধে মুসলিমগণের সঙ্গে দেখা গিয়েছিল এবং তাদেরকে হুনায়েন যুদ্ধের গণীমতের অংশও প্রদান করা হয়েছিল। আবার মক্কা বিজয় হতে প্রত্যাবর্তনের পর তাদের সদকা গ্রহণের জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের কর্মচারীদের প্রেরণ করা হয়েছিল এবং তারা নিয়মিত সদকা ও যাকাত আদায় করেছিল। মূলকথা হচ্ছে, এ কৌশল অবলম্বনের ফলে ঐ তিনটি শক্তি ভেঙ্গে যায় যারা খন্দকের যুদ্ধে মদীনার উপর আক্রমণ চালিয়েছিল এবং যার ফলে সমগ্র অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছিল।
এরপর কতগুলো গোত্র বিভিন্ন অঞ্চলে যে গন্ডগোল ও চক্রান্তমূলক কাজকর্ম আরম্ভ করেছিল মুসলিমগণ খুব সহজেই তাদের আয়ত্বে নিতে সক্ষম হয়েছিল। অধিকন্তু, এ যুদ্ধের পর বড় বড় শহর ও বিভিন্ন দেশ বিজয়ের পথ প্রশস্ত হতে শুরু করে। কারণ, এ যুদ্ধের পর দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা ইসলাম ও মুসলিমগণের নিরাপত্তা ও শান্তি স্বস্তির জন্য পুরোপুরি অনুকূল হয়ে ওঠে।
[2] শাইখ আব্দুল্লাহ নাজদীকৃত মুখতাসারুস সীরাত ২৬৪ পৃঃ। ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৪১৬ পৃঃ।
[3] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৯৩ পৃঃ।
[4] ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৪১৭-৪২৮ পৃঃ।
[5] যাদুল মা’আদ ২য় খন্ড ১১২ পৃঃ। এ যুদ্ধের বিস্তারিত তথ্যাদির জন্য আরও দ্রষ্টব্য ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ২০৩ থেকে ২০৯ পৃঃ। যাদুল মা’আদ ২য় খন্ড ১১০-১১২ পৃঃ। ফাতহুল বারী ৪১৭-১২৮ পৃঃ।
উপরোল্লিখিত যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সপ্তম হিজরীর শওয়াল মাস পর্যন্ত মদীনায় অবস্থান করেন। এ সময় মদীনায় অবস্থান কালে তিনি যে সকল অভিযান প্রেরণ করেন তার বিবরণ নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হল-
১. কুদাইদ অভিযান (৭ম হিজরী সফর কিংবা রবিউল আওয়াল মাস) :
বনু মুলাওওয়াহ গোত্রকে শায়েস্তার জন্য গালিব বিন আব্দুল্লাহ লায়সীর পরিচালনাধীনে কুদাইদ নামক স্থানে এ অভিযান প্রেরিত হয়। বনু মলুহ বিশর বিন সোয়াইদের বন্ধুগণকে হত্যা করেছিল। এ হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে এ অভিযান প্রেরিত হয়েছিল। এ অভিযাত্রী দল রাত্রি বেলা আক্রমণ করে বনু মলুহ গোত্রের অনেক লোককে হত্যা করেন এবং গবাদি পশু খেদিয়ে নিয়ে আসেন। শত্রু পক্ষ একটি বড় আকারের বাহিনীসহ মুসলিম বাহিনীকে অনুসরণ করে অগ্রসর হতে থাকে। উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম বাহিনীর উপর পাল্টা আঘাত হানা। কিন্তু তারা যখন মুসলিম বাহিনীর কাছাকাছি এসে পড়েন তখন প্রবল বেগে বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে প্লাবন দেখা দেয়। এ প্লাবনই উভয় পক্ষের মধ্যে প্রতিরক্ষা প্রাচীর হিসেবে কাজ করে। সে সুযোগে মুসলিম বাহিনী নিরাপত্তা ও শান্তির মধ্য দিয়ে অবশিষ্ট পথ অতিক্রম করেন।
হিসমা অভিযান (৭ম হিজরী, জুমাদাস সানীয়াহ) : এ অভিযান সংক্রান্ত আলোচনা রাজন্যবর্গের নিকট পত্রলিখন অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে।
তুরাবাহ অভিযান (৭ম হিজরী শা‘বান মাস) : এ অভিযান প্রেরণ করা হয়েছিল উমার বিন খাত্তাব (রাঃ)-এর নেতৃত্বে। এ অভিযানে ত্রিশ জন মুসলিম সৈন্য অংশ গ্রহণ করেন। তাঁরা রাত্রি বেলা সফর করতেন এবং দিবা ভাগে আত্মগোপন করে থাকতেন। এ অভিযানের লক্ষ্যস্থল ছিল বনু হাওয়াযিন। মুসলিম অগ্রাভিযানের খবর পেয়ে বনু হাওয়াযিন পলায়ন করে যার ফলে মুসলিম বাহিনী সেখানে কাউকে না পেয়ে মদীনা ফিরে আসেন।
ফাদাক অঞ্চল অভিমুখে অভিযান (৭ম হিজরী শা‘বান মাস) : এ অভিযান প্রেরণ করা হয় বশীর বিন সা‘দ আনসারী (রাঃ)-এর নেতৃত্বে বনু মুররার সংশোধন উপলক্ষে। এ অভিযাত্রী দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ত্রিশ জন। বশীর (রাঃ) তাদের অঞ্চলে পৌঁছে ভেড়া বকরী এবং গবাদী পশু খেদিয়ে নিয়ে মদীনার পথে অগ্রসর হন। কিন্তু রাত্রে শত্রুদল তাঁদের পশ্চাদনুসরণ করে। অভিযাত্রীগণ তাদের দিকে তীর নিক্ষেপ করে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তীর শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে তারা নিরস্ত্র হয়ে পড়েন এবং অবশেষে সকলকেই শাহাদত বরণ করতে হয়। কেবল মাত্র বশীর (রাঃ) আহত অবস্থায় জীবিত থাকেন। আহত অবস্থায় তাকে ফাদাকে আনা হয়। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ইহুদীগণের নিকট অবস্থান করেন। সুস্থতা লাভের পর তিনি মদীনায় ফিরে আসেন।
মাইফা’আহ অভিযান (৭ম হিজরীর রমাযান মাস) : এ অভিযান প্রেরণ করা হয় গালিব বিন আব্দুল্লাহ লাইসীর নেতৃত্বে বনু ওয়াল ও বনু আবদ বিন সা’লাবাহর সংশোধন উপলক্ষে এবং বলা হয়েছে যে, জুহায়নাহ গোত্রের শাখা হারাকাতকে শিক্ষা দানের জন্য। অভিযাত্রীদলের সদস্য সংখ্যা ছিল একশ ত্রিশ।
মুসলিম মুজাহিদগণ সংঘবদ্ধভাবে শত্রুদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং যে কেউ মাথা উঁচু করে আক্রমণ প্রতিহত করতে আসে তাকে হত্যা করেন। অতঃপর শত্রুপক্ষের গবাদি পশুগুলো খেদিয়ে নিয়ে আসেন।
এ অভিযান কালে উসামা বিন যায়দ নাহিক বিন মের্দাসকে (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) বলা সত্ত্বেও হত্যা করেছিলেন। এ প্রেক্ষিতে নাবী কারীম (ﷺ) নিন্দা করে বলেছিলেন,
(أَقَتَلْتَهُ بَعْدَ مَا قَالَ: لَا إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ؟ فَهَلاَّ شَقَقْتَ عَنْ قَلْبِهِ فَتَعْلَمُ أَصَادِقٌ هُوْ أَمْ كَاذِبٌ؟).
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার পরও তুমি তাকে হত্যা করলে? ‘তুমি তার অন্তর চিরে কেন বুঝাবার চেষ্টা করল না? সে সত্যবাদী কি মিথ্যাবাদী ছিল?’
খায়বার অভিযান (৭ম হিজরী, শাওয়াল মাস) : এ অভিযান ছিল ত্রিশ জন ঘোড়সওয়ার সমন্বয়ে গঠিত একটি দল। আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহার (রাঃ) নেতৃত্বে প্রেরিত হয়েছিল এ অভিযান। এ অভিযানের কারণ ছিল, আসীর অথবা বশীর বিন যারাম মুসলিমগণের উপর আক্রমণ পরিচালনার জন্য গাত্বাফানদের একত্রিত করছিল।
মুসলিমগণ যথাস্থানে পৌঁছার পর আসীরকে এ মর্মে আশ্বাস প্রদান করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে খায়বারের গর্ভনর নিযুক্ত করবেন। তার ত্রিশ জন বন্ধুসহ তাঁদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য তাঁরা তাকে উদ্বুদ্ধ করলেন। কিন্তু কারকা নিয়ার পৌঁছার পর দু’ দলের মধ্যে কিছুটা সন্দেহের সৃষ্টি হওয়ার ফলে আসীর এবং তার ত্রিশ জন সাথী মুসলিমগণের হাতে নিহত হয়। ওয়াক্বিদী এই সারিয়্যাকে খায়বারের কয়েকমাস পূর্বে ৬ষ্ঠ হিজরীর শাওয়াল মাসে সংঘটিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
ইয়ামান ও জাবার অভিযান (৭ম হিজরী শাওয়াল মাস) : জাবার এর জিম-এ জবর (হরকত) আছে। এটা বনু গাত্বাফান এবং বলা হয়েছে যে, বনু ফাযারা ও বনু উযরা এলাকার নাম। বাশীর বিন কা‘ব আনসারী (রাঃ)-কে তিনশ মুসলিম সৈন্যের একটি দলসহ সেখানে প্রেরণ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল মদীনার উপর আক্রমণ চালানোর লক্ষে প্রস্তুতি গ্রহণরত এক বিরাট বাহিনীকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়া। অভিযাত্রী মুসলিম বাহিনী রাত্রিবেলা পথ চলতেন এবং দিবাভাগে আত্মগোপন করে থাকতেন। শত্রুরা যখন বশীরের অগ্রাভিযানের সংবাদ অবগত হল তখন তারা পলায়ন করল। বশীরের বাহিনী শত্রুপক্ষের দু’ ব্যক্তিকে বন্দী করতে এবং অনেকগুলো গবাদি পশু আয়ত্বে নিতে সক্ষম হন। বন্দী দু’জনকে খিদমতে নাবাবীতে হাজির করা হলে তারা ইসলাম গ্রহণ করে।
গা-বা অভিযান : ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম এ অভিযান উমরায়ে ক্বাযার পূর্বে ৭ম হিজরীর অভিযান সমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ অভিযানের মূল কথা হচ্ছে, জাশম বিন মু’আবিয়া গোত্রের এক ব্যক্তি অনেক লোকজন নিয়ে গাবা নামক স্থানে আসে। তার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বনু ক্বায়স গোত্রের লোকজনদের একত্রিত করা। এ সংবাদ অবগত হয়ে নাবী কারীম (ﷺ) আবূ হাদরাদ (রাঃ)-কে মাত্র দু’জন সঙ্গীসহ তাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। হাদরাদ (রাঃ) এমন এক যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করেন যার ফলে শত্রুদল শোচনীয় ভাবে পরাজয় বরণ করে। মুসলিম বাহিনী অনেক উট, ভেড়া ও ছাগল খেদিয়ে নিয়ে আসেন।[1]