আর-রাহীকুল মাখতূম হুনাইন যুদ্ধ (غَزْوَةُ حُنَيْنٍ) আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ) ১ টি
ইসলামী সৈন্যদের উপর হঠাৎ তীর নিক্ষেপ (الْجَيْشُ الْإِسْلَامِيْ يُبَاغَتْ بِالرَّمَاةِ وَالْمُهَاجِمِيْنَ):

মঙ্গলবার ও বুধবার পথ চলার পর ১০ই শাওয়াল মধ্য রাত্রি মুসলিম বাহিনী হোনাইনে গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু মালিক বিন আওফ পূর্বেই তার বাহিনী নিয়ে সেখানে অবতরণ করে এবং রাতের অন্ধকারে অত্যন্ত সঙ্গোপনে তারা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটকে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে মোতায়েন করে দেয়। অধিকন্তু, তাদের এ নির্দেশও প্রদান করা হয় যে, মুসলিম বাহিনী উপত্যকায় অবতরণ করা মাত্রই যেন প্রবলভাবে তাদের উপর তীর নিক্ষেপ করে তাদের ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলা হয় এবং একযোগে তাদের উপর আক্রমণ চালানো হয়।

এদিকে সাহরীর সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সৈন্যদের শ্রেণী বিন্যাস করে নিলেন এবং পতাকা বেঁধে লোকজনের মধ্যে বিতরণ করলেন। অতঃপর সকালে মুসলিম বাহিনী দ্রুততার সঙ্গে অগ্রসর হয়ে হুনাইন উপত্যকায় উপস্থিত হলেন। শত্রুদের অবস্থান সম্পর্কে তাঁদের জানা ছিল না। তাঁরা জানতেন না যে, শত্রুপক্ষের সাক্বীফ ও হাওয়াযিন গোত্রের বীর সৈনিকগণ এ উপত্যকায় সংকীর্ণ গিরিপথে অবস্থান গ্রহণ করেছে অগ্রসরমান মুসলিম বাহিনীর উপর অতর্কিতভাবে আঘাত হানার উদ্দেশ্যে। এ কারণে সম্পূর্ণ নিরুদ্বিগ্ন চিত্তেই তাঁরা সেখানে অবতরণ করছিলেন। এমন সময় আকস্মিকভাবে তাঁদের তীর বর্ষণ শুরু হয়ে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই শত্রু দলে দলে তাঁদের উপর এক যোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আকস্মিক এ আক্রমণের প্রচন্ডতা সামলাতে না পেরে মুসলিম বাহিনী ছত্রভঙ্গ অবস্থায় এমনভাবে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে থাকল যে কেউ কারো প্রতি লক্ষ্য করল না। এ ছিল এক পর্যুদস্ত অবস্থা এবং অবমাননাকর পরাজয়। এমন কি আবূ সুফইয়ান বিন হারব (যিনি নতুন মুসলিম হয়েছিলেন) বললেন, ‘এখন তাদের দৌড়াদৌড়ি সমুদ্রের আগে থামবে না। জাবালাহ অথবা কালাদাহ বিন হাম্বাল চিৎকার করে বললেন, ‘দেখ, জাদু বাতিল হয়ে গেল।’

যাহোক, যখন দৌড় ঝাঁপ অরম্ভ হয়ে গেল তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ডান দিক থেকে উচ্চৈঃস্বরে ডাক দিলেন, ‘ওহে লোকজনেরা! আমার দিকে এসো, আমি মুহাম্মাদ (ﷺ) বিন আব্দুল্লাহ। ঐ সময় কিছু সংখ্যক মুহাজির এবং পরিবারের লোকজন ছাড়া অন্য কেউ তাঁর সঙ্গে ছিলেন না।[1]

ইবনু ইসহাক্বের বর্ণনামতে তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র নয় জন। আর ইমাম নাবাবী মতানুসারে তাদের সংখ্যা ছিল বার জন। বিশুদ্ধ কথা সেটাই যা ইমাম আহমাদ ও হাকিম তাঁর মুসতাদরাকে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, হুনাইন যুদ্ধে আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে ছিলাম। লোকেরা সব পালিয়ে গেল এমতাবস্থায় তাঁর সাথে আনসার ও মুহাজির মিলে মাত্র আশি জন্য অবশিষ্ট ছিল। আমরা সবাই দৃঢ়পদে যুদ্ধ করলাম এবং আমাদের কেউ পলায়ন করেনি’।

ইমাম তিরমিযী হাসান সূত্রে ইবনু ‘উমার হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আমরা দেখলাম যে, লোকেরা হুনাইন ছেড়ে পলায়ন করছে। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে রয়েছেন তিনশত সাহাবা (রাঃ)।

উল্লেখিত সংকটপূর্ণ সময়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে তেজোদীপ্ততা ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন তার কোন তুলনা ছিল না। মুসলিম বাহিনীর ইতস্তত বিক্ষিপ্ততা এবং দৌঁড় ঝাঁপের মুখেও তিনি ছিলেন অচল অটল ও শত্রু অভিমুখী এবং সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার জন্য তাঁর খচ্চরকে উত্তেজিত করতে থাকেন। এ সময় তিনি বলতেছিলেন

‏(‏أنــا النبي لا كَذِبْ ** أنا ابن عبد المطلب‏)‏

অর্থ : আমি সত্যই নাবী, মিথ্যা নই, আমি আব্দুল মুত্তালিবের পৌপুত্র।

কিন্তু সে সময় আবূ সুফইয়ান বিন হারিস (রাঃ) নাবী কারীম (ﷺ)-এর খচ্চরকে রেকাব ধরে টেনে রেখেছিলেন এবং আব্বাস (রাঃ) খচ্চরের রিক্বা’ব ধরে তাকে থামিয়ে রেখেছিলেন। তাঁরা উভয়েই এ কারণে খচ্চরকে থামিয়ে রেখেছিলেন যেন সে দ্রুতগতিতে এগিয়ে না যায়।

[1] তিরমিযী বাবুল ফিতান, তোমরা পূর্বপুরুষদের নিয়ম মেনে চলবে, ২য় খন্ড ৪১ পৃঃ