সাহাবীগণ (রাঃ) যখনই অবগত হলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রুমীগণের বিরুদ্ধে উত্তম যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন, তখনই তাঁরা পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন গোত্র এবং মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনেরা মদীনায় সমবেত হতে আরম্ভ করে দিলেন। যাদের অন্তরে কপটতা ছিল তারা ব্যতীত কোন মুসলিমই এ যুদ্ধের ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকার কথাটা ঘুণাক্ষরেও মনে ঠাঁই দেন নি। তবে তিন জন মুসলিম এ নির্দেশের বাইরে ছিলেন। নিষ্ঠাবান ঈমানদার হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন নি।
পক্ষান্তরে অবস্থা এই ছিল যে, গরীব ও অসহায় ব্যক্তিবর্গ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করতেন যে, তাঁদের জন্য সওয়ারীর ব্যবস্থা করা হলে তাঁরাও যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেন। নাবী কারীম (ﷺ) যখন তাঁদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতেন যে,
(لاَ أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ تَوَلَّواْ وَّأَعْيُنُهُمْ تَفِيْضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَنًا أَلاَّ يَجِدُوْا مَا يُنفِقُوْنَ) [التوبة:92]
‘তাদের বিরুদ্ধেও কোন অভিযোগ নেই যারা তোমার কাছে যখন বাহন চাওয়ার জন্য এসেছিল তখন তুমি বলেছিলে, ‘আমি তো তোমাদের জন্য কোন বাহন পাচ্ছি না’। তখন তারা ফিরে গেল, আর সে সময় তাদের চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ছিল- এ দুঃখে যে, ব্যয় বহন করার মত কোন কিছু তাদের ছিল না।’ [আত্-তাওবাহ (৯) : ৯২]
যুদ্ধ প্রস্তুতির প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে মুসলিমগণের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। পরস্পর পরস্পরের তুলনায় সাদকা এবং দান-খয়রাত করতে পারে কে কত বেশী আল্লাহর রাহে। সেই সময় উসমান বিন আফফান শাম রাজ্যের উদ্দেশ্যে এমন একটি বাণিজ্য কাফেলা প্রস্তুত করছিলেন যার মধ্যে ছিল পালান ও গদিসহ দু’শ উট এবং দু’শ উকিয়া রৌপ্য (যার ওজন ছিল প্রায় ঊনত্রিশ কেজি)। এর সব কিছুই তিনি সাদকা করে দেন যুদ্ধের জন্য। এর পর তিনি হাওদাসহ আরও একশ উট দান করেন। এর পরও পুনরায় তিনি এক হাজার (আনুমানিক সাড়ে পাঁচ কেজি ওজনের) স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে এসে নাবী কারীম (ﷺ)-এর কোলের উপর ঢেলে দেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বর্ণমুদ্রাগুলো উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, ‘আজকের পর উসমান যা কিছু করবে তাতে তার কোনই ক্ষতি হবে না। এর পরও উসমান আবার দান করেন এবং আরও সাদকা করেন। এমন কি তাঁর দানকৃত জিনিসের পরিমাণ নগদ অর্থ বাদে নয়শ উট এবং একশ ঘোড়া পর্যন্ত পৌছেছিল।[1]
অন্যদিকে আব্দুর রহমান বিন আওফ (রাঃ) দু’শ উকিয়া রৌপ্য (যার ওজন ছিল প্রায় সাড়ে ঊনত্রিশ কেজি) নিয়ে এলেন এবং আবূ বাকর (রাঃ) তাঁর সমস্ত সম্পদ নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে এনে সমর্পণ করলেন। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ছাড়া তাঁর পরিবারবর্গের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। তাঁর দানের পরিমাণ ছিল চার হাজার দিরহাম এবং নাবী কারীম (ﷺ) সমীপে দান সামগ্রী আনার জন্য তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি। উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) দান করেন তাঁর অর্ধেক সম্পদ। আব্বাস (রাঃ) অনেক সম্পদ নিয়ে আসেন। ত্বালহাহ (রাঃ), সা‘দ বিন অবী ওয়াক্কাস (রাঃ) এবং মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ যথেষ্ট অর্থ নিয়ে আসেন। ‘আসিম বিন আদী নব্বই অসাক (অর্থাৎ সাড়ে তের হাজার কেজি) খেজুর নিয়ে হাজির হন। অন্যান্য সাহাবীগণও কম বেশী দান খয়রাতের বিভিন্ন দ্রব্য নিয়ে আসেন। এমনকি কেউ কেউ এক মুঠ দু’ মুঠ যার নিকট যা ছিল তাই দান করেন। কারণ, এর বেশী দান করার ক্ষমতা তাঁদের ছিল না। মহিলাগণ গলার মালা, হাতের চুড়ি, পায়ের অলংকার, কানের রিং, আংটি ইত্যাদি যার যা ছিল তা নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে কেউ কৃপণতা করেন নি এবং এমন কোন হাত ছিল না যে হাত কিছুই দান করে নি। শুধু মুনাফিক্বগণ দান খয়রাতে অংশ গ্রহণ করে নি। শুধু তাই নয়, যে সকল মুসলিম দান খয়রাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, কথাবার্তায় তাঁদের খোঁচা দিতে তারা ছাড়েনি। যাঁদের শ্রম ছাড়া অন্য কিছুই দেবার মতো ছিল না, তাঁদের ঠাট্টা বিদ্রূপ করে বলল, ‘একটা দু’টা খেজুর দিয়েই এরা রোমক সাম্রাজ্য জয়ের স্বপ্ন দেখছে। (৯ : ৭৯)।
(الَّذِيْنَ يَلْمِزُوْنَ الْمُطَّوِّعِيْنَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ فِيْ الصَّدَقَاتِ وَالَّذِيْنَ لاَ يَجِدُوْنَ إِلاَّ جُهْدَهُمْ فَيَسْخَرُوْنَ مِنْهُمْ)[التوبة: 79]
‘মু’মিনদের মধ্যে যারা মুক্ত হস্তে দান করে, তাদেরকে যারা দোষারোপ করে আর সীমাহীন কষ্টে দানকারীদেরকে যারা বিদ্রূপ করে, আল্লাহ তাদেরকে বিদ্রূপ করেন আর তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি।’ আত্-তাওবাহ (৯) : ৭৯]