রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে বিভিন্নমুখী শক্ৰতা (اعتداءات على رسول الله):

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দাওয়াতের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর থেকে তার সম্মান-মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকলো এবং তাদের কাছে বিষয়টা খুব কঠিন হয়ে গেল যে তাদের ধৈৰ্য্যের ভেঙ্গে গেল। তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে শত্রুতার হাতকে প্রশস্ত করে দিল। ফলে তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ, উপহাস, সংশয়-সন্দেহ, বিশৃংখলা সৃষ্টি ইত্যাদি যাবতীয় প্রকার দুর্ব্যবহার শুরু করে দিল। প্রকৃতপক্ষে প্রথম থেকেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি আবূ লাহাবের দৃষ্টিভঙ্গ ছিল অত্যন্ত কঠোর ও কঠিন। সে ছিল বনু হাশিমের অন্যতম নেতা। সে অন্যান্যদের চেয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর ব্যাপারে বেশি ভীত ছিল। সে ও তার স্ত্রী ছিল ইসলামের গোড়ার শত্রু। এমনকি অন্যান্য কুরাইশগণ যখন ঘুণাক্ষরেও নাবী কারীম (ﷺ)-কে নির্যাতন করার চিন্তা-ভাবনা করেন নি তখনে আবূ লাহাবের আচরণ ছিল অত্যন্ত মারমুখী। বনু হাশিমের বৈঠকে এবং সাফা পর্বতের নিকট তিনি যা কিছু করেছিলেন তা ইতোপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় এটা উল্লেখিত হয়েছে যে, সাফা পর্বতের উপর নাবী কারীম (ﷺ)-কে আঘাত করার জন্য তিনি একখণ্ড পাথর হাতে উঠিয়েছিলেন।[1]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর আবূ লাহাব যে কত পৈশাচিকতা ও নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করেছিলেন তার আরও বিভিন্ন প্রমাণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তার ছেলে ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মেয়ের মধ্যকার বিবাহ সম্পর্কোচ্ছেদ। নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দু’মেয়ের সঙ্গে আবূ লাহাব তার দু’ছেলের বিবাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু নবুওয়াত প্রাপ্তির পর অত্যন্ত নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতনের মাধ্যমে তিনি তার দু’ছেলেরই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেন।[2]

তাঁর পাশবিকতার আরও একটি ঘটনা হচ্ছে নাবী কারীম (ﷺ)-এর পুত্র আব্দুল্লাহ যখন মারা যান তখন তিনি (আবূ লাহাব) উল্লাসে ফেটে পড়েন, টগবগিয়ে দৌড়াতে তার বন্ধু-বান্ধবগণের নিকট এ দুঃসংবাদকে শুভ সংবাদরূপে পরিবেশন করেন যে, মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর লেজকাটা (পুত্রহীন) হয়েছে।[3]

অধিকন্তু, ইতোপূর্বে আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখিত হয়েছে যে, হজ্বের মৌসুমে আবূ লাহাব নাবী কারীম (ﷺ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বাজার ও গণজমায়েতে তার পিছনে লেগে থাকতেন এবং জনতার মাঝে অপপ্রচার চালাতেন।

তারিক্ব বিন আব্দুল্লাহ মুহারিবীর বর্ণনায় জানা যায় যে, এ ব্যক্তি নাবী কারীম (ﷺ)-কে শুধু মাত্র মিথ্যা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালিয়েই ক্ষান্ত হন নি, বরং কোন কোন সময় তিনি নাবী (ﷺ)-কে লক্ষ্য করে প্রস্তর নিক্ষেপ করতেন, যার ফলে তার পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত রক্তাক্ত হয়ে যেত।[4]

আবূ লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল (যার নাম আরওয়া) ছিলেন হারব বিন উমাইয়ার কন্যা আবূ সুফইয়ানের বোন। নাবী (ﷺ)-এর প্রতি অত্যাচার ও জুলম ও নির্যাতনে তিনি ছিলেন স্বামীর যোগ্য অংশিদারিণী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিদ্বেষপরায়ণা ও প্রতিহিংসাপরায়ণা মহিলা। এ সকল দুষ্কর্মে তিনি স্বামী থেকে পশ্চাদপদ ছিলেন না। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চলার পথে এবং দরজায় কাঁটা ছড়িয়ে কিংবা পুঁতে রাখতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ দেয়া, কটুক্তি করা, মিথ্যা অপবাদ দেয়া ইত্যাদি নানাবিধ জঘন্য কাজকর্মে তিনি লিপ্ত থাকতেন। তাছাড়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে নানাবিধ ফেৎনা ফাসাদের আগুন জ্বলিয়ে দেয়া এবং উস্কানী দিয়ে ভয়াবহ যুদ্ধের বিভীষিকা সৃষ্টিকরা তাঁর অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এজন্যই আল কুরআনে তাঁকে الحطب (খড়ির বোঝা বহনকারিণী) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

যখন তিনি অবগত হলেন তাঁর এবং তাঁর স্বামীর ব্যাপারে নিন্দাসূচক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খোঁজ করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন মসজিদুল হারামে কাবাহ গৃহের পাশে অবস্থান করছিলেন। আবূ বকর সিদীকও (রা.) তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন। আবূ লাহাব পত্নী যখন এক মুষ্ঠি পাথর নিয়ে বায়তুল হারামে (পবিত্র গৃহে) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সম্মুখভাগে এসে দণ্ডায়মান হলেন তখন আল্লাহ তা’আলা মহিলার দৃষ্টিশক্তি বন্ধ করে দেয়ার কারণে তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দেখতে পেলেন না।

অথচ আবূ বাকর (রাঃ)-কে তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন। তাঁর সামনে গিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, আবূ বাকর তোমার সাথী কোথায়? আমি জানতে পারলাম যে, সে নাকি আমাদের কুৎসা রটনা করে বেড়াচ্ছে? আল্লাহ করে আমি যদি এখন তাকে পেতাম তার মুখের উপর এ পাথর ছুঁড়ে মারতাম। দেখ আল্লাহর শপথ আমি একজন মহিলা কবি। তারপর সে এ কবিতা আবৃত্তি করে শোনাল।[5]

مذمما عصينا ٭ وامره ابينا ٭ ودينه قلينا

অর্থ : আমরা মন্দের অবজ্ঞা করেছি। তার নির্দেশ অমান্য করেছি এবং তাঁর দ্বীনকে (ধর্ম) ঘৃণা এবং নীচু মনে করে ছেড়ে দিয়েছি।

এর পর তিনি সেখান হতে চলে গেলেন। আবূ বাকর (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল। তিনি কি আপনাকে দেখেন নাই?’ আল্লাহর নাবী বললেন, (ما رأتنى لقد أخذ الله ببصرها عنى)

“না, তিনি আমাকে দেখতে পান নি। আল্লাহ তার দর্শন শক্তিকে আমার থেকে রহিত করে দিয়েছিলেন।[6]

আবূ বাকর বাযযারও এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন এবং এর সঙ্গে আরও কিছু কথা সংযোজন করেছেন। তিনি বলেছেন যে, আবূ লাহাব পত্নী আবূ বাকর (রা.)-এর সামনে উপস্থিত হয়ে বললেন, আবূ বাকর! তোমার সঙ্গী আমার বদনাম করেছে। আবূ বাকর (রা.) বললেন, ‘না, এ ঘরের প্রভুর শপথ! তিনি কোন কবিতা রচনা কিংবা আবৃত্তি করেন না। আর না, সে সব তিনি মুখেই আনেন। তিনি বললেন, ‘তুমি সত্যই বলছ’।

এ সব সত্ত্বেও আবূ লাহাব সেই সব লোহমর্ষক ঘটনাবলী ঘটিয়ে চলেছিলেন যদিও তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চাচা ও প্রতিবেশী। উভয়ের ঘর ছিল পাশাপাশি এবং লাগালাগি। এভাবেই তাঁর অন্যান্য প্রতিবেশীগণও তার উপর নির্যাতন চালাতেন।

ইবনে ইসহাক্বের বর্ণনায় রয়েছে যে, যে সকল লোকজনেরা নাবী কারীম (ﷺ)-কে তার বাড়িতে জ্বালা-যন্ত্রণা দিতেন তাদের নেতৃত্ব দিতেন আবূ লাহাব, হাকাম বিন আবিল আস বিন উমাইয়া, উক্ববা বিন আবী মু’আইত্ব , আদী বিন হামরা সাক্বাফী, ইবনুল আসদা হুযালী; এঁরা সকলেই ছিলেন তার প্রতিবেশী। এঁদের মধ্যে হাকাম বিন আবিল আস[7] ব্যতীত কেউই ইসলাম গ্রহণ করেন নাই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর তাদের জুলম নির্যাতনের ধারা ছিল এরূপ, তিনি যখন সালাতে রত হতেন তখন ছাগলের নাড়ি ভূড়ি ও মলমূত্র এমনভাবে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা হতো যে, তা গিয়ে পড়ত তার উপর। উনুনের উপর হাড়ি পাতিল চাপিয়ে রান্নাবান্না করার সময় এমনভাবে আবর্জনাদি নিক্ষেপ করা হতো যে, তা গিয়ে পড়ত হাড়ি পাতিলের উপর। তাদের থেকে নিস্কৃতি লাভের মাধ্যমে তিনি নিবিষ্ট চিত্তে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে তিনি একটি পৃথক মাটির ঘর তৈরি করে নিয়েছিলেন।

যখন তাঁর উপর এ সকল আবর্জনা নিক্ষেপ করা হতো তখন সেগুলো নিয়ে বেরিয়ে দরজায় খাড়া হতেন এবং তাঁদের ডাক দিয়ে বলতেন, يا بنى عبد مناف أي جوار هذا

“ওহে আবদে মানাফ প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর এ কেমন আচরণ।”

তারপর আবর্জনা স্তুপে নিক্ষেপ করে আসতেন।[8]

উক্ববা বিন আবী মু’আইত্ব আরও দুষ্ট প্রকৃতির এবং প্রতি হিংসাপরায়ণ ছিলেন। সহীহুল বুখারীতে আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, ‘একদা নাবী কারীম (আঃ) বায়তুল্লাহর পাশে সালাত আদায় করছিলেন, এমতাবস্থায় আবূ জাহল এবং তার বন্ধুবৰ্গ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এদের মধ্যে কোন এক ব্যক্তি অন্যদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘কে এমন আছে যে, অমুকের বাড়ি থেকে উটের ভূড়ি আনবে এবং মুহাম্মাদ যখন সালাত রত অবস্থায় সিজদায় যাবে তখন তার পিঠের উপর ভূড়িটি চাপিয়ে দিবে। ঐ সময় আরববাসীগণের মধ্যে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি উক্ববা বিন আবী মু’আইত্ব [9] উঠল এবং কথিত ভূড়িটি নিয়ে এসে অপেক্ষা করতে থাকল। যখন নাবী কারীম (ﷺ) সিজদায় গেলেন তখন সেই দুরাচার নরাধম ভুঁড়িটি নিয়ে গিয়ে তার পিঠের উপর চাপিয়ে দিল। আমি সব কিছুই দেখছিলাম, কিন্তু কোন কিছু করার ক্ষমতা আমার ছিল না। হায় যদি আমার মধ্যে তাকে বাচানোর কোন ক্ষমতা থাকত।

আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ আরও বলেন, ‘এর পর তারা দানবীয় আনন্দ ও উত্তেজনায় পরস্পর পরস্পরের গায়ে ঢলাঢলি, পাড়াপাড়ি করে মাতামাতি শুরু করে দিল। মনে হল ওদের জন্য এর চেয়ে বড় আনন্দের ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না। হায় আফসোস! যদি তারা একটু বুঝত যে, কী সর্বনাশের পথ তারা বেছে নিয়েছে’।

একদিকে অর্বাচীনের দল যখন দানবীয় আনন্দ ও নারকীয় কার্যকলাপে লিপ্ত ছিল তখন দুনিয়ার সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মহানাবী মুহাম্মাদ (ﷺ) সিজদারত অবস্থায় বেহেশতী আবেহায়াত পানে বিভোর ছিলেন। কী অদ্ভুত বৈপরীত্য।

নাবী তনয়া ফাত্বিমাহ (রা.) এ দুঃসংবাদপ্রাপ্ত হয়ে দ্রুত সেখানে আগমন করেন এবং ভূঁড়ি সরিয়ে পিতাকে তার নীচ থেকে উদ্ধার করেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শির উত্তোলন করে তিনবার বললেন :

[اللهم عليك بقريش]

হে আল্লাহ! এ কুরাইশদিগকে পাকড়াও কর।”

যখন তিনি আল্লাহর নিকট এ আরয পেশ করলেন তখন তাদের মধ্যে কিছুটা অসুবিধা বোধের সৃষ্টি হল এবং তারা বিচলিত হয়ে পড়ল। কারণ তাদের এ বিশ্বাসও ছিল যে, এ শহরের মধ্যে প্রার্থনা কবুল হয়ে থাকে। তারপর তিনি নাম ধরে কয়েক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও আরজি পেশ করলেনঃ

اللهم عليك بأبى جهل وعليك بعتبة بن ربيعة وشيبة بن ربيعة ووالد بن عتبة وامية بن خلف وعقبة بن ابى معيظ

‘হে আল্লাহ আবূ জাহেলকে, উতবাহহ বিন রাবী’আহকে, শায়বাহ বিন রাবী’আহকে অলীদ বিন উতবাহহকে, উমাইয়া বিন খালাফ এবং উক্ববা বিন মু’আইত্ব কে পাকড়াও কর।’

রাসূলুল্লাহ সপ্তম জনের নাম বলেছিলেন কিন্তু বর্ণনাকারীর তা স্মরণ নেই। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, ‘সেই সত্ত্বার শপথ যার হাতে রয়েছে আমার জীবন! এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যাদের নামে আরজি পেশ করেছিলেন বদর যুদ্ধে নিহত হয়ে কৃয়োর মধ্যে পতিত অবস্থায় আমি তাদের সকলকেই দেখেছি।[10]

উমাইয়া বিন খালাফের এ রকম এক স্বভাব হয়ে গিয়েছিল যে, যখনই সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দেখত তখনই তাঁকে ভর্ৎসনা করত এবং অভিশাপ দিত। এ প্রেক্ষিতে এ আয়াত কারীমা অবতীর্ণ হয় :

وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ

‘প্রত্যেক অভিশাপকারী, ভর্ৎসনাকারী এবং অন্যায়কারীর জন্যই রয়েছে ধ্বংস (আল-হুমাযাহ ১০৪ : ১)

ইবনে হিশাম বলেন যে, ‘হুমাযাহা’ ঐ ব্যক্তি যে প্রকাশ্যে অশ্লীল বা অশালীন কথাবার্তা বলে ও চক্ষু বাঁকা টেড়া করে ইশারা ইঙ্গিত করে এবং ‘লুমাযাহ’ ঐ ব্যক্তি যে অগোচরে লোকের নিন্দা বা বদনাম করে ও তাদের কষ্ট দেয়।[11]

উমাইয়ার ভাই উবাই ইবনে খালফ ‘উক্ববা বিন আবী মু’আইতের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। এক দফা উক্ববা নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট বসে কিছু শুনল। উবাই এ কথা জানতে পেরে তাকে খুব ধমক দিল, তার নিন্দা করল। তার নিকট অত্যন্ত কঠোরতার সঙ্গে কৈফিয়ত তলব করল এবং বলল যে, তুমি গিয়ে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর মুখে থুথু নিক্ষেপ করে এস। শেষ পর্যন্ত উক্ববা তাই করল। উবাই বিন খালফ নিজেই একবার মরা পচা হাড় নিয়ে তা চূৰ্ণ করে এবং জোরে ফূঁ দিয়ে তার রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দিকে উড়িয়ে দেয়।[12]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে নির্যাতনকারী দলের মধ্যে যারা ছিল তাদের অন্যতম হচ্ছে আখনাস বিন শারীক সাক্বাফী। আল কুরআনে তার ৯টি বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণিত হয়েছে। এর মাধ্যমে তার মন মানসিকতা ও কাজকর্ম সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে :

وَلَا تُطِعْ كُلَّ حَلَّافٍ مَّهِينٍ هَمَّازٍ مَّشَّاءٍ بِنَمِيمٍ مَّنَّاعٍ لِّلْخَيْرِ مُعْتَدٍ أَثِيمٍ عُتُلٍّ بَعْدَ ذَٰلِكَ زَنِيمٍ

“তুমি তার অনুসরণ কর না, যে বেশি বেশি কসম খায় আর যে (বার বার মিথ্যা কসম খাওয়ার কারণে মানুষের কাছে) লাঞ্ছিত। - যে পশ্চাতে নিন্দা করে একের কথা অপরের কাছে লাগিয়ে ফিরে, - যে ভাল কাজে বাধা দেয়, সীমালঙ্ঘনকারী, পাপিষ্ঠ, - কঠোর স্বভাব, তার উপরে আবার কুখ্যাত।” (আল-ক্বালাম ৬৮ : ১০-১৩)

আবূ জাহল কখনো কখনো রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এসে কুরআন শ্রবণ করত। কিন্তু তার সে শ্রবণ ছিল নেহাৎই একটি মামুলী ব্যাপার। তার এ শ্রবণের মূলে আন্তরিক বিশ্বাস, আদব কিংবা আনুগত্যের কোন প্রশ্নই ছিল না। সেটাকে কিছুটা যেন তার উদ্ভট খেয়াল বলা যেতে পারে। সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে অশ্লীল কিংবা কর্কশ কথাবার্তার মাধ্যমে কষ্ট দিত এবং আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করত। অধিকন্তু, অন্যায় অত্যাচারের ক্ষেত্রে সফলতা হওয়াটাকে গর্বের ব্যাপার মনে করে গর্ব করতে করতে পথ চলত। মনে হতো সে যেন মহা গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ সম্পাদন করেছে। কুরআন মাজীদের এ আয়াত তার স্পর্কেই অবতীর্ণ হয়েছিল।[13]

فَلَا صَدَّقَ وَلَا صَلَّىٰ

“কিন্তু না, সে বিশ্বাসও করেনি, সলাতও আদায় করেনি।” (আল-ক্বিয়ামাহ ৭৫ : ৩১)

সেই ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রথমদিকে যখন থেকে সালাত পড়তে দেখল তখন থেকে সালাত হতে নিবৃত্ত করার চেষ্টা চালাতে থাকে। এক দফা নাবী কারীম (ﷺ) মাকামে ইবরাহীমের নিকট সালাত পড়ছিলেন এমন সময় সে সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তাকে দেখেই সে বলল, মুহাম্মাদ! আমি কি তোমাকে সালাত পড়া থেকে বিরত থাকতে বলিনি? সঙ্গে সঙ্গে সে নাবী কারীম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ধমকও দিল। নাবী কারীম (ﷺ)-ও ধমকের সুরে তাঁর এ কথার কঠোর প্রতিবাদ করলেন। প্রত্যুত্তরে সে বলল, “হে মুহাম্মাদ। আমাকে কেন ধমকাচ্ছ? আল্লাহর শপথ দেখ এ উপত্যকায় (মক্কায়) আমার বৈঠক সব চেয়ে বড়’। তার উক্তির প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন[14]

فَلْيَدْعُ نَادِيَهُ

“কাজেই সে তার সভাষদদের ডাকুক।” (আল-আলাক্ব ৯৬ : ১৭)

এক বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার জামার বুকের অংশ ধরে জোরে হেঁচকা একটান দিলেন এবং এ আয়াতে কারীমা পাঠ করলেন :

أَوْلَىٰ لَكَ فَأَوْلَىٰ ثُمَّ أَوْلَىٰ لَكَ فَأَوْلَىٰ

“দুর্ভোগ তোমার জন্য, দুর্ভোগ, -তারপর তোমার জন্য দুর্ভোগের উপর দুর্ভোগ।” (আল-ক্বিয়ামাহ ৭৫ : ৩৪-৩৫)

এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহর সেই শত্রু বলতে লাগল, হে মুহাম্মাদ! তুমি আমাকে ধমক দিচ্ছ। আল্লাহর শপথ, তুমি ও তোমার প্রতিপালক আমার কিছুই করতে পারবে না। আমি মক্কার পর্বতের মধ্যে বিচরণকারীদের মধ্যে সব চেয়ে মর্যাদা-সম্পন্ন ব্যক্তি।[15]

তার এ অসার এবং উৎকট অহমিকা প্রকাশের পরও আবূ জাহাল সেসব থেকে নিবৃত্ত হল না। বরং তার অনাচার ও অন্যায় আচরণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েই চলল। যেমনটি সহীহুল মুসলিমে আবূ হুরাইরাহহ (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন যে, এক দফা আবূ জাহল কুরাইশ প্রধানদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘আপনাদের সম্মুখে মুহাম্মাদ (ﷺ) কি স্বীয় মুখমণ্ডলকে ধূলায় লাগিয়ে রাখে? প্রত্যুত্তরে বলা হল, হ্যাঁ”।

এরপর সে আস্ফালন করে বলল, ‘লাত ও উযযার কসম, যদি আমি তাকে পুনরায় সেই অবস্থায় (সালাতরত) দেখি তাহলে গ্ৰীবা পদতলে পিষ্ঠ করে ফেলব এবং মুখমণ্ডল মাটির সঙ্গে আচ্ছা করে ঘর্ষণ দিয়ে মজা দেখিয়ে দিব’।

কিছু দিন পর ঘটনাক্রমে একদিন সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সালাত পড়তে দেখে ফেলে এবং কুরাইশ প্রধানদের নিকট স্বঘোষিত সংকল্প কার্যকর করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু আকস্মিকভাবে পরিলক্ষিত হল যে, অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে সে পশ্চাদপসরণ শুরু করেছে এবং আত্মরক্ষার জন্য অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে দু’হাত নড়াচড়া করে কী যেন এড়ানোর প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

উপস্থিত লোকজন জিজ্ঞাসা করল, ‘ওহে আবূল হাকাম! তোমার কী এমন হল যে, তুমি অমন ধারা ব্যস্ততায় লিপ্ত হয়ে পড়লে? সে উত্তর করল, ‘আমার এবং তার মধ্যে আগুনের এক গর্ত রয়েছে, ভয়াবহ বিভীষিকাময় ও ভীতপ্রদ শিকল রয়েছে’।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, ‘সে যদি আমার নিকট যেত তবে ফেরেশতাগণ তার এক একটা অঙ্গ উঠিয়ে নিয়ে যেতেন।[16]

উপর্যুক্ত বর্ণনা হচ্ছে, মুশরিকগণ (যারা ধারণা করতো তারা আল্লাহর বান্দা এবং তার হারামের অধিবাসী) মুসলমান এবং নাবী কারীম (ﷺ)-এর উপর যেভাবে অবর্ণনীয় অন্যায়, অত্যাচার ও উৎপীড়ন চালিয়ে আসছিল তার সংক্ষিপ্ত চিত্র।

এ রকম ভয়াবহ সংকটময় অবস্থায় এমন যথোচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী ছিল যার মাধ্যমে মুসলমানগণ মুশরিকদের এমন বর্বোরোচিত অত্যাচার হতে রেহাই পেতে পারে। অতএব তিনি (ﷺ) দুটি হিকমতপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যাতে করে সহজ পন্থায় দাওয়াতী কাজ চালানো যায় এবং অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছা যায়। সিদ্ধান্ত দুটি হলো :

১. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরক্বাম বিন আবিল আরক্বাম মুখযুমীর বাড়িকে দাওয়াতী কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং শিক্ষা-প্রশিক্ষণের কেন্দ্র হিসেবে মনোনিত করলেন।

২. নবদীক্ষিত মুসলমানদেরকে হাবশায় হিযরত করার আদেশ করলেন।

[1] তিরমিযী শরীফ।

[2] ফী যিলালিল কুরআন ৩০ খণ্ড ২৮২ পৃঃ, তাফহীমূল কুরআন ৬ষ্ঠ খণ্ড ৫২২ পৃঃ।

[3] তাফহীমূল কুরআন ৬ষ্ঠ খণ্ড ৪৯০ পৃঃ।

[4] জামে তিরমিযী।

[5] মুশরিকগণ ক্রোধাম্বিত হয়ে নবী (সা.)-কে মুহাম্মাদ নামের পরিবর্তে মুযাম্মাম বলতেন যার অর্থ মুহাম্মাদ নামের বিপরীত। মুহাম্মাদ ঐ ব্যক্তি যাঁর প্রশংসা করা হয় এবং মুযামমাম ঐ ব্যক্তি যাকে তিরস্কার করা হয়।

[6] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩৩৫-৩৩৬ পৃঃ।

[7] ইনি উমাইয়া খলীফা মারওয়ান বিন হাকামের পিতা ছিলেন।

[8] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৪১৬ পৃঃ।

[9] সহীহুল বুখারী এবং অন্য বর্ণনায় এর স্পষ্ট বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। দ্রষ্টব্য ১ম ৫৪৩ পৃঃ।

[10] সহীহুল বুখারী, অযু পর্বের ‘যখন কোন নামায়ীর উপর আবর্জনা নিক্ষিপ্ত” অধ্যায় ১ম খণ্ড ৩৭ পৃঃ।

[11] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩৬১-৩৬২ পৃঃ।

[12] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩৫৬ ও ৩৫৭ পৃঃ।

[13] ফী যিলালিল কুরআন ২৯/২১২।

[14] প্রাগুক্ত ৩০ পারা ২০৮।

[15] ফী যিলালিল কুরআন ২৯ পারা ৩১২।

[16] সহীহুল মুসলিম শরীফ।