নাবী কারীম (ﷺ)-এর তাবলীগ ও দাওয়াতের কৃতকার্যতা এবং অন্যায় ও উৎপীড়নের মধ্য পর্যায়ে অতিক্রম করে চলছে। সুদূর আকাশের প্রান্তে আশার ক্ষীণ আলো এবং ধূলিযুক্ত ঝলক দৃষ্টি গোচর হতে আরম্ভ করেছে। ঠিক এমন সময়ে নৈশ ভ্রমণ ও উর্ধ্বগমনের ঘটনাটি সংঘটিত হয়। (একে আরবী ভাষায় বলা হয় মি’রাজ এবং এ নামেই ঘটনাটির সমধিক প্রসিদ্ধ রয়েছে)।
মি’রাজের এ বিশ্ববিশ্রুত অলৌকিক ঘটনাটি কোন্ সময় সংঘটিত হয়েছিল সে ব্যাপারে জীবনচরিতকারগণের মধ্যে যে মতভেদ লক্ষ্য করা যায় তা নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হল,
১. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে যে নবুওয়াত প্রদান করা হয়েছিল সে বছর মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল (এটা তাবারীর কথা)।
২. নবুওয়াতের পাঁচ বছর পর মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল (ইমাম নাবাবী এবং ইমাম কুরতুবী এ মত অধিক গ্রহণযোগ্য বলে স্থির করেছেন)।
৩. দশম নবুওয়াত বর্ষের ২৭শে রজব তারীখে মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল। (আল্লামা মানসুরপুরী এ মত গ্রহণ করেছেন)।
৪. হিজরতের ষোল মাস পূর্বে, অর্থাৎ নবুওয়াত দ্বাদশ বর্ষের রমযান মাসে মি’রাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
৫. হিজরতের এক বছর দু’মাস পূর্বে অর্থাৎ নবুওয়াত ত্রয়োদশ বর্ষের মুহারম মাসে মি’রাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
৬. হিজরতের এক বছর পূর্বে অর্থাৎ নবুওয়াত ত্রয়োদশ বর্ষের রবিউল আওয়াল মাসে মি’রাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
এর মধ্যে প্রথম তিনটি মত এ জন্য সহীহুল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না যে, উম্মুল মু’মিনীন খাদীজাহ (রাঃ)-এর মৃত্যু হয়েছিল পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হওয়ার পূর্বে। অধিকন্তু, এ ব্যাপারে সকলেই এক মত যে, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হয়েছে মি’রাজের রাত্রিতে। কাজেই, এ থেকে এটা পরিস্কার বুঝা যায় যে, খাদীজাহ (রাঃ)-এর মৃত্যু হয়েছিল মি’রাজের পূর্বে। তাছাড়া, এটাও সর্বজনবিদিত ব্যাপার যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল দশম নবুওয়াত বর্ষের রমাযান মাসে। এ প্রেক্ষিতে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, মি’রাজের ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পরে, পূর্বে নয়।
অবশিষ্ট থাকে শেষের তিনটি মত। এ তিনটির কোনটিকেই কোনটির উপর অগ্রাধিকার দানের প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে সূরাহ ‘ইসরার’ বর্ণনাভঙ্গি থেকে অনুমান করা যায় যে, এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মক্কা জীবনের শেষ সময়ে।[1]
হাদীস বিশারদগণ এ ঘটনার যে বিস্তারিত রিওয়ায়াত প্রদান করেছেন পরবর্তী পঙ্ক্তিগুলোতে তার সার সংক্ষেপ লিপিবদ্ধ করা হল :
ইবনুল কাইয়্যেম লিখেছেনঃ প্রাপ্ত তথ্যাদি মোতাবেক প্রকৃত ব্যাপারটি হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সশরীরে বুরাকের উপর আরোহন করিয়ে জিবরাঈল (আঃ) মসজিদুল হারাম থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসে অবতরণের পর সেখানে সমাগত নাবীগণ (আঃ)-এর জামাতে ইমামত সহকারে সালাত আদায় করেন। সালাত আদায়ের পর পুনরায় তাঁকে বুরাকে আরোহন করিয়ে পৃথিবীর নিকটতম আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথম আসমানের দরজা খোলা হল সেখানে মানুষের আদি পিতা আদম (আঃ)-এর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। জিবরাঈল (আঃ) এর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন যে, ‘ইনি হচ্ছেন আপনার আদি পিতা আদম (আঃ)। একে সালাম করুন। এ কথা শ্রবণের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে শ্রদ্ধাভারে সালাম জানান। আদম (আঃ) আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে সালামের জবাব দিয়ে বললেন, ‘খোশ আমদেদ!’ হে বংশের মধ্যমণি! খোশ আমদেদ! হে আমার বংশের গৌরব!’ তারপর তিনি তাঁর নবুওয়াতের স্বীকারোক্তি করলেন এবং ডান দিকে আল্লাহর নেককার বান্দাগণের এবং বাম দিকে বদকার বান্দাগণের আত্মাসমূহ তাঁকে প্রদর্শন করালেন।
এরপর তাঁকে দ্বিতীয় আসমানে নিয়ে যাওয়া হল। দরজা খোলা হলে সেখানে ইয়াহইয়া বিন যাকারিয়া এবং ঈসা বিন মরিয়ম (আঃ)-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। পরিচয় পর্বের পর তিনি তাঁকে শ্রদ্ধাভরে সালাম জানান। উভয়েই সালামের জবাব দিয়ে তাঁকে মুবারাকবাদ ও উষ্ণ অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করে তাঁর নবুওয়াতের স্বীকারোক্তি করেন।
তৃতীয় পর্যায়ে তাঁকে তৃতীয় আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ইউসুফ (আঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনি তাঁকে শ্রদ্ধাভরে সালাম জানান। তিনিও সালামের জবাব দিয়ে তাঁকে মুবারকবাদ জানান এবং তাঁর নবুওয়াতের স্বীকারোক্তি করেন।
তারপর তাঁকে চতুর্থ আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি ইদরীস (আঃ)-কে দেখেন এবং শ্রদ্ধাভরে সালাম জানান। তিনি সালামের জবাব দিয়ে তাঁকে মুবারকবাদ জানান এবং তাঁর নবুওয়াতের স্বীকারোক্তি করেন।
পঞ্চম আসমানে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তিনি হারুন বিন ইমরান (আঃ)-কে দেখতে পান এবং তাঁকে শ্রদ্ধাভরে সালাম জানান। তিনি যথারীতি সালামের জবাব দিয়ে তাঁকে মুবারকবাদ জানান এবং তাঁর নবুওয়াতের স্বীকারোক্তি জ্ঞাপন করেন।
তারপর রাসূলে কারীম (ﷺ)-কে ৬ষ্ঠ আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মুসা বিন ইমরান (আঃ)-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাঁকে শ্রদ্ধাভরে সালাম জানিয়ে কুশলাদি বিনিময় করেন। মুসা (আঃ) সম্ভ্রমের সঙ্গে সালামের জবাব দিয়ে তাঁকে মুবারকবাদ জানান এবং তাঁর নবুওয়াতের স্বীকারোক্তি জ্ঞাপন করেন।
এরপর রাসূলুল্লাহ যখন সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন তখন তিনি ক্রন্দন করতে থাকেন। তাঁকে ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন যে, ‘আমার পূর্বে এমন এক যুবককে নাবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে যাঁর উম্মতগণ আমার উম্মতদের তুলনায় অধিক সংখ্যায় জান্নাতে প্রবেশ লাভ করবেন।’’
অগ্রযাত্রার পরবর্তী পর্যায়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সপ্তম আসমানে। সপ্তম আসমানে তাঁর সাক্ষাৎলাভ হয় ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আঃ)-এর সঙ্গে, তিনি (রাসূলুল্লাহ (ﷺ)) তাঁকে শ্রদ্ধাভরে সালাম ও মুবারকবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনিও সসম্ভ্রমে সালামের জবাব দিয়ে তাঁকে মুবারকবাদ জানান এবং তাঁর নবুওয়াতের স্বীকারোক্তি জ্ঞাপন করেন।
অতঃপর তাঁকে সিদরাতুল মুনতাহায় উঠিয়ে নেয়া হয়। তথাকার কূল বৃক্ষের এক একটা ফল ‘হাজার’ অঞ্চলের কুল্লাহ’র ন্যায়। আর তার পত্র-পল্লবগুলো হাতির কানের মতো। অতঃপর সেই বৃক্ষকে স্বর্ণের প্রজাপতি, জ্যোতি ও বিভিন্ন বিচিত্র রং আচ্ছন্ন করে ফেলল। ফলে তা এমন রুপে পরিবর্তিত হলো যে, কোন সৃষ্টির পক্ষেই তার সৌন্দর্য বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
চলার শেষ পর্যায়ে তাঁকে বায়তুল মা’মুরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ বায়তুল মা’মূর এমন এক ঘর যাতে প্রত্যেক দিন সত্তর হাজার ফিরিশতা প্রবেশ করে। অতঃপর তারা আর সেখানে দ্বিতীয়বার প্রবেশ করার সুযোগ লাভ করে না। এরপর তিনি (ﷺ) জান্নাতে প্রবেশ করেন। সেখানে রয়েছে মোতি নির্মিত রশি, জান্নাতের মাটি হলো মেশক নামক সুগন্ধির তৈরী। অতঃপর তাঁর নিকট এমন বিষয় পেশ করা হয় যে, শেষ পর্যন্ত তিনি কলমের খসখস শব্দ শুনতে পান।
তারপর এ বিশ্বের মহা গৌরব, চির আকাঙ্ক্ষিত মানব নাবী, দোজাহানের মহাসম্মানিত সম্রাট, তাজদারে মদীনা, নাবীকুল শিরোমণি, রহমাতুল্লিল আলামীন, খাতামুন্নাবিয়ীন নীত হলেন অনাদি অনন্ত, অবিনশ্বর, অসীম শক্তি-সামর্থ্য ও হিকমতের মালিক আল্লাহ তা‘আলার সান্নিধ্যে। পর্দার একপাশে চির বিশ্ব জাহানের চির আরাধ্য, চির উপাস্য, অদ্বিতীয় স্রষ্টা প্রতিপালক প্রভূ, অন্যপাশে তাঁর একান্ত অনুগ্রহভাজন সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ও প্রিয়তম নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ), মধ্যখানে রয়েছে দু’ধনুকের জ্যার সমপরিমাণ ব্যবধান কিংবা তার চাইতেও কম। অনুষ্ঠিত হল স্রষ্টা ও সৃষ্টির অভূতপূর্ব সাক্ষাৎকার, অশ্রুত পূর্ব সম্মেলন। অত্যন্ত প্রতাপান্বিত স্রষ্টা প্রভূ এবং মনোনীত প্রিয়তম সৃষ্টির মধ্যে হল আল্লাহর বাণী বিনিময়। তোহফা স্বরূপ বরাদ্দ করা হল পঞ্চাশ ওয়াক্ত ফরজ সালাত।
এরপর শুরু হল নাবীজী (ﷺ)-এর মর্তলোকে প্রত্যাবর্তনের পালা। এক পর্যায়ে সাক্ষাৎ হল মুসা (আঃ)-এর সঙ্গে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কী কী নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাঁকে। উত্তরে নাবী কারীম (ﷺ) বললেন পঞ্চাশ ওয়াক্ত ফরজ সালাতের কথা।
উত্তরে মুসা (আঃ) বললেন, ‘আপনার উম্মতের পক্ষে সম্ভব হবে না পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা। আপনি ফিরে গিয়ে আপনার উম্মতের উপর আরোপিত এ গুরু দায়িত্ব হালকা করে নেয়ার জন্য আল্লাহর সমীপে আবেদন পেশ করুন।
এ কথা শ্রবণের পর জিবরাঈল (আঃ)-এর পরামর্শ গ্রহণের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। জিবরাঈল (আঃ) ইঙ্গিতে বুঝালেন যে, তিনি ইচ্ছা করলে তা করতে পারেন। এরপর জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে মহাপরাক্রশালী আল্লাহ তা‘আলার দরবারে নিয়ে গেলেন, তিনি নিজ স্থানেই ছিলেন। কোন কোন বর্ণনায় সহীহুল বুখারীতে এ কথা আছে যে, পরম করুণাময় আল্লাহ তা‘আলা দশ ওয়াক্ত সালাত কমিয়ে দিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে নীচে আনা হল।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন মুসা (আঃ)-এর নিকট আগমন করে দশওয়াক্ত কমানোর কথা বললেন, তখন তিনি পুনরায় পরামর্শ দিলেন আল্লাহর সমীপে ফিরে গিয়ে এ গুরুভার আরও লাঘব করার জন্য আরও আবেদন পেশ করতে। শেষমেষ পাঁচওয়াক্ত সালাত নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত মুসা (আঃ) এবং আল্লাহ তা‘আলার দরবারে এ দু’মঞ্জিলের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যাতায়াত অব্যাহত থাকল। শেষ দফায় যখন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করে দেয়া হল তখনো মুসা (আঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে পরামর্শ দিলেন পুনরায় আল্লাহ তা‘আলার দরবারে ফিরে গিয়ে আরও কিছুটা হালকা করে নেয়ার জন্য। প্রত্যুত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘এ ব্যাপারটি নিয়ে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে পুনরায় যেতে আমি খুবই লজ্জাবোধ করছি। অত্যন্ত সন্তুষ্টির সঙ্গে আমি দিন ও রাতের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাতের সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিলাম।’ এ বলে তিনি সম্মুখের দিকে এগিয়ে চললেন। যখন তিনি বেশ কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করলেন তখন নিম্নোক্ত কথাগুলো তাঁর শ্রুতিগোচর হল।
‘‘আমি আমার বান্দাদের জন্য আপন ফরজ জারী করে দিলাম এবং বান্দাদের দায়িত্বভার কিছুটা হালকা করে দিলাম।[2]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আপন প্রভূকে বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখেছেন কিনা সে ব্যাপারে ইবতুল কাইয়্যেম মতভেদ বর্ণনা করেছেন। এরপর ইবনে তাইমিয়ার এক সূক্ষ্ণ বর্ণনার আলোচনা করেছেন, যার মূল বক্তব্য হচ্ছে ‘আল্লাহকে চাক্ষুস দেখার কোন প্রমাণ নেই।’ কোন সাহাবীও এরকম কোন কথা বলেন নি। আর ইবনে আব্বাস থেকে বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখার এবং অন্তর্দৃষ্টিতে দেখার যে দুটি মত বর্ণিত হয়েছে এর মধ্যে প্রথতুটি দ্বিতীয়টির বিপরীত নয়।
এরপর ইবনুল কাইয়্যেম লিখেছেন, সূরাহ নাজমে আল্লাহ তা‘আলার যে ইরশাদ,
(ثُمَّ دَنَا فَتَدَلّٰى) [النجم : 8]
‘‘তারপর সে (নাবীর) নিকটবর্তী হল, তারপর আসল আরো নিকটে,’ (আন-নাজ্ম ৫৩ : ৮)
‘তৎপর সে নিকটে আসল এবং আরও নিকটে আসল।’ এটা ঐ নৈকট্য থেকে ভিন্ন যেটা মি’রাজের ঘটনায় ঘটেছিল। কেননা, সূরাহ নাজমে যে নৈকট্যের উল্লেখ রয়েছে তাতে জিবরাঈল (আঃ)-এর নৈকট্যের কথা বলা হয়েছে। যেমনটি ‘আয়িশাহ সিদ্দীকা (রাঃ) এবং ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন এবং বর্ণনা ভঙ্গিতেও এটাই নির্দেশিত হচ্ছে। এর বিপরীত মি’রাজের হাদীসে যে নৈকট্য লাভের কথা বলা হয়েছে তাতে সর্বশক্তিমান প্রভূ আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের কথা পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে। সূরাহ নাজমে একথার কোন উল্লেখ নেই। বরং তাতে বলা হয়েছে যে, রাসূল (ﷺ) তাঁকে দ্বিতীয়বার দেখেছিলেন সিদরাতুল মুনতাহার নিকট এবং তিনি ছিলেন জিবরাঈল (আঃ)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দুবার তাঁকে তাঁর আসলরূপে দেখেছিলেন। একবার পৃথিবীতে এবং অন্যবার সিদরাতুল মুনতাহার নিকট।[3] এ সম্পর্কে সঠিক কী, সেটা আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
এ সময় পুনরায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বক্ষ বিদারণের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল এবং এ সফরকালে তাঁকে কয়েকটি জিনিসও দেখানো হয়েছিল। তাঁর সম্মুখে দুধ ও মদ পেশ করা হয়েছিল। তিনি দুধ পছন্দ করেছিলেন। এতে তাঁকে বলা হয়েছিল ‘আপনাকে ফিতরাতের (ইসলামের) পথ দেখানো হয়েছে আর আপনি যদি মদ গ্রহন করতেন তাহলে আপনার উম্মত পথভ্রষ্ট হয়ে যেত। তিনি জান্নাতে চারটি নদী দেখেছিলেন। এর মধ্যে দুটি প্রকাশ্যে এবং দুটি গোপন। প্রকাশ্য দুটি হচ্ছে নীল ও ফোরাত। সম্ভবতঃ এর তাৎপর্য এই ছিল যে, তাঁর রেসালাত নীল ও ফোরাত নদের শস্য শ্যামল এলাকায় ইসলামের বিস্তৃতি ঘটাবে এবং এখানকার মানুষ বংশপরম্পরা সূত্রে মুসলিম হবে। ব্যাপারটি এ নয় যে, এ দু’পানির উৎস জান্নাত থেকে উৎসারিত হচ্ছে। অবশ্য আল্লাহই সব কিছু ভাল জানেন। তিনি জাহান্নামের মালিক এবং দারোগাকেও দেখেছেন। তাঁরা হাসছিলেন না এবং তাঁদের মুখমণ্ডলে আনন্দ এবং প্রফুল্লতাও ছিল না। তিনি জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেছিলেন।
তিনি তাদেরকেও দেখেছিলেন যারা অন্যায়ভাবে ইয়াতীমের মাল আত্মসাৎ করে চলেছে। তাদের ঠোঁটের আকার আকৃতি উটের ঠোঁটের মতো। তারা পাথরের টুকরোর মতো আগুনের ফুলকি মুখের মধ্যে পুরছিল এবং সেগুলো গুহ্যদ্বার দিয়ে নির্গত হয়ে আসছিল।
তিনি সুদখোরদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাদের পেটগুলো এতই প্রকান্ড আকারের ছিল যে, পেটের ভার বহন করা ছিল তাদের জন্য খুবই কষ্টকর ব্যাপার এবং পেটের ভারে এদিক ওদিক নড়াচড়া তাদের পক্ষে ক্রমেই সম্ভব হচ্ছিল না। অধিকন্তু, ফেরাউনের বংশধরগণকে যখন অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপের জন্য পেশ করা হচ্ছিল তখন তারা এদেরকে পদদলিত করে অতিক্রম করছিল।
এক পর্যায়ে তিনি ব্যভিচারীদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাদের সম্মুখে টাটকা ও মোটা গোস্ত ছিল এবং তার পাশে দুঃসহ দুর্গন্ধযুক্ত পচা মাংস ছিল। এরা টাটকা ও মোটা গোস্ত বাদ দিয়ে পচা গোস্ত খাচ্ছিল।
তিনি সেই সকল স্ত্রীলোকদেরকেও দেখেছিলেন যারা স্বামীদেরকে অন্যের ঔরষ জাত সন্তান প্রদান করত। (অর্থাৎ তারা ছিল ব্যভিচারিণী, ব্যভিচারের কারণে তারা পর পুরুষের বীর্যে গর্ভ ধারণ করত কিন্তু স্বামীর অজানতে সে সন্তান স্বামীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিত)। তিনি দেখলেন তাদের বক্ষস্থল বড় বড় বড়শী দ্বারা বিদ্ধ করে আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থানে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
যাতায়াতের সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরববাসীদের এক বণিক দলকেও দেখেছিলেন এবং তাদের এক পলাতক উট দেখিয়ে দিয়েছিলেন এবং তাদের পানিও পান করেছিলেন। ঐ পানি একটি পাত্রে ঢাকা ছিল। এ সময়ে বণিকেরা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। পানি পান করার পর পুনরায় তিনি পাত্রটিকে ঢেকে রেখেছিলেন। মি’রাজের রাত্রিশেষে সকাল বেলা এ ঘটনাটি তাঁর (ﷺ) দাবীর সত্যতা প্রমাণার্থে দলিল হিসেবে প্রতিপন্ন হয়।[4]
ইবনুল কাইয়্যেম বলেছেন, ‘যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সকালবেলায় স্বগোত্রীয় লোকজনদের নিকট আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রদর্শিত নিদর্শনসমূহের কথা বর্ণনা করলেন, তখন তারা এ সব কিছুকে মিথ্যা এবং বাজে গল্প বলে উড়িয়ে দিল এবং তাঁর প্রতি যুলম নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। শুধু তাই নয়, তারা তাঁকে নানাভাবে পরীক্ষা করতে থাকে এবং প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। তারা বায়তুল মুক্বাদ্দাস সম্পর্কে তাঁকে নানা প্রশ্ন করতে থাকে এবং উত্তরের জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে। এমন অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দৃষ্টি সম্মুখে বায়তুল মুকাদ্দাসের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি সেই চিত্র প্রত্যক্ষ করে তাদের প্রশেণর জবাব দিতে থাকেন। এর ফলে নির্দ্বিধায় তাদের সকল প্রশ্নের জবাব দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়। তারা তাঁর কোন কথার প্রতিবাদ করতে সক্ষম হয়নি।
অধিকন্তু যাতায়াতের সময় তাদের যে কাফেলা তিনি দেখেছিলেন তার আগমনের সময় এবং বিবরণ ও তিনি বর্ণনা করে শোনালেন। এমন কি কাফেলার অগ্রগামী উটের চিহ্নও তিনি বলে দিলেন। তাছাড়া কাফেলার যে যা কিছু বলেছিল সবকিছুই সত্য বলে প্রমাণিত হয়ে গেল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কুরাইশ মুশরিকগণ এ সব কিছুকেই সত্য বলে মেনে নিতে চাইল না।[5]
পক্ষান্তরে আবূ বাকর (রাঃ) এ সব কথা শোনামাত্র একে সত্য বলে মেনে নেন এবং এর সত্যতার ঘোষণা দিতে থাকেন। এ সময়ে আবূ বাকর (রাঃ) কে সিদ্দীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। কারণ, সকলে যখন এ ঘটনাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে চাচ্ছিল তখন তিনি একে সর্বান্তঃকরণে সত্য বলে মেনে নিয়েছিলেন।[6]
মি’রাজের প্রসঙ্গ এবং উপকারিতা বর্ণনা করতে গিয়ে সব চাইতে সংক্ষিপ্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ কথা যেটা বলা হয়েছে সেটা হচ্ছে,
(لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا) [الإسراء: 1]
‘‘এ জন্য যে, আমি (আল্লাহ তা‘আলা) তাঁকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাব।’ (আল-ইসরা ১৭ : ১)
নাবী (আঃ)-দের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার এটাই নীতি। সূরাহ আনআমে বলেছেন,
(وَكَذٰلِكَ نُرِيْ إِبْرَاهِيْمَ مَلَكُوْتَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَلِيَكُوْنَ مِنَ الْمُوْقِنِيْنَ) [الأنعام:75]
‘‘ এভাবে আমি ইবরাহীমকে আকাশ ও পৃথিবী রাজ্যের ব্যবস্থাপনা দেখিয়েছি যাতে সে নিশ্চিত বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।’ (আল-আন‘আম ৬ : ৭৫)
তারপর আল্লাহ মূসাকে বললেন,
(لِنُرِيَكَ مِنْ آيَاتِنَا الْكُبْرَى) [طه:23]
‘যাতে আমি তোমাকে আমার বড় বড় নিদর্শনগুলোর কিছু দেখাতে পারি।’ (ত্ব-হা ২০ : ২৩)
ফলে যখন আম্বিয়ায়ে কিরামের জ্ঞান এভাবে প্রত্যক্ষদর্শিতার সনদ প্রাপ্ত হয়ে যায় তখন তাঁদের আয়নুল ইয়াকীনের (স্বচক্ষে দর্শনের) ঐ পর্যায় হাসেল হয়ে যায়। যার সম্পর্কে অনুমান করা সম্ভব নয়। যেমন শোনা কি দেখার মতো হয়। আর এই কারণেই নাবীগণ (আঃ) আল্লাহর পথে এমন সব দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে পারেন অন্য কেউ তা পারেন না। একারণে ঐ শক্তির পক্ষ থেকে আসা কোন প্রকার কঠোরতা কিংবা দুঃখ কষ্টকে তাঁরা দুঃখ কষ্ট বলে মনেই করতেন না।
এ মি’রাজের ঘটনার অন্তরালে যে সকল বিজ্ঞানময় এবং রহস্যজনক ব্যাপার রয়েছে তার আলোচনার স্থান হচ্ছে শরীয়ত দর্শনের পুস্তকাবলী। কিন্তু এমন কিছু তত্ত্ব রয়েছে যার দ্বারা এ বরকতময় সফরের স্রোতস্বিনী থেকে প্রবাহিত হয়ে নাবী (ﷺ)-এর জীবন উদ্যান অভিমুখে প্রবাহিত হয়েছে। এ কারণে সে সব সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল,
পাঠকেরা দেখতে পায় যে, আল্লাহ তা‘আলা সূরাহ বণী ইসরাঈলে রাত্রি ভ্রমণের ঘটনা কেবলমাত্র একটি আয়াতে বর্ণনা করে কথার মোড় ইহুদীদের অন্যায় ও পাপকার্যের বর্ণনার দিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এরপর তাদেরকে অবহিত করা হয়েছে যে, এ কুরআন ঐ পথের সন্ধান দেয় যে পথ হচ্ছে সব চাইতে সোজা-সরল ও শুদ্ধ। কুরআন পাঠকেরা হয়তো সন্দেহ করতে পারে যে, কথা দুটির মধ্যে কোন মিল নেই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়, বরং আল্লাহ তা‘আলা এ বর্ণনাভঙ্গি দ্বারা ঐ দিকে ইঙ্গিত করেছেন যে, ইহুদীগণকে মানুষের নেতৃত্ব দেয়া থেকে বরখাস্ত করা হবে। কারণ তারা এমন সব অন্যায় করেছে যে, ঐ সকল কর্ম করার পর তাদেরকে ঐ পদে আর অধিষ্ঠিত রাখা সঙ্গত নয়। কাজেই এ পদ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রদান করা হবে এবং ইবরাহীমী দাওয়াতের দুটি কেন্দ্রকেই তাঁর নেতৃত্বাধীনে স্থাপন করা হবে। অন্য কথায় বলা যায় যে, এখন এমন এক অবস্থার সূত্রপাত হয়েছে যার ফলে আত্মিক নেতৃত্বের প্রসঙ্গটি এক সম্প্রদায়ের নিকট হতে অন্য সম্প্রদায়ের নিকট হস্তান্তর করা দরকার। অর্থাৎ এমন এক সম্প্রদায় যাদের ইতিহাস বিশ্বাস ঘাতকতা, খেয়ানত, আসাধূতা, অন্যায়, অত্যাচার ও অপকর্মে ভরপুর তাদের হাত থেকে নেতৃত্ব কেড়ে নিয়ে অন্য এক উম্মত বা সম্প্রদায়কে দায়িত্বভার দেয়া দরকার যাঁরা প্রবাহিত হবেন কল্যাণ ও পুণ্যের প্রস্রবন হয়ে এবং যাঁদের নাবী (ﷺ) সর্বাধিক হেদায়েত প্রাপ্ত, সঠিক পথ প্রদর্শক ও আল্লাহর বাণী কুরআনের দ্বারা লাভবান হবেন।
কিন্তু যখন এ উম্মতের রাসূল (ﷺ) মক্কার পর্বত শ্রেণীতে মানুষের মাঝে ঠক্কর খেয়ে বেড়াচ্ছেন তখন এ প্রত্যাবর্তন কিভাবে সম্ভব হতে পারে? এটা একটা সে সময়ের প্রশ্নমাত্র, যে সময় এক অন্য রহস্যের আবরণ উন্মোচিত হচ্ছিল। আর সেই রহস্যটি ছিল, ইসলামী দাওয়াতের একটি পর্যায় শেষ যার ধারা থেকে কিছুটা ভিন্ন। এ জন্য আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কোন আয়াতে অংশীবাদীদেরকে খোলাখুলি সতর্ক করে ধমক দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
(وَإِذَا أَرَدْنَا أَن نُّهْلِكَ قَرْيَةً أَمَرْنَا مُتْرَفِيْهَا فَفَسَقُوْا فِيْهَا فَحَقَّ عَلَيْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنَاهَا تَدْمِيْرًا وَكَمْ أَهْلَكْنَا مِنَ الْقُرُوْنِ مِن بَعْدِ نُوْحٍ وَكَفَى بِرَبِّكَ بِذُنُوْبِ عِبَادِهِ خَبِيْرًَا بَصِيْرًا) [الإسراء:16، 17]
‘‘আমি যখন কোন জনবসতিকে ধ্বংস করতে চাই তখন তাদের সচ্ছল ব্যক্তিদেরকে আদেশ করি (আমার আদেশ মেনে চলার জন্য)। কিন্তু তারা অবাধ্যতা করতে থাকে। তখন সে জনবসতির প্রতি আমার ‘আযাবের ফায়সালা সাব্যস্ত হয়ে যায়। তখন আমি তা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে দেই। ১৭. নূহের পর বহু বংশধারাকে আমি ধ্বংস করে দিয়েছি, বান্দাহ্দের পাপকাজের খবর রাখা আর লক্ষ্য রাখার জন্য তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট। ’ [আল-ইসরা (১৭) : ১৬-১৭]
পক্ষান্তরে এ সকল আয়াতের পাশে পাশে এমন সব আয়াতও রয়েছে যার মাধ্যমে মুসলিমগণকে তাহযীব, তমদ্দুনের এমন সব নিয়ম-কানুন এবং প্রতিরক্ষার সাধারণ নিয়মাবলী শিক্ষা দেয়া হয়েছে যার উপর ভিত্তি করে নবাগত ইসলামী জিন্দেগীর ভিত্তি নির্মিত, নিয়ন্ত্রিত ও সুদৃঢ় হতে পারে। মনে হয় মুসলিমগণ এখন এমন এক সরজমিনের উপর নিজ ঠিকানা বানিয়েছেন সেখানে সকল দিক দিয়ে নিজেদের সমস্যাবলী আপন হাতের মুঠোর মধ্যে রয়েছে এবং সমাজ জীবন যাত্রার ক্ষেত্রে তাঁরা এমন এক ঐকমত্য গঠনে সক্ষম হয়েছেন যার উপর ভিত্তি করে সমাজের যাঁতা ঘুরছে। অধিকন্তু, এ আয়াতে আরও ইঙ্গিত রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অচিরেই এমন এক স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করবেন, যা সম্পূর্ণ নিরাপদ হবে এবং তাঁর প্রচারিত ধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।
এই নৈশ ভ্রমণ ও মি’রাজ বরকতময় ঘটনার তলদেশে হিকমত ও রহস্যসমূহের মধ্যে এমন একটি হিকমত যা আমাদের বিষয়বস্তুর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। এ জন্য বর্ণনা উপযোগী মনে করে আমি এখানে তা লিপিবদ্ধ করলাম। এরকম দুটি বিরাট হিকমতের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপের পর আমি এ ব্যাপারে মতস্থির করেছি যে, এ নৈশ ভ্রমণের ঘটনা ‘আক্বাবাহর প্রথম বাইআতের ঘটনার কিছু পূর্বের অথবা দু’বাইআতের মধ্যবর্তী সময়ের ঘটনা হতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা সব চাইতে ভাল জানেন।
[2] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৪৭-৪৮ পৃঃ।
[3] যা’দুল মায়দ ২য় খন্ড ৪৭-৪৮ পৃঃ, সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫০, ৪৫৫, ৪৫৬, ৪৭০, ৪৮১, ৫৪৮, ৫৫০, ২য় খন্ড ৬৮৪ মসলিম ১ম খন্ড ৯১, ৯২, ৯৩, ৯৪, ৯৬।
[4] পূর্ববর্তী উদ্ধৃতি, এ ছাড়া ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৯৭, ৪০২ ও ৪০৬ পৃঃ। তফসীরের কিতাব সমূহের সূরাহ ইসরার তফসীর দ্রষ্টব্য।
[5] যা’দুল মাদ ১/৪৮ পৃঃ, এটা ছাড়া সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৬৮৪, সহীহুল মুসলিম ১ম খন্ড ৯৬ পৃঃ, ইবনে হিশাম ১/৪০২-৪০৩ পৃঃ।
[6] ইবনে হিশাম ১/৩৯৯ পৃঃ।
পূর্বে আমি বলেছি যে, একাদশ নবুওয়াত বর্ষে হজ্বের মৌসুমে ইয়াসরিবের ছয়জন লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট অঙ্গীকার করেছিলেন যে, ‘আমরা নিজ জাতির নিকট গিয়ে আপনার নবুওয়াতের কথা প্রচার করব।’
এর ফল হল যে, পরবর্তী বছর যখন হজ্বের মৌসুম এল (অর্থাৎ দ্বাদশ নবুওয়াত বর্ষের জিলহজ্ব মোতাবেক ৬২১ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই) তখন বারোজন লোক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে এসে উপস্থিত হলেন। এদের মধ্যে জাবির বিন আব্দুল্লাহ বিন রেআব ছাড়া অবশিষ্ট পাঁচজন তাঁরাই ছিলেন যাঁরা পূর্বের বছর এসেছিলেন। এছাড়া অন্য সাত জন ছিলেন নতুন। নাম হল যথাক্রমেঃ
১. মা’আয বিন হারিস ইবনে আফরা- |
কবীলাহ বনী নাজ্জার |
(খাযরাজ) |
২. যাকওয়ান বিন আব্দুল ক্বায়স |
,, বনী যুরাইক্ব |
(খাযরাজ) |
৩. উবাদা বিন সামিত |
,, বনী গানাম |
(খাযরাজ) |
৪. ইয়াযীদ বিন সা’লাবাহ |
,, বনী গানামের মিত্র |
(খাযরাজ) |
৫. আব্বাস বিন উবাদাহ বিন নাযলাহ |
,, বনী সালিম |
(খাযরাজ) |
৬. আবুল হায়সাম বিন তায়্যাহান |
,, বনী আব্দুল আশহাল |
(আউস) |
৭. উয়াইম বিন সায়িদাহ |
,, বনী ‘আমর বিন আওফ |
(আউস) |
এর মধ্যে কেবল শেষের দুজন আউস গোত্রের। তাছাড়া বাকী সকলেই ছিলেন খাযরাজ গোত্রের।[1] এ লোকগুলো মিনার ‘আক্বাবাহর নিকটে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর প্রচারিত দ্বীনের ব্যাপারে কিছু কথার উপর অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। ঐ কথাগুলো সবই পরবর্তীকালে সম্পাদিত হুদায়বিয়াহর সন্ধিপত্র এবং মক্কা বিজয়ের সময় মহিলাদের নিকট থেকে গৃহীত অঙ্গীকারনামার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ‘আক্বাবাহর এ অঙ্গীকার নামার ঘটনা সহীহুল বুখারী শরীফে উবাদাহ বিন সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘এসো, আমার নিকট এ কথার উপর অঙ্গীকার গ্রহণ কর যে, আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুকেই অংশীদার করবে না, চুরি করবে না, যেনা করবে না, নিজ সন্তানকে হত্যা করবেনা, হাত পায়ের মাঝে মন গড়া কোন অপবাদ আনবে না এবং কোন ভাল কথায় আমাকে অমান্য করবে না। যারা এ সকল কথা মান্য এবং পূর্ণ করবে আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাদের পুরষ্কার রয়েছে। কিন্তু যারা এগুলোর মধ্যে কোনটি করে বসে এবং তার শাস্তি এখানেই প্রদান করা হয় তবে সেটা তার মুক্তিলাভের কারণ হয়ে যাবে। আর যদি কেউ সবের মধ্যে কোন কিছু করে বসে এবং আল্লাহ তা গোপন রেখে দেন তবে তার ব্যাপারটি আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া হবে, চাইলে তিনি শাস্তি দিবেন, নচেৎ ক্ষমা করে দিবেন। উবাদাহ (রাঃ) বলেছেন এ সব কথার উপরে আমরা নাবী (ﷺ)-এর নিকট অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম।[2]
[1] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৮৫ পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৩১-৪৩৩ পৃঃ।
[2] সহীহুল বুখারী বাবু বা’দা হালাওয়াতিল ঈমান ১/৭ পৃঃ। বাবু অফদিল আনসার ১/৫৫০-৫৫১ শব্দ এ বাবেরই , বাবু কাওলেহী তা‘আলা, ২য় খন্ড ৭২৭ পৃৃৃঃ। বাবুল হদুদে কাফ্ফারাতুন ২/১০০৩ পৃঃ।
অঙ্গীকার সম্পাদিত এবং হজ্বব্রত সম্পন্ন হয়ে গেলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ লোকদের সঙ্গে ইয়াসরিবে প্রথম ধর্ম প্রচারক দল প্রেরণ করলেন। দ্বিবিধ উদ্দেশ্যে এ প্রচারক দল প্রেরণ করা হয়। প্রথম উদ্দেশ্য ছিল নব দীক্ষিত মুসলিমগণকে ইসলামের আহকাম এবং ধর্মের নিয়ম কানুন শিক্ষা দেয়া। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি ছিল যারা এখনও শিরকের উপরেই রয়ে গেছে তাদের নিকট ইসলাম প্রচার করা। নাবী কারীম (ﷺ) এ প্রবাসের জন্য প্রথম অগ্রগামীদের মধ্যে স্বনামধন্য এক যুবককে নির্বাচন করেন যার নাম হল মুসআব বিন উমায়ের আবদারী (রাঃ)।
মুসআব বিন উমায়ের (রাঃ) মদীনায় গিয়ে আস’আদ বিন যুবারাহ (রাঃ)-এর বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং উভয়ে মিলে ইয়াসরিববাসীদের নিকট প্রবল উদ্যম ও উদ্দীপনা নিয়ে ইসলামের প্রচার-প্রচারণার কাজ আরম্ভ করলেন। তাঁর উত্তম প্রচার কার্য্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ‘মুক্বরিউন’ উপাধিতে ভূষিত হন।
মুক্বরিউন অর্থ পাঠদানকারী। সে সময় শিক্ষক বা উস্তাদকে মুক্বরিউন বলা হতো।
প্রচার কার্যের মধ্যে সবচাইতে সফল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটির কথা এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে। একদিন আস’আদ বিন যুরারাহ তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বণী আব্দুল আশহাল ও বণী যাফরের মহল্লায় গমন করলেন এবং সেখানে বণী যাফরের একটি বাগানের মধ্যে ‘মরক’ নামক এক কূয়ার উপরে বসে পড়লেন। সে সময় তাঁদের নিকট কিছু সংখ্যক মুসলিম এসে একত্রিত হলেন। তখন পর্যন্ত বণী আব্দুল আশহালের দু’জন নেতা সা’দ বিন মু’আয ও উসাইদ বিন হুযায়ের শিরকের উপরেই ছিলেন অর্থাৎ মুসলিম হন নি।
তাঁরা যখন তাঁদের আগমনের খবর জানতে পারলেন তখন সা’দ উসাইদকে বললেন, ‘একটু যান এবং তাঁদের উভয়কে বলে দিন যাঁরা আমাদের দুর্বল চিত্তের মানুষগুলোকে বোকা বানাতে এসেছেন তাঁদেরকে সাবধান করে বলে দিন যে, তাঁরা যেন আমাদের মহল্লায় না আসেন। আস’আদ বিন যুরারাহ আমার খালাতো ভাই, কাজেই আপনাকে পাঠাচ্ছি। অন্যথায় এ কাজ আমি নিজেই সম্পন্ন করতাম।’’
উসাইদ (রাঃ) নিজ বর্শা উত্তোলন করে তাঁদের দুজনের নিকট পৌঁছলেন। আস’আদ (রাঃ) তাঁদের আসতে দেখে মুসআবকে বললেন, ‘ইনি নিজ জাতির সরদার, আপনার কাছে আসছেন। এর জন্য আল্লাহর নিকট দু‘আ করুন।’ মুসআব বললেন, ‘যদি তিনি বসেন তাহলে কথা বলব।’ উসাইদ তাঁদের নিকট পৌঁছার পর দাঁড়িয়ে কঠোর ভাষায় কথা বলতে লাগলেন।
বললেন, ‘তোমরা দুজন আমাদের এখানে কেন এসেছে? আমাদের দুর্বল চিত্তের মানুষকে বোকা বানাচ্ছ? যদি তোমাদের প্রাণ বাঁচানোর ইচ্ছা থাকে তাহলে আমাদের নিকট হতে দূরে যাও।’ মুসআব বললেন ‘আপনি কিছুক্ষণের জন্য বসুন এবং কিছু কথাবার্তা শুনন। যদি কোন কথা পছন্দ হয় তা হলে তা গ্রহণ করুন। পছন্দ না হলে বর্জন করুন।’
উসাইদ বললেন, ‘কথা তো ন্যায়সঙ্গতই বলছেন।’ তারপর তিনি নিজ বর্শা মাটিতে পুঁতে দিয়ে বসে পড়লেন। এ সময় মুসআব ইসলামের কথা বলতে লাগলেন এবং কুরআন তিলাওয়াত করলেন। তাঁর বর্ণনায় এ কথা রয়েছে যে, ‘উসাইদকে আল্লাহ তা‘আলার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করলাম যে, তাঁর মুখ মন্ডলে একটা চমকের ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে আমাদের ধারণা হল যে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করবেন।
এরপর তিনি মুখ খুললেন এবং বললেন, আপনারা যেসব কথা বলছেন তার চাইতে উত্তম কথা তো আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আপনারা যখন কাউকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে চান তখন কী করেন?
উত্তরে তাঁরা বললেন, ‘আপনি গোসল করুন, পাক-সাফ পরিচ্ছদ পরিধান করুন এবং সত্যের সাক্ষ্য প্রদান করে দু’ রাকায়াত সালাত পড়ুন।’ তিনি গোসল করে নিয়ে পাক সাফ পরিচ্ছদ পরিধান করলেন, কালেমা শাহাদত পাঠ করে সত্যের সাক্ষ্য প্রদান করে দু’ রাকায়াত সালাত আদায় করলেন। তারপর বললেন, ‘আমার পিছনে আরও একজন আছেন।’ যদি তিনি অনুসারী হয়ে যান তা হলে তাঁর সম্প্রদায়ে কেউ পিছনে পড়ে থাকবে না। আমি এখনই তাঁকে আপনাদের খেদমতে প্রেরণ করছি।’ (তাঁর ইঙ্গিত সা’দ বিন মুয়াযের প্রতি ছিল)।
এরপর উসাইদ (রাঃ) নিজ বর্শা উত্তোলন করে সায়াদের নিকট প্রত্যাবর্তন করলেন। তিনি তখন তাঁর স্বজাতীয় লোকজনদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় রত ছিলেন। উসাইদকে আসতে দেখে তিনি বললেন, ‘আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি এ ব্যক্তি তোমাদের নিকট যে চেহারা নিয়ে আসছেন এটা ঐ চেহারা নয় যা নিয়ে তিনি এখান থেকে প্রস্থান করেছিলেন।’ তারপর উসাইদ যখন সভাস্থানে এসে দাঁড়ালেন তখন সা’দ তাঁকে এ বলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কী করে এলেন?’
তিনি বললেন, ‘আমি তাঁদের দুজনের সঙ্গে কথা বলেছি কিন্তু আল্লাহর কসম কোন প্রকার অন্যায় কিংবা অসুবিধা তো আমার নযরে পড়ল না। তবে তাদের নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। তাঁরাও বলেছেন, ‘ঠিক আছে, আপনারা যা চান তা করা হবে।
অধিকন্তু, আমি জানতে পারলাম যে, বণী হারেসের লোকজন আস’আদ বিন যুরারাকে (রাঃ) হত্যা করতে গিয়েছে আর এর কারণ হলো তারা জানে যে, আস’আদ আপনার খালাতো ভাই। কাজেই, তারা চাচ্ছে যে, আপনার সঙ্গে যে চুক্তি রয়েছে তা ভঙ্গ করে দেবে। এ কথা শুনে সা’দ (রাঃ) রাগান্বিত ও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন এবং নিজ বর্শা উত্তোলন করে সোজা ঐ দুজনের নিকট গিয়ে পৌঁছলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন যে, তাঁরা নিশ্চিন্তে বসে রয়েছেন। এতে তিনি এ কথা বুঝে গেলেন যে, উসাইদের ইচ্ছা ছিল যে, তিনি যেন তাদের কথা শোনেন। কিন্তু তাঁদের নিকট গিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি কঠোর ভাষায় আস’আদ বিন যুরারাকে বলতে লাগলেন, ‘খোদার শপথ! হে আবূ উমামা, আমার ও আপনার মধ্যে যদি আত্মীয়তার বন্ধন না থাকত তবে আপনার কোন দিনই সাহস হতো না যে, আপনি এলাকায় এসে আমার অপছন্দীয় কথাবার্তা বলবেন।’
এ দিকে আস’আদ (রাঃ) পূর্বেই মুসয়াব (রাঃ)-কে এ কথা বলেছিলেন যে, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনার নিকট এমন এক নেতা আসছেন যার পিছনে তাঁর সমস্ত জাতি রয়েছে। যদি তিনি আপনাদের কথা মেনে নেন তাহলে কেউই তারা পিছে থাকবে না। এ জন্য মুসয়াব (রাঃ) সা’দ (রাঃ)-কে বললেন, আপনি কেন আগমন করবেন না? আর কেনইবা আমাদের কথা শুনবেন না? যদি কোন কথা পছন্দ হয় তবে গ্রহণ করবেন। আর যদি অপছন্দ হয় তাহলে আমরা আপনার অপছন্দীয় কথা থেকে আপনাকে দূরেই রাখব। সা’দ (রাঃ) বললেন ‘ন্যায়সঙ্গত কথাই তো বলছেন।’ এর পর তিনি আপন বর্শা পুঁতে দিয়ে বসে পড়লেন। মুসয়াব তার নিকট ইসলাম পেশ করলেন এবং কুরআন পাঠ করলেন। তাঁর বর্ণনায় রয়েছে যে, সায়াদের বলার পূর্বেই তাঁর মুখমণ্ডলের জৌলুস দেখে তাঁর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি আঁচ করতে পেরেছিলাম। এর পর তিনি মুখ খুললেন এবং বললেন, ‘আপনারা কিভাবে ইসলামে দীক্ষিত করেন।’
তারা বললেন, ‘আপনি গোসল করুন, পাক-সাফ পরিচ্ছদ পরিধান করুন এবং সত্যের সাক্ষ্য প্রদান করে দু’রাকয়াত সালাত আদায় করুন। সা’দ তাই করলেন। এর পর তিনি নিজ বর্শা উত্তোলন করে আপন সম্প্রদায়ের লোকজনদের সভায় গমন করলেন।
তাকে দেখা মাত্রই লোকেরা বললেন, আল্লাহর শপথ! সা’দ যে মুখমণ্ডল নিয়ে গিয়েছিলেন তার স্থানে অন্য একটি মুখমণ্ডল নিয়ে ফিরে এসেছেন। সা’দ (রাঃ) যখন সভায় উপস্থিত লোকজনদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘হে বণী আব্দুল আশহাল! তোমরা আমাকে তোমাদের মধ্যে কেমন মনে কর?’ তাঁরা বললেন, ‘আপনি আমাদের নেতা, অগাধ জ্ঞান গরিমার অধিকারী এবং বরকতময় কান্ডারী।’
তিনি বললেন, ‘বেশ ভালো, তবে এখন একটা কথা শোন। কথাটা হচ্ছে এখন থেকে তোমাদের নারী-পুরুষ সকলের সঙ্গে আমার কথা বলা হারাম, যে পর্যন্ত তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর উপর ঈমান না আনছ।’
তাঁর এ কথার এমন একটি প্রতিক্রিয়া হল যে, সন্ধ্যা হতে না হতেই ঐ গোত্রের এমন একটি পুরুষ কিংবা মাহিলা রইল না যারা ইসলাম গ্রহণ করে নি। কেবলমাত্র একজন লোক সে সময়ই ইসলাম গ্রহণ করে নি যাঁর নাম ছিল ইসাইরিম, তাঁর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি উহুদের যুদ্ধকাল পর্যন্ত বিলম্বিত হয়েছিল। উহুদ যুদ্ধের দিন ইসলাম গ্রহণ করে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং যুদ্ধরত অবস্থায় শাহাদত বরণ করেছিলেন। কালেমায়ে শাহাদত পাঠ করে তিনি ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার অল্প সময় পরেই শহীদ হন। আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে সিজদাহহ করার সুযোগ তাঁর হয়নি। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি অল্প পরিশ্রম করে অধিক পুরষ্কার লাভ করলেন।’
মুসয়াব (রাঃ) আস’আদ বিন যুরারাহর বাড়িতে থেকেই ইসলামের প্রচার কাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন। কেবলমাত্র বণী উমাইয়া বিন যায়দ, খাতমা ও ওয়ায়েলের বাড়ি ব্যতীত আনসারদের এমন কোন বাড়ি ছিল না যার পুরুষ ও মহিলাদের কিছু সংখ্যক মুসলিম হন নি। বিখ্যাত কবি ক্বায়স বিন আসলাত তাঁদেরই লোক ছিলেন। এরা তাঁরই কথা মান্য করতেন। এ কবিই তাঁদেরকে খন্দকের যুদ্ধ (৫ম হিজরী) পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখেন। যাহোক, পরবর্তী হজ্ব মৌসুম পর্যন্ত, অর্থাৎ ত্রয়োদশ নবুওয়াত বর্ষের হজ্ব মৌসুম আগমনের পূর্বেই মুসয়াব বিন উমায়ের (রাঃ) তাঁর সাফল্যের সংবাদ মক্কায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে নিয়ে আসেন এবং তাঁকে ইয়াসরিবের গোত্রগুলোর অবস্থা, তাদের রণকৌশল ও প্রতিরক্ষামূলক দক্ষতার উৎকর্ষতা সম্পর্কে অবগত করেন।[1]
নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বর্ষে হজ্বের মৌসুমে (জুন, ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে) ইয়াসরিবের সত্তর জনেরও অধিক মুসলিম ফরজ হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় আগমন করেন। তাঁরা নিজ সম্প্রদায়ের মুশরিক হজ্বযাত্রীগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইয়াসরিবের মধ্যে কিংবা মক্কার পথে ছিলেন এমন এক পর্যায়ে, তারা পরস্পর পরস্পরের মধ্যে বলাবলি করতে থাকলেন, ‘আমরা কতদিন আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এভাবে মক্কার পাহাড় সমূহের মধ্যে চক্কর ও ঠোক্কর খেতে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় ফেলে রাখব?’
এ মুসলিমগণ যখন মক্কায় পৌঁছলেন তখন গোপনে নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে যোগাযোগ আরম্ভ করলেন এবং শেষ পর্যন্ত সর্ব সম্মতিক্রমে এ কথার উপর সিদ্ধান্ত গৃহীত হল যে, আইয়ামে তাশরীকের[1] মধ্য দিবসে (১২ই জিলহজ্জ তারীখে) উভয় দল মিনায় জামরাই উলা, অর্থাৎ জামরাই ‘আক্বাবাহর নিকটে যে সুড়ঙ্গ রয়েছে সেখানে একত্রিত হবেন এবং সে সমাবেশ গোপনে রাতের অন্ধকারে অনুষ্ঠিত হবে। এ ঐতিহাসিক সমাবেশ কিভাবে ইসলাম ও মূর্তিপূজার মধ্যে চলমান সংঘর্ষের মোড় পালটিয়ে দেয় তা একজন আনসার সাহাবীর নিকট থেকে প্রাপ্ত বিবরণ সূত্রে জানা যায়।
কা‘ব বিন মালিক (রাঃ) বলেছেন, ‘আমরা হজ্জের জন্য বের হলাম। আইয়াম তাশরীকের মধ্যবর্তী দিবাগত রাত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত গৃহীত হল এবং শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত সময় উপস্থিত হল। আমাদের সঙ্গে আমাদের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা আব্দুল্লাহ বিন হারামও উপস্থিত ছিলেন (যিনি ইসলাম গ্রহণ করেন নি)। মুশরিকগণের মধ্যে একমাত্র তাঁকেই আমরা সঙ্গে নিয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে আগত অন্যান্য মুশরিকদের থেকে আমাদের কাজকর্ম ও কথাবার্তা গোপন রাখছিলাম। কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন হারামের সঙ্গে আমাদের কথোপকথন ঠিকভাবেই চলছিল। আমরা তাকে বললাম, ‘হে আবূ জাবির! আপনি আমাদের একজন প্রভাবশালী এবং উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন নেতা। আপনার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সূত্রে আমরা আপনাকে বর্তমান অবস্থা থেকে বের করে আনতে চাচ্ছি যাতে করে আপনি জাহান্নামের ভয়াবহ অগ্নিকুন্ডের ইন্ধন হয়ে না যান। এর পর তাঁকে আমরা ইসলামের দাওয়াত দিলাম এবং বললাম যে, ‘আজ ‘আক্বাবাহয় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের কথাবার্তা আছে’’, তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং আমাদের সাথে ‘আক্বাবাহয় গমন করলেন। তারপর তিনি আমাদের নেতা নির্বাচিত হলেন।
কা‘ব (রাঃ) ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমরা এ রাতেও যথারীতি নিজ নিজ সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু যখন রাত্রের তৃতীয় অংশ অতিবাহিত হল তখন আমরা নিজ নিজ তাঁবু থেকে বের হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য নির্ধারিত স্থানে গেলাম যেমনটি পাখি নিজ বাসা থেকে নিজেকে জড়োসড়ো করে বের হয়। শেষ পর্যন্ত আমরা সকলে গিয়ে ‘আক্বাবাহয় একত্রিত হলাম। আমরা সংখ্যায় ছিলাম মোট পঁচাত্তর জন। তেহাত্তর জন্য পুরুষ এবং দু’জন মহিলা। মহিলা দু’জনের একজন ছিলেন উম্মু আম্মারা নাসীবা বিনতে কা‘ব। তিনি কাবিলা বনু মাযেন বিন নাজ্জারের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। দ্বিতীয় জন ছিলেন উম্মু মানী আসমা বিনতে ‘আমর। তিনি বনু সালামাহ গোত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন।
আমরা সকলে সুড়ঙ্গে একত্রিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত সে আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তে এসে পড়ল এবং তিনি তশরীফ আনয়ন করলেন। সঙ্গে ছিলেন তার চাচা আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব। যদিও তিনি তখনো নিজ সম্প্রদায়ের ধর্মের উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তবুও তিনি এটা চাচ্ছিলেন যে, আপন ভ্রাতুষ্পুত্রের সমস্যায় উপস্থিত থাকেন যাতে তাঁর পূর্ণ ইত্বমিনান হাসিল হয়ে যায়। তিনিই সর্বপ্রথম কথা বলা আরম্ভ করেন।[2]
[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৪০ ও ৪৪১ পৃঃ।
সভার প্রাথমিক কাজকর্ম সম্পন্ন হলে ধর্মীয় ও সামরিক সাহায্যকল্পে সন্ধি ও চুক্তির পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা তৈরির জন্য কথোপকথন আরম্ভ হল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চাচা আব্বাস (রাঃ) সর্বপ্রথম মুখ খুললেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল তাদের সম্পাদিত চুক্তির ফলে তাদের উপর যে দায়িত্ব কর্তব্য আরোপিত হয়েছে এবং পরিণামে যে নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে তা ব্যাখ্যা করা।
কাজেই তিনি বললেন, ‘হে খাযরাজের লোকজন! (আরববাসীগণের নিকট আনসারদের মধ্যে দু’গোত্রের অর্থাৎ খাযরাজ এবং আউস, খাযরাজ নামেই পরিচিত ছিল) আমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে তোমরা সকলেই ওয়াকেফহাল রয়েছ। ধর্মের ব্যাপারে আমরা যে মনোভাব পোষণ করি আমাদের সম্প্রদায়ের লোকজনও একই মনোভাব পোষণ করে। আমরা তাঁকে তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের অনিষ্ট থেকে হেফাজত করে রেখেছি। তিনি এখন আপন আবাসস্থানে নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে মানসম্মান, শক্তি সামর্থ্য এবং হেফাজতের সঙ্গেই রয়েছেন। কিন্তু এখন তিনি তোমাদের সেখানে গিয়ে তোমাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য সংকল্পবদ্ধ। এ অবস্থায় যদি এমনটি হয় যে, তোমরা তাঁর কাজকর্মে সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করবে এবং তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের অনিষ্ট থেকে তাঁকে রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট থাকবে তাহলে সব ঠিক আছে, আপত্তির কোন কিছু নেই। তোমরা জিম্মাদারীর যে গুরুভার গ্রহণ করতে যাচ্ছ আশা করি তার গুরুত্ব সম্পর্কে তোমাদের সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে। কিন্তু এমনটি যদি হয় যে, তোমরা তাঁকে নিয়ে গিয়ে আলাদা হয়ে যাবে কিংবা প্রয়োজনে তোমরা তাঁর কোন উপকারে আসবে না তাহলে তাঁকে এখনি ছেড়ে দাও। কেননা, তিনি নিজ আবাসিক নগরীতে আপন সম্প্রদায়ের মধ্যে মান-সম্মান ও হেফাজতের সঙ্গেই রয়েছেন।
কা‘ব (রাঃ) বলেছেন যে, ‘আব্বাস (রাঃ)-কে বললাম, ‘আমরা আপনার কথা শুনেছি।’ তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে লক্ষ্য করে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি কথাবার্তা বলুন এবং নিজের জন্য ও নিজ প্রভূর জন্য যে সন্ধি ও চুক্তি করতে পছন্দ করেন তা করুন’’।[1]
কা‘ব (রাঃ)-এর উত্তর থেকে এটা সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, এ বিরাট জিম্মাদারী বহন করা এবং এর অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক পরিণতির ব্যাপারে আনসারগণের দৃঢ় সংকল্প, বাহাদুরী, ঈমান, উদ্যম ও খুলুসিয়াত কোন পর্যায়ের ছিল।
এর পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কথাবার্তা বললেন। তিনি (ﷺ) প্রথমে কুরআন শরীফ থেকে কিছু অংশ তিলাওয়াত করলেন, আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পেশ করলেন এবং ইসলামের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করলেন। এরপর আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করলেন।
ইমাম আহমাদ জাবির (রাঃ) হতে বাইয়াতের ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। জাবির বলেছেন, ‘আমরা আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমরা আপনার নিকট কোন শপথ গ্রহণ করব?’
তিনি বললেন, ‘তোমরা যে কথার উপর শপথ গ্রহণ করবে তা হচ্ছে,
১. সুখে দুঃখে সর্ব অবস্থায় কথা শুনবে ও মেনে চলবে।
২. অভাবে ও স্বচ্ছলতায় একই ধারায় খরচ করবে।
৩. ভাল কাজের জন্য আদেশ করবে এবং মন্দকাজ থেকে বিরত থাকতে বলবে।
৪. আল্লাহর পথে দন্ডায়মান থাকবে এবং আল্লাহর ব্যাপারে কোন ভৎর্সনাকারীর ভৎর্সনার পরওয়া করবে না।
৫. যখন আমি তোমাদের নিকট হিজরত করে যাব তখন আমাকে সাহায্য করবে এবং যেমনভাবে আপন জান মাল ও সন্তানদের হেফাজত করছ সেভাবেই আমার হেফাজত করবে। এ সব করলে তোমাদের জন্য জান্নাত রয়েছে।[1]
কা‘ব (রাঃ)-এর বর্ণনা সূত্রে ইবনে ইসহাক্ব যে আলোচনা করেছেন তাতে শেষ ধারার (৫) কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুরআন তিলাওয়াত করলেন, আল্লাহর দ্বীনের প্রতি দাওয়াত এবং ইসলাম গ্রহণের প্রতি অনুপ্রেরণা দানের পর বললেন, ‘আমি তোমাদের নিকট এ কথার শপথ গ্রহন করছি যে, তোমরা আমাকে ঐ সকল জিনিস থেকে হেফাযত করবে যে সকল জিনিস থেকে তোমরা আপন ছেলেমেয়ে এবং আত্মীয়-স্বজনদের হেফাজত করে থাক।’ এ কথা বলার পরেই বারা (রাঃ) বিন মা’রুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাত ধরে বললেন, ‘ঐ সত্ত্বার শপথ! যিনি আপনাকে সত্য নাবীরূপে প্রেরণ করেছেন, সুনিশ্চিত আমরা আপনাকে ঐ সকল অনিষ্ট থেকে হেফাজত করব, যে সকল অনিষ্ট থেকে আমাদের ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়-স্বজনদের হেফাজত করি। অতএব, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আপনি আমাদের আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করুন। আল্লাহর শপথ! আমরা যুদ্ধের সন্তান এবং অস্ত্র আমাদের খেলনা। আমাদের এ পদ্ধতি বাপদাদার কাল থেকে চলে আসছে।
কা‘ব (রাঃ) বলেন যে, বারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন এমন সময় আবুল হায়সাম বিন তায়হান কথার ছেদ কেটে বললেন ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের ও কিছু মানুষের অর্থাৎ ইহুদীদের মধ্যে চুক্তি ও সন্ধির বন্ধন রয়েছে, আর আমরা এখন সে বন্ধন ছিন্ন করছি। তা হলে এ রকম তো হবে না যে, আমরা এরূপ করে ফেলি তারপরে আল্লাহ যখন আপনাকে জয়যুক্ত করবেন, তখন আপনি আমাদেরকে ছেড়ে দিয়ে নিজ জাতির দিকে ফিরে যাবেন।’
এ কথা শ্রবণের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মৃদু হেসে বললেন, ‘না, বরং তোমাদের রক্ত আমার রক্ত এবং তোমাদের ধ্বংস আমার ধ্বংস, আমি তোমাদেরই এবং তোমরাও আমারই। তোমরা যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে আমিও তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব। তোমরা যাদের সঙ্গে সন্ধি করবে আমিও তাদের সঙ্গে সন্ধি করব।[2]
[2] ইবনে হিশাম ১/৪৪২ পৃঃ।
অঙ্গীকারের শর্তাদি সংক্রান্ত আলাপ আলোচনা প্রায় সমাপ্তির পথে এবং লোকজনেরা যখন অঙ্গীকার গ্রহণ আরম্ভ করতে যাচ্ছেন এমন সময় প্রথম সারির দুজন মুসলিম যারা একাদশ বা দ্বাদশ নবুওয়াত বর্ষে হজ্জ্বের মৌসুমে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা উঠে পড়েন, যাতে মানুষের সামনে তাদের দায়িত্বের নাজুকতা ও ভয়াবহতা অর্থাৎ সম্ভাব্য বিপদাপদের ব্যাপারটি ভালভাবে ব্যাখ্যা করার প্রেক্ষাপটে সমস্যার সকল দিক ভালভাবে অবহিত হওয়ার পর তারা শপথ গ্রহণ করে। এর পিছনে আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল তা হচ্ছে এ সকল লোকজন কতটুকু আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত রয়েছে তা অনুধাবন করা।
ইবনে ইসহাক্ব বলেছেন যে, যখন লোকজন অঙ্গীকার গ্রহণের জন্য একত্রিত হলেন তখন আব্বাস বিন উবাদাহ বিন নাযলাহ বললেন, ‘তোমরা কি জানো যে, তাঁর সাথে (রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ইঙ্গিত ছিল) কোন কথার উপর অঙ্গীকার গ্রহণ করতে যাচ্ছ?’ তাঁরা সমবেত কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘জী হ্যাঁ’’।
আব্বাস (রাঃ) বললেন, ‘লাল ও কালো মানুষের বিরুদ্ধে জান্নাতের বিনিময়ে যুদ্ধ করার ব্যাপারে তোমরা তাঁর কাছে অঙ্গীকার গ্রহণ করতে যাচ্ছ। যদি তোমাদের এ রকম ধারণা যে, যখন তোমাদের সকল সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং তোমাদের দলের সম্ভ্রান্ত লোকজনকে হত্যা করা হবে তখন তোমরা তাঁর সঙ্গ ছেড়ে যাবে তাহলে এখনই ছেড়ে যাও। কেননা , তাঁকে নিয়ে যাওয়ার পর যদি তোমরা তাঁকে ছেড়ে দাও তাহলে ইহ ও পরকালের জন্য তা হবে চরম বেইজ্জতির ব্যাপার। আর যদি তোমাদের ইচ্ছা থাকে যে, তোমাদের ধনমাল ধ্বংসের এবং মর্যাদাসম্পন্ন লোকদের হত্যা সত্ত্বেও এ চুক্তি সম্পন্ন করবে যার প্রতি তোমরা তাকে আহবান করছ তবে অবশ্যই তা গ্রহণ করবে। কেননা, আল্লাহর শপথ! এতেই ইহলৌকিক এবং পরলৌকিক জীবনের জন্য মঙ্গল রয়েছে।
এ কথা শ্রবণের পর সকলেই সমবেত কণ্ঠে বললেন, ‘ধন-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের হত্যার মতো অত্যন্ত বিপদ সংকুল পরিস্থিতির বিনিময়ে এটা আমরা গ্রহণ করছি। তবে হাঁ একটি প্রাসঙ্গিক কথা, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমরা যদি যথাযথভাবে এ অঙ্গীকার পূরণ করি তবে প্রতিদানে আমাদের জন্য কি পুরষ্কারের ব্যবস্থা রয়েছে?
তিনি বললেন, ‘জান্নাত’’।
লোকেরা বললেন, ‘আপনার হাত মুবারক প্রশস্ত করুন।’
তিনি হাত প্রসারিত করলে লোকেরা তাঁর হাত ধারণ করে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন।[1]
জাবির (রাঃ)-এর বর্ণনা হচ্ছে অঙ্গীকার গ্রহণের জন্য যে সময় আমরা দাঁড়ালাম সে সময় সত্তর জনের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য আস’আদ বিন যুরারাহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাত ধারণ করে বললেন, ‘ইয়াসরিববাসীরা! একটু থেমে যাও। আমরা উটের কলিজা নষ্ট করে (অর্থাৎ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে) এ বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে তাঁর খিদমতে উপস্থিত হয়েছি যে, তিনি আল্লাহর রাসূল (ﷺ)। আজ তাঁকে নিয়ে যাওয়ার অর্থ সমস্ত আরববাসীর সঙ্গে শত্রুতা, তলোয়ারের আঘাতে তোমাদের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের হত্যা এবং ধন-সম্পদের অসামান্য ক্ষয়-ক্ষতি। অতএব, যদি এ সব সহ্য করতে পার তবে তাকে নিয়ে চল। এ সবের বিনিময়ে আল্লাহর সমীপে তোমাদের জন্য যে মহা পুরষ্কারের ব্যবস্থা রয়েছে তা হচ্ছে ‘জান্নাত’’। আর যদি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চাইতে এ সব কিছুই তোমাদের নিকট অধিক প্রিয় হয় তবে এখনই তাঁকে ছেড়ে দাও। এটাই হবে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য ওজর বা আপত্তি।[2]
[2] মুসনদে আমেদ।
বাইআতের শর্ত বা দফাসমূহ পূর্বেই নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর ভয়াবহ দিক গুলো সম্পর্কে একবার ব্যাখ্যাও প্রদান করা হয়েছিল। যখন এ অতিরিক্ত সতর্কতার কথা বলা হল তখন লোকেরা সমস্বর বলে উঠলেন, ‘আস’আদ বিন যুরারাহ! নিজ হাত হটাও। আল্লাহর কসম! আমরা এ অঙ্গীকার ছাড়তে কিংবা ভঙ্গ করতে পারি না।[1] উপস্থিত জনতার এ উত্তরে আস’আদ বিন যুরারাহ ভালভাবে ওয়াকিফহাল হওয়ার সুযোগ লাভ করলেন যে, লোকেরা আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর জন্য কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছেন। প্রকৃত পক্ষে আস’আদ বিন যুরারাহ মুসআব বিন উমায়েরের সাথে একযোগে মদীনায় ইসলাম প্রচার কার্যে লিপ্ত ছিলেন এবং সব চেয়ে বড় মুবাল্লেগ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায় যে, তিনি অঙ্গীকার গ্রহণকারীদের ধর্মীয় নেতাও ছিলেন। ফলে তিনিই সর্বপ্রথম অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন। এ জন্য ইবনে ইসহাক্বের বর্ণনায় রয়েছে যে, বনু নাজ্জার বলেছেন আবূ উমামা আস’আদ বিন যুরারাহ সর্ব প্রথম মানুষ যিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিলেন।[2] এরপর সাধারণ অঙ্গীকার অুনষ্ঠিত হয়। জাবির (রাঃ)-এর বর্ণনায় রয়েছে যে, আমরা একে একে দাঁড়ালাম আর নাবী কারীম (ﷺ) আমাদের থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন। আর এর বিনিময়ে জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করলেন।[3]
অবশিষ্ট রইলেন দুজন মহিলা যাঁরা সেখানেই উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের শপথ হল মৌখিক। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনও কোন পরস্ত্রীর সঙ্গে করমর্দন করেন নাই।[4]
[2] ইবনে ইসহাক্বের বর্ণনায় রয়েছে যে, বুন আব্দুল্ আশহাল বলেছেন সর্ব প্রথম অঙ্গীকার গ্রহণ করেন আবুল হাইশাম বিন তায়্যেহান। কা‘ব বিন মালিক বলেছেন যে, বারা বিন মা’রুর প্রথম অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। ইবনে হিশাম ১/৪৪৭ পৃঃ। আমার ধারনায় সম্ভবতঃ আবুল হাইশাম ও বারার সাথে বাইআতের পূর্বে যে কথাবার্তা হয়েছিল তাকেই মানুষ অঙ্গীকার বলে ধরে নিয়েছে। অন্যথায় এ সময় সর্বপ্রথম আগে যাওয়ার অধিকতর অধিকার আস’আদ বিন যুরারারই বয়েছে। আল্লাহই ভাল জানেন।
[3] মুসনাদে আহমাদ।
[4] সহীহুল মুসলিম বাবু কাইফিয়াতে বাইআতিন নিসা ২/ ১৩১ পৃঃ।
অঙ্গীকার পর্ব সম্পন্ন হলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অঙ্গীকারাবদ্ধ লোকদের মধ্যে থেকে বারোজন নেতা নির্বাচন করলেন। নির্বাচিত ব্যক্তিগণ নিজ নিজ সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন এবং আপন আপন সম্প্রদায়ের মধ্যে অঙ্গীকারের ধারাসমূহ বাস্তবায়ণের ব্যাপারে জিম্মাদারী ও দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর এরূপ ইঙ্গিত ছিল যে, নিজেদের মধ্যে থেকে তাঁরা এমন সব নেতা নির্বাচন করবেন যাঁরা নিজ নিজ সম্প্রদায়ের সমস্যাবলী সমাধানের ব্যাপারে যথোপযোগী ভূমিকা পালন করবেন। তাঁর ইঙ্গিতে তড়িঘড়ি নেতা নির্বাচন পর্ব সমাপ্ত হল। নয়জন খাযরাজ এবং তিন জন আউস গোত্র থেকে মোট বারজন নেতা নির্বাচন করা হল। খাযরাজ গোত্রের নেতাগণের নাম হচ্ছে যথাক্রমেঃ
(১) আস’আদ বিন যুরারাহ বিন আদাস (২) সা’দ বিন রাবী’আহ বিন ‘আমর (৩) আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহাহ বিন সা’লাবাহ (৪) রাফি বিন মালিক বিন আজলান (৫) বারা বিন মা’রুর বিন সাখর (৬) আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর বিন হারাম (৭) উবাদা বিন সামিত বিন ক্বায়স (৮) সা‘দ বিন উবাদাহ বিন অইম (৯) মুনযির বিন ‘আমর বিন খুনাইস।
আউস গোত্রের নেতাগণ হচ্ছেন, (১) উসাইদ বিন হুযাইর বিন সামাক (২) সা’দ বিন খায়সামা বিন হারিস এবং (৩) রিফাআ’হহা বিন আব্দুল মুনযির বিন যুবাইর।[1]
যখন এ সকল নেতার নির্বাচন পর্ব সমাপ্ত হল তখন নাবী কারীম (ﷺ) তাঁদের নিকট থেকে পুনরায় অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন, ঈসা (আঃ)-এর পক্ষ যেভাবে হাওয়ারীগণের উপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল সেভাবে আজ থেকে আপনাদের উপর আপন আপন সম্প্রদায়ের যিম্মাদারী বা দায়িত্ব অর্পিত হল। আর আমার উপর যিম্মাদারী বা দায়িত্ব ভার রইল সমগ্র মুসলিম জাতির। তাঁরা সকলে এক বাক্যে বলে উঠলেন ‘জী হ্যাঁ’’।[2]
[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৪৩-৪৪৬ পৃঃ।