مُؤْتَلِفٌ مُتَّفِقُ الْخَطِّ فَقَطْ | وَضِدُّهُ مُخْتَلِفٌ فَاخْشَ الْغَلَطْ
‘মু’তালিফ’: যা শুধু লিখায় সাদৃশ্যপূর্ণ, আর তার বিপরীত মুখতালিফ, অতএব ভুল থেকে সাবধান থেকো”। অত্র কবিতায় বর্ণিত ক্রমানুসারে হাদিসের ঊনবিংশ প্রকার মু’তালিফ ও মুখতালিফ। পূর্বে বর্ণিত প্রকার ও এ প্রকার খুব কাছাকাছি। এ প্রকারের সম্পর্কও সনদের সাথে।
مُؤْتَلِفٌ ‘মু’তালিফ’ অর্থ মিলপূর্ণ, এখানে অর্থ লিখায় সাদৃশ্যপূর্ণ। مُختَلِفٌ অর্থ পৃথক, এখানে অর্থ রাবিগণ ও তাদের নামের উচ্চারণ পৃথক। এক বস্তুর যদি অপর বস্তুর সাথে কতক বিষয়ে মিল ও কতক বিষয়ে অমিল থাকে, তাহলে ‘মুতালিফ ও মুখতালিফ’ বলা হয়।
‘মুতালিফ ও মুখতালিফে’র পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রসঙ্গে লেখক বলেন: “একাধিক রাবির নাম লিখায় সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে উচ্চারণ পৃথক হলে ‘মু’তালিফ ও মুখতালিফ’ বলা হয়। আভিধানিকভাবে এ প্রকারকে মু’তালিফ ও মুফতারিক বলা যায়, কারণ মুখতালিফ ও মুফতারিক অর্থ এক।
লেখকের বর্ণনা রীতি থেকে ‘মু’তালিফ ও মুখতালিফ’ দু’প্রকার বুঝে আসে, বিশেষ করে وضِدُّهُ শব্দ এ ধারণাকে শক্তিশালী করে, অথচ উভয় একপ্রকর।
লেখক فَاخْشَ الغَلَطْ বলে ‘ভুল থেকে সতর্ক করেছেন’। কারণ, এ অধ্যায়ে ভুল হওয়া স্বাভাবিক, এতে কিয়াস ও গবেষণার কোনো দখল নেই, যার উপর ভিত্তি করে শুদ্ধ উচ্চারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়। তাই মুহাদ্দিসগণ এ অধ্যায়কে গুরুত্বসহ গ্রহণ করেছেন। উদাহরণত سلام ও سلاَّمদু’টি শব্দ, প্রথম শব্দের উচ্চারণ সালাম, দ্বিতীয় শব্দের উচ্চারণ সাল্লাম, লিখায় পার্থক্য নেই, উচ্চারণে শুধু তাশদীদের পার্থক্য। অনুরূপعُمارة ও عِمارةদু’টি শব্দ, প্রথম শব্দের উচ্চারণ উমারাহ, দ্বিতীয় শব্দের উচ্চারণ ইমারাহ, লিখায় পার্থক্য নেই, উচ্চারণে শুধু কাসরা ও দাম্মার পার্থক্য। অনুরূপحزام ও حرام দু’টি শব্দ, প্রথম শব্দের উচ্চারণ হিযাম, দ্বিতীয় শব্দের উচ্চারণ হারাম, লিখায় শুধু একটি নোকতার পার্থক্য। অনুরূপبَشير ও بُشير দু’টি শব্দ, প্রথম শব্দের উচ্চারণ বাশির, দ্বিতীয় শব্দের উচ্চারণ বুশাইর, লিখায় তফাৎ নেই, উচ্চারণে শুধু ফাতহা ও দাম্মার পার্থক্য। অনুরূপحَميد ও حُميد প্রথম শব্দের উচ্চারণ হামিদ, দ্বিতীয় শব্দের উচ্চারণ হুমাইদ, লিখায় পার্থক্য নেই, উচ্চারণে শুধু ফাতহা ও দাম্মার পার্থক্য। এ শব্দগুলোর লেখার আকৃতি এক, কিন্তু উচ্চারণ ভিন্ন, সচেতন না হলে ভুল হওয়া স্বাভাবিক।
‘মু’তালিফ ও মুখতালিফে’র কয়েকটি অবস্থা:
১. রাবিদের নামের বর্ণ এক, তবে হরকত ও উচ্চারণ পৃথক, যেমন سلام ও سلاَّم দু’টি শব্দ, প্রথম শব্দের উচ্চারণ সালাম, দ্বিতীয় শব্দের উচ্চারণ সাল্লাম। অনুরূপبَشير ও بُشير প্রথম শব্দের উচ্চারণ বাশির, দ্বিতীয় শব্দের উচ্চারণ বুশাইর। অনুরূপحَميد ও حُميد প্রথম শব্দের উচ্চারণ হামিদ, দ্বিতীয় শব্দের উচ্চারণ হুমাইদ ইত্যাদি। এসব নামের বর্ণ ও আকৃতিতে কোনো পরিবর্তন নেই, তবে হরকত ও উচ্চারণ ভিন্ন।
২. রাবিদের নামের বর্ণের আকৃতি এক, কিন্তু নোকতা পৃথক, যেমনخازم ও حازمদু’টি নামের আকৃতি এক, তবে প্রথমটিতে নোকতা আছে দ্বিতীয়টিতে নোকতা নেই। অনুরূপ حضين و حصين দু’টি নামের আকৃতি এক, তবে প্রথমটিতে নোকতা আছে, দ্বিতীয়টিতে নোকতা নেই। এসব বর্ণের আকৃতি এক, শুধু নোকতায় পার্থক্য।
৩. রাবিদের নামের বর্ণের লেখার আকৃতি এক, কিন্তু বর্ণ পৃথক, যেমনحِبَّان ও حَيَّان ‘হিব্বান ও হাইয়ান’। অনুরূপعباس ও عياش ‘আব্বাস ও ‘আইয়াশ’। অনুরূপ خياط ও حباط ‘খাইয়াত ও হাব্বাত’ ইত্যাদি দু’টি নামের বর্ণের আকৃতি এক, তবে বর্ণ দু’টি পৃথক, একটিতে ب অপরটিকে ي রয়েছে।
‘মুত্তাফিক ও মুফতারিক’ এবং ‘মুতালিফ ও মুখতালিফ’ প্রকারে রাবিগণ পৃথক সন্দেহ নেই, কিন্তু তাদের নাম এক তাই মুত্তাফিক বলা হয়। রাবিদের নাম ও নামের উচ্চারণ পৃথক হলে মু’তালিফ ও মুখতালিফ। রাবিদের নাম ও উচ্চারণ এক হলে মুত্তাফিক ও মুফতারিক।
এ প্রকার ইলমের উপকারিতা:
এ প্রকার ইলম জানা থাকলে রাবিদের চিহ্নিত করা সহজ হয়। উদাহরণত: দশজন মুহাদ্দিসের নাম ‘আব্বাস। রাবি যখন ‘আব্বাস নামক মুহাদ্দিস থেকে বর্ণনা করেন, তখন জানা উচিত কোন আব্বাস তার উস্তাদ। কারণ হাদিস শাস্ত্রে সকল ‘আব্বাস সমান পারদর্শী নয়। তাদের দীনদারি, স্মরণ শক্তি ও হাদিসে মগ্নতা বরাবর নয়। কেউ দুর্বল কেউ সবল, কেউ গ্রহণযোগ্য কেউ পরিত্যক্ত, তাই সহি ও দ্বা‘ঈফ নির্ণয় করার জন্য আব্বাসকে নির্ণয় করা জরুরি।
‘মু’তালিফ ও মুখতালিফ’ চেনা অপেক্ষাকৃত সহজ। তাদের নামের উচ্চারণ যেরূপ পৃথক, বাস্তবেও তারা পৃথক। আমরা যদি শব্দের হরকত ও নোকতা ত্যাগ করে পূর্ব যুগের পদ্ধতি অনুসরণ করি, তাহলে সমস্যা দেখা দিবে। যেমন পূর্বে عباس ও عيَّاش শব্দদ্বয় এক ছিল। কারণ পূর্বে হরকত ও নোকতা ব্যবহার করা হত না, পরবর্তী যুগে হরকত ও নোকতা ব্যবহার করার ফলে এসব ভুল কম হয়।
‘মুত্তাফিক ও মুফতারিক’ জানা কঠিন, পরবর্তী যুগেও কঠিন, কারণ নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার জন্য গভীর পড়াশোনা ও রাবিদের অবস্থা জানা দরকার।
‘মু’তালিফ ও মুখতালিফ’ জানার পদ্ধতি দু’টি:
১. ‘মু’তালিফ ও মুখতালিফ’ থেকে যে নাম অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহার হয়, তা চিহ্নিত করা সহজ।
২. যেসব ‘মু’তালিফ ও মুখতালিফ’ কোনো নিয়মের অধীনে নেয়া সম্ভব নয়, সেগুলো শুনে মুখস্থ করা জরুরি।
নিয়মের অধীন নামগুলোকে ইব্নুস সালাহ প্রমুখ দু’ভাগে ভাগ করেছেন।
১. সাধারণ নিয়মের অধীন নাম, যেমন কতক রাবির ক্ষেত্রে বলা যায় তাদের নামের উচ্চারণ এভাবে, অবশিষ্টগুলো ওভাবে। যেমন سلاَّم ‘সাল্লাম’ নামগুলো তাশদীদ যুক্ত, পাঁচটি নাম ব্যতীত, যথা:
ক. আব্দুল্লাহ ইব্ন সালাম সাহাবি।
খ. মুহাম্মদ ইব্ন সালাম বুখারি।
গ. সালাম ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন নাহিদ।
ঘ. মুহাম্মদ ইব্ন আব্দুল ওয়াহহাব সালাম মুতাযেলি জুব্বায়ি।
ঙ. সালাম ইব্ন মিশকাম।
এ পাঁচটি নামের উচ্চারণ ‘সালাম’, এ ছাড়া সকল سلاَّم তাশদীদ যুক্ত, অর্থাৎ তাদের উচ্চারণ ‘সাল্লাম’।
২. নির্দিষ্ট কিতাব হিসেবে কতক নামের নিয়ম বলা যায়, যেমন বুখারি, মুসলিম ও মুয়াত্তায় এ নামে শুধু অমুকে আছেন, যার উচ্চারণ এভাবে।
জ্ঞাতব্য: হাদিস শাস্ত্রের এ প্রকার জানা খুব জরুরি, যেসব মুহাদ্দিস হাদিসের এ প্রকার জানে না, তারা অধিক ভুল করেন ও বরাবর লজ্জিত হন। এ জাতীয় নাম খুব বেশী, যার কোনো নিয়ম নেই, অনেক নাম দেখে বিভ্রাটে পড়তে হয়। সকল রাবিকে জানা ব্যতীত এ ইলম হাসিল হয় না।
এ বিষয়ে লিখিত কিতাব:
‘মুতালিফ ও মুখতালিফে’র উপর সর্বপ্রথম কিতাব লিখেন আবু জা‘ফর মুহাম্মদ ইব্ন হাবিব আল-বাগদাদি, তার কিতাবের নাম: (المؤتلف والمختلف) في أسماء القبائل তবে তার কিতাব ছিল ব্যাপক, সেখানে মুহাদ্দিস ও গায়রে মুহাদ্দিস সবার নাম ছিল। মুহাদ্দিসদের নামের উপর সর্বপ্রথম মুতালিফ ও মুখতালিফ লিখেন আব্দুল গনি ইব্ন সায়িদ, তার কিতাবের নামও (المؤتلف والمختلف)
মুতাশাবেহ
উসুলে হাদিসের কিতাবসমূহে এ অধ্যায়ে তৃতীয় একপ্রকার উল্লেখ করা হয় ‘মুতাশাবেহ’, যা পূর্বের দু’প্রকার থেকে গঠিত। যেমন রাবিদের নাম এক, যাদের পিতার নাম লেখায় সাদৃশ্যপূর্ণ, তবে উচ্চারণ ভিন্ন যথা محمد بن عقيل মুহাম্মদ ইব্ন আকিল ও محمد بن عقيل মুহাম্মদ ইব্ন উকাইল। প্রথম ব্যক্তি নিশাপুরি, দ্বিতীয় ব্যক্তি ফিরইয়াবি। উভয়ে প্রসিদ্ধ ও এক যুগের ব্যক্তিত্ব।
রাবিদের নাম সাদৃশ্যপূর্ণ, উচ্চারণে ভিন্ন, তবে পিতাদের নাম এক, যেমন شريح بن النعمان শুরাই ইব্ন নুমান ও سريج بن النعمان সুরাইজ ইব্ন নুমান। প্রথম রাবি তাবে‘ঈ, আলি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে হাদিস বর্ণনা করেন। দ্বিতীয় রাবি ইমাম বুখারির শায়খ। অনুরূপ একাধিক রাবি ও তাদের পিতার নাম এক, তবে বংশ পৃথক, তবুও এ প্রকার ভুক্ত।
এ জাতীয় নামের ভুল-ভ্রান্তি থেকে বাচার পদ্ধতি হচ্ছে এ বিষয়ে লিখিত কিতাব পাঠ করা, শায়খদের থেকে শ্রবণ করা এবং ভাল করে তাদের নামগুলো জেনে নেয়া ও স্মরণ রাখা।