সালাম বিন আবিল হুক্বাইক্বের উপ নাম ছিল আবূ রাফি’। ইসলাম বিদ্বেষী ও ইসলামের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন ইহুদী প্রধানদের সে ছিল অন্যতম ব্যক্তি। মুসলিমগণের বিরুদ্ধে মুশরিকদের প্ররোচিত ও প্রলোভিত করার ব্যাপারে সে সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করত এবং ধন সম্পদ ও রসদ সরবরাহ করে তাদের সাহায্য করত।[1] এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে কষ্ট দেয়ার ব্যাপারে সর্বক্ষণ সে উদ্বাহু থাকত। এ কারণে মুসলিমগণ যখন বনু কুরাইযাহর সমস্যাবলী থেকে মুক্ত হয়ে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন তখন খাযরাজ গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করার জন্য নাবী কারীম (ﷺ)-এর অনুমতি প্রার্থী হলেন। যেহেতু ইতোপূর্বে আউস গোত্রের কয়েকজন সাহাবা কা‘ব বিন আশরাফকে হত্যা করেছিলেন সেহেতু খাযরাজ গোত্রও অনুরূপ একটি দুঃসাহসিক কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। তাই তাঁরা অনুমতি গ্রহণের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করতে চাইলেন।
রাসূলে কারীম (ﷺ) তাঁদের অনুমতি প্রদান করলেন। কিন্তু বিশেষভাবে নির্দেশ প্রদান করলেন যে, মহিলা এবং শিশুদের যেন হত্যা করা না হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুমতি লাভের পর পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি দল অভীষ্ট গন্তব্য অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যান। এরা সকলেই ছিলেন খাযরায গোত্রের শাখা বনু সালামাহ গোত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। এদের দলনেতা ছিলেন আব্দুল্লাহ বিন আতীক।
এ দলটি সোজা খায়বার অভিমুখে গেলেন। কারণ আবূ রাফি’র দূর্গটি তথায় অবস্থিত ছিল। যখন তাঁরা দূর্গের নিকটে গিয়ে পৌঁছলেন সূর্য তখন অস্তমিত হয়েছিল। লোকজনরা তখন গবাদি পশুর পাল নিয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেছিল। আব্দুল্লাহ বিন আতীক তাঁর সঙ্গীদের বললেন, ‘তোমরা এখানে অপেক্ষা করতে থাকে। আমি দরজার প্রহরীর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে গিয়ে এমন সূক্ষ্ণ কৌশল অবলম্বন করব ফলে হয়তো দূর্গাভ্যন্তরে প্রবেশ লাভ সম্ভব হতে পারে। এরপর তিনি দরজার নিকট গেলেন এবং মাথায় ঘোমটা টেনে এমনভাবে অবস্থান গ্রহণ করলেন যাতে দেখলে মনে হয় যে, কেউ যেন প্রস্রাব কিংবা পায়খানার জন্য বসেছে। প্রহরী সে সময় চিৎকার করে ডাক দিয়ে বলল, ‘ওহে আল্লাহর বান্দা! যদি ভেতরে আসার প্রয়োজন থাকে তবে এক্ষুনি চলে এসো, নচেৎ আমি দরজা বন্ধ করে দিব।’
আব্দুল্লাহ বিন আতীক বলছেন, ‘আমি সে সুযোগে দূর্গাভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম এবং নিজেকে গোপন করে রাখলাম। যখন লোকজন সব ভেতরে এসে গেল প্রহরী তখন দরজা বন্ধ করে দিয়ে চাবির গোছাটি একটি খুঁটির উপর ঝুলিয়ে রাখল। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর যখন লক্ষ্য করলাম যে, সমগ্র পরিবেশটি নিশ্চুপ ও নিস্তব্ধ হয়ে গেছে তখন আমি চাবির গোছাটি হাতে নিয়ে দরজা খুলে দিলাম।
আবূ রাফি’ উপর তলায় অবস্থান করছিল। সেখানেই তার পরামর্শ বৈঠক অনুষ্ঠিত হত। বৈঠক শেষে বৈঠককারীগণ যখন নিজ নিজ স্থানে চলে গেল তখন আমি উপর তলায় উঠে গেলাম। আমি যে দরজা খুলতাম ভেতর থেকে তা বন্ধ করে দিতাম। আমি এটা স্থির করে নিলাম যে যদি লোকজনেরা আমার অনুপ্রবেশ সম্পর্কে অবহিত হয়েও যায়, তবুও আমার নিকট তাদের পৌঁছবার পূর্বেই যেন আবূ রাফিকে হত্যা করতে পারি। এভাবে আমি তার কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। কিন্তু সে পরিবার পরিজন এবং সন্তানাদি পরিবেষ্টিত অবস্থায় এক অন্ধকার কক্ষে অবস্থান করছিল। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছিলাম না যে, সে কক্ষের ঠিক কোন্ স্থানে অবস্থান করছে। এ কারণে আমি তার নাম ধরে ডাক দিলাম, ‘আবূ রাফি’।’
সে উত্তরে বলল, ‘কে ডাকে?’
তৎক্ষণাৎ আমি তার কণ্ঠস্বরকে অনুসরণ করে দ্রুত অগ্রসর হলাম এবং তরবারী দ্বারা জোরে আঘাত করলাম। কিন্তু আমার দৈহিক ও মানসিক অবস্থাজনিত বিশৃঙ্খলার কারণে এ আঘাতে কোন ফল হল না বলে মনে হল। এদিকে সে জোরে চিৎকার করে উঠল। কাজেই, আমি দ্রুতবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম এবং অল্প দূরে এসে থেমে গেলাম। অতঃপর কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করে আবার ডাক দিলাম, ‘আবূ রাফি, এ কণ্ঠস্বর কেমন?’
সে বলল, ‘তোমার মা ধ্বংস হোক! অল্পক্ষণ পূর্বে এ ঘরেই কে আমাকে তরবারী দ্বারা আঘাত করেছে।’
আব্দুল্লাহ বিন আতীক বললেন, ‘আমি আবার প্রচন্ড শক্তিতে তরবারী দ্বারা তাকে আঘাত করলাম। তার ক্ষতস্থান থেকে রক্তের ফোয়ারা ছুটতে থাকল। কিন্তু এতেও তাকে হত্যা করা সম্ভব হল না। তখন আমি তরবারীর অগ্রভাগ সজোরে তার পেটের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিলাম। তরবারীর অগ্রভাগ তার পৃষ্ঠদেশ পর্যন্ত পৌঁছে গেল। এখন আমি স্থির নিশ্চিত হলাম যে, সে নিহত হয়েছে। তাই আমি একের পর এক দরজা খুলতে খুলতে নীচে নামতে থাকলাম। অতঃপর সিঁড়ির মুখে শেষ ধাপে গিয়ে বুঝতে পারলাম যে, আমি মাটিতে পৌঁছে গিয়েছি। কিন্তু কিছুটা অসাবধানতার সঙ্গে মাটিতে পা রাখতে গিয়ে আমি নীচে পড়ে গেলাম।
চাঁদের আলোয় আলোকিত ছিল চার দিক। নীচে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পায়ের গোড়ালি গেল স্থানচ্যুত হয়ে। মাথার পাগড়ী খুলে শক্ত করে বেঁধে ফেললাম পায়ের গোড়ালি। অতঃপর দরজা হতে দূরে গিয়ে বসে পড়লাম এবং মনে মনে স্থির করলাম যে, যতক্ষণ না ঘোষণাকারীর মুখ থেকে তার মৃত্যুর ঘোষণা শুনতে পাচ্ছি ততক্ষণ আমি এ স্থান পরিত্যাগ করব না।
মোরগের ডাক শুনে বুঝতে পারলাম, রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এমন সময় দূর্গ শীর্ষ থেকে ঘোষণাকারী ঘোষণা করল যে, ‘আমি হিজাযের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবূ রাফি’র মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করছি। এ কথা শ্রবণের পর অত্যন্ত দ্রুত গতিতে আমি সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম এবং সঙ্গীদের নিকট গিয়ে বললাম, ‘আল্লাহ তা‘আলা আবূ রাফি'কে তার মন্দ কথাবার্তা ও মন্দ কাজের চূড়ান্ত বিনিময় প্রদান করেছেন। আবূ রাফি’ নিহত হয়েছে। চলো আমরা এখন এখান থেকে পলায়ন করি।’
মদীনা প্রত্যাবর্তনের পর নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে হাজির হলাম এবং ঘটনাটি আনুপূর্বিক বর্ণনা করলাম। ঘটনাটি অবগত হওয়ার পর তিনি বললেন, ‘তোমার পা প্রসারিত কর।’ আমার পা প্রসারিত করলে তিনি স্থানচ্যুত গোড়ালিটির উপর তাঁর হাত মুবারক বুলিয়ে দিলেন। তাঁর হাত পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গেই এটা অনুভূত হল যে, ব্যথাবেদনা বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। শুধু তাই নয়, ঐ স্থানে যে কোন সময় ব্যথা বেদনা ছিল সে অনুভূতিও যেন তখন ছিল না।[2]
এ হচ্ছে সহীহুল বুখারী শরীফের বর্ণনা। ইবনু ইসহাক্বের বর্ণনায় রয়েছে যে, আবূ রাফি’র ঘরে পাঁচ জন সাহাবীই (রাযি.) প্রবেশ করেছিলেন এবং তার হত্যার ব্যাপারে সকলেই সক্রিয় ছিলেন। তবে যে সাহাবী তরবারীর আঘাতে তাকে হত্যা করেছিলেন তিনি হচ্ছেন আব্দুল্লাহ বিন উনাইস।
এ বর্ণনায় এ কথাও বলা হয়েছে যে, তাঁরা যখন রাত্রিতে আবূ রাফি’কে হত্যা করেন এবং আব্দুল্লাহ বিন আতীকের পায়ের গোড়ালি স্থানচ্যুত হয়ে যায় তখন তাঁকে উঠিয়ে এনে দূর্গের দেয়ালের আড়ালে যেখানে ঝর্ণার নহর ছিল সেখানে আত্মগোপন করে থাকেন।
এদিকে ইহুদীগণ অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে চতুর্দিকে দৌড়াদৌড়ি করে অনুসন্ধান চালাতে থাকল। অনেক অনুসন্ধানের পরও যখন তারা কোন খোঁজ না পেল তখন নিরাশ হয়ে নিহত ব্যক্তির নিকট প্রত্যাবর্তন করল। এ সুযোগে সাহাবীগণ আব্দুল্লাহ বিন আতীককে কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে হাজির হলেন।[3] প্রেরিত এ ক্ষুদ্র বাহিনীটির সফল অভিযান অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৫ম হিজরীর যুল ক্বা’দাহ অথবা যুল হিজ্জাহ মাসে।[4]
রাসূলে কারীম (ﷺ) যখন আহযাব এবং বনু কুরাইযা যুদ্ধ হতে নিস্কৃতি লাভ করলেন এবং যুদ্ধাপরাধীর বিচার কাজ সমাধা করলেন তখন শান্তি শৃঙ্খলার পথে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী গোত্রসমূহ এবং বেদুঈনদের বিরুদ্ধে সংশোধনী আক্রমণ পরিচালনা শুরু করলেন। এ পর্যায়ে তিনি যে সকল অভিযান পরিচালনা এবং যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন নিম্নে তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা লিপিবদ্ধ করা হল।
[2] সহীহুল বুখারী ২/৫৭৭ পৃঃ।
[3] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড, ২৭৪-২৭৫ পৃঃ।
[4] রহমাতুল্লিল আলামীন, ২য় খন্ড ২২৩ পৃ: এবং আহযাব যুদ্ধের বর্ণনায় উল্লেখিত অন্যান্য উৎস।
আহযাব ও বনু কুরাইযাহ সংকট থেকে মুক্ত হওয়ার পর এটাই ছিল প্রথম অভিযান। ত্রিশ জন মর্দে মু’মিনের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল এ অভিযাত্রী দলটি। এ অভিযান পরিচালনার্থে অভিযাত্রী দলটি প্রেরিত হয়েছিলেন নাজদের অভ্যন্তর ভাগে বাকারাত অঞ্চলে যারিয়ার পার্শ্ববর্তী ‘ক্বারত্বা’ নামক স্থানে। যারিয়্যাহ এবং মদীনার অবস্থান ছিল সাত রাত্রি দূরত্বের ব্যবধানে। অভিযাত্রীগণের এ অভিযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ৬ষ্ঠ হিজরীর ১০ই মুহাররম। তাদের লক্ষ্যস্থলে ছিল বনু বাকর বিন কিলাব গোত্রের একটি শাখা।
মুসলিমগণ অতর্কিত শত্রুদের আক্রমণ করলে তারা হতকচিত ও বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে এবং পলায়ন করে। তাদের পরিত্যক্ত ধন সম্পদ এবং গবাদি পশুসমূহ মুসলিমগণের হস্তগত হয়। সে সকল ধন সম্পদ এবং গবাদির পাল নিয়ে তাঁরা মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেন। তাঁরা যখন মদীনায় প্রত্যাগমন করেন তখন মুহাররম মাসের মাত্র একদিন অবশিষ্ট ছিল। প্রত্যাবর্তনের সময় তাঁরা বনু হানীফার সরদার সুমামাহ বিন আসাল হানাফীহকেও বন্দী করে নিয়ে আসেন। সে মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের নির্দেশে নাবী কারীম (ﷺ)-কে হত্যা করার জন্য ছদ্মবেশে বাহির হয়েছিল।[1] কিন্তু অভিযানকারী সাহাবীগণ তাকে বন্দী করে নিয়ে আসেন এবং মসজিদে নাবাবীর খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখেন।
এমতাবস্থায় নাবী কারীম (ﷺ) যখন সেখানে আগমন করলেন তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে সুমামাহ! তোমার নিকট কি আছে?’
প্রত্যুত্তরে সে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ (ﷺ)! আমার নিকট (কল্যাণ) ধন-সম্পদ রয়েছে। যদি তুমি আমাকে হত্যা কর তবে প্রকৃতই একজন খুনী আসামীকে হত্যা করবে। আর যদি অনুগ্রহ কর তবে প্রকৃতই একজন গুণগ্রাহী ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ করবে। পক্ষান্তরে যদি ধন-সম্পদ চাও তাহলে যা চাবে তাই পাবে।’ তার মুখ থেকে এ সব কথা শ্রবণের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে ঐ একই অবস্থার মধ্যে রেখে চলে গেলেন।
অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ) যখন দ্বিতীয় বার সেখানে এসে উপস্থিত হলেন তখন উপরোক্ত প্রশ্নগুলোই তাকে জিজ্ঞেস করলেন। সে উত্তরও দিল ঠিক পূর্বের মতোই। এবারও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে একই অবস্থার মধ্যে রেখে চলে গেলেন। এরপর যখন তিনি তৃতীয় বার আগমন করলেন তখনো ঐ একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। সুমামাহ এবারও একই উত্তর প্রদান করলেন। তৃতীয় বার তার মুখ থেকে উত্তর শোনার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবায়ে কেরামকে নির্দেশ প্রদান করলেন তাকে মুক্ত করে দেয়ার জন্য।
তাঁরা তাকে মুক্ত করে দিলে সে মসজিদে নাবাবীর নিকট একটি খেজুর বাগানে গেল। সেখানে গোসল করে পাক সাফ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট ফিরে এসে ইসলাম গ্রহণ করল। অতঃপর বলল, ‘আল্লাহর শপথ! পৃথিবীর বুকে কোন মুখমণ্ডল আপনার মুখমণ্ডলের চাইতে অধিক ঘৃণিত ছিল না, কিন্তু এ মুহূর্তে আমার নিকট আপনার মুখমণ্ডলের চাইতে অধিক প্রিয় মুখমণ্ডল আর পৃথিবীতে নেই। সে আরও বলল, ‘আল্লাহর শপথ! ইতোপূর্বে পৃথিবীর বুকে আপনার প্রচারিত দ্বীন ছিল আমার নিকট সব চাইতে ঘৃণিত, কিন্তু এ মুহূর্তে আপনার দ্বীন আমার নিকট সব চাইতে প্রিয় এবং পবিত্র বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ অভিযানে প্রেরিত অভিযাত্রীগণ আমাকে এমন সময় গ্রেফতার করেছিল যখন আমি উমরাহ পালনের জন্য মনস্থির করছিলাম।
রাসূলে কারীম (ﷺ) তাকে উমরাহ পালনের নির্দেশ এবং শুভ সংবাদ প্রদান করলেন। উমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে যখন সে কুরাইশদের অঞ্চলে পৌঁছিল তখন তারা তাকে বলল, ‘হে সুমামা তুমিও বেদ্বীন হয়ে গিয়েছ?’
সুমামাহ বলল, ‘না, বরং আমি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর হাতে বাই‘আত হয়ে মুসলিম হয়েছি।’ তিনি আরও বললেন, ‘জেনে রাখ, আল্লাহর কসম! ইয়ামামা হতে তোমাদের নিকট গমের একটি দানাও আসবে না, যে পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ ব্যাপারে অনুমতি প্রদান না করবেন।’ ইয়ামামা মক্কাবাসীগণের শস্য ভূমির মর্যাদা রাখত।
সুমামাহ দেশে ফিরে গিয়ে মক্কা অভিমুখী খাদ্যদ্রব্যের চালান বন্ধ করে দিলেন। এর ফলে মক্কাবাসীগণ খাদ্য সংকটজনিত অসুবিধার মধ্যে নিপতিত হলেন। এ প্রেক্ষিতে আত্মীয়তার সূত্র উল্লেখ করে তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এ মর্মে পত্র লিখল যাতে তিনি সুমামাহকে খাদ্যদ্রব্য চালান বন্ধ করা থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। রাসূলে কারীম (ﷺ) সুমামাহকে খাদ্যদ্রব্যের চালান বন্ধ করা থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করলেন।[2]
[2] যা’দুল মাআদ, ২য় খন্ড ১১৯ পৃঃ, শাইখ আব্দুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ ২৯২-২৯৩ পৃঃ।
বুন লাহইয়ান গোত্রের লোকজনেরা প্রতারণার মাধ্যমে রাজী নামক স্থানে ১০ জন সাহাবা (রাঃ)-কে আটক করার পর আটজনকে হত্যা করেছিল এবং অবশিষ্ট দু’ জনকে মক্কার মুশরিকগণের নিকট বিক্রয় করে দিয়েছিল যেখানে তাঁদেরকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। অঞ্চলটি হিজাযের অভ্যন্তরে মক্কা সীমানার নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল এবং যেহেতু মুসলিমগণের সঙ্গে কুরাইশ ও বেদুঈনদের সম্পর্কের একটা কঠিন টানাপোড়নের অবস্থা বিরাজমান ছিল সেহেতু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হিজাযের গভীর অভ্যন্তর ভাগে প্রবেশ করে বড় শত্রুদের নিকট যাওয়াকে সমীচীন মনে করেন নি।
কিন্তু কাফের মুশরিকগণ যখন বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ল এবং দলে ভাঙ্গন ধরার ফলে তাদের ঐক্য বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে পড়ল, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এটা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন যে, রাজী নামক স্থানে লাহইয়ান গোত্রের লোকজনেরা সাহাবীগণকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল তার প্রতিশোধ গ্রহণের উপযুক্ত সময় সমাগত। কাজেই ৬ষ্ঠ হিজরীর রবিউল আওয়াল, মতান্তরে জুমাদালউলা মাসে দু’ শত সাহাবী সমভিব্যাহারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাযী অভিমুখে যাত্রা করেন। যাত্রার প্রাক্কালে মদীনার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অর্পণ করেন ইবনু উম্মু মাকতুমের উপর এবং ঘোষণা করেন যে, তিনি শাম রাজ্য অভিমুখে যাত্রা করেছেন।
অগ্রাভিযানের এক পর্যায়ে অভিযাত্রী দলসহ তিনি উমাজ এবং উসফান স্থান দ্বয়ের মধ্যস্থলে অবস্থিত বাতনে গাররান নামক উপত্যকায় উপস্থিত হলেন। এখানেই বনু লাহইয়ান গোত্রের লোকেরা সাহাবীগণকে হত্যা করেছিল। সেখানে উপস্থিত হয়ে তিনি শহীদ সাহাবাগণের (রাঃ) জন্য আল্লাহ তা‘আলার সমীপে রহমতের প্রার্থনা করলেন। এদিকে বনু লাহইয়ান গোত্রের লোকেরা মুসলিম বাহিনীর অগ্রাভিযানের সংবাদ অবগত হয়ে পর্বতশীর্ষ অতিক্রম করে পলায়ন করল, ফলে তাদের কাউকেও গ্রেফতার করা সম্ভব হল না।
রাসূলে কারীম (ﷺ) তাঁর বাহিনীসহ বনু লাহইয়ান গোত্রের আবাসস্থানে দুই দিন অবস্থান করলেন, কিন্তু এ গোত্রের কোন লোকজনেরই খোঁজ খবর তিনি পান নি। দ্বিতীয় দিনের পর তিনি সেখান হতে উসফানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। সে স্থানে পৌঁছার পর তিনি দশ জন ঘোড়সওয়ারকে কোরাউলগমীমের দিকে প্রেরণ করেন। যাতে কুরাইশগণও নাবী কারীম (ﷺ)-এর অভিযান সম্পর্কে অবগত হন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় নি। এভাবে মোট চৌদ্দ রাত মদীনার বাহিরে অতিবাহিত করার পর তিনি মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।
বনু লাহইয়ান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর রাসূল (ﷺ) ক্রমান্বয়ে একের পর এক অভিযানের পর অভিযান পরিচালনা করতে থাকেন। পরিচালিত সে সকল অভিযানের সংক্ষিপ্ত আলোচনা নিম্নে প্রদত্ত হল:
গামরের অভিযান (سَرِيَّةُ عُكَّاشَةَ بْنِ مِحْصَنٍ إِلٰى الْغَمْرِ) : ৬ষ্ঠ হিজরীর রবিউল আওয়াল, মতান্তরে রবিউল আখের মাসে ‘উক্বাশাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে চল্লিশ জন সাহাবী (রাঃ)-এর সমন্বয়ে এক বাহিনী গামর অভিমুখে প্রেরণ করেন। এ হচ্ছে বনু আসাদ গোত্রের একটি ঝর্ণার নাম। মুসলিম বাহিনীর অগ্রাভিযানের সংবাদ অবগত হয়ে বনু আসাদ গোত্রের লোকজনেরা তাদের গবাদি পাল পেছনে রেখে প্রাণভয়ে পলায়ন করে। মুসলিম বাহিনী তাদের পরিত্যক্ত দু’ শত উট নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন।
যুল ক্বাসসাহর প্রথম অভিযান (سَرِيَّةُ مُحَمَّدِ بْنِ مَسْلَمَةَ إِلٰى ذِي الْقِصَّةِ) : উল্লেখিত ৬ষ্ঠ হিজরীর রবিউল আওয়াল কিংবা রবিউল আখের মাসে মুহাম্মাদ বিন মাসলামা (রাঃ)-এর নেতৃত্বে দশ সদস্য বিশিষ্ট এক সৈন্যদল জুলকেসসা অভিমুখে প্রেরণ করা হয়। ইহা বনু সা’লাবা নামক অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। শত্রুদলের সৈন্য সংখ্যা ছিল এক শত। শত্রুদল একটি গুপ্তস্থানে আত্মগোপন করে।
কিছুটা অসতর্ক অবস্থায় মুসলিম বাহিনী যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন এমন সময় শত্রু বাহিনী অতর্কিত আক্রমণ পরিচালন করে তাঁদের সকলকে হত্যা করে। শুধুমাত্র মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ (রাঃ) মারাত্মকভাবে আহত হয়ে কোন ভাবে প্রাণে বেঁচে যান।
যুল ক্বাসসাহর দ্বিতীয় অভিযান (سَرِيَّةُ أَبِيْ عُبِيْدَةَ بْنِ الْجَرَّاحِ إِلٰى ذِي الْقِصَّةِ) : বনু সা’লাবাহ অভিযানে শাহাদত প্রাপ্ত সাহাবীগণের এ শোকাবহ ঘটনার প্রতিশোধ গ্রহণ এবং বনু সা’লাবাহকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে রবিউল আখের মাসেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবূ উবায়দাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে যুল ক্বাসসাহ অভিমুখে চল্লিশ সদস্যের এক বাহিনী প্রেরণ করেন। রাতের অন্ধকারে পায়ে হেঁটে এ বাহিনী বনু সা’লাবাহ গোত্রের সন্নিকটে উপস্থিত হয়ে অতর্কিত আক্রমণ শুরু করেন। কিন্তু বনু সা’লাবাহর লোকজনেরা দ্রুত গতিতে পর্বতশীর্ষ অতিক্রম করে পলায়ন করে। মুসলিম বাহিনীর পক্ষে তাদের নাগাল পাওয়া সম্ভব হয় নি। তাঁরা শুধু এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়, যিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলিমগণের দলভুক্ত হয়ে যান। কাজেই, বনু সা’লাবাগ গোত্রের পরিত্যক্ত গবাদি পশুর পাল নিয়ে মুসলিম বাহিনী মদীনা প্রত্যাবর্তন করেন।
জামুম অভিযান (سَرِيَّةُ زَيْدِ بْنِ حَارِثَةَ إِلٰى الْجُمُوْمِ) : ৬ষ্ঠ হিজরীর রবিউল আখের মাসে যায়দ বিন হারিসাহর নেতৃত্বে জামূম অভিমুখে এ বাহিনী প্রেরণ করা হয়। জামূম হচ্ছে মাররুয যাহরানে (বর্তমান ফাত্বিমাহ উপত্যকা) বনু সুলাইম গোত্রের একটি ঝর্ণার নাম। যায়দ (রাঃ) তাঁর বাহিনীসহ সেখানে পৌঁছার পর পরই মুযাইনা গোত্রের হালীমাহ নাম্নী এক মহিলা তাঁদের হাতে বন্দিনী হয়। এ মহিলার নিকট হতে বনু সুলাইম গোত্রের নির্দিষ্ট এবং বিভিন্ন তথ্য তাঁরা অবগত হন। বনু সুলাইমের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাঁরা বহু লোককে বন্দী করেন এবং অনেক গবাদি পশু তাঁদের হস্তগত হয়। যায়দ এবং তাঁর বাহিনী এ সকল বন্দী ও গবাদি পশুসহ মদীনা প্রত্যাবর্তন করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ মুযাইনী গোত্রীয় বন্দিনী মহিলাকে মুক্ত করার পর তাঁর বিবাহের ব্যবস্থা করেন।
‘ঈস অভিযান (سَرِيَّةُ زَيْدِ إِلٰى الْعِيْصِ) : ৬ষ্ঠ হিজরীর জুমাদাল উলা মাসে যায়দ বিন হারিসাহর নেতৃত্বে ‘ঈস অভিমুখে এক বাহিনী প্রেরণ করা হয়। এ বাহিনীতে ছিলেন এক শত সত্তর জন ঘোড়সওয়ার মর্দে মুজাহিদ। এ অভিযানকালে এক কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলার কিছু সম্পদ মুজাহিদ বাহিনীর হস্তগত হয়। এ কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলাটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জামাতা আবুল আসের নেতৃত্বাধীনে ভ্রমণরত ছিল। আবুল আস তখনো ইসলাম গ্রহণ করেন নি।
কাফেলার সম্পদসমূহ মুসলিম বাহিনীর হস্তগত হওয়ায় গ্রেফতার এড়ানো এবং মালপত্র ফেরত পাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে মদীনা অভিমুখে পলায়ন করেন এবং নাবী তনয়া যয়নাবের আশ্রয় গ্রহণ করে কাফেলার সকল সম্পদ যাতে ফেরত দেয়া হয় সে ব্যাপারে তার পিতাকে অনুরোধ করার জন্য তাঁকে বলেন। যায়নাব পিতার নিকট বিষয়টি উপস্থাপন করলে কোন প্রকার শর্ত ব্যতিরেকেই সকল সম্পদ ফেরত দানের জন্য সাহাবীগণকে নাবী কারীম (ﷺ) নির্দেশ প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ মোতাবেক সাহাবায়ে কেরাম কাফেলার সকল সম্পদ ফেরত প্রদান করেন। সমস্ত ধন সম্পদসহ আবুল আস মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং মালিকগণের নিকট সমস্ত মালামাল প্রত্যাবর্তন করার পর ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় হিজরত করেন। পূর্বের বিবাহের ভিত্তিতেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মেয়ে যায়নাবকে তার হাতে সমর্পণ করেন। সহীহুল হাদীসের মাধ্যমে এ তথ্য প্রমাণিত হয়েছে।[1]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পূর্বের বিবাহের ভিত্তিতে এ জন্য তাঁর মেয়ে যায়নাবকে সমর্পণ করেছিলেন যে ঐ সময় পর্যন্ত মুসলিম মহিলাদের উপর কাফের স্বামীর সঙ্গে বসবাস করা হারাম হওয়ার নির্দেশ সম্বলিত আয়াত অবতীর্ণ হয়নি। অন্য এক হাদীসে এ কথাও বর্ণিত হয়েছে যে, নতুন বিবাহের মাধ্যমে নাবী তনয়া যায়নাবকে তাঁর স্বামীর নিকট সমর্পণ করা হয়েছিল। এটা অর্থ ও বর্ণনাপঞ্জী কোন হিসেবে সহীহুল নয়।[2] অধিকন্তু এ কথাও উল্লেখিত হয়েছে যে, ছয় বছর পর তাঁকে সমর্পণ করা হয়েছিল। কিন্তু সনদ কিংবা অর্থগত কোন দিক দিয়েই এ হাদীস বিশুদ্ধ বলে প্রতীয়মান হয় না। বরং উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই এ হাদীস দুর্বল। যাঁরা এ হাদীসের কথা উল্লেখ করেন তাঁরা অদ্ভূত রকমের দুই বিপরীতমুখী কথা বলে থাকেন। তাঁরা বলেন যে, ৮ম হিজরীর শেষভাগে মক্কা বিজয়ের কিছু পূর্বে আবুল আস মুসলিম হয়েছিলেন। অথচ কেউ কেউ এ কথাও বলে থাকেন যে, ৮ম হিজরীর প্রথম ভাগে যায়নাব মৃত্যুবরণ করেন। অথচ যদি এ কথা দু’টি মেনে নেয়া যায় তাহলে বিপরীতমুখী আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমতাবস্থায় আবুল আসের ইসলাম গ্রহণ এবং হিজরত করে তার মদীনা গমণের সময় যায়নাব জীবিত থাকলেন কোথায় যে নতুন ভাবে বিবাহের ব্যবস্থা হবে কিংবা পুরাতন বিবাহের ভিত্তিতেই তাঁকে সমর্পণ করা হবে। এ বিষয়ের উপর আমি বুলুগুম মারাম গ্রন্থের টীকাতে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছি।[3]
বিখ্যাত মাগাযী বিশারদ মুসা বিন উক্ববাহর ঝোঁক এ দিকেই আছে যে, এ ঘটনা সপ্তম হিজরীতে আবূ বাসীর এবং তার বন্ধুদের হাতে ঘটেছিল। কিন্তু এর অনুকূলে কোন বিশুদ্ধ অথবা যঈফ সমর্থন পাওয়া যায় না।
ত্বারিফ অথবা ত্বারিক্ব অভিযান (سَرِيَّةُ زَيْدٍ أَيْضاً إِلٰى الطَّرْفِ أَوْ الطَّرْقِ) : এ অভিযানটিও সংঘটিত হয়েছিল জুমাদাল আখের মাসে। যায়দ বিন হারিসাহর নেতৃত্বে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট এ বাহিনীটি প্রেরণ করা হয় তরফ অভিমুখে। এ স্থানটি ছিল বনু সা’লাবা গোত্রের অঞ্চলে অবস্থিত। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর অগ্র যাত্রার সংবাদ অবগত হওয়া মাত্রই বেদুঈনরা সেস্থান থেকে পলায়ন করল। পলায়নরত বেদুঈনদের চারটি উট মুসলিম বাহিনীর হস্তগত হয়েছিল। সেখানে চারদিন অবস্থানের পর তাঁরা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। বেদুঈনদের ভয় ছিল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজেই আগমন করেছেন।
ওয়াদিল কুরা অভিযান (سَرِيَّةُ زَيْدٍ أَيْضاً إِلٰى وَادِيْ الْقُرٰي) : যায়দ বিন হারিসাহর নেতৃত্বে এ অভিযানটিও পরিচালিত হয়। ১২ জন সাহাবীর সমন্বয়ে সংগঠিত হয়েছিল এ অভিযাত্রী দল। ৬ষ্ঠ হিজরীর রজব মাসে অনুষ্ঠিত হয় ওয়াদিল কুরা অভিযান। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল শত্রুদের গতিবিধি সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়া। কিন্তু ওয়াদিল কুরার অধিবাসীগণ আকস্মিকভাবে মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণ করে ৯ জন সাহাবীকে হত্যা করে। শুধুমাত্র ৩ জন সাহাবী এ হত্যাকান্ড থেকে রক্ষা পান। এ তিন জনের অন্যতম ছিলেন যায়দ বিন হারিসাহ।[4]
খাবাত্ব অভিযান (سَرِيَّةُ الخَبَطِ) : এ অভিযানের সময় সম্পর্কে বলা হয়েছে ৮ম হিজরীর রজব মাস। কিন্তু হিসাব করে দেখা যায় যে এ অভিযান ছিল হুদায়বিয়াহহর পূর্বের ঘটনা। জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, নাবী কারীম (ﷺ) এ অভিযানে তিনশত ঘোড়সওয়ারের এক বাহিনী প্রেরণ করেন। এ অভিযানের নেতৃত্ব অর্পণ করা হয় আবূ ওবায়দা বিন জাররাহর (রাঃ) উপর। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল এক কুরাইশ কাফেলার গতিবিধি লক্ষ্য করা ও খোঁজ খবর সংগ্রহ করা। কথিত আছে যে, এ বাহিনী পরিচালনা কালে অভিযাত্রীগণ চরম অনাহারে ও ক্ষুধার মধ্যে নিপতিত হন। খাদ্য সামগ্রীর সংস্থান করতে সক্ষম না হওয়ার কারণে এক পর্যায়ে এ বাহিনীর সদস্যগণকে ক্ষুধা নিবৃত্তির উদ্দেশ্যে গাছের পাতা ভক্ষণ করতে হয়। এ প্রেক্ষিতেই এ অভিযানের নামকরণ হয়েছিল। ‘খাবত অভিযান (ঝরানো পাতাসমূহকে খাবাত্ব বলা হয়)। অবশেষে এক ব্যক্তি তিনটি উট যবেহ করেন, অতঃপর তিনটি উট যবেহ করেন, পরবর্তী পর্যায়ে পুনরায় তিনটি উট যবেহ করেন। কিন্তু আরও উট যবেহ করার ব্যাপারে আবূ ওবায়দা তাঁকে বাধা প্রদান করেন।
এর পরেই সমুদ্রবক্ষ হতে ‘আম্বার’ নামক এক জাতীয় একটি বিশালকায় উত্থিত মাছও নিক্ষিপ্ত হয়। অভিযাত্রীদল অর্ধমাস যাবৎ এ মস্য ভক্ষণ এবং এর দেহ নিঃসৃত তেল ব্যবহার করতে থাকেন। এ মৎস ভক্ষণের ফলে তাদের ঝিমিয়ে পড়া মাংস পেশী ও স্নায়ুতন্ত্রগুলো পুনরায় সুস্থ ও সতেজ হয়ে ওঠে। আবূ ওবায়দা এ মাছের একটি কাঁটা নেন এবং সৈন্যদলের মধ্যে সব চাইতে লম্বা ব্যক্তিটিকে সব চাইতে উঁচু উটটির পৃষ্ঠে আরোহণ করে সেই কাঁটার ঘোরের মধ্য দিয়ে যেতে বলেন এবং অনায়াসেই তিনি তা করেন। মৎসটির বিশালকায়ত্ব প্রমাণের জন্যেই তিনি এ ব্যবস্থা করেন।
সেই মৎসা দেহের প্রয়োজনরিক্ত অংশ বিশেষ সংরক্ষণ করে তা মদীনা প্রত্যাগমনের সময় সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে সেই মৎস্য বৃত্তান্ত পেশ করা হলে তিনি বলেন,
(هُوَ رِزْقٌ أَخْرَجَهُ اللهُ لَكُمْ، فَهَلْ مَعَكُمْ مِنْ لَحْمَةِ شَيْءٌ تُطْعِمُوْنَا؟)
‘এ হচ্ছে তোমাদের জন্য আল্লাহর প্রদত্ত এক প্রকারের রুজী বা আহার্য। এর গোস্ত তোমাদের নিকট যদি আরও কিছু থাকে তাহলে আমাদেরকেও খেতে দাও। কিছুটা গোস্ত আমরা তাঁর খিদমতে পাঠাবার ব্যবস্থা করি।[5]
খাবাত্ব অভিযানের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করলে এটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল হুদায়বিয়াহর সন্ধির পূর্বে। এর কারণ হচ্ছে, হুদায়বিয়াহর সন্ধিচুক্তির পর মুসলিমগণ কোন কুরাইশ কাফেলার চলার পথে কোন প্রকার অন্তরায় সৃষ্টি করেন নি।
[2] এ দুটি আলোচনা সম্পর্কে তোহফাতুল আহওয়াযী ২/১৯৫, ১৯৬ পৃঃ।
[3] ইতহাফুল কিরাম ফী তা’লীকি বুলুগিল হারাম।
[4] রহামাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ২২৬ পৃঃ। যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১২০-১২২ পৃ: এবং তালকিহু ফুহুমি আহলিল আসরের টীকা ২৮ ও ২৯ পৃঃ। এ অভিযান সমূহের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যাবে।
[5] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৬২৫-৬২৬ পৃঃ, সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ড ১৪৫-১৪৬ পৃঃ।