ওফাত প্রাপ্তির চার দিনে পূর্বে বৃহস্পতিবার যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কঠিন রোগযন্ত্রণার সম্মুখীন হলেন তখন বললেন,

(‏هَلُمُّوْا أَكْتُبُ لَكُمْ كِتَاباً لَنْ تَضِلُّوْا بَعْدَهُ)

‘তোমরা আমার নিকট কাগজ কলম নিয়ে এসো, আমি তোমাদের জন্য একটি নোট লিখে দেই যাতে তোমরা আমার পরে কোন দিনই পথভ্রষ্ট হবে না’।

ঐ সময় ঘরে কয়েক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন উমার (রাঃ), তিনি বললেন, ‘আপনার উপর রোগ যন্ত্রণার প্রাধান্য রয়েছে এবং আমাদের নিকট আল্লাহর কিতাব কুরআন রয়েছে। আল্লাহর কিতাব কুরআন আমাদের জন্য যথেষ্ট’- এ নিয়ে কথা কাটাকাটি করতে লাগলেন। কেউ কেউ বললেন, ‘কাগজ কলম আনা হোক এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা বলবেন তা লিখে নেয়া হোক।’ অন্যেরা উমার (রাঃ)-এর মত সমর্থন করলেন। লোকজনদের মধ্যে যখন এভাবে কথা কাটাকাটি চলতে থাকল তখন নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‏(‏قُوْمُوْا عَنِّيْ‏)‏‏ ‘আমার নিকট থেকে তোমরা উঠে যাও’।[1]

অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ) সে দিনটিতে উপদেশ প্রদান করলেন। এর প্রথমটি হচ্ছে,‘ইহুদী, নাসারা এবং মুশরিকদেরকে আরব উপদ্বীপ হতে বহিস্কার করবে। দ্বিতীয়টি হল, ‘প্রতিনিধিদলের সে ভাবেই আপ্যায়ণ করবে যেমনটি (আমার আমলে) করা হতো।’ তৃতীয় উপদেশটি বর্ণনাকারী ভুলে গিয়েছিলেন। তবে সম্ভবত সেটি ছিল আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে ধরে থাকার উপদেশ, অথবা তা ছিল উসামা (রাঃ)-এর বাহিনী কার্যক্রম বাস্তবায়নের উপদেশ, অথবা তা ছিল ‏(‏الصَّلَاةُ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ‏)‏‏ ‘সালাত’ এবং তোমাদের অধীনস্থ অর্থাৎ দাসদাসীদের প্রতি মনোযোগী হওয়ার উপদেশ। কঠিন অসুস্থতা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐ দিন (অর্থাৎ ওফাত প্রাপ্তির চার দিন পূর্বের বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত সকল সালাতেই ইমামত করেন। এ দিবস মাগরিবের সালাতেও তিনি ইমামতি করেন এবং সূরাহ ‘ওয়াল মুরসালাতে উরফা’ পাঠ করেন।[2]

কিন্তু এশা সালাতের সময় অসুস্থতা এতই বৃদ্ধি পেল যে, মসজিদে যাওয়ার মতো শক্তি সামর্থ্য আর তাঁর রইল না। আয়িশা (রাঃ) বলেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিজ্ঞাসা করলেন যে, ‏ (‏أصَلَّى النَّاسُ‏؟‏‏)‏ ‘লোকজনেরা সালাত আদায় করে নিয়েছে? আমি উত্তর দিলাম, ‘না’, হে আল্লাহর রাসূল! তাঁরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‏(‏ضَعُّوْا لِيْ مَاءً فِي الْمِخْضَبِ‏) ‘আমার জন্য বড় পাত্রে পানি দাও।’ তাঁর চাহিদা মোতাবেক পানি দেয়া হলে তিনি গোসল করলেন। অতঃপর দাঁড়াতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না, অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। জ্ঞান ফিরে পেলে তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‏(‏أَصَلَّى النَّاسُ‏؟‏‏) ‘লোকেরা কি সালাত আদায় করেছে? উত্তর দিলাম, ‘না’, হে আল্লাহর রাসূল! তাঁরা আপনার জন্য অপেক্ষামান রয়েছেন।’

অতঃপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় বারেও তিনি একইরূপ করলেন, যেমনটি প্রথমবার করেছিলেন, অর্থাৎ গোসল করলেন এবং দাঁড়াতে চাইলেন কিন্তু পারলেন না।, অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। অবশেষে তিনি আবূ বাকর (রাঃ)-কে বলে পাঠালেন সালাতে ইমামত করার জন্য। এ প্রেক্ষিতে আবূ বাকর (রাঃ) ঐ দিনগুলোতে সালাতে ইমামত করেন।[3] নাবী কারীম (ﷺ)-এর পবিত্র জীবদ্দশায় আবূ বাকর (ﷺ)-এর ইমামতে সালাতে সংখ্যা ছিল সতের ওয়াক্ত।

আয়িশাহ (রাঃ) তাঁর পিতা আবূ বাকর (রাঃ)-এর পরিবর্তে অন্য কারো উপর ইমামতের দায়িত্ব অর্পণের জন্য নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট তিন কিংবা চারবার অনুরোধ জানিয়েছেন। তাঁর এ অনুরোধের উদ্দেশ্য ছিল লোকেরা যেন তাঁর পিতা সম্পর্কে কোন প্রকার খারাপ ধারণা পোষণের কোন অবকাশ বা সুযোগ না পায়। কিন্তু নাবী কারীম (ﷺ) প্রত্যেকবারই তা অস্বীকার করে বললেন, (‏إِنَّكُنَّ لَأَنْتُنَّ صَوَاحِبَ يُوْسُفَ، مُرُّوْا أَبَا بَكْرٍ فَلْيُصَلِّ بِالنَّاسِ‏) ‘তোমরা সকলেই ইউসুফ (আঃ)-এর সঙ্গীসাথীদের মতোই হয়ে গিয়েছ।[4] সালাতে ইমামতি করার জন্য আবূ বাকর (রাঃ)-কে নির্দেশ দাও।’[5]

[1] বুখারী, মুসলিম, সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ২২ পৃ: ৪২৯, ৪৪৯ পৃ: ২য় খন্ড ৬৩৮ পৃঃ।

[2] সহীহুল বুখারী উম্মুল ফযল হতে নাবী (সাঃ)-এর অসুখ অধ্যায় ২য় খন্ড ৬৩৭ পৃঃ।

[3] বুখারী ও মুসলিমের সম্মিলিত বর্ণনা, মিশকাত ১ম খন্ড ১০২ পৃঃ।

[4] ইউসুফ (আঃ)-এর ব্যাপারে যে মহিলাগণ আযীয মিসরের স্ত্রীকে ভাল মন্দ বলেছিল যা প্রকাশ্যে তার নিন্দনীয় কাজ কর্মের রূপ প্রকাশ করছিল। কিন্তু ইউসুফ (আঃ)-কে দেখে যখন তারা নিজ নিজ আঙ্গুল কাটল তখন বুঝা গেল যে, মুখে বললেও প্রকৃতপক্ষে মনে মনে তারাও তাঁর প্রতি আসক্ত হয়েছে। এর অনুরূপ ব্যাপার এখানেও ছিল। রাসূলে কারীম (সাঃ)-কে প্রকাশ্যে বলা হচ্ছিল যে, আবূ বকর (রাঃ) নরম অন্তকরণের মানুষ, আপনার স্থানে যখন দাঁড়াবেন তখন তাঁর পক্ষে কেরাত করা সম্ভব হবে না, কিন্তু তাঁদের অন্তরে একথা নিহিত ছিল যে, (আল্লাহ না করুন) এ অসুখের কারণে যদি নাবী কারীম (সাঃ)-এর পবিত্র জিন্দেগীর পরিসমাপ্তি ঘটে তাহলে আবূ বকর (রাঃ) সম্পর্কে মানুষের অন্তরে অমঙ্গলজনক এবং অশুভ ধারণার সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, আয়িশা (রাঃ)-এর অনুরোধের কণ্ঠের সঙ্গে অন্যান্য বিবিগণের কণ্ঠও মিলিত ছিল। এ কারণেই নাবী কারীম (সাঃ) বললেন, তোমরা সকলেই আযীযে মিসরের স্ত্রী ও তার সহচরীবৃন্দের মতই বলছ। অর্থাৎ তোমাদের অন্তরে রয়েছে এক কথা কিন্তু প্রকাশ করছ অন্য কথা।

[5] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৯৯ পৃঃ।