আহযাব ও বনু কুরাইযাহ সংকট থেকে মুক্ত হওয়ার পর এটাই ছিল প্রথম অভিযান। ত্রিশ জন মর্দে মু’মিনের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল এ অভিযাত্রী দলটি। এ অভিযান পরিচালনার্থে অভিযাত্রী দলটি প্রেরিত হয়েছিলেন নাজদের অভ্যন্তর ভাগে বাকারাত অঞ্চলে যারিয়ার পার্শ্ববর্তী ‘ক্বারত্বা’ নামক স্থানে। যারিয়্যাহ এবং মদীনার অবস্থান ছিল সাত রাত্রি দূরত্বের ব্যবধানে। অভিযাত্রীগণের এ অভিযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ৬ষ্ঠ হিজরীর ১০ই মুহাররম। তাদের লক্ষ্যস্থলে ছিল বনু বাকর বিন কিলাব গোত্রের একটি শাখা।
মুসলিমগণ অতর্কিত শত্রুদের আক্রমণ করলে তারা হতকচিত ও বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে এবং পলায়ন করে। তাদের পরিত্যক্ত ধন সম্পদ এবং গবাদি পশুসমূহ মুসলিমগণের হস্তগত হয়। সে সকল ধন সম্পদ এবং গবাদির পাল নিয়ে তাঁরা মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেন। তাঁরা যখন মদীনায় প্রত্যাগমন করেন তখন মুহাররম মাসের মাত্র একদিন অবশিষ্ট ছিল। প্রত্যাবর্তনের সময় তাঁরা বনু হানীফার সরদার সুমামাহ বিন আসাল হানাফীহকেও বন্দী করে নিয়ে আসেন। সে মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের নির্দেশে নাবী কারীম (ﷺ)-কে হত্যা করার জন্য ছদ্মবেশে বাহির হয়েছিল।[1] কিন্তু অভিযানকারী সাহাবীগণ তাকে বন্দী করে নিয়ে আসেন এবং মসজিদে নাবাবীর খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখেন।
এমতাবস্থায় নাবী কারীম (ﷺ) যখন সেখানে আগমন করলেন তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে সুমামাহ! তোমার নিকট কি আছে?’
প্রত্যুত্তরে সে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ (ﷺ)! আমার নিকট (কল্যাণ) ধন-সম্পদ রয়েছে। যদি তুমি আমাকে হত্যা কর তবে প্রকৃতই একজন খুনী আসামীকে হত্যা করবে। আর যদি অনুগ্রহ কর তবে প্রকৃতই একজন গুণগ্রাহী ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ করবে। পক্ষান্তরে যদি ধন-সম্পদ চাও তাহলে যা চাবে তাই পাবে।’ তার মুখ থেকে এ সব কথা শ্রবণের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে ঐ একই অবস্থার মধ্যে রেখে চলে গেলেন।
অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ) যখন দ্বিতীয় বার সেখানে এসে উপস্থিত হলেন তখন উপরোক্ত প্রশ্নগুলোই তাকে জিজ্ঞেস করলেন। সে উত্তরও দিল ঠিক পূর্বের মতোই। এবারও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে একই অবস্থার মধ্যে রেখে চলে গেলেন। এরপর যখন তিনি তৃতীয় বার আগমন করলেন তখনো ঐ একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। সুমামাহ এবারও একই উত্তর প্রদান করলেন। তৃতীয় বার তার মুখ থেকে উত্তর শোনার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবায়ে কেরামকে নির্দেশ প্রদান করলেন তাকে মুক্ত করে দেয়ার জন্য।
তাঁরা তাকে মুক্ত করে দিলে সে মসজিদে নাবাবীর নিকট একটি খেজুর বাগানে গেল। সেখানে গোসল করে পাক সাফ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট ফিরে এসে ইসলাম গ্রহণ করল। অতঃপর বলল, ‘আল্লাহর শপথ! পৃথিবীর বুকে কোন মুখমণ্ডল আপনার মুখমণ্ডলের চাইতে অধিক ঘৃণিত ছিল না, কিন্তু এ মুহূর্তে আমার নিকট আপনার মুখমণ্ডলের চাইতে অধিক প্রিয় মুখমণ্ডল আর পৃথিবীতে নেই। সে আরও বলল, ‘আল্লাহর শপথ! ইতোপূর্বে পৃথিবীর বুকে আপনার প্রচারিত দ্বীন ছিল আমার নিকট সব চাইতে ঘৃণিত, কিন্তু এ মুহূর্তে আপনার দ্বীন আমার নিকট সব চাইতে প্রিয় এবং পবিত্র বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ অভিযানে প্রেরিত অভিযাত্রীগণ আমাকে এমন সময় গ্রেফতার করেছিল যখন আমি উমরাহ পালনের জন্য মনস্থির করছিলাম।
রাসূলে কারীম (ﷺ) তাকে উমরাহ পালনের নির্দেশ এবং শুভ সংবাদ প্রদান করলেন। উমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে যখন সে কুরাইশদের অঞ্চলে পৌঁছিল তখন তারা তাকে বলল, ‘হে সুমামা তুমিও বেদ্বীন হয়ে গিয়েছ?’
সুমামাহ বলল, ‘না, বরং আমি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর হাতে বাই‘আত হয়ে মুসলিম হয়েছি।’ তিনি আরও বললেন, ‘জেনে রাখ, আল্লাহর কসম! ইয়ামামা হতে তোমাদের নিকট গমের একটি দানাও আসবে না, যে পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ ব্যাপারে অনুমতি প্রদান না করবেন।’ ইয়ামামা মক্কাবাসীগণের শস্য ভূমির মর্যাদা রাখত।
সুমামাহ দেশে ফিরে গিয়ে মক্কা অভিমুখী খাদ্যদ্রব্যের চালান বন্ধ করে দিলেন। এর ফলে মক্কাবাসীগণ খাদ্য সংকটজনিত অসুবিধার মধ্যে নিপতিত হলেন। এ প্রেক্ষিতে আত্মীয়তার সূত্র উল্লেখ করে তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এ মর্মে পত্র লিখল যাতে তিনি সুমামাহকে খাদ্যদ্রব্য চালান বন্ধ করা থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। রাসূলে কারীম (ﷺ) সুমামাহকে খাদ্যদ্রব্যের চালান বন্ধ করা থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করলেন।[2]
[2] যা’দুল মাআদ, ২য় খন্ড ১১৯ পৃঃ, শাইখ আব্দুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ ২৯২-২৯৩ পৃঃ।