আলাপ আলোচনার বিষয়াদি অবহিত হয়ে বনু কিনানাহ গোত্রের হুলাইস বিন আলকামা বলল, ‘আমাকে তাঁর নিকট যেতে দাও।’ লোকজনেরা বলল, ‘বেশ তবে যাও।’
যখন সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে উপস্থিত হল তখন নাবী কারীম (ﷺ) সাহাবীগণ (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বললেন, (هٰذَا فُلاَنٌ، وَهُوَ مِنْ قَوْمٍ يُعَظِّمُوْنَ الْبُدْنَ، فَابْعَثُوْهَا) ‘এ ব্যক্তি এমন এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত যারা হাদ্য়ীর পশুকে অনেক সম্মান করে। অতএব পশুগুলোকে দাঁড় করে দাও।’
সাহাবীগণ (রাযি.) পশুগুলোকে দাঁড় করে দিলেন এবং নিজেরাও লাববায়েক বলে তাকে খুশ আহমেদ জানালেন। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে সে ব্যক্তি আনন্দে বিভোর হয়ে বলে উঠল, ‘সুবহানাল্লাহ! এ সকল লোককে আল্লাহর ঘর হতে বিরত রাখা কোন মতেই সমীচীন হবে না।’ এ কথা বলেই সে তার সঙ্গীদের নিকট ফিরে গেল।
ফিরে গিয়ে সে কুরাইশগণের নিকট বলল, ‘আমি হাদয়ীর পশু দেখে এলাম যাদের গলায় হার দেওয়া আছে এবং পৃষ্ঠদেশ চিরে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য আল্লাহর ঘর থেকে তাদের নিবৃত্ত রাখা আমি সমীচীন মনে করছি না।’ তার এ সকল কথার প্রেক্ষাপটে কুরাইশ লোকজন ও তার মধ্যে এমন কিছু বাক্য বিনিময় হয়ে গেল যার ফলে সে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
এমন সময় উরওয়া বিন মাসউদ সাক্বাফী হস্তক্ষেপ করল এবং বলল, ‘ঐ ব্যক্তি (মুহাম্মাদ (ﷺ)) তোমাদের নিকট একটি ভাল প্রস্তাব দিয়েছে। তোমরা তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করে নাও এবং আমাকে তাঁর নিকট যেতে দাও।’’
লোকজনেরা তাকে যাওয়ার অনুমতি দিলে সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে কথোপকথন আরম্ভ করল। আলোচনায় নাবী কারীম (ﷺ) তাকে সে সব কথাই বললেন, যা তিনি বুদাইলকে বলেছিলেন। প্রত্যুত্তরে উরওয়া বলল, ‘হে মুহাম্মাদ (ﷺ)! যদি আপনি নিজ জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেন তবে কি আপনার পূর্বের কোন আরব সম্পর্কে শুনেছেন যে, সে নিজ জাতিকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে? আর যদি দ্বিতীয় অবস্থা ঘটে যায় তবে আল্লাহর কসম! আমি এমন কতগুলো মূর্খ ও লম্পট দেখছি যারা আপনাকে ছেড়ে পলায়ন করবে।’
এ কথা শুনে আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, ‘লাতের লজ্জাস্থানের ঝুলন্ত চর্ম চুষতে থাক, আমরা নাবী (ﷺ)-কে ছেড়ে পলায়ন করব?
উরওয়া বলল, ‘এ লোকটি কে?’
লোকজনেরা বলল, ‘তিনি আবূ বাকর।’
সে আবূ বাকরকে সম্বোধন করে বলল, ‘দেখ, সেই সত্তার কসম! যাঁর হাতে রয়েছে আমার জীবন যদি এমন ব্যাপার না হতো যে, তুমি আমার একটি উপকার করেছিলে এবং আমি তার প্রতিদান দিতে পারি নি, তবে অবশ্যই এর জবাব আমি দিয়ে দিতাম।’
এরপর উরওয়া পুনরায় নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে কথোপকথন শুরু করল এবং আলাপ-আলোচনা চলা অবস্থায় বার বার নাবী কারীম (ﷺ)-এর দাড়ি মুবারক ধরে নিচ্ছিল। মুগীরা বিন শো‘বা নাবী কারীম (ﷺ)-এর মাথার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর হাতে ছিল একটি তরবারী। আলোচনার সময় উরওয়া যখন নাবী কারীম (ﷺ)-এর দাড়ি মুবারকের দিকে হাত বাড়াত তখন তিনি তরবারীর হাতল দ্বারা তার হাতে আঘাত করতেন এবং বলতেন, নাবী কারীম (ﷺ)-এর দাড়ি মুবারক হতে হাত দূরে রাখ।’
অবশেষে উরওয়া নিজ মস্তক উত্তোলন করে বলল, ‘এ লোকটি কে?’
লোকেরা বলল, মুগীরাহ বিন শো‘বা। তাতে সে বলল, ‘অঙ্গীকার ভঙ্গকারী! আমি কি তোমার অঙ্গীকার ভঙ্গের ব্যাপারে দৌঁড় ঝাঁপ করছিনা?’’
প্রকৃত ঘটনাটি হচ্ছে জাহেলীয়াত যুগে মুগীরা (রাঃ) কিছু সংখ্যক লোকের সঙ্গে ছিলেন। কোন এক অবস্থায় তিনি সঙ্গী সাথীদের হত্যা করেন এবং তাদের ধন সম্পদ নিয়ে পলায়ন করেন। অতঃপর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নাবী কারীম (ﷺ) বলেছিলেন,أَمَّا الْإِسْلاَمُ فَأَقْبَلُ، وَأَمَّا الْمَالُ فَلَسْتَ مِنْـُهُ فِـْي شَيْءٍ وَكَانَ الْمُغِيْرَةُ اِبْنُ أَخِيْ عُرْوَةَ ‘তুমি তো ইসলাম গ্রহণ করছ কিন্তু তোমার ধন সম্পদের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক থাকবে না। এ ব্যাপারে উরওয়ার দৌঁড় ঝাঁপ করার কারণ ছিল, মুগীরাহ (রাঃ) ছিলেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র।
এরপর উরওয়া নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে সাহাবায়ে কেরামের সম্পর্ক সৌকর্যের ক্ষেত্রে আন্তরিকতার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে থাকল। অতঃপর সে স্বগোত্রীয় লোকজনদের নিকট ফিরে এসে বলল, ‘হে গোত্রীয় ভ্রাতৃবর্গ! আল্লাহর কসম! আমি কায়সার ও কিসরা এবং নাজ্জাসীদের সম্রাটের দরবারে গিয়েছি, আল্লাহর কসম! আমি কোন সম্রাটকে দেখি নি যে, তাঁর অনুসারী বা সঙ্গীসাথীগণ তাঁর এতটুকু সম্মান করছে মুহাম্মাদ (ﷺ)- কে তাঁর সাহাবাবর্গ যত বেশী সম্মান করছে। আল্লাহর কসম! তিনি যখন থু-থু ফেলছেন তখন যে কেউ তা হাতে নিয়ে আপন মুখমণ্ডলে কিংবা শরীরে তা মেখে নিচ্ছেন। যখন তিনি কোন কাজের নির্দেশ প্রদান করছেন তখন তা বাস্তবায়নের জন্য সকলের মধ্যেই তৎপরতা শুরু হয়ে যাচ্ছে। যখন তিনি অযু করছেন তখন মনে হচ্ছে যেন তাঁর ব্যবহৃত পানির জন্য লোকেরা যুদ্ধ শুরু করে দেবে। যখন তিনি কোন কথা বলছেন তখন সকলের কণ্ঠস্বর নীচু হয়ে যাচ্ছে। তাঁর সম্মানের খাতিরে সাহাবীগণ কখনই তাঁর প্রতি পূর্ণভাবে দৃষ্টিপাত করেন না। নিশ্চয়ই তাঁর মধ্যে এমন গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছে যার ফলে সাহাবীগণ তাঁকে এতটা শ্রদ্ধা করছেন। তিনি তোমাদের জন্য একটি উত্তম প্রস্তাব দিয়েছেন। তোমাদের উচিত তা গ্রহণ করে নেয়া।’